আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেটে আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন প্রায়। তাই বুটজোড়া তুলে রেখে উড়াল দিয়েছিলেন বিদেশে। কিন্তু প্রিয়জন সেই ক্রিকেটের টানেই তাকে দেশে ফিরিয়েছিল। অন্তত আরেকবার, আর একটাবার যদি চেষ্টা করা যায়, ক্ষতি কী!
সেই ফেরাটাই সৌভাগ্যের সুতোয় গেঁথেছিল আবু জায়েদ রাহীকে। ক্রিকেটে ফিরলেন, জয় করলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটটা আগে থেকেই মনে রাখার মতো খেলেছেন। তারপর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), সেখান থেকে একটা সময়ে জাতীয় দলের জার্সি।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় রাহীর। একই বছরে সাদা পোশাকের টেস্টেও অভিষেক। এখন পর্যন্ত ৩ টি-টোয়েন্টিতে ৪ উইকেট, আর ৫ টেস্টে ১১ উইকেট নিয়ে মাঝারি মানের পারফরম্যান্স দিয়ে ভালো কিছু করার চেষ্টায় পরিশ্রম করে যাচ্ছেন রাহী। এই ‘মাঝারি মান’ বলাটাও খুব ঠিক হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, প্রতিটি ম্যাচে খেলার সুযোগ হয় না তার।
এখনও ৫০ ওভারের ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে ওঠেনি সিলেটের এই ক্রিকেটারের। এবার সেই স্বপ্নটাও হয়তো পূরণ হতে যাচ্ছে… সেটাও আবার বিশ্বকাপের মতো আসর দিয়ে!
আসন্ন ২০১৯ বিশ্বকাপে ১৫ সদস্যের দলে নির্বাচকদের তালিকায় লেখা হয়েছে রাহীর নাম। অপেক্ষা এখন ২২ গজের লড়াইয়ে, যেখানে লেখা হবে তার স্বপ্নজয় কাব্যের শেষ পংক্তেয়।
১.
ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদ বিশ্বকাপের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। সেটা থাকারই কথা ছিল। বিশেষ করে মাত্র শেষ হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) সর্বোচ্চ ২৩ উইকেট পাওয়া এই ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সের বরাত দিয়েই বিশ্বকাপ দলে সুযোগটা পেতে পারতেন। কিন্তু হয়নি। হয়নি কেবল তার ইনজুরি আর ফিটনেসের কারণে। পারফরম্যান্স ‘আপ টু দ্য মার্ক’ থাকলেও ফিটনেসের কারণেই বাদ পড়েছেন তিনি। ঠিক এই কারণেই নিউ জিল্যান্ড সফরে বাদ পড়েন তিনি। ফেরার জন্য বিপিএলে চোখ রেখেছিলেন, ফিরেছিলেনও। কিন্তু সিলেট সিক্সার্সের এই ক্রিকেটার ফিল্ডিং করতে গিয়ে আবারও চোট পান, আবারও মাঠের বাইরে চলে যান।
তাকে নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছেন,
‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাসকিনের একটা দীর্ঘ বিরতি পড়ে গেছে। ওকে আমরা যখন নিউ জিল্যান্ড সিরিজের জন্য চিন্তা করলাম, তখন ও আবার চোটে পড়ল। আমাদের কাছে যে রিপোর্টগুলো আছে ফিজিও’র, সেখানে বলা হচ্ছে, তাসকিন এখনো পুরোপুরি ফিট না। স্কিলের দিক দিয়ে পুরোপুরি ফিট হিসেবে চাচ্ছিলাম ওকে। এখন ওকে নিতে চাচ্ছি না। ঘরোয়া ক্রিকেটে একটা ম্যাচ খেলেছে সে। তবুও তার ফিটনেস সন্তোষজনক নয়।’
ঠিক এই কারণেই ইংল্যান্ডের পেস কন্ডিশনে তাসকিনের পরিবর্তে আরও একজন পেসার দরকার ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় নির্বাচকদের তালিকায় ছিল দু’জনের নাম, শফিউল ইসলাম এবং আবু জায়েদ রাহী। শফিউলের অভিজ্ঞতা আর পুরনো সুখস্মৃতির হাত ধরে খানিকটা গণমাধ্যমের অনুগ্রহ পেলেও হার মেনে যান নিজের ফর্মের কারণে, যে কারণে ভাগ্য খুলে যায় রাহীর। মে মাসের ৩০ তারিখ থেকে শুরু হওয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। সেটাও আবার কোনো ওয়ানডে না খেলেই!
তবে রাহীকে বিশ্বকাপ দলে নেওয়ার পিছনে দলের প্রধান কোচ স্টিভ রোডসের বিশেষ ভূমিকা ছিল বলেই মনে করা হয়। তিনি বারবার রাহীর সুইং ও গতির উপর বিশ্বাস রেখেছেন, যা কি না বাংলাদেশকে ইংলিশ কন্ডিশনে বাড়তি সুবিধা দেবে বলেই তার ধারণা।
তবে ওয়ানডে না খেলার অভিজ্ঞতা নিয়েও সরাসরি ওয়ানডে বিশ্বকাপের দলে ডাক পাওয়াটা নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেন না রাহী। তাই উচ্ছ্বাসটা লুকিয়ে রাখতে পারেননি। রাহীর ভাষায়,
‘স্বাভাবিকভাবেই খুব অবাক হয়েছি। আমি ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে (ডিপিএল) দু’টি ম্যাচে খুব ভালো খেলেছি। তারপর থেকে আমি ভাবছিলাম, আমি হয়তো বিশ্বকাপের ২০ সদস্যের দলে থাকবো। কিন্তু যখন দেখলাম ১৫ সদস্যের দলে আমার নাম আছে, অবাক হয়েছি।’
৫ টেস্ট খেলা রাহীর লাল বলে সুইং করানোর অভিজ্ঞতা আছে। এখন সাদা বলে দ্রুত এই কৌশল শিখতে হবে তাকে। যদিও তিনি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন, তারপরও লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটের জন্যই ২৫ বছরের এই ক্রিকেটার বেশি পরিচিত।
তবে ওয়ানডে না খেলার অভিজ্ঞতাকে বিশ্বকাপের মঞ্চে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে নারাজ এই ক্রিকেটার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
‘আমি গত ১০ বছর ধরে ক্রিকেট খেলছি। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে ক্রিকেট খেলার সুযোগ আমার হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় না, বিশ্বকাপের মঞ্চে আমার জন্য খুব বেশি সমস্যা হবে।’
২.
বাংলাদেশের স্পিনসহায়ক উইকেটে পেসারদের জন্য তেমন কিছু থাকে না। তবে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে ইংল্যান্ডের মাটিতে। সেখানকার পেস-সহায়ক উইকেটের কথা চিন্তা করেই মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন এবং মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের সঙ্গে আরও একজন পেসার হিসেবে রাহীকে দলে নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তার গতির চেয়ে সুইং করানোর ক্ষমতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন নির্বাচকরা।
রাহী বলেন,
‘ইংল্যান্ডের মতো পেস-সহায়ক দেশে বল সুইং করানো সহজ। তাছাড়া আমার মূল শক্তির জায়গাটাও সুইং। তাই আমি আশাবাদী। আমি আমার সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস রাখছি। তাছাড়া সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সিরিজে আমি বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যাটসম্যানের উইকেট নিয়েছি, যা আমাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করছে। ইংল্যান্ডের মতো নিউ জিল্যান্ডের উইকেটও পেস সহায়ক। তাছাড়া কিছুদিন আগে মাশরাফি ভাই (বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক) আমাকে আমার সুইং করানোর সামর্থ্যের ব্যাপারে তার আশার কথা জানিয়েছেন।’
পেস বোলার হিসেবে নিজের দক্ষতা কিংবা সামর্থ্য নয়, বরং রাহী চ্যালেঞ্জ দেখছেন স্কোয়াডে থাকা বাকি পেসারদের কারণে। তাদেরকে পিছনে ফেলে মূল একাদশে সুযোগ পাবেন কি না, কিংবা পেলেও কয়টি ম্যাচে তিনি সুযোগ পাবেন, সেটা নিয়েই মূলত চিন্তা এই ক্রিকেটারের। তবে সুখের কথা এই যে, নিয়মিত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার কারণে তিনি স্কোয়াডের অন্যান্য পেসারদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে আছেন। এমনকি চলমান ঘরোয়া টুর্নামেন্টেও তিনি ঝুলিতে ভরছেন একের পর এক উইকেট, যেটা তাকে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে রাখবে।
‘১৫ সদস্যের দলে জায়গা পাওয়াটা অবশ্যই দারুণ কিছু। কিন্তু এখন চ্যালেঞ্জটা হলো নিজেকে মূল একাদশে দেখা। সেটা হলেই হয়তো আমাকে সুযোগ দেওয়ার প্রতিদান আমি বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্টকে দিতে পারবো।’
বললেন রাহী।
শুরু থেকেই বিশ্বকাপে সেরা দল দেওয়ার মিশনে নেমেছিলেন নির্বাচকরা। দীর্ঘদিন থেকেই দল নিয়ে কাটাছেঁড়া করার পর ১৫ সদস্যের এই দল ঘোষণা করে বিসিবি। ফর্মে থেকেও যেমন কেবল ফিটনেসের কারণে বাদ পড়েছেন তাসকিন আহমেদ, তেমনই কোনো এক অজানা কারণে ১৫ সদস্যের দলের বাইরে ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েস।
আবার বিশ্বকাপ দল মানেই চমক। নির্বাচকরা সেই চমক দিয়েছেন একটিও ওয়ানডে না খেলা এই আবু জায়েদ রাহীকে দিয়েই। এখন কেবলই অপেক্ষা, নির্বাচকদের ‘নির্বাচিত’ হয়ে কতটা প্রতিদান দিতে পারেন এই ক্রিকেটার।