ক্রীড়া জগতটাও মাঠের খেলার মতোই বড় বিচিত্র। জন্মভূমির জন্য জীবন দিয়ে খেলা খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনেক। গ্যারি নেভিল ও ফিল নেভিল বা ফ্রাঙ্ক ডি বোর ও রোনাল্ড ডি বোর ভাইদের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য খেলার উদাহরণ যেমন আছে, তেমনই আছে সহোদর ভাই হয়েও আলাদা দেশে খেলার ঘটনা। একই মায়ের গর্ভজাত ভাইয়েরা যখন ভিন্ন দেশের হয়ে খেলে, তখন কেমন লাগে দেখতে? এ বড় বিচিত্র এক দৃশ্য। সৃষ্টিকর্তা তাঁদের একই গর্ভে পাঠালেও ক্রীড়া-নিয়তি তাদেরকে এক বিন্দুতে মেলাতে পারেনি। আজ রয়েছে তেমনই কিছু ভাইদের কথা।
ম্যাথিয়াস, ফ্লোরেন্তিন পোগবা (গিনি) ও পল পোগবা (ফ্রান্স)
পল পোগবাকে নিয়মিত ফুটবল দর্শকদের কে না চেনেন? বিশ্বের সবচেয়ে দামী মিডফিল্ডার তিনি, জুভেন্টাস থেকে ম্যানচেস্টারে তার ট্রান্সফার ফি ইতিহাসের সবচেয়ে দামী ট্রান্সফারের একটি। পোগবা ফ্রান্স জাতীয় দল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঝমাঠের এক ভরসার নাম। কিন্তু অনেকে আর দুই পোগবা ভাইয়ের কথা জানেন না। পোগবার ওই দুই ভাই যমজ এবং তাঁরা দুজনই গিনি জাতীয় দলের হয়ে খেলেন; ফ্লোরেন্তিন ও ম্যাথিয়াস।
ফ্লোরেন্তিনের বেড়ে ওঠা সেল্টা ভিগোতে। সেখান থেকে ফ্রান্সের ঘরোয়া লিগের ৩য় বিভাগের দলে খেলে সেখান থেকে যান সেন্ট ইটিনি-তে। ফ্লোরেন্তিন মূলত ডিফেন্ডার, সেন্ট ইটিনির সাম্প্রতিক সাফল্যের অংশ এই ফ্লোরেন্তিন গিনির হয়ে খেলেছেন ২০ ম্যাচ। ম্যাথিয়াস পোগবা অত ভালো কোনো খেলোয়াড় না। ইংলিশ ২য় বিভাগের ক্লাব রটারড্যামে খেলেন স্ট্রাইকার হিসেবে। তিনিও তার যমজ ভাইয়ের মতো বেছে নিয়েছেন গিনিকে। জাতীয় দলে খেলেছেন ৩ ম্যাচ। একবার ভাবুন, পোগবার মা-বাবার কথা? তাঁরা দ্বৈত নাগরিক, আর ছেলেরাও তাঁদের অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেনি। জন্মভূমি ও বর্তমান- সব মিলিয়েই তাদের ছেলেরা তাদের যৌক্তিক অবস্থানেই রেখেছেন!
থিয়াগো আলকান্তারা (স্পেন) ও রাফায়েল আলকান্তারা (রাফিনহা) (ব্রাজিল)
মাজিনহো এক জীবনে আর কী চাইতে পারেন? নিজে খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছেন ব্রাজিলের হয়ে ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ। রয়েছে তাঁর দুই বিখ্যাত ছেলে। থিয়াগো খেলেন বায়ার্নে, বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার তিনি। রাফিনহা বার্সা থেকে যোগ দিয়েছেন ইন্টার মিলানে, ইনজুরিতে পড়ার আগে বার্সায় এনরিকের অধীনে ভালই ফুটে উঠছিলেন তিনি। পিতা মাজিনহো ব্রাজিলের হয়ে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপ ট্রফিটির স্বাদ পেলেও তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান থিয়াগো বেছে নিয়েছেন স্পেন। বার্সা একাডেমিতেই তার বেড়ে ওঠা, পেপ গার্দিওলার এই ছাত্রকে নিতে কালক্ষেপণ করছিল মানো মেনেজেসের ব্রাজিল। তখন স্পেনের মাঝমাঠে বার্সার জাভি, ইনিয়েস্তা, বুস্কেটসদের দাপট। তারা থিয়াগোকে জোর দেন স্পেনের হয়ে খেলতে। এটা খুবই সহজ ছিল বোঝা যে, জাভির আসল রিপ্লেসমেন্ট হতে পারে থিয়াগোই। থিয়াগোও শেষাবধি বেছে নেন স্পেনকেই, ব্রাজিল হারায় এক অসামান্য প্রতিভাকে।
রাফিনহা আবার উল্টো, তার বেড়ে ওঠা বার্সা একাডেমিতে হলেও তিনি ভাইয়ের পথ মাড়াননি। তাঁর ভাষায় সিদ্ধান্তটা ছিল খুবই সহজ, কারণ তার মানসপটে গেঁথে আছে তার বাবার ব্রাজিলের জার্সিতে বিশ্বকাপ উচিয়ে ধরার ছবি। তাই তিনি ব্রাজিলের হয়েই খেলার সিদ্ধান্ত নেন এবং জাতীয় দলে তার অভিষেক হয়েও গেছে। ইনজুরি তার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ না করলে হয়তো আরো ম্যাচ খেলা হয়ে যেত জাতীয় দলে।
ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি (ইতালি) ও ম্যাসিমিলানো ভিয়েরি (অস্ট্রেলিয়া)
ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি একজন সাবেক ইতালীয় ইন্টার মিলান তারকা, সেই আমলের বিখ্যাত এক স্ট্রাইকার। জুভেন্টাস, এটলেটিকো মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান, এসি মিলানের মতো ক্লাবে খেললেও আশ্চর্যজনকভাবে তাকে একবার এক অস্ট্রেলিয়ান কোচ নাকচ করে দিয়েছিলেন দলে নিতে। ভিয়েরি পরিবার অনেকদিন ধরে তখন অস্ট্রেলিয়ায় বাস করছে। ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরিকে দেখে অতটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি সেই সময়কার অজি ফুটবল কোচ। কিন্তু ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর রাডারে ঠিকই চলে আসেন তিনি। ইতালিতে এসে পেতে থাকেন দারুণ সাফল্য। তাই পরবর্তীতে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন ইতালির হয়েই। অস্ট্রেলিয়াও পেয়েছিল আরেক ভিয়েরিকে, তবে ‘সেরা’ ভিয়েরিকে না! ভাই ম্যাসিমিলানো ভিয়েরি ক্রিশ্চিয়ানের মতো কোনো দারুণ প্রতিভা ছিলেন না। ইতালিয়ান লিগের ছোট ছোট দলগুলোতেই তার খেলা হতো। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দল থেকে যখন তাকে ডাকা হয় তিনি সায় দিয়ে দেন, কারণ তার পক্ষে ইতালি জাতীয় দলে খেলা কখনো সম্ভব হতো না। এভাবেই দুই ভাই যেন হয়ে যান দুই মহাদেশের!
গ্রানিথ ঝাকা (সুইজারল্যান্ড) ও তোলান্ট ঝাকা (আলবেনিয়া)
২০১৬ ইউরো; সুইজারল্যান্ডের সাথে খেলছে আলবেনিয়া। শুধু দুটি দেশই খেলছে না, খেলছে দুই সহোদর একে অপরের বিরুদ্ধে। তাদের মায়ের এই দৃশ্য দেখা লাগতো না যদি আলবেনিয়ান ফুটবল কাউন্সিল সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতো!
গ্রানিথ ও তোলান্ট দুইজনই বেড়ে উঠছিলেন সুইজারল্যান্ডের ক্লাব এফসি বাসেলে। মিডফিল্ডার হিসেবে গ্রানিথ ছিলেন দারুণ, তাই বাসেল থেকে যোগ দেন জার্মান ক্লাব মনশেনগ্লাডবাখে। সেখানেও তার ফর্মের লেখচিত্র ছিল একইরকম উর্ধ্বমুখী। কিছুদিন পরই ডাক আসে আর্সেনাল থেকে। গ্রানিথ বর্তমানে আর্সেনালে খেলছেন। তার বরাবরই ইচ্ছা ছিল আলবেনিয়ার হয়ে খেলবেন। এদিকে সুইস নাগরিকত্ব থাকায় সুইজারল্যান্ডও চাপ দিচ্ছিল তাদের হয়ে খেলার জন্য। গ্রানিথের তখনও ইচ্ছে ছিল আলবেনিয়ার জার্সি গায়ে তোলার। কিন্তু আলবেনিয়ান বোর্ড সময়ক্ষেপণ করছিল আর অপরদিকে সুইস বোর্ড ছিল গ্রানিথের জন্য মরিয়া। নিজ থেকে যেচে গ্রানিথ আলবেনিয়া কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলেও তারা তেমন গাঁ করেন নি। অপমানিত গ্রানিথ বেছে নেন সুইজারল্যান্ডকে। আলবেনিয়া হারায় এক দারুণ মিডফিল্ডারকে।
ভাই তোলান্টের উঠে আসাও একইভাবে। সুইস যুব দল বা ক্লাব বাসেল- সব জায়গাতেই ভাইয়েরই পথাবলম্বন করছিলেন তিনি। কিন্তু বাদ গেল শুধু জাতীয় দল। গ্রানিথ ঝাকা নিজেই তাঁর ভাই তোলান্টকে বলেন আলবেনিয়ার হয়ে খেলার জন্য! তোলান্টকে ডেকে নেয় আলবেনিয়া, আগের ভুল আর পুনর্বার করেনি আলবেনিয়ান বোর্ড। মাঝখান থেকে বোর্ডের আলস্যের কারণে ২০১৬ সালের এক সন্ধ্যায় ঝাকা দম্পত্তির দেখতে হয়েছিল তাদেরই দুই ছেলের দুই দেশের হয়ে খেলা!
কেভিন প্রিন্স বোটেং (ঘানা) ও জেরোমে বোটেং (জার্মানি)
বোটেং সিনিয়র ১৯৮১ সালে ঘানা ছেড়ে জার্মানি আসেন পড়াশোনার জন্য। তারপর থেকে তার সেখানেই থেকে যাওয়া। তার দুই ছেলেরই ছিল ফুটবলের দিকে বেশী ঝোঁক। দুজনেই বেড়ে উঠছিলেন হার্থা বার্লিন একাডেমিতে। একটা সময় তাদের সামনে এক কঠিন পরীক্ষার মুহুর্ত এসে উপস্থিত হয়। তারা কি জার্মানির হয়ে খেলবেন নাকি ঘানার হয়ে? একটু ব্যাতিক্রমী ওরা দু’জন, ওরা সহোদর ছিলেন না।
ততদিনে জেরোমে জার্মানিতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন তার দারুণ ডিফেন্সিভ পারফর্মেন্সের জন্য। কেভিনও খুব একটা সাদামাটা খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু কেভিন বেছে নিলেন তার পিতার জন্মস্থল ঘানাকে। তবে বোটেং এর ভাষ্য ছিল পরিষ্কার। ছোট থেকে যে দেশে বেড়ে ওঠা, সেই দেশটাকে ততদিনে একটু বেশিই ভালবেসে ফেলেছেন। বোটেং বেছে নিলেন জার্মানিকে। ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির সাথে ঘানার ম্যাচে মুখোমুখি হয় এই দুই ভাই। সে ম্যাচে ঘানা হেরে যায় ১-০ গোলে, কিন্তু সেবার ঘানা ব্যাপক প্রশংসা কুড়োয়। সুয়ারেজের সেই হ্যান্ডবল-নাটক না হলে সেমি ফাইনালেও উঠে যেতে পারতো ঘানা। আবার ঘানার সাথে জার্মানির দেখা হয় ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে। সে ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হলেও জেরোমে তাঁর জীবনের সেরা অর্জনটি বাগিয়ে নেন, তা হলো বিশ্বকাপ ট্রফি। দেশ আলাদা হলেও এই দুই ভাইয়ের দারুণ হৃদ্যতা আজও অটুট।
ফিচার ইমেজ: Business Insider