কোনো স্বপ্ন জয়ের গল্পে তাদের নাম প্রথমে শোনা যাবার কথা নয়। কারণ, মিডফিল্ডাররা সবসময়ই পর্দার পেছনের নায়ক। আর ঝলমলে সব আলো কেড়ে নেন পর্দার সামনে থাকা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা। কেননা, মাঠের দর্শক অথবা টেলিভিশনের সামনে, সবাই দেখছেন আপাতদৃষ্টিতে একজন ফরোয়ার্ড বা উইঙ্গার গোল করে ম্যাচ জিতিয়ে দিচ্ছে।
রিয়াল মাদ্রিদের প্রাক্তন কোচ রাফায়েল বেনিতেজকে তাদের সমর্থকেরা মনে রাখেনি। কারণ, জিদান যেখানে তাদের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েছে, সেখানে বেনিতেজের সাফল্য বলতে তেমন কিছুই নেই। তবে রিয়াল মাদ্রিদের পাড় ভক্ত হলে একটিমাত্র কারণে বেনিতেজকে ধন্যবাদ দিতে পারেন। রিয়াল মাদ্রিদের ‘হোল্ডিং মিডফিল্ড’ পজিশন ঠিক করতে তিনি ফিরিয়ে এনেছিলেন ক্যাসেমিরো নামক এক ব্রাজিলিয়ান তরুণকে, যিনি পরবর্তীতে রিয়াল মাদ্রিদকে দু’হাত ভরে সাফল্য এনে দিয়েছেন।
২০০৭ এর পর গত বছর আবারও ব্রাজিলের কোপা আমেরিকা শিরোপা জেতার পেছনে ক্যাসেমিরোর বড় অবদান ছিল। ঐ ফাইনালের পর ক্যাসেমিরো ছুটিতে ছিলেন পরিবারের সাথে। সাও পাওলোতে কেবল রবিবার রাতটাই তিনি ছিলেন। কিন্তু তখন তার ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ছিল নিউ জার্সিতে, প্রাক-মৌসুম টুর্নামেন্ট খেলতে। সেখানে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে ৩-৭ গোলে লজ্জাজনকভাবে হেরে বসে রিয়াল মাদ্রিদ। এরকম হার ক্যাসেমিরোর দৃষ্টিকটু লাগে। এমন বিপর্যয় তার সহ্য হবার কথাও নয়।
ফ্লোরিডায় তার পরিবারের সাথে ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা ছিল। দ্বিতীয়বার না ভেবেই ক্যাসেমিরো তার সব পরিকল্পনা বাতিল করেন, এবং সাথে সাথে চেপে বসেন স্পেনের ফ্লাইটে, যাতে ভ্যালদেবেবাসে থাকা তার দলের সাথে ট্রেনিংয়ে যোগ দিতে পারেন। সে সপ্তাহেই রেড বুল সালজবার্গের বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদের প্রাক-মৌসুমের ম্যাচ। ক্যাসেমিরো মাঠে নামেন দ্বিতীয়ার্ধের ৪৫ মিনিটের জন্য। সে ম্যাচে লস ব্লাঙ্কোসরা জেতে ১-০ গোলের ব্যবধানে।
ক্যাসেমিরোর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক? তার দলকে একই সুতোয় জুড়ে দেবার ক্ষমতা। ১৯৯০ সালের দিকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ও দেপোর্তিভো লা করুনা দলে খেলা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনে খেলা দোনাতোর ভাষ্যমতে,
‘তার খেলার ভবিষ্যৎ বুঝতে পারার দারুণ এক ক্ষমতা আছে। তিনি সেইসব খেলোয়াড়দের একজন, যারা প্রতিপক্ষের খেলার স্বাভাবিক গতিতে বাধা দেয়। কীভাবে যেন এই ঘরানার ফুটবলাররা বিপদ আগে থেকেই বুঝে নেয়। ক্যাসেমিরোরও এই প্রতিভার অধিকারী, যা রিয়াল মাদ্রিদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।”
দোনাতো আরো বলেন, ক্রুস, মদ্রিচ বা ইসকোর মতো দ্রুত ও আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়দের পিছনে খেলেও কীভাবে গোলের চেষ্টায় বুভুক্ষু হয়ে উঠতে পারেন, সেই পরিপক্কতাই ক্যাসেমিরোকে অনন্য করে তুলেছে,
“সে এমনভাবে কাজটা করে, যেন একদম সহজ ব্যাপার। মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে সে অনেক কিছু করে, যা বাকিদের চোখে পড়ে না। কিন্তু তাকে আমি একটু বেশিই পছন্দ করি, কারণ সে প্রচণ্ড পরিপক্ক স্বভাবের। যখন রিয়াল মাদ্রিদের প্রয়োজন হয় ক্যাসেমিরোকে কিছুটা ভিন্ন রূপে, তখনই সে নিজেকে বদলে ফেলে। সে জানে, বিপদ কখন আসন্ন। মধ্যমাঠে নিয়ন্ত্রণ রেখে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে গিয়ে গোলের চেষ্টায় অংশ নেয়ার মতো কাজ সে মোক্ষম সময়ে করতে পারে।”
এ মৌসুমেই সেভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ। রিয়াল মাদ্রিদের অবস্থা সে সময়ে তেমন ভালো নয়। তাই সেভিয়ার সাথে ম্যাচটি জেতা ছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের সামনে। বার্নাব্যুতে এই ম্যাচটি যথেষ্ট কঠিন রূপেই আবর্তিত হলো। কিন্তু ত্রাতারূপে হাজির হলেন সেই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। রিয়ালের হয়ে প্রথম গোলটি আসে ক্যাসেমিরোর পা থেকেই। সেভিয়া গোল করে সমতায় গেলেও জয়সূচক গোলটাও করে শেষ পেরেক ঠুকে দেন ক্যাসেমিরো। সেদিন বার্নাব্যুতে থাকা প্রত্যেক দর্শক দেখেছিলেন তার ভিন্ন এক রূপ।
জিনেদিন জিদান রিয়াল মাদ্রিদের কোচের চেয়ারে বসার পর ক্যাসেমিরো তার একাদশের সব থেকে নিয়মিত মুখ। করিম বেনজেমার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত খেলোয়াড়। মার্কাস লরেন্তেকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে বিক্রি করার পর দলে ক্যাসেমিরোর বিকল্প কোনো খেলোয়াড় ছিল না রিয়াল মাদ্রিদের বেঞ্চে। এজন্য ক্যাসেমিরোকে খেলতে হয়েছে প্রায় প্রত্যেকটি ম্যাচ। কিন্তু টানা খেললেও ক্যাসেমিরোর খেলায় এর প্রভাব পড়েনি। প্রত্যেক ম্যাচের ৯০ মিনিট রিয়াল মাদ্রিদের অর্ধেক মাঠ দখল রেখেছেন, দায়িত্ব থেকে তিনি কখনোই পিছিয়ে যাননি।
শুধু রিয়াল মাদ্রিদের জন্য নয়, ব্রাজিলের দলেও যে তিনি অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ, তা দোনাতে দারুণভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন। ব্রাজিল দলে ক্যাসেমিরোর অবদান বোঝাতে উদাহরণস্বরূপ তুলে আনা যায় গত রাশিয়া বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের কথা। সে ম্যাচে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ছিলেন না ক্যাসেমিরো। বেলজিয়ামের পাস এবং প্রেসিং ফুটবলের সামনে ব্রাজিলের মধ্যমাঠ সেদিন কোনো ব্যবধানই গড়ে তুলতে পারেনি। কেভিন ডি ব্রুইনের মতো শৈল্পিক মিডফিল্ডার ইচ্ছামতো নাচিয়েছেন ব্রাজিলের মধ্যমাঠকে। ডি ব্রুইনের বুদ্ধিদীপ্ত ও রক্ষণচেরা পাস ঠেকাতে গিয়ে ফার্নান্দিনহো নিতে পারেননি ক্যাসেমিরোর স্থান। ফলে ব্রাজিল সে ম্যাচে ১-২ ব্যবধানে হেরে বিদায় নেন।
রিয়াল মাদ্রিদ ও ব্রাজিলের একাদশ বর্তমানে যাকে ছাড়া ভাবা যায় না, সেই ক্যাসেমিরোর জীবনের শুরু এত মসৃণ ছিল না। যদিও অধিকাংশ ব্রাজিলিয়ানদের বেড়ে ওঠার পেছনের গল্প এমনই। তার বয়স যখন মাত্র চার, সে সময় তার বাবা তাদের রেখে চলে যায়। সংসারের ভরণপোষণ মেটানোর জন্য ক্যাসেমিরোর মা শুরু করেন মানুষের বাসায় কাজ করা। দিনে যখন তিনি কাজে বের হতেন, ক্যাসেমিরোকে তার দুই বড় ভাইবোনের সাথে বাড়িতে তালা দিয়ে যেতেন। জীবনের প্রথম ১৪ বছর এভাবেই কেটেছে তার। এরপর সাও পাওলোর বয়সভিত্তিক দলে নিয়মিত খেলার সুযোগ হলে তার নতুন জীবন শুরু হয়। কিন্তু অর্থকষ্ট বা দুর্ভাগ্য তখনও তার নিয়মিত সঙ্গী। একসময় তাকে একেক দিন একেক বাড়িতে রাত কাটাতে হয়েছে।
দোনাতের ভাষায়,
‘ক্যাসেমিরো এমন একটি দেশ থেকে উঠে এসেছে, যেখানে প্রতিযোগিতা মানুষের জীবনে নিত্যদিনের সঙ্গী। এখানের মানুষ প্রতিযোগিতা পছন্দও করে। সে ব্রাজিলে যা শিখেছে, ইউরোপে এসে তার সঠিক প্রয়োগ করেছে, যেমনটা আমি নিজেও করেছি। একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমরা বেশ ভালোভাবেই জানি। এখন ক্যাসেমিরো রিয়াল মাদ্রিদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের একজন। ক্লাবের মধ্যেও সেখানে প্রতিযোগিতার বিশেষ অভাব নেই। সেখানে বছরের পর বছর খেলে যাওয়া সহজ কোনো ব্যাপার নয়।”
ক্যাসেমিরোর প্রতিভার অন্যতম একটি গুণ, প্রতি ম্যাচ থেকে শেখা এবং ম্যাচের পূর্বে সে ম্যাচ সম্পর্কে আগে থেকে পরিষ্কার ধারণা রাখা। প্রথমদিকের ম্যাচগুলো থেকে তার খেলার স্পষ্টতা ও সিদ্ধান্তে অনেক উন্নতি লক্ষ্যনীয়। তার সম্পর্কে করা বিশ্লেষণগুলো থেকেই সে উন্নতি করার চেষ্টা করে। বর্তমানে তার নজর কম ফাউল করে আরও বেশি বল কেড়ে নেওয়ার দিকে। তিন বছর আগে থেকে বর্তমানে তার পায়ে আরও বেশি বল থাকে। নিজে থেকে শেখা ও এমন আত্ম-উন্নয়নের প্রবণতাই আজ ক্যাসেমিরোকে নিয়ে গেছে সময়ের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের কাতারে।
উদাহরণস্বরূপ, ক্যাসেমিরো নিজে স্বীকার করেছেন প্রতি ম্যাচের পূর্বে কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড় সম্পর্কে পড়াশোনার কথা। গত নভেম্বরে চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসজির বিপক্ষের ম্যাচের পূর্বে তিনি কিলিয়ান এমবাপের খেলার ধরন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন। পরবর্তীতে সে ম্যাচে মধ্যমাঠ থেকে এমবাপের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া বা তার পাস নষ্ট করতে সেই ধারণা ক্যাসেমিরোকে সাহায্য করেছিল।
বর্তমান সময়ের ফুটবলে দুই ধরনের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পাওয়া যায়। এক জাতীয় খেলোয়াড়, যারা মাঝমাঠ থেকে প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট করেই থেমে যায়। যেমন: কান্তে, ম্যানচেস্টার সিটির রদ্রি বা পিএসজির ভেরাত্তি। এবং অন্য ধরন হচ্ছে, যারা আক্রমণ নষ্টের পাশাপাশি আক্রমণ গড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন। যেমন: বার্সেলোনার সার্জিও বুসকেটস। ক্যাসেমিরো মূলত প্রতিপক্ষের আক্রমণ ধসিয়ে দেবার জন্যই বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু দলের প্রয়োজনে তিনি তার ধরন বদলে ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাবেন না।
বর্তমানে ভালভার্দে ও ক্রুসের নিচে রিয়াল মাদ্রিদে ক্যাসেমিরো একজন অতন্দ্র প্রহরী। যার ট্যাকলে সৌন্দর্য্য নেই, নেই শৈল্পিকতার ছোঁয়া। কিন্তু দৃষ্টিকটু এই ট্যাকলই প্রত্যেক ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেয়। তার খেলার ধরনের জন্য অনেকের কাছে তিনি ঘৃর্ণার পাত্র। কিন্তু বুসকেটসের পর নিখুঁত পাসিং দক্ষতা ছাড়াই ক্যাসেমিরো বর্তমান ফুটবলে হোল্ডিং মিডফিল্ডারের এক নিখুঁত দৃষ্টান্ত।