লুইস সুয়ারেজ থেকে রুড ফন নিস্তলরয়, সার্জিও আগুয়েরো থেকে এডিনসন কাভানি, আক্রমণভাগে ডিয়েগো ফোরলানের সঙ্গী হয়েছেন অনেক রথী-মহারথীই। তবে যার সাথে ফোরলানের বোঝাপড়া ছিল সবচেয়ে ভালো, তিনি ফোরলানের কোনো সতীর্থ নন, তার পরিবার বা বন্ধুমহলের কেউ নন, আদতে তিনি কোনো মানুষই নন। ফোরলানের সাথে সবচেয়ে ভালো বোঝাপড়া ছিল একটি বলের। নাহ, এই গল্পটা ডিয়েগো ফোরলানের শৈশবের নয়; এই বলটাও শৈশবের কোনো নেহায়েত সাধারণ বল নয়। বলা হচ্ছে ২০১০ বিশ্বকাপে ব্যবহৃত একটি বলের কথা – জাবুলানি।
জাবুলানি বলতেই নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়ে গেছে ২০১০ বিশ্বকাপ, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভুভুজেলা, ‘ওয়াকা ওয়াকা’, ‘ওয়েভিং ফ্ল্যাগ’ এবং আরো কিছু টুকরো স্মৃতি। ঐ বিশ্বকাপের অফিশিয়াল বলের নাম ছিল ‘জাবুলানি’, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় খুশি বা আনন্দ। আটটি প্যানেলকে জোড়া লাগিয়ে অ্যাডিডাসের তৈরি করা এই বলটা অবশ্য বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের কাছে আনন্দের বদলে এসেছিল বিরক্তির কারণ হয়ে। ব্রাজিলীয় গোলরক্ষক জুলিও সিজার ক্ষোভটা প্রকাশ করেছিলেন এই বল দিয়ে অনুশীলন করার পরই।
“এই বলটা ভয়ঙ্কর, মনে হচ্ছে সুপারমার্কেট থেকে কিনে আনা হয়েছে।”
– জুলিও সিজার, সাবেক গোলরক্ষক, ব্রাজিল জাতীয় দল
‘ভদ্রলোক’ হিসেবে পরিচিত ইতালির গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফনও চেপে রাখতে পারেননি তার বিরক্তিটা।
“এই বলটা একেবারে খেলার অযোগ্য। আমার মনে হয়, এমন একটা প্রতিযোগিতায়, যেখানে সেরা দলগুলো অংশ নিচ্ছে, এমন বল দিয়ে খেলা হওয়াটা লজ্জাজনক।”
– জিয়ানলুইজি বুফন, সাবেক গোলরক্ষক, ইতালি জাতীয় দল
শুধু গোলরক্ষকেরা নন, জাবুলানির ওপর বিরক্ত ছিলেন ফরোয়ার্ডরাও।
“এই বলটা খুবই অদ্ভুত। হঠাৎ করে এটা দিক পরিবর্তন করে, যা আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট। এটা অবিশ্বাস্য, মনে হচ্ছে যেন অন্য কেউ এটাকে পরিচালনা করছে। আপনি বলে লাথি মারতে গেলে এটা যেন তার জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে, মাঝে মধ্যে এটাকে আধিভৌতিক ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে।”
– লুইস আদ্রিয়ানো, স্ট্রাইকার, ব্রাজিল ফুটবল দল
গগণবিদারী শব্দসৃষ্টিকারী ভুভুজেলার মতো জাবুলানি বলও খুব দ্রুত চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাধারণ পাসগুলোও ঠিকঠাক হচ্ছিল না, ফ্রি কিকগুলো আছড়ে পড়ছিলো গ্যালারিতে, সব মিলিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে হতাশা আসতে শুরু করে।
তবে একজন ছিলেন ব্যতিক্রম।
বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই যখন জাবুলানির ব্যাপারে অভিযোগ করতে ব্যস্ত, ডিয়েগো ফোরলান তখন উরুগুয়ের বেস ক্যাম্পে সময় কাটাচ্ছেন নির্ভাবনায়, নিশ্চিন্তে, সবার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থেকে। ২০০৯-১০ মৌসুমে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে ২৮ গোল করা ফোরলানই ছিলেন আট বছর পরে বিশ্বকাপের মঞ্চে ফিরে আসা উরুগুয়ের সবচেয়ে বড় তারকা। তিনি খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন যে জাবুলানি হতে পারে আফ্রিকা বিশ্বকাপে ফুটবলারদের সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম, তাই তিনি টুর্নামেন্ট শুরুর অনেক আগে থেকেই অনুশীলনে এই বলটা ব্যবহার করতে শুরু করেন। তিন মাস ধরে অনুশীলন করে জাবুলানি বলের ওপর নিজের দখল নিয়ে আসেন ফোরলান।
“২০১০ বিশ্বকাপের তিন মাসে আগে ফোরলান অ্যাডিডাসের কাছে একটা জাবুলানি বল চেয়েছিলেন। অ্যাটলেটিকোতে নিয়মিত অনুশীলনের পরও তিনি নিজের উদ্যোগে বাড়তি অনুশীলন করতেন। গতিশীল বল নিয়ন্ত্রণ আর ফ্রি কিক নিয়েও কাজ করেছিলেন তিনি।”
– সেবাস্তিয়ান আব্রেউ, ডিয়েগো ফোরলানের সাবেক সতীর্থ
ঐ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের শুরুটা হয়েছিল ফ্রান্সের মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে। প্রথমার্ধে ২০ গজ দূর থেকে ফোরলানের শট ঠেকিয়ে দেন ফরাসি গোলরক্ষক হিউগো লরিস। প্রথম ম্যাচে গোলের দেখা না পেলেও বোঝা যাচ্ছিল, জাবুলানি বলের আচরণের সাথে অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছেন ফোরলান। আর গোলের অভাবটাও কেটে গেল পরের ম্যাচেই, স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তার ৩৫ গজ দূর থেকে নেওয়া শটটা গোলরক্ষক ইতুমেলেং খুনেকে ফাঁকি দিয়ে জড়াল জালে। তবে শুধু ফোরলানের কৃতিত্বই নয়, ঐ গোলে ছিল সৌভাগ্যের ছোঁয়াও। জাল খুঁজে নেওয়ার আগে বলটা সামান্য দিক পরিবর্তন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ডিফেন্ডার অ্যারন মোকোয়েনার গায়ে লেগে। মোকোয়েনা অবশ্য ঐ গোলে দেখেছিলেন শুধু ফোরলানের নৈপুণ্যই:
“ফোরলানের গোলটা ছিল বিশেষ কিছু। তার বলে লাথি মারার কৌশলটা পুরোপুরি সঠিক ছিল, আর এভাবেই সে আমাকে আর ইতুকে (গোলরক্ষক ইতুমেলেং খুনে) পরাস্ত করেছিল। আমি চেষ্টা করেছিল শট নেওয়ার আগে তাকে আটকাতে, তবে সে পোস্ট থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছিল, আর আমি আশা করিনি যে সে শট নেবে।”
– অ্যারন মোকোয়েনা, সাবেক ডিফেন্ডার, দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দল
ঐ ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে পেনাল্টি থেকে আরেকটা গোল করেন ফোরলান।
পরের দুই ম্যাচে সুয়ারেজ-ঝলকে কিছুটা আড়ালে চলে যান ফোরলান। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে জয়সূচক গোল করে পাদপ্রদীপের আলো কেড়ে নেন সুয়ারেজ, রাউন্ড অব সিক্সটিনে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে করেন জোড়াগোল। তবে ফোরলানও তো সুয়ারেজের ছায়ায় হারিয়ে যেতে চাননি, পরের ম্যাচে, ঘানার বিপক্ষে তিনি পরে নেন তার গোল করার জুতোটা।
ততদিন পর্যন্ত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ভিয়ারিয়াল, অথবা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে ফ্রি-কিকে কোনো গোল করার রেকর্ড ছিল না ফোরলানের। কিন্তু ম্যাচের পঞ্চান্নতম মিনিটে, যখন সুলেই মুনতারির দুর্দান্ত লং-রেঞ্জ গোলে উরুগুয়ে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে, ফোরলান চেয়েছিলেন নিজের ভাগ্যকে একটু পরীক্ষা করতে। আর বিশ্বকাপের আগে যে জাবুলানিকে সাথে নিয়ে এত ট্রেনিং করলেন তিনি, সেই জাবুলানি এই পরীক্ষায় ফোরলানকে সাহায্য করবে না, এটা কি হয়? বক্সের বাইরে থেকে ফোরলানের ফ্রি-কিকটা বাতাসে দিক পাল্টালো, তাতে বিভ্রান্ত হলেন গোলরক্ষক রিচার্ড কিংসন, হাত বাড়িয়েও বলের নাগাল পেলেন না তিনি। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে হাত দিয়ে নিশ্চিত গোল ঠেকিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলেন লুইস সুয়ারেজ, কিন্তু পিছিয়ে পড়া উরুগুয়েকে ম্যাচে ফেরানোর মূল কাণ্ডারির নাম ঐ ডিয়েগো ফোরলানই ছিল।
সেমিফাইনালে ফোরলানের একটা নতুন অভিজ্ঞতা হয়। বিশ্বকাপের এই পর্যায়ে এসে তিনি বুঝতে পারেন, জাবুলানির সাথে দারুণ সখ্যতাটা শুধু তারই নেই, নেদারল্যান্ডের জিওভান্নি ফন ব্রঙ্কহর্স্টও দারুণ বোঝাপড়া রেখেছেন জাবুলানির সাথে। ১৮ মিনিটে ব্রঙ্কহর্স্টের গোলে এগিয়ে যায় ডাচরা, তবে ৪১তম মিনিটে অসাধারণ বাম পায়ের দূরপাল্লার শটে সমতা ফেরান ফোরলান। তবে ফোরলানের এই নৈপুণ্যও বিফলে চলে যায় দ্বিতীয়ার্ধে তিন মিনিটের ব্যবধানে ওয়েসলি স্নেইডার আর আরিয়েন রোবেনের গোলে। ৩-২ গোলে পরাজয়ে উরুগুয়ের সামনে এগোনোর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বাকি থাকে শুধু তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ, কোনো দলই অবশ্য এই ম্যাচটা খেলতে চায় না। তবে ফোরলানের মাথায় ঘুরছিল অন্য চিন্তা।
বিশ্বকাপের পরে ফোরলান একটা ইউটিউব চ্যানেলে কথা বলেছিলেন জাবুলানি বলের সাথে তার অসাধারণ সম্পর্কের রহস্যের ব্যাপারে।
“কোনো রহস্য নেই। শুধুই অনুশীলন, অনুশীলন এবং অনুশীলন। আমার ভাগ্য ভালো ছিল যে জাবুলানি বলটা আমার সাথে ভালো আচরণ করেছিল। আর দল হিসেবেও আমরা ভালো খেলেছিলাম।”
– ডিয়েগো ফোরলান
প্রথমার্ধে টমাস মুলার আর এডিনসন কাভানির গোল-বিনিময়ের পর দ্বিতীয়ার্ধে দেখা গেল ফোরলান-জাদু, বিশ্বকাপের শেষবারের মতো। দারুণ অ্যাক্রোবেটিক হাফ-ভলিটা একবার মাটি ছুঁয়ে জড়িয়ে যায় জার্মানির জালে। গোলটা কতটা দারুণ ছিল সেটা বলার জন্য একটা তথ্যই যথেষ্ট, ২০১০ বিশ্বকাপের সেরা গোল নির্বাচিত হয়েছিল এই গোলটা।
দল হিসেবে উরুগুয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারেনি, তবে গোল্ডেন বল এবং বিশ্বকাপের সেরা গোল, দুটো ব্যক্তিগত পুরস্কারই হাতে তুলেছিলেন ডিয়েগো ফোরলান। আর এই অর্জনের পেছনে শুধু তাঁর অনুশীলন আর ভাগ্যই ছিল না, ছিল জাবুলানি নামের এক ‘বন্ধু’র সাহায্যও!