দুটোই মাঠ। একটা খেলার, আরেকটি রাজনীতির। দুটো মাঠেই কাঁপিয়ে বেড়ানো যায়, বিতর্কিত হওয়া যায়। কিন্তু যিনি খেলার মাঠ কাঁপিয়েছেন, তিনি রাজনীতির মাঠ কতটা কাঁপাতে পারেন? কিংবা একসঙ্গে দুটো? আদৌ সম্ভব?
রাজনীতি এমনই এক বিষয়, যেখানে আসলে সবই সম্ভব। সে এক অন্যরকম আগ্রহের জায়গা। দেশের হয়ে ক্রীড়াজগতে অনন্য সম্মান এনে দেওয়া অনেক খেলোয়াড় তাই নিজেদের খেলোয়াড়ী জীবন শেষে ঘাঁটি গেড়েছেন রাজনীতির মাঠে। ব্যর্থ হয়েছেন সেটা ঠিক বলা যায় না। বরং সফলতার হারই বেশি। সেটার কারণ হতে পারে ‘ধৈর্য্য’, যেটা সাধারণ মানুষের চেয়ে একজন ক্রীড়াবিদের মধ্যেই বেশি। কারণ তাদেরকে যেমন খারাপ সময় পার করতে হয়েছে, তেমনই তারা জানেন কিভাবে ভালো সময় আসবে।
ইতিহাস বলছে, রাজনীতির মাঠে ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণ নেহাত কম নয়। দুজন আবার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন! এই তো, ক’দিন আগে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খান তালিকার সর্বশেষ সংযোজন। খেলতে খেলতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাসও আছে শ্রীলঙ্কায়। তেমনই কিছু গল্প নিয়ে এই আয়োজন।
জর্জ উইয়াহ
ক্রীড়াজগত থেকে রাজনীতিতে আসার মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত হলেন জর্জ উইয়াহ। এই মুহূর্তে তিনি লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট। বস্তি থেকে উঠে আসা এই লোক নিজের নাম লিখিয়েছিলেন ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। লাইবেরিয়ার মতো জায়গায় জন্ম নিয়েও খেলেছিলেন ইউরোপিয়ান ফুটবলে। নিজের সময়ে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের (পিএসজির) অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন তিনি। খেলেছেন এসি মিলান আর চেলসির মতো ক্লাবেও। তিনি ব্যালন ডি’অরও জিতেছেন। টানা ১৮ বছর পেশাদার ফুটবল খেলার পর ২০০৩ সালে সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসর নেন এই আফ্রিকান।
এরপর ২০০৫ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন উইয়াহ। নিজে তৈরি করেন ‘কংগ্রেস ফর ডেমক্রেটিক চেঞ্জেস’ নামের দল। কিন্তু উইয়াহর দুর্ভাগ্য। সে বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যোগ দিতে গিয়ে বেশ হ্যাপা পোহাতে হয়েছে তাকে। শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে প্রতিপক্ষ দল। নির্বাচনে অংশগ্রহণই ভেস্তে যাচ্ছিল তার। যদিও হেরে গিয়েছিলেন তিনি।
যে পড়াশোনার কারণে খোঁচা সহ্য করছিলেন, সেটার পিছনেই দৌড়ালেন এবার। প্রথমে ক্রীড়া ব্যবস্থাপনার উপর স্নাতক করলেন লন্ডনের পাকউড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর মায়ামির দেভরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ। তারপর আবার রাজনীতি। ২০১৪ সালে জিতলেন সিনেট নির্বাচনে। হারিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্টের ছেলে রবার্ট শিরলিফকে। তারপর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হলেন ২০১৭ সালে। ব্যস, ১২ বছর দায়িত্বে থাকা তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে হারিয়ে রাজনীতিতেও ‘গোল’ করলেন এই ফুটবলার।
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন
এখনও মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনকে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মনে করা হয়। কিন্তু তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার অনেক বিতর্কের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল।
১৬ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ৩৩৪ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে মোট ৯৩৭৮ রান তুলেছিলেন আজহার। তার সময়ে এটা ছিল বিশ্বরেকর্ড। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তার ফিক্সিং কেলেঙ্কারিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) আজহারউদ্দিনকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে।
এরপর রাজনীতিতে আসেন তিনি। ২০০৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টির হয়ে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে অন্ধ্র প্রদেশের হাইকোর্ট তার উপরে থাকা জীবনের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়। কারণ সাবেক এই ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কোনো শক্ত প্রমাণ ততদিনেও পাওয়া যায়নি।
গ্যারি কাসপারোভ
রাশিয়ান গ্যারি কাসপারোভকে এখনও সর্বকালের সেরা দাবাড়ু বলা হয়। ২০০৫ সালে দাবা থেকে অবসর নেওয়ার পর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় তিনি খরচ করেছেন রাজনীতি ও লেখালিখি করে। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতিপক্ষ পার্টিতে অংশ নেন। তিনি পুতিনের এডমিনিস্ট্রেশন পলিসি নিয়ে তুমুল সমালোচনা করেন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন কাসপারোভ। কিন্তু নির্বাচনের দাবার বোর্ডে হেরে যান তিনি। এই মুহূর্তে তিনি ক্রোয়েশিয়ার নাগরিক।
সনাৎ জয়সুরিয়া
ক্রীড়া জগতে শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি সনাৎ জয়সুরিয়া হলেন একমাত্র ক্রিকেটার যিনি কি না জাতীয় দলে থাকার সময়েই রাজনীতিতে বিচরণ করেছেন। এমনকি জাতীয় দলে থাকার সময়েই সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, পাশ করেছেন। ২০১০ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জয়সুরিয়া। জাতীয় দল থেকে অবসরে যান ২০১১ সালে। রাজনীতি করার পথে একবার মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন সয়সুরিয়া। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে আর তাকে নির্বাচনে পাওয়া যায়নি।
১৯৮৯ সাল থেকে ২০১১; জাতীয় দলের হয়ে টানা ২২ বছর খেলেছেন জয়সুরিয়া। এই সময়ে ১১০ টেস্ট, ৪৪৫টি ওয়ানডে ও ৩১টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান ফরম্যাটগুলোতে যথাক্রমে ৬৯৭৩ রান, ১৩৪৩০ রান ও ৬২৩ রান তুলেছেন।
অলরাউন্ডার ছিলেন। তাই বোলিংয়ের পরিসংখ্যানটাও নেহাত কম নয় এই কিংবদন্তির। বাঁহাতি স্পিনে অবসরে যাওয়ার আগপর্যন্ত তুলে নিয়েছিলেন ৯৮ টেস্ট উইকেট, ৩২৩ ওয়ানডে উইকেট ও ১৯ টি-টোয়েন্টি উইকেট।
অর্জুনা রানাতুঙ্গা
শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা এই মুহূর্তে দেশটির ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ। তার শুরুটা হয়েছিল শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে। ২০০১ সংসদ নির্বাচনে তিনি কলম্বোর সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে শিল্প, পর্যটন ও বিনিয়োগ মন্ত্রালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর ২০১০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান সারাথ ফোনসেকার দলে যোগ দেন। ২০১০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফোনসেকা মাহিন্দা রাজাপাকশের বিপক্ষে নির্বাচনে হেরে যান। তারপর মিলিটারিদের কোর্ট মার্শালের খড়গে পড়তে হয় তাকে। তবে কারণটা ছিল অজানা।
পরবর্তীতে ২০১২ সালে ফোনসেকার দল থেকে পদত্যাগ করেন। তবে যোগাযোগটা বন্ধ করেননি। ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাইথ্রিপালা সিরিসেনাকে সমর্থন দেন। সিরিসেনা জয় পেলে হাইওয়ে, বন্দর ও জাহাজ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান রানাতুঙ্গা। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে তিনি এই মন্ত্রী হিসেবে কর্মরত আছেন।
শ্রীলঙ্কা জাতীয় দল ১৯৯৬ সালে রানাতুঙ্গার অধীনে বিশ্বকাপ জয় করে। ১৯৮২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত, শ্রীলঙ্কার হয়ে ৯৩টি টেস্ট ম্যাচ ও ২৬৯টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন রানাতুঙ্গা।
নাইমুর রহমান দূর্জয়
বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দূর্জয় জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজনীতিতে ক্যারিয়ার গড়েছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনীতিতে জড়ান তিনি। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের সাবেক এই ক্রিকেটার।
জাতীয় দলের হয়ে তিনি ৮ টেস্ট ও ২৯টি ওয়ানডে খেলেছেন। ১৯৯৫ সালে অভিষেকের পর ২০০২ সালে নিজের ব্যাট-প্যাড তুলে রাখেন দূর্জয়। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন ডানহাতি অলরাউন্ডার।
ইমরান খান
ক্রীড়াবিদদের রাজনৈতিক সফলতার সর্বশেষ সংযোজন পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ক’দিন পরই শপথ নেবেন তিনি। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সব মিলিয়ে ১১৭টির মতো আসনে জয়লাভ করে।
ইমরান খানের অধীনেই বিশ্বকাপ জেতে পাকিস্তান ক্রিকেট দল। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন ফাস্ট বোলার ও মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। তার গতি আর সুইং প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের কাছে সাক্ষাত ত্রাস ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলে অভিষেকের পর দেশটির হয়ে খেলেছেন ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। মাঠে নেমেছেন ৮৮ টেস্ট ও ১৭৫ ওয়ানডে ম্যাচে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার ৪ বছর পর রাজনীতিতে নামেন ইমরান খান। ১৯৯৬ সালে নিজের পার্টি পিটিআই তৈরি করেন। ২২ বছর রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়ে এবার ২০১৮ সালে এসে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন তিনি।
ফিচার ইমেজ: Reuters Photo