এই পৃথিবীর আজব রীতি। আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। এই সত্য অনেকের কাছেই খুব সহজবোধ্য। প্রকৃত উদাহরণও আছে অনেক। জীবনের প্রতিটি ধাপে মানুষের চাওয়া পাওয়ার পরিবর্তন সর্বদাই দৃশ্যমান। কিছু কিছু সময় ভাগ্যের পরিহাস, আবার কিছুটা নিজের খামখেয়ালিপনাও সেই পরিহাসের দাবিদার।
আজ এমন একজনের কথা বলছি যার জীবনে ছিল অপার সম্ভাবনা। কিন্তু ভাগ্যের দোলাচলে হয়ে উঠলো না তার স্বপ্নপূরণ। অনেকেই আমরা এই লোকটিকে চিনি না, চেনার কথাও নয়। নাম হল ‘অনিল গুরভ’। রুগ্ন শরীরে সাদা-কালো চুলে একজন যেকোনো ছাপোষা মানুষ এই অনিল গুরভ। ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে বসতভিটা তার। হালকা বৃষ্টি পড়লেই গড়িয়ে পরে ঘরের চালা বেয়ে ফোটা ফোটা পানি। তবুও পাড়ায় তার যথেষ্ট নামডাক। কারণ ছোট ছোট বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলার আসরে তার ডাক যে অনিবার্য!
সবার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে ‘কে এই অনিল গুরভ?’ সেই প্রসঙ্গে আসছি একটু পরেই। জীবনের নানান মোড়ে নানান গল্প ওঁত পেতে রয়েছে। কখন কার ভাগ্য পাল্টে যাবে কেউ বলতে পারে না। কেউ অনেক উঁচুতে পৌঁছে যায়, আবার কেউ পড়ে থাকে তার চেনা গন্ডিতে।
ক্রিকেটের জগতে শচীন টেন্ডুলকার এমন একটি নাম, যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এর পর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ফর্মের উত্থান-পতন হয়েছে সত্য, কিন্তু নিরলস চেষ্টা আর পরিশ্রমের দ্বারা অতিক্রম করে গেছেন জীবনের অনেক বাধা। এখন শচীন যে জায়গায় পৌঁছে গেছেন, সেখানে পৌঁছানোর জন্য প্রতিভার পাশাপাশি তাকে করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রমও। এছাড়াও এর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির অবদান তো রয়েছেই।
শচীন টেন্ডুলকারকে বিশ্ববিখ্যাত ক্রিকেটার হিসেবে তৈরি করার পেছনে তার বড় ভাই অজিতের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। শচীন যখন ক্রিকেটের অনুশীলন করতেন, তখন তার ভাই একজন কোচের ভূমিকায় থাকতেন। শচীনের অনুশীলনে সমস্ত সময় দেওয়ার জন্য তিনি সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন।
ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য রমাকান্ত আচরেকর ছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের কোচ। রমাকান্ত শচীনকে ক্রিকেটের অনেক ধরনের কৌশল শিখিয়েছিলেন এবং তাকে এই খেলার মাস্টার হিসেবে তৈরি করেছেন। এই রমাকান্ত আচরেকরের আরেকজন শিষ্য ছিল যার নাম ‘অনিল গুরভ’। কোচ নিজেই টেন্ডুলকারকে বলেছিলেন অনিলের মতো শট লাগানোর চেষ্টা করতে।
শচীন টেন্ডুলকার একদিন মাঠে বসে খেলা দেখছেন। মাঠে তখন খেলছিলেন তখনকার সময় মুম্বাইয়ের ভিভ রিচার্ডস নামে খ্যাত ‘অনিল গুরভ’। এই লোকটির খেলার মনোমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। শচীন তখন এই খেলোয়াড়ের এতই গুণগ্রাহী ছিলেন যে তার সতীর্থদের কাছে অনিল গুরভের ব্যাট নিয়ে খেলতে চান এমন ইচ্ছা পোষণ করে বসেন। কিন্তু লাজুক শচীন সেই কথা সরাসরি অনিলকে বলতে পারেননি।
একদিন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে স্কোর লেখক রমেশ পরব শচীনের এই ইচ্ছার কথা অনিল গুরভকে বলেন। তখন অনিল শচীনের কাছে গিয়ে বলেন শচীন যদি পরের ম্যাচে সেঞ্চুরি করে, তাহলে তার ব্যাট শচীনকে দিয়ে দেবেন। এই কথায় যেন শচীন আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন। এই চ্যালেঞ্জকে মেনে নিয়ে শচীন পরের খেলায় ১১৮ রান করে বসেন আর পেয়ে যান তার কাঙ্ক্ষিত ব্যাট, আর সাথে প্রাণঢালা শুভকামনা। শচীন খুব যত্ন করে এখনও রেখে দিয়েছেন সেই ব্যাট। এই ব্যাট নিয়ে আরও ঘটনা আছে যা লেখার শেষের দিকে বলব।
একসময়ের মুম্বাই কাঁপানো ক্রিকেটার ছিলেন এই অনিল গুরভ। অনুর্ধ-১৯ এর হয়ে খেলতেন। মুম্বাইয়ের আরেক নামীদামী খেলোয়াড় সুনীল গাভাস্কারেরও খুব পছন্দের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। সকলে বলত মুম্বাইয়ের পরবরর্তী সুনীল গাভাস্কার হবে এই অনিল গুরভ। একসময় তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের হাল ধরবেন বলে অনেকেই আশা করছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সবসময় সবাইকে নিজের অনুকূলে সহায়তা করে না। এর এক জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে রইলেন এই ক্রিকেটের। অভাবের কারণে বর্তমানে মুম্বাইয়ের নালাসোপারাতে অবস্থিত একটি ১০×১৫ ফুটের চালের তৈরি ছোট রুমে থাকেন তিনি। পাশে পড়ে আছে জরাজীর্ণ কিছু আসবাবপত্র। তখনকার সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত তার কিছু ছবি আর প্রতিবেদন এখনও যত্ন করে বিছানার তোষকের নিচে রেখে দিয়েছেন। সাথে আছে তার অর্জিত কিছু ট্রফি, যার কোনো মূল্যই নেই তার স্ত্রী বা সন্তানের কাছে।
শচীনের প্রথম গুরু যেমন তার ভাই অজিত ছিলেন, তেমনই অনিলেরও বড় ভাই ছিল। কাকতালীয় হলেও সত্য যে, অনিলের সেই ভাইয়ের নামও ছিল অজিত। কিন্তু তাদের ভূমিকাটা ছিল ভিন্ন। অজিত শচীনের ক্রিকেট জীবনকে করেছেন বর্ণময়, আর অন্যদিকে আরেক অজিত নিজের ছোট ভাই অনিলের ক্রিকেট জীবন করেছেন ধ্বংস। অনিলের ভাই অজিতের সম্পর্ক ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে। প্রতিদিন চুরি, ব্যাংক ডাকাতি ও হত্যাকান্ডের সাথে তার নাম জড়িত থাকার খবর পাওযা যেত। প্রায়ই অনিল এবং তার মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হতো। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতেও পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবদ করতে ডাকতো। ফলে প্রায়শই অনেক খেলা মিস দিতে হতো অনিলকে। ভাইয়ের এই দুর্নামের ভাগীদার তাকেও হতে হয়। সমাজের চোখে আস্তে আস্তে কলুষিত হতে থাকে তার নাম।
প্রতিদিনকার এই অপমানে অনিল একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিলেন। তিনি এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে, কখনও এই বিষয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ফলে আটকে পড়লেন মদের আসক্তিতে। মদের অভ্যাস তাকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলল। হাতে ব্যাটের বদলে চলে আসলো মদের বোতল। এই নেশা থেকে আর বের হতে পারেননি অনিল। ফলশ্রুতিতে ক্রিকেটকে বিদায় দিয়ে পড়ে রইলেন ছোট্ট একখানা ঘরের কোণে। অন্যদিকে শচীন হয়ে উঠলেন ভারতের ক্রিকেটের ঈশ্বর।
ক্রিকেটে নাম করার পরেও কিন্তু শচীন ভুলে যাননি অনিলকে। অনিলের সাথে শচীনের শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৯০ এর গোড়ার দিকে ইসলাম জিমখানা ক্লাবে। চারদিক দিয়ে রক্ষিবাহিনী দিয়ে ঘিরে থাকার পরও এক কোণে দাড়িয়ে থাকা অনিলকে দেখে চিনতে পারেন শচীন। অনিলের সাথে অনেক কথা বলেন শচীন। তার বাড়িতে অনিলকে আমন্ত্রণও জানান। কিন্তু অভিমানী অনিল সেখানে যাননি কখনও। শচীনের সাথে দেখা করারও চেষ্টা করেননি। অনিল শচীনকে বলেছিলেন, “তুমি এখন ক্রিকেটে অন্য উচ্চতায় উঠে গেছ। আমার ব্যাট তোমার আর কোনো কাজে আসবে না। তাই আমার ব্যাটটা আমাকে ফেরত দিয়ে দাও।” উত্তরে শচীন একটু মুচকি হেসে বলেছিলেন, “সেটা ছিল আমার একমাত্র উপার্জিত ব্যাট”।
অনিলের বয়স এখন পঞ্চাশোর্ধ্ব। পুরনো দিনের খেলোয়াড়ি জীবনের কিছু সুখস্মৃতি ছাড়া মলিন হয়ে গেছে আর সব। সঙ্গী এখন শুধুই মদের বোতল আর কিছু না পাওয়ার বেদনা। ত্রিশ বছর আগের আলোকিত অধ্যায়ের চিরসমাপ্তির পর এখন হাতে রয়েছে শুধু সে সময়ের কিছু নিদর্শন যা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। অনিলের মতে, শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, লাগে উপযুক্ত পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশ। আর এই পরিবেশ এবং ভাগ্যের দোলাচলে পেছনে পড়ে থাকতে হলো একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে।