১.
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যনের কাজ কী?
উত্তরটি অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। প্রথমে ব্যাটিং করলে একরকম কৌশল, পরে ব্যাটিং করলে আরেক রকম। আবার ছোট টার্গেট নিয়ে ব্যাটিং করলে একরকম, বড় টার্গেট নিয়ে করলে আরেক। ‘৯০ এর দশকের আগে সাধারণত ওপেনিং ব্যাটসম্যানদের কাছে চাওয়া ছিল কোনো রকমে প্রথম ৩০ ওভার টিকে থেকে ১০০ রান করা। ‘৯২ এর বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক মার্টিন ক্রো এক নতুনত্ব আনলেন। যেহেতু তখন পাওয়ার প্লে শুরু হয়েছিল, তাই তিনি গ্রেটব্যাচকে নিয়ে একটি জুয়া খেললেন।
পাওয়ার প্লেতে ফিল্ডাররা বৃত্তের ভেতরে থাকায় মারকুটে ব্যাটসম্যনদেরকে নিয়ে একটি ঝুঁকি নেওয়ার প্রচেষ্টা দারুণ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। সেই পথ ধরেই পরবর্তীতে জয়াসুরিয়া, বীরেন্দর শেবাগ, শহীদ আফ্রিদীর মতো ব্যাটসম্যানদের আবির্ভাব। এ ব্যাটসম্যানদের লক্ষ্য থাকতো শুরুতে যতটা সম্ভব রান তুলে দিয়ে দলকে সাহায্য করা। এই কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে দ্রুত উইকেটও হারাতে হতো। এর মাঝে শচীন টেন্ডুলকার, সাঈদ আনোয়ার কিংবা সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো কয়েকজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান আসলেন, যারা রান করার সাথে সাথে উইকেট ধরে রাখার কাজটাও করতে থাকলেন। ধীরে ধীরে রোহিত শর্মার মতো ব্যাটসম্যানও আসলেন, যারা কি না দ্রুত রান করার সাথে সাথে বড় ইনিংসও খেলতে পারেন।
তবে সব ফ্যাক্টর বিবেচনায় আনলেও বলা যায়, বর্তমান যুগে ওপেনিং ব্যাটসম্যনদের কাজ হচ্ছে শুরুর দিকে উইকেট টিকিয়ে রাখার সাথে সাথে দ্রুতগতিতে রান তোলার চেষ্টা করা, যাতে পরবর্তীতে ব্যাটসম্যানরা কিছুটা নির্ভার থাকতে পারেন। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের কাজ হচ্ছে শুরুর ব্যাটসম্যানরা যদি দ্রুত আউট হয়ে যান, তাহলে প্রাথমিক বিপর্যয় সামলে দলকে এক স্থিতিশীল অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা, কিংবা শুরুটা ভালো হলে সেটাকে ধরে রেখে রানের গতি বাড়ানো। লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের কাজ মূলত শেষের দিকে রানের গতি বাড়ানো।
কিন্তু কোনো ব্যাটসম্যান যদি ওপেনিংয়ে নেমে দলের রানের গতি বাড়াতে থাকলেও অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যাওয়ার কারণে দল বিপর্যয়ে পড়ে এবং সেই বিপর্যয় সামলে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মতো ইনিংস মেরামত করেন এবং শেষের দিকে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মতো পিটিয়ে খেলে রানের গতি বাড়িয়ে ফেলেন, তাহলে একই ইনিংসে তিন ভূমিকা পালনের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। তবে বাস্তবিক পক্ষে এরকম ইনিংসের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটাই।
তেমন দূর্লভ একটি ইনিংসের গল্পই আজ শোনা হবে। ইনিংসটির স্রষ্টা ছিলেন মারকুটে ব্যাটসম্যান সনাথ জয়াসুরিয়া।
২.
ম্যাচটিতে কি যথেষ্ট প্রতিযোগীতা হয়েছিল?
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যে ম্যাচের জয়-পরাজয়ের ব্যবধান থাকে ২৪৫ রানের, পরিসংখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে সহজেই বলে ফেলা যায় যে, সেই ম্যাচটি একতরফাই ছিল। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি রানের ব্যবধানে জেতার রেকর্ডে ম্যাচটির অবস্থান ১০ নম্বরে হলেও তখন সেটা ১ নম্বরেই ছিল।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দলীয় ২৪৫ রানও যেখানে অনেক সময় চ্যালেঞ্জিং স্কোর, সেখানে ব্যবধান ২৪৫ রানের হলে ভাবনাটা একেবারে অমূলকও নয়। তবে ঐ যে একটা কথা আছে না, “পরিসংখ্যান আস্ত একটা গাধা”। সেই প্রবাদটি প্রমাণ করার জন্য হলেও এই ম্যাচটিকে উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। ক্রিকেটে মোমেন্টাম অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটি ছোট মুহূর্ত যে পক্ষ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যাচের ফলাফল সেই পক্ষেই যায়। এই ম্যাচেও তেমন এক মোমেন্টামের সৃষ্টি হয়েছিল।
২০০০ সালের ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত শারজাহর সেই ত্রিদেশীয় ফাইনাল ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে ভারত কিছুটা হলেও পিছিয়ে ছিল। টুর্নামেন্টের বাকি দল জিম্বাবুয়ে হওয়ায় ফাইনালের জন্য এই দুই দলই মোটামুটি ফেভারিট ছিল। গ্রুপ পর্বের দুই দেখাতেই ভারতকে হারানোর সুবাদে ফাইনালে শ্রীলংকা কিছুটা এগিয়ে থাকলেও যে দলে শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, যুবরাজ সিং, বিনোদ কাম্বলী কিংবা রবিন সিংয়ের মতো ব্যাটসম্যানরা থাকেন, সেই দলের চ্যাম্পিয়ন হবার সম্ভাবনাকে একেবারে অমূলক বলা উচিত হতো না।
তাছাড়া শ্রীলংকা দলেও সমস্যা ছিল। ওপেনিংয়ে কালুভিথরানা অনেক দিন ধরেই বড় স্কোর করতে ব্যর্থ। সর্বশেষ পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেছিলেন ১৪ ইনিংস আগে। চলতি সিরিজে সর্বোচ্চ ইনিংস মাত্র ২৫ রানের। ৫৮টি ম্যাচ খেলা জয়াবর্ধনের গড় মাত্র ২৬.৪২ এবং কুমার সাঙ্গাকারা তখন মাত্র ১১টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে নেমেছেন, যেখানে তার মাত্র ১টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার রেকর্ড রয়েছে। সেই হিসেবে ব্যাটিং লাইন আপে ভরসা করার মতো দুজন ছিলেন, অভিজ্ঞ আতাপাত্তু এবং অধিনায়ক জয়াসুরিয়া নিজে।
৩.
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামলো শ্রীলংকা, ওপেনিংয়ে নামলেন জয়াসুরিয়া এবং কালুভিথরানা। ম্যাচের প্রথম বলেই জহির খানের বলে চার মেরে শুরুটা ভালোই করলেন জয়াসুরিয়া। প্রথম ৮ ওভারে উঠলো ৪৪ রান। নবম ওভারের প্রথম বলে ১৯ রান করে জহির খানের বলে বোল্ড হলেন কালুভিথরানা। মাঠে নামলেন অভিজ্ঞ আতাপাত্তু। সিরিজে আতাপাত্তুর আগের তিন ইনিংসের রান ছিল যথাক্রমে ৯০, ৫৮ ও অপরাজিত ১০২। পরিসংখ্যানটি একদিকে যেমন ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যানকে পাওয়ার আনন্দ, ঠিক অন্যদিক থেকে এটা কিছুটা দূর্ভাবনারও। ক্রিকেটে ‘ল অফ অ্যাভারেজ’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। সেই হিসেবে আতাপাত্তুর আজ কম রানেই আউট হয়ে যাবার কথা। প্রচলিত কথাকে সত্য প্রমাণিত করে মাত্র ৯ রান করেই আউট হয়ে গেলেন আতাপাত্তু। নতুন ব্যাটসম্যান জয়াবর্ধনেও মাত্র ৩ রান করে আউট হলে শ্রীলংকা কিছুটা চাপে পড়ে গেলো।
জয়াসুরিয়া অন্যপ্রান্তে তার স্বভাবসুলভ খেলা খেলে যাচ্ছিলেন। মাত্র ৫৩ বলে ৯টি বাউন্ডারির সাহায্যে ব্যক্তিগত অর্ধশতক পূর্ণ করলেন, একইসাথে শ্রীলংকার দলীয় রানও ১০০ রানে পৌঁছালো ২২তম ওভারের প্রথম বলে। মাঠে তার সঙ্গী ছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। সাঙ্গাকারা যখন ব্যক্তিগত ৮ রানের মাথায় বোল্ড হলেন, তখন শ্রীলংকার সংগ্রহ ২৮ তম ওভারে মাত্র ১১৭ রান।
দলের টপ অর্ডার চারজন ব্যাটসম্যান সাজঘরে, রান রেট মাত্র ৪.১৭। শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান রাসেল আর্নল্ডকে নিয়ে একটু লম্বা পথ পাড়ি দেবার কথাই হয়তো ভাবলেন অধিনায়ক জয়াসুরিয়া। এজন্যই হয়তোবা পরের ব্যক্তিগত ৫০ রান করতে খেললেন ৫৭টি বল; ব্যক্তিগত ১০০ রান পূরণ করলেন মাত্র ১১০ বলে। এই সময়ে ১টি করে বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারি মেরেছিলেন সনাথ। দলীয় সংগ্রহ তখন ৩৬ ওভার ২ বলে মাত্র ১৬৭। মাঝে ব্যক্তিগত ৯৩ রানে একটি কঠিন সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সুনীল যোশী নিজের বলে নিজে ক্যাচটা ধরলেও রাখতে পারেননি।
একজন ব্যাটসম্যান যদি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ১০০ রান করার পরে আউট হয়ে যান, তাহলে সেই ব্যাটসম্যানকে সেই ম্যাচে অন্তত ব্যর্থ বলা যাবে না। কিন্তু সেই সময়ে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, জয়াসুরিয়া যদি ১০০ রান করার সাথে সাথেও আউট হয়ে যেতেন, তাহলেও শ্রীলংকার ২০০ এর নীচে অল আউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অন্যদিকে রাসেল আর্নল্ড কেবলমাত্র জয়াসুরিয়াকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।
সেঞ্চুরি করার পর জয়াসুরিয়া উইকেট টিকিয়ে রাখার সাথে সাথে একটু হাত খুলেও খেলতে লাগলেন। ৪০ তম ওভারে শ্রীলংকার দলীয় সংগ্রহ ২০০ রানে গিয়ে দাঁড়ালো। জয়াসুরিয়ার ১৫০ রান আসলো দলীয় ২২৯ রানের মাথায়। ১০০ থেকে ১৫০ পর্যন্ত যেতে তাকে খেলতে হয়েছে মাত্র ২৫টি বল। দলীয় ১৬৭ থেকে ২২৯ পর্যন্ত ৬২ রানের মাঝে জয়াসুরিয়ার অবদানই ৫২।
শেষ দুই ওভার যখন বাকি, তখন জয়াসুরিয়ার স্কোর ১৮৫ রান। সেই সময় ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোর ছিল সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ রান। সৌরভ গাঙ্গুলী যখন বল হাতে তুলে নিলেন, তখন দর্শকরা মোটামুটি নিশ্চিত যে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা এই ওভারেই অতীত হতে চলছে, হয়তো ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটাও হয়ে যাবে।
প্রথম বলেই বাউন্ডারি মেরে জয়াসুরিয়া পৌঁছে গেলেন ১৮৯ রানে, ভিভ রিচার্ডসের সাথে যৌথভাবে সর্বোচ্চ স্কোরের দ্বিতীয় অবস্থানে। দ্বিতীয় বলে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আবারও মারতে গেলেন, আর সাথে সাথেই ঘটলো বিপত্তি। ব্যাটসম্যানকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখেই সৌরভ গাঙ্গুলী অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে বলটা ফেললেন। জয়াসুরিয়া বলের লাইন মিস করাতে বল চলে গেলো কিপারের কাছে, আর সাথে সাথেই স্ট্যাম্পিং। অ্যাম্পায়ার ওয়াইড বলের সংকেত দিলেন, কিন্তু তাতে কি? একটা রান অতিরিক্ত দিয়ে হলেও জয়াসুরিয়ার উইকেট পাওয়াটাই তখন মূল বিষয়। দেড়শ রান করার পর বল খেলেছেন ১৮টি, যে বলে আউট হয়েছেন সেটা বাদে ১৭টি বলে তুলে ফেলেছিলেন ৩৮ রান। ইনিংসের বল বাকি ছিল তখনো ১১টি, এই ১১টি বলের মাঝে ৬টিতেও টিকে গেলে ডাবল সেঞ্চুরি করার জন্য প্রয়োজনীয় রানটা সেই মূহুর্তে তুলে ফেলাটা মোটেও অসম্ভব ছিল না।
৫০ ওভার শেষে শ্রীলংকার দলীয় সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ালো ২৯৯ রানে।
৪.
রান তাড়া করার ক্ষেত্রে ৩০০ রান সবসময়ই কঠিন। ২০০০ সালে সেটা মোটামুটি নিশ্চিত স্কোরই ছিল। এরপরও শচীন টেন্ডুলকার আর সৌরভ গাঙ্গুলীর সমন্বয়ে দুর্দান্ত ব্যাটিং লাইন আপের জন্য আগেভাগেই ম্যাচের শেষ অনেকেই দেখতে চাচ্ছিলেন না।
তবে ম্যাচ শুরু হবার পর সবাই দেখলো ভাসের ম্যাজিক। ৯ ওভারের মাঝেই প্রথম চারজন ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফিরিয়ে দিয়ে লড়াই করার সম্ভাবনা যতটুকু ছিল, সেটিও মিলিয়ে দিলেন, সবকটি উইকেটই ভাসের। মাঝে মুরালিধরনের ৩ উইকেট এবং ভাস আরেকটি উইকেট পাওয়ার ফলে ভারত অলআউট হলো মাত্র ২৬.২ ওভারেই, করতে পারলো মাত্র ৫৪ রান। হয়তো বড় টার্গেটের চাপে পড়েই এই ভেঙে পড়া। ভারতীয় ইনিংসে দুই অংকের ঘরে পৌঁছতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র রবিন সিং (১১)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে পিচে রাসেল আর্নল্ড বাদে আর কোনো ব্যাটসম্যানের আশির অধিক স্ট্রাইক রেট এবং বিশোর্ধ্ব রান করার সামর্থ্য হলো না, সেই পিচে জয়াসুরিয়া ১১৭ স্ট্রাইক রেটে প্রায় দ্বিশতকের কাছাকাছি একটি ইনিংস কীভাবে খেললেন? চমৎকার একটি শুরুর পর দলীয় বিপর্যয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে ইনিংস গড়ে আবার শেষের দিকে আক্রমণ করে রান বাড়ানোর কাজটা সবাই করতে পারে না। সবসময় এমন সুযোগও আসে না, আবার সুযোগ আসার পর সব ব্যাটসম্যান এমন খেলতেও পারেন না। উইজডেন কর্তৃক নির্বাচিত গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে ইনিংসে এর অবস্থান ৩ নম্বরে।
অসাধারণ ইনিংস খেলার বা দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয়, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ইনিংস খেলার বা দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। সনাথ জয়াসুরিয়া অবশ্যই ভাগ্যবান এরকম একটা ইনিংস খেলতে পারার জন্য, একইসাথে তারাও সৌভাগ্যবান যারা কি না এমন ইনিংস দেখার সাক্ষী হতে পেরেছেন।