নায়ক হওয়ার সুযোগ ছিল বিনোদ কাম্বলির। ১৯৯৬ সালে যে বিশ্বকাপ জিতেছিল শ্রীলঙ্কা, সেই দলটাই সেমিফাইনালে ভারতের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দেয়। তাতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার শেষ ধাপের আগে বাদ পড়ে ভারত। আর বিনোদ কাম্বলি মাঠ ছাড়েন চোখের পানিতে। সেদিনের ম্যাচ এককথায় নাটকীয় হয়েছিল। লঙ্কানরা ২৫১ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিল। ইডেন গার্ডেনে সেই লক্ষ্যের পিছনে ছুটতে গিয়ে মাত্র ২২ রানেই ভারত হারিয়ে বসলো ৭ উইকেট! ঘরের মাঠে এহেন পারফর্মেন্স গ্যালারির দর্শকরা নিতে পারেনি। বিক্ষুব্ধ জনতার কারণে আগাম বিপদ সংকেত দেখছিলেন ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড। তাই সেই অবস্থায় ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন তিনি। জয় পায় শ্রীলঙ্কা দল। সেই ম্যাচ নিয়ে এখনও আক্ষেপ রয়েছে কাম্বলির।
২০০০ সাল পর্যন্ত খেলেছেন কাম্বলি। ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের প্রিয় বন্ধু ও একই কোচের শিষ্য কাম্বলি খুব বেশি ম্যাচ ভারতের হয়ে খেলেননি বটে। তারপরও তিনিও হতে পারতেন বিশ্বসেরা। ভারতের সাবেক অধিনায়ক কপিল দেবের মতে, পরিবার-বন্ধুদের সমর্থন পেলে শচীনকেও নাকি ছাড়িয়ে যেতেন তিনি। কিন্তু পারেননি কেবল বিতর্কিত হয়ে যাওয়ার কারণে।
মাঠের বাইরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তাকে বিপাকে ফেলেছে। চোখের বালি হয়েছেন তিনি। কখনও গৃহকর্মীকে মারধোর করা, কখনও বিতর্কিত মন্তব্য করা, মদ্যপান করে মাতলামী; এমন কিছু নেই যে তিনি করেননি। এসব নেতিবাচক দিক তার ক্যারিয়ারে যেমন প্রভাব ফেলেছে, তেমনই বিপদে ফেলেছে পরবর্তীতেও। অথচ শচীনের সঙ্গেই তার নাম উচ্চারিত হতো।
ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন। অফস্পিনও কালেভাদ্রে করতেন, সেটাও বেশ কার্যকরী ছিল। ভারত জাতীয় দলের হয়ে ১৯৯১ সালে অভিষেক করেন। ক্যারিয়ার শেষ হয় ২০০০ সালে। খেলেছেন ১০৪ ওয়ানডে ও ১৭টি টেস্ট ম্যাচ। সাদা পোশাকের টেস্টে তার মোট রান রয়েছে ১০৮৪। সেঞ্চুরি ৪টি, হাফ সেঞ্চুরি ৩টি। সর্বোচ্চ ২২৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ওয়ানডেতে তার মোট রান ২,৪৭৭। সেঞ্চুরি আছে ২টি, হাফ সেঞ্চুরি ১৪টি। ৫০ ওভারের এই ফরম্যাটে তার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ১০৬ রানের। ওয়ানডেতে একটি উইকেটও আছে তার।
জাতীয় দলের বাইরে ঘরোয়া ক্রিকেটেও মনে রাখার মতোই পারফর্মেন্স করেছেন বিনোদ কাম্বলি। ১২৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে তুলেছেন ৯,৯৬৫ রান, উইকেট ১০টি। সেঞ্চুরি আছে ৩৫টি, হাফ সেঞ্চুরি ৪৪টি। ২২১ লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে রয়েছে ৬,৪৭৬ রান। রয়েছে ১১টি সেঞ্চুরি ও ৩৫টি হাফ সেঞ্চুরি। ভারতীয় এই ক্রিকেটার ২০০৪ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে তারপর অবসর নিয়েছেন।
এরপর বিভিন্নভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার চেষ্টা করেছেন। টিভি চ্যানেলে ছিলেন নিয়মিত মুখ। নতুন করে শুরু করেছেন কোচিং। নিজের সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে এবার তরুণদের জন্য যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন সেটাকে পার করার চেষ্টায় রয়েছেন বিনোদ কাম্বলি। পুরনো ক্যারিয়ার, নতুন ভাবনা, ১৯৯৬ বিশ্বকাপের দুঃস্মৃতি; সবকিছু মিলিয়ে এক সাক্ষাতকার দিয়েছেন। সেখানে মন খুলে বলেছেন অনেক কথা।
বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে কাঁদতে কাঁদতে ইডেন গার্ডেন থেকে বের হচ্ছেন বিনোদ কাম্বলি। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে এই ছবিটা এখনও ভাসে। সেই রাতের সেই কষ্টের অভিজ্ঞতা এখনও মনে পড়ে?
বিনোদ কাম্বলি: টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বারবার আমাকে দেখিয়েই যাচ্ছিলো যে, আমি কাঁদছি। সত্য বলতে, আজও সেই কষ্টের কথা মনে পড়লে আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। আমরা পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ ক্রিকেট খেলেছিলাম। কোয়ার্টার ফাইনালে আমরা পাকিস্তানকে হারাই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সব ঠিক ছিল যতক্ষণ শচীন ব্যাট করছিলেন। যখনই তিনি আউট হলেন, তখন থেকেই সবকিছু গড়বড় হয়ে গেল। আমার এখনও মনে আছে, আমি যখন উইকেটে ছিলাম তার মধ্যেই ৫ জন ব্যাটসম্যান আউট হলেন। অন্তত একজনও যদি আমাকে উইকেটে থেকে সঙ্গ দিতেন, হয়তো আমরা ম্যাচটা বের করে আনতে পারতাম। আমি কাঁদছিলাম কারণ আমি দেশের হয়ে একটি অর্জনের খুব কাছে গিয়েও ফিরে এলাম সেকারণে। পুরো দল আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমাদের বেশিরভাগই কাঁদছিল। হ্যাঁ, মহেন্দ্র সিং ধোনি ও বাকিরা ২০১১ সালে বিশ্বকাপ জিতেছে, আমাদের জন্য এটা অনেক আনন্দের। কিন্তু ‘৯৬ এর সেই হার এখনও আমাকে কষ্ট দেয়।
ইদানিং আপনি আবারও ক্রিকেটে ফিরেছেন। কোচ হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ছেন। বাচ্চাদের ক্রিকেট শেখানোর ব্যাপারটা কিভাবে মাথায় এলো?
বিনোদ কাম্বলি: আমি যখন ক্রিকেট থেকে অবসর নিলাম, তখনই ব্যাপারটা ঘটেছিল। কিন্তু আমি কী করলাম? ধারাভাষ্য দিলাম, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কথা বলা শুরু করলাম। কিন্তু সবসময়ই আমার ভালোবাসার জায়গা ছিল ক্রিকেট। আমি মাঠের সঙ্গে থাকতে চাইতাম। শচীন টেন্ডুলকার জানেন, আমি ক্রিকেটকে কতটা ভালোবাসি। তিনিই আমাকে বললেন কোচিং শুরু করতে। সেক্ষেত্রে কোচিংয়ে আসার ব্যাপারে যে আগুনটা আমার দরকার ছিল, সেটার কাজ করে দিয়েছে শচীন। আমি বলবো, শচীনই সেই মানুষ যার কারণে আমি কোচিং শুরু করেছি।
এখন পর্যন্ত কোচিং করাতে কেমন লাগছে?
বিনোদ কাম্বলি: আমি আর শচীন টেন্ডুলকার দুজনই বিখ্যাত কোচ রামাকান্ত আচরেকারের শিষ্য। আমরা যা কিছু শিখেছি তার সবটুকুই পেয়েছি আচরেকার স্যারের কাছ থেকে। তো, আমার মনে হয়েছে এখনই সময় এসেছে, আমরা তার কাছ থেকে যা শিখেছি সেটা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে দেওয়ার। তরুণ ক্রিকেটাররা যদি এই সুযোগটা নিতে পারে, তাহলে দারুণ ব্যাপার হবে। আচরেকার স্যারের কাছ থেকে আমি যা শিখেছি সেগুলোকে আমি অনেক মূল্য দেই। বিশেষ করে সবসময় ঠিক কাজটা করা, ঠিকটা বুঝতে পাড়া; এগুলো খুব জরুরি। হোক সেটা আপনি স্কুলের জন্য কিংবা রঞ্জি ট্রফির জন্য খেলছেন। অথবা হোক আপনি দেশের জন্য খেলছেন।
তরুণদের জন্য আপনার ক্রিকেট মন্ত্র কী?
বিনোদ কাম্বলি: সবাই বলেন ‘প্র্যাকটিস মেকস আ ম্যান পারফেক্ট’। কিন্তু আমার কোচ আচরেকার স্যার প্রায়ই বলতেন, ‘পারফেক্ট প্র্যাকটিস মেকস আ ম্যান পারফেক্ট’। বিশ্বের ক্রীড়াক্ষেত্র সম্পর্কে আমি আমার ছাত্রদের বলি। ফলাফলের পুরোটা আপনার হাতে কখনোই থাকবে না। কিন্তু আপনি যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, নিশ্চিত হতে পারবেন আপনার প্রস্তুতি সঠিক হয়েছে তখন আপনি ফলাফলের আশা করতেই পারেন। আমার স্যার আমাকে প্রায়ই আরেকটা কথা বলতেন। তিনি বলতেন, একজন কোচের কাজ ৩০ শতাংশ। খেলোয়াড়ের কাজ ৭০ শতাংশ। এই দুইয়ে মিলিয়ে হবে ১০০ শতাংশ।
ভবিষ্যতে ভালো করবে এমন তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য উদাহরণ হিসেবে কাকে সামনে আনবেন? এবং কেন?
বিনোদ কাম্বলি: আমার মনে হয় তরুণদের শচীনকে অনুসরণ করা উচিত। প্রতিটি বিকাশমান ক্রিকেটারের উচিত শচীনের জীবনের গল্পটা জানা। ভারত জাতীয় দলের ক্যাপ পাওয়ার জন্য সে কতটা পরিশ্রম করেছিল, কিভাবে পরিশ্রম করেছিল, কতটা স্বপ্ন দেখেছিল, ধারণ করেছিল এগুলো সবার জানা উচিত। ক্রিকেট দুনিয়ার শীর্ষে পৌঁছাতে শচীনের দুই দশক সময় লেগেছিল। এটা কিন্তু মজার কথা নয়! তরুণ ক্রিকেটাররা শচীনের থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে, নিজেদের চলার পথে তাকে আদর্শ হিসেবে নিতে পারে।
এই মুহূর্তে আপনার চোখে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান কে?
বিনোদ কাম্বলি: অবশ্যই বিরাট কোহলি! সামনে আরও কিছু নাম চলে আসবে। যেমন ইংল্যান্ডের জো রুট, নিজিল্যান্ডের কেন উইলিয়ামস আর অস্ট্রেলিয়ার স্টিভেন স্মিথ। কিন্তু বিরাট কোহলি যেভাবে পারফর্ম করছে, প্রতিটি জায়গায় সে নিজের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। সবমিলিয়েই সে আসলে রাজত্ব করার ক্ষমতা রাখে। তার ব্যাটিং ইফোর্টলেস। চোখে দেখতেও অনেক শান্তি লাগে।
ফিচার ইমেজ- Getty Image