দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিসুর জেলার এক নির্জন গ্রাম মারোত্তিচাল। কেরালার প্রত্যন্ত এই পাহাড়ি গ্রাম একসময় ট্রেকিংয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকের দিকে গ্রামটি হঠাৎই যেন বদলে যেতে থাকে। মদ আর জুয়া গ্রামের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। গ্রামের একটি পরিবারও জুয়া আর মদের আসক্তি থেকে মুক্ত ছিল না। ফলে তীব্র নেশাগ্রস্ত গ্রামবাসীদের মধ্যে নানা অস্থিরতা দেখা দিতে থাকে।
গ্রামের চিরচেনা পরিচিত শান্ত, নিরূপদ্রব চিত্রটি আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকে। গ্রামের প্রতিটি পরিবারে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাও তীব্রতর হচ্ছিল। গ্রামের সবসময় কোথাও না কোথাও ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত। সামান্য কিছুতেই হাতাহাতি থেকে মারামারি শুরু হয়ে যেত।
গ্রামের প্রতিটি পরিবারে নিত্য অশান্তি লেগে থাকতো। গ্রামের স্থানীয় প্রবীণরাও সমাজের এই অস্থিরতার চিত্রটি বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় কী, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কীভাবে গ্রামের এ মানুষগুলোকে জুয়া ও অ্যালকোহলের আসক্তি থেকে মুক্ত করা যাবে, তা নিয়ে বিশেষ করে গ্রামের নারী ও বয়স্করা চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
জুয়া এবং অ্যালকোহল মুক্ত করার প্রয়াসে গ্রামেরই কিছু ব্যক্তি এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগে এলাকায় বেশ কয়েকবার অভিযানও চালানো হয়। তারপরও গ্রামের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হচ্ছিল না। গ্রামের মানুষদের এ দুরবস্থা থেকে মুক্তি দিতে সি অন্নিকৃষ্ণান নামের এক ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। তার নিরলস প্রচেষ্ঠায় পুরো গ্রামটি আমূল পাল্টে যায়। কীভাবে গ্রামটি বদলে গেল, সে গল্প এবার শোনা যাক।
সি অন্নিকৃষ্ণান মারোত্তিচাল গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনি ছিলেন দাবা খেলার ভক্ত। এটি ভারতের খুব প্রাচীন এক খেলা। ধারণা করা হয়, ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে খেলাটির প্রথম প্রচলন হয়। তখন থেকে এটি ভারতবর্ষের সর্বত্রই খেলা হয়ে থাকে। অন্নিকৃষ্ণান দাবাড়ু ববি ফিশারের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে সবচেয়ে কমবয়সী আমেরিকান দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন। দাবা ছিল তার কাছে আবেগের এক স্থান। যুবক বয়সে গ্রামের দুরবস্থা দেখে গ্রাম থেকে চলে গিয়ে পাশের এক ছোট শহরে বাস করতে থাকেন। সেখানে থাকতে তিনি দাবা খেলা শেখেন।
ধীরে ধীরে দাবার প্রতি তিনি খুবই অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এদিকে গ্রাম থেকে চলে আসার পরও সেই চিরচেনা গ্রামবাসীদের প্রতি টান তার এতটুকুও কমে যায়নি। প্রতিনিয়ত তাদের জন্য ভাবতেন। চিন্তা করতেন, কীভাবে গ্রামবাসীদের জীবনে পরিবর্তন ঘটানো যায়। দাবার প্রতি ভালোবাসা থেকে তার মনে হলো, যদি এলাকার মানুষদের মাঝে এ খেলাটি ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে গ্রামের দুরবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও হতে পারে।
এমন ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজ গ্রামে ফিরে যাবেন। গ্রামে ফিরে প্রথমে তিনি একটি চায়ের স্টল খোলেন। স্থানীয়রা যখন চায়ের কাপে চুমুক দিতে তার স্টলটিতে আসতেন, তিনি তাদেরকে তখন চায়ের সাথে দাবা খেলার বিষয়ে নানা রকম ধারণা দিতে থাকেন।
গ্রামের লোকেরা প্রথমদিকে দাবা খেলার প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো কয়েকজন যুবকের এ খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে গ্রামের অন্যান্য অধিবাসীর মাঝে খেলার প্রতি আগ্রহ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইতোমধ্যে অন্নিকৃষ্ণান গ্রামের প্রায় সাতশো জনকে দাবা খেলায় প্রশিক্ষিত করেন।
গ্রামের যে ব্যক্তিরা জুয়া ও মদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন, অন্নিকৃষ্ণান তাদেরকেও দাবা খেলা শেখাতে শুরু করেন। তারাও সময়ের সাথে সাথে দাবা খেলায় অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এভাবে রাতারাতি পাল্টে যায় গ্রামের চিরচেনা অভ্যাস আর আচার-আচরণ।
গ্রামের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে খেলাটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অন্নিকৃষ্ণানের উৎসাহ আর আগ্রহে গ্রামের পুরুষ থেকে শুরু করে যুবক, যুবতী এমনকী বয়স্ক নারীরাও এর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন।
বর্তমানে অন্নিকৃষ্ণান একটি রেস্তোরাঁ খুলেছেন, যেখানে লোকেরা যেকোনো সময় দাবা খেলতে আসতে পারেন। অ্যালকোহলে আসক্ত গ্রামটি এভাবে দাবায় আসক্ত হয়ে পড়তে থাকে। ক্ষতিকর মদ ও জুয়ার আসক্তি থেকে সবাই সরে আসতে থাকেন।
দাবা খেলায় আগ্রহের পর থেকেই এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হওয়ার এই উত্তেজনাপূর্ণ মজার খেলাটি গ্রামবাসীদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠতে শুরু করে। এ খেলা যেন তাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
খেলাটি গ্রামবাসীদেরকে সম্মুখ বিপর্যয় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এলাকার মানুষেরা এই প্রাচীন কৌশলী খেলাটি সম্পূর্ণ উৎসাহ ও আবেগ নিয়ে খেলে থাকেন। বর্তমানে এই সাদা-কালো বোর্ড গেমটি গ্রামবাসীদের জন্য কেবল অবসরে সময় কাটানো ও বিনোদনের প্রধান মাধ্যমই শুধু নয়, বরং এটি তাদের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে মারোত্তিচালের প্রায় ৯০ শতাংশ লোক দাবা খেলোয়াড়। প্রত্যেক বাড়ির কমপক্ষে একজন সদস্য দাবা খেলোয়াড়। গ্রামের সবচেয়ে কমবয়সী দাবা খেলোয়াড়ের বয়স ৮ আর সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড়ের বয়স ৮০ বছর। গ্রামটি এখন ‘Chess Village’ বা ‘দাবাগ্রাম’ নামে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।
মজার বিষয় হলো, গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ছ’ হাজার। আর তার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি লোক এখন ব্যস্ত দাবা খেলায়! এমনকি গ্রামবাসীরা টেলিভিশন দেখার চেয়েও দাবা খেলা ও একে অপরের সাথে কথা বলা পছন্দ করেন। দাবার জন্য মারোত্তিচাল গ্রামের খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া। গ্রামের স্কুল সিলেবাসেও দাবা বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়েছে।
গ্রামের যে দোকানগুলোতে একসময় মদ বিক্রি হতো, বসতো জুয়ার রমরমা আসর- সেসব দোকানগুলোতে টেবিল বিছিয়ে বসানো হয়েছে দাবার সাদা-কালো বোর্ড। বোর্ডের দু’পাশে কালো আর সাদা রঙের দুই রাজা তাদের মন্ত্রী আর হাতি-ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েছে দুই প্রতিপক্ষ। দুজন খেলোয়াড় দাবার চাল দিচ্ছেন আর চারপাশে গোল হয়ে সে খেলা উপভোগ করছেন আরো বেশ কিছু দর্শক। নিজ নিজ খেলোয়াড়ের সমর্থনে চলছে হৈচৈ, ভালো চালের জন্য পড়ছে হাততালি। অবসরের মুহূর্তগুলোতে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনায় ভরপুর এ খেলার জমাটি আসর বসে যায়।
সি অন্নিকৃষ্ণান বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
“আমরা যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সংগ্রাম করে বেঁচে রয়েছি, তেমনি দাবা বোর্ডেও আমরা সে লড়াইটাই উপভোগ করতে চেষ্টা করি। দাবা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের নানা সমস্যা ও দুর্ভোগ কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করছে।”
পাঁচবারের বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব জয়ী ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্বনাথান আনন্দ গ্রামবাসীদের এ প্রচেষ্টাকে সাধাবাদ জানিয়েছেন। মারোত্তিচালের দাবা সমিতির সভাপতি বেবি জন তার এক সাক্ষৎকারে বলেছেন, ভারতের অন্যান্য গ্রামগুলোতে যেখানে দাবা খেলা জানা লোকের সংখ্যা ৫০ এর চেয়ে কম, সেখানে মারোত্তিচাল গ্রামে ছ’ হাজার অধিবাসীদের মধ্যে চার হাজার জনই দাবা খেলা জানেন এবং অবসর সময়ে খেলাটি খেলে থাকেন।
এছাড়াও, একই সময়ে ১০০০ জন দাবা খেলার এশিয়ান রেকর্ডটি মারোত্তিচালের গ্রামের বাসিন্দাদের অধিকারে রয়েছে। তবে সি অন্নিকৃষ্ণানের দৃষ্টি আরো উঁচুতে। গিনেস বুকে নাম লেখানোর জন্য তিনি প্রতিনিয়ত গ্রামবাসীদের উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। এজন্য তিনি গ্রামের ছোট বাচ্চাদেরও দাবা খেলার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
কেরালার অন্যান্য অঞ্চলের লোকেরাও মারোত্তিচালের গ্রামের মানুষদের এ পরির্তনে যেমন বিস্মিত হয়েছেন, তেমনি মুগ্ধও হয়েছেন। শুধু কেরালার অধিবাসীরাই নয়, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অনেক দর্শনার্থীরাও দাবা শিখতে এই গ্রামে আসেন। এভাবে দাবা মারোত্তিচালের গ্রামের এক অসাধারণ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিশ্বের জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
দাবা সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ