২০১৫-১৬ সিরি আ মৌসুমের শেষ দিন। উড়ে আসা বল ডি-বক্সের ভেতর বুক দিয়ে নামিয়ে গঞ্জালো হিগুয়াইনের দুর্দান্ত ভলি। সেই ভলি ফ্রসিনোন গোলকিপার মাসিমো জাপ্পিনোকে পেরিয়ে আশ্রয় নেয় জালে। সেই মৌসুমে আক্ষরিক অর্থেই ‘মাইডাস’ হয়ে উঠেছিলেন গঞ্জালো হিগুয়াইন। নাপোলির হয়ে ডি-বক্সে স্পর্শ করা সবকিছুই যেন সোনায় পরিণত হচ্ছিল। তবে ফ্রসিনোনের বিপক্ষে করা গোলটি ছিল ষোলকলা পূর্ণের শেষ ধাপ। এই গোলের মাধ্যমেই ৮৭ বছরের পুরনো রেকর্ড স্পর্শ করেন এই আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার। সর্বশেষ ১৯২৯ সালের পর এই প্রথম সিরি ‘আ’তে কোনো খেলোয়াড় ৩৬ গোল করতে সক্ষম হন। পাশাপাশি নিজের নামও ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখেন গঞ্জালো হিগুয়াইন।
হিগুয়াইনের নেপলসের সেই সোনালি সময় আবার স্মরণ করিয়ে দেয় আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার ও সিরি-আ’এর মেলবন্ধনের সেই ইতিহাস। সর্বশেষ ৫০ বছর ধরে সিরি ‘আ’ জুড়ে আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের আধিপত্য। ১৯২৩ সালে চালু হওয়া ক্যাপোচেনোরি পুরস্কার, যেটি কি না সিরি ‘আ’-এর সর্বোচ্চ গোলদাতাকে প্রদান করা হয়, সেটিও ইতালিয়ান বাদে সবচেয়ে বেশিবার জিতেছেন আর্জেন্টাইনরাই। আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে, আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডরা। নব্বইয়ের দশকে ইতালিয়ান লিগ পুরো ইউরোপজুড়ে রাজত্ব করেছেন তারা। সেই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি’অরজয়ী খেলোয়াড় ছিল ইতালিয়ান লিগ থেকেই। সিরি ‘আ’-এর এই রাজত্বের অনেকাংশেই কৃতিত্ব প্রাপ্য আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডদের। ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে বাতিস্তুতা, ক্রেসপো, মিলিতো, তেভেজ, হিগুয়াইন – সিংহভাগ আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকাররাই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ইতালিয়ান লিগ।
আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড আর সিরি ‘আ’-এর এই রোমান্স শুরু হয়েছিল অ্যান্তোনিও ভ্যালেন্টিন অ্যাঞ্জেলিলো আর পেদ্রো মানফ্রেডিনিকে দিয়ে। এই দুই ফরোয়ার্ডই জিতেছিলেন সিরি ‘আ’ মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। তবে মূলত এই রোমান্স সাড়া জাগায় ১৯৮৪ সালে। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার নেপলসে আগমনের পর থেকে।
ম্যারাডোনার নাপোলিতে আসার আগের ১৪ মৌসুম ধরে সিরি ‘আ’ রাজত্ব করেছিল ইন্টার, এসি মিলান ও জুভেন্টাস। এই তিন ক্লাব মিলেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ১২ বার। আর একবার করে লাৎসিও আর রোমা। ম্যারাডোনার আগমনে এই প্রাধান্যে ভাগ বসায় নাপোলি। গড়পড়তা মানের এই ক্লাবকে মাঝ টেবিল থেকে শিরোপার যোগ্য দাবিদার করে তোলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ততদিনে ম্যারাডোনায় উত্তাল নেপলস শহর। শুধু নেপলস কেন, গোটা ইতালি। আক্ষরিক অর্থেই ম্যারাডোনা বন্দনায় ও পূজায় মেতে থাকত নেপলসের বাসিন্দারা।
‘৯০ দশকের শেষের দিকে ম্যারাডোনার দাপট কিছুটা কমে এলে এসি মিলান, জুভেন্টাস, ইন্টার মিলানের মতো ক্লাবদের আবারও আধিপত্য দেখা যেতে শুরু করে। ঠিক সেই সময়টায় উদিনেস সিরি ‘আ’তে পরিচয় করিয়ে দেয় আরেক আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড আবেল বালবো নামের এক ‘বিস্ময়বালক’কে। ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে ২১ গোল করেই অভিষেক মৌসুমটি রাঙান তিনি। সেবার সিরি ‘আ’-এর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন বালবো। এর পরের ১২ মৌসুমও তিনি কাটিয়ে গেছেন ইতালিয়ান লিগেই। রোমা, ফিওরেন্টিনা ও পার্মার হয়ে খেলে করেছিলেন ১১৭ গোল; ধরে রেখেছিলেন ম্যারাডোনার দেখিয়ে যাওয়া পথটাও।
বালবোর পর এইবার ইতালিতে আগমন আরেক অ্যালবিসেলেস্তে কিংবদন্তি গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার। ‘বাতিগোল’ নামে খ্যাতি লাভ করা এই ফরোয়ার্ড বক্সের মধ্যে ছিলেন অন্যতম ভয়ঙ্কর এক স্ট্রাইকার। ১৯৯১ সালে আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জেতানোর পর থেকেই ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর রাডারে ছিলেন বাতিস্তুতা। কিন্তু ম্যারাডোনা ও বালবোর মতোই বাতিস্তুতা বেছে নিয়েছিলেন অখ্যাত ক্লাব ফিওরেন্টিনা। মিলান, জুভেন্টাস, ইন্টার বাদ দিয়ে নিজের তাঁবু গাড়েন ফ্লোরেন্সে। নিজের দুর্দান্ত ফর্ম সত্ত্বেও ফিওরেন্টিনাকে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমেই অবনমন থেকে বাঁচাতে পারেননি বাতিস্তুতা, তবে থেকে গিয়েছিলেন ফিওরেন্টিনাতেই। সিরি ‘বি’তে ১৬ গোল করে আবারও ক্লাবকে সিরি ‘আ’তে নিয়ে আসেন এই ফরোয়ার্ড।
পরের গল্পটা মধুর। পর্তুগিজ মিডফিল্ডার রুই কস্তার সাথে জুটি বেঁধে ফিওরেন্টিনাকে বাতিস্তুতা জিতিয়েছেন কোপা ইতালিয়া ও সুপার কোপা। এমনকি, সিরি ‘আ’তে রোনালদো লিমার আগমনও ফিওরেন্টিনা ফ্যানদের বিচলিত করেনি। কারণ, তাদের যে আছেন একজন বাতিস্তুতা! ফ্লোরেন্সে সাকুল্যে নয় মৌসুমে বাতিস্তুতা করেছিলেন ২০৭ গোল। বলার অপেক্ষা রাখে না, নেস্তা-মালদিনি-বারেসি-ক্যানাভোরাদের সময়কার সিরি ‘আ’তে ফিওরেন্টিনার হয়ে এত গোল করা চাট্টিখানি কথা নয়। নিজেদের ইতিহাসসেরা খেলোয়াড়ের সম্মানে ২০১৪ সালে বাতিস্তুতার স্ট্যাচু তৈরি করে ফিওরেন্টিনা ক্লাব।
‘নেক্সট বাতিস্তুতা’ তকমা পেয়ে যাওয়া আরেক ফরোয়ার্ড হার্নান ক্রেসপোও পূর্বসূরীদের দেখানো পথে হাঁটেন। ১৯৯৬ অলিম্পিকে ৬ গোল করে সিলভার মেডেল পাওয়া ক্রেসপো যোগ দেন ইতালিয়ান ক্লাব পার্মাতে। সেই সময়টায় পার্মা ছিল উত্থানের পথে। কার্লো আনচেলত্তি চিয়েসা ও ক্রেসপোকে দিয়ে গড়ে তোলেন ভয়ঙ্কর ফরোয়ার্ড জুটি। প্রথম ১২ ম্যাচ গোলবিহীন থাকার পরও তার উপর আশা হারাননি আনচেলত্তি। সেই মৌসুমে ২৭ ম্যাচে ক্রেসপো করেন ১২ গোল। নিজের তৃতীয় মৌসুমেই সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩০ গোল করে পার্মাকে জেতান ঘরোয়া ‘ডাবল’ শিরোপা। পুরো পার্মার ইতিহাসে সেটিই হয়ে আছে তাদের সেরা সাফল্য।
২০০০ সালে সেই সময়ের রেকর্ড ফি ৩৫ মিলিয়ন ইউরোতে লাৎসিওতে পাড়ি জমান ক্রেসপো। কিন্তু তার ২৬ গোলেও শিরোপা পুনরোদ্ধার করতে পারেনি লাৎসিও, রোমা জিতে নেয় সিরি ‘আ’। মজার ব্যাপার হলো, সেই সময়টায় ফিওরেন্টিনা ছেড়ে রোমায় নাম লিখিয়েছেন বাতিস্তুতা। অর্থাৎ, ‘বাতিগোল’-এর কাছেই হেরে যান ক্রেসপো।
বাতিস্তুতা-ক্রেসপো উত্তর যুগে সিরি ‘আ’তে আগমন জুলিও ক্রুজের। যদিও সেই মানের গোলস্কোরার ছিলেন না তিনি কখনোই। প্রথমে বোলোনিয়ায় নাম লেখালেও পরবর্তীতে যোগ দেন ইন্টার মিলানে। ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি, আদ্রিয়ানো, স্লাতান থাকার পরও দলের দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন ক্রুজ। নেরাজ্জুরিদের হয়ে চারটি স্কুদেত্তো, দুইটি কোপা ইতালিয়া ও সুপার কোপা জিতে সিরি ‘আ’-এর অন্যতম সফল স্ট্রাইকার বনে যান আর্জেন্টাইন জুলিও ক্রুজ।
আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডদের লিগ্যাসি ধরে রাখতে এইবার সিরি ‘আ’তে আসেন ডিয়েগো মিলিতো। যেখানে বাতিস্তুতা-ক্রেসপো ছিলেন দ্রুতগতির, ফিজিক্যালি শক্ত ও লিথ্যাল, সেখানে মিলিতোর অস্ত্র ছিল ডি-বক্সে তার ধূর্ত মুভমেন্ট। তাই ২০০৯-১০ মৌসুমে ইতো’র আগমনের পরও মরিনহো মিলিতোকেই বানিয়েছিলেন ইন্টারের প্রধান স্ট্রাইকার। মরিনহোর আশা বিফলে যেতে দেননি মিলিতো। দুর্দান্ত ফর্মে থেকে সেবার ইন্টারকে ট্রেবল জেতাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ডিয়েগো মিলিতো। যদিও বাতিস্তুতা ক্রেসপোর মতো কখনো সিরি ‘আ’ মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার জেতেননি তিনি, তবে ইতালিয়ানদের উজাড় করা ভালবাসা পেয়েছেন বাকি সবার মতোই।
মিলিতোর পর এইবার ২০১৩ সালে সিরি ‘আ’তে কার্লোস তেভেজ ও গঞ্জালো হিগুয়াইনের আগমন। কার্লোস তেভেজ জুভেন্টাসে আসার আগের দুই মৌসুমে জুভেন্টাস সিরি ‘আ’ জিতেছিল ৪ পয়েন্ট ও ৬ পয়েন্টের ব্যবধানে। তেভেজের আগমনের পর পরের মৌসুমেই তারা স্কুদেত্তো জিতে নেয় ১৭ পয়েন্টের ব্যবধানে। নিজের শেষ ও দ্বিতীয় মৌসুমে তেভেজ করেন ২০ গোল। একই সাথে আবারও স্কুদেত্তো জিতে নেয় তুরিনের বুড়িরা। তেভেজের হাত ধরেই বহু বছর পর আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলতে সমর্থ হয় জুভেন্টাস। দুই মৌসুমে ৫০ গোল করে নিজের ছোট সময়টাতেও সিরি ‘আ’তে বিস্তর প্রভাব রেখে যান ‘অ্যাপাচি’-খ্যাত তেভেজ। অন্যদিকে, গঞ্জালো হিগুয়াইন নিজের দুর্দান্ত নাপোলি সময়টা শেষ করে এখন আছেন জুভেন্টাসেই। ৭৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ২০১৬ সালে নাপোলি থেকে জুভেন্টাসে আসেন হিগুয়াইন।
হিগুয়াইন, তেভেজের পরও ধারাটি থেমে থাকেনি, বরং সেই দেখানো পথেই হেটেছেন পাওলো দিবালা, মাউরো ইকার্দি, লাউতারো মার্টিনেজ, জিওভান্নি সিমিওনেসহ আরো অনেকেই। ইকার্দি ও দিবালা ইতঃমধ্যেই প্রমাণ করেছেন নিজেদের সেরা দিনে জ্বলে উঠতে পারার ক্ষমতা। লাউতারো ও সিমিওনে সেই পথে ভালোভাবেই এগোচ্ছেন। ‘৯০-এর দশকের সেই ইতিহাসের পর থেকে ইতালি ও আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকারদের রোমান্স আরো পাকাপোক্ত হয়েছে গত কয়েক বছরে।
ম্যারাডোনার সম্মানার্থে নাপোলি তাদের ১০ নাম্বার জার্সিটি তুলে রেখেছে, বাতিস্তুতা আছেন ফিওরেন্টিনার হল অফ ফেমে, ‘৯০ এর অবিশ্বাস্য সাফল্যের সময় পার্মার পোস্টারবয় ছিলেন ক্রেসপো, জুভেন্টাসকে তেভেজ নিয়ে গেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে, নাপোলির হয়ে হিগুয়াইন ভেঙেছেন ৮৭ বছরের পুরনো রেকর্ড। তারা সবাই হয়তো চলে গিয়েছেন, কিন্তু তাদের ঐতিহ্য চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ