প্রায় পনের বছর আর্জেন্টিনা রক্ষণভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন রবার্তো আয়ালা, বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের বড় একটি অংশ কাটিয়েছেন নাপোলি ও ভ্যালেন্সিয়ার মতো নামকরা ক্লাবে। অসাধারণ পারফরম্যান্সের পুরস্কারস্বরূপ ২০০১ সালে উয়েফার সেরা ডিফেন্ডারের পুরস্কারও জিতেছিলেন তিনি। এই পুরস্কার জেতার তিন বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৯৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে বেশ ভালো ফর্ম নিয়েই খেলতে গেছিলেন তিনি। গ্রুপপর্বের প্রতিটি ম্যাচে ক্লিনশিট রাখায় বড় ভূমিকা রেখে দলকে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে উন্নীত করেন।
সেই ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা, ফকল্যান্ড যুদ্ধের কারণে এই দু’দলের মাঝে সম্পর্কের বৈরিতা বেশ পুরনো। এমন হাই-ভোল্টেজ ম্যাচেও বেশ দৃঢ়তার সাথে আর্জেন্টাইন রক্ষণভাগকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন আয়ালা। আসলে তার ফর্ম তখন এতটাই দুরন্ত ছিল যে, পৃথিবীর যেকোনো স্ট্রাইকারকে আটকে দেওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তবে ১৬ মিনিটে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল, যা আয়ালার ওই আত্মবিশ্বাসে বেশ বড় একটি ফাটল ধরিয়ে দেয়।
খেলার আয়ু তখন ১৬ মিনিট, স্কোরলাইন ছিল ১-১। এমন সময়ে সেন্টার সার্কেলে দাঁড়িয়ে থাকা আঠারো বছর বয়সী সতীর্থের দিকে বল এগিয়ে দেন ডেভিড বেকহ্যাম। ওই তরুণকে তখন কড়া পাহারায় রেখেছিলেন আর্জেন্টিনার সেরা ডিফেন্ডার আয়ালা। কিন্তু তাতে সে তরুণ থোঁড়াই কেয়ার করল! ডান পায়ে দারুণ এক টাচে মুহূর্তের মধ্যে আয়ালাকে ফাঁকি দিয়ে সামনে চলে গেলেন, পিছন থেকে তাকে থামানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন আয়ালা।
পেনাল্টি বক্সের কাছাকাছি যখন চলে যান, তখন তার ডান পাশেই আনমার্কড অবস্থায় পল স্কোলস দৌঁড়ে চলে এসেছিলেন। কিন্তু তার আত্মবিশ্বাসের পারদ তখন এতটাই উঁচুতে যে, স্কোলসকে পাস না দিয়ে সামনে থাকা আরেক আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার হোসে চ্যামটকে ড্রিবল করে নিজেই শট নিলেন। এমন অভাবনীয় গোলে পুরো বিশ্ব রীতিমত হতভম্ব হয়ে যায়। ইংল্যান্ড না জিতলেও ওই গোলের কারণে সেই তরুণ ঠিকই পুরো বিশ্বে পরিচিত হয়ে যায়।
বলছিলাম একসময়ের সাড়া জাগানো ইংলিশ ‘বিস্ময়বালক’ মাইকেল ওয়েনের কথা।
১৯৭৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া মাইকেল ওয়েন শৈশবে একজন এভারটন ফ্যান হলেও ১২ বছর বয়সে সুযোগ পান লিভারপুলের একাডেমি দলে। ‘অলরেড’দের যুব দলের হয়ে দারুণ পারফর্ম করেন তিনি, প্রথমবারের মতো দলটিকে এফএ ইয়ুথ কাপ জয়ের ক্ষেত্রে বড় অবদান ছিল তার। এর পুরস্কারস্বরূপ নিজের ১৭তম জন্মদিনে লিভারপুলের সাথে পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন।
১৯৯৬-৯৭ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগে সেলহার্স্ট পার্কে উইম্বলডনের বিপক্ষে যখন ২-০ গোলে পিছিয়ে ছিল লিভারপুল, তখন ‘অলরেড’দের কোচ রয় ইভান্স খেলার মোড় ঘোরাতে মাইকেল ওয়েনকে বদলি হিসেবে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন। প্রিমিয়ার লিগে নিজের অভিষেকটা স্মরণীয় করে রাখেন তিনি, তার গোলেই খেলায় আবারও ফিরে আসে লিভারপুল। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা ২-১ গোলে সেদিন হেরে যায়, কিন্তু অভিষেকেই গোল করার কারণে ওয়েনের ক্যারিয়ার বেশ ভালো একটি ভিত্তি পেয়ে যায়।
তখন লিভারপুলের প্রথম পছন্দের স্ট্রাইকার ছিলেন রবি ফাওলার, তার ইনজুরিতে ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে লিভারপুলের মূল একাদশে সুযোগ পান মাইকেল ওয়েন। আর সুযোগটি বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগান তিনি, ১৭ গোল করে যৌথভাবে ওই মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পাশাপাশি প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন তিনি।
মাত্র ১৮ বছর বয়সী এক তরুণের জন্য এসব অর্জন সত্যিই অভাবনীয় ছিল। আর এ কারণেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত ইংল্যান্ড দলে তাকে জায়গা করে দেন কোচ গ্লেন হোডল। সেই আসরে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ওই জাদুকরী গোলটি ছাড়াও গ্রুপপর্বে রোমানিয়ার বিপক্ষে একটি গোল করেন ওয়েন। এমন পারফরম্যান্সের জন্য আসরের সেরা তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে তাকে নির্বাচিত করা হয়।
বিশ্বকাপের পর রীতিমতো তারকা বনে যাওয়া ওয়েন পরের মৌসুমেও গোলের ধারা ধরে রাখেন। তবে ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে লিডস ইউনাইটেডের বিপক্ষে ইনজুরিতে পড়ায় ঐ মৌসুমে ‘অলরেড’দের হয়ে আর কোনো ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি। এই ইনজুরি সত্ত্বেও আবারও প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি।
প্রায় পাঁচ মাস মাঠের বাইরে কাটিয়ে প্রত্যাবর্তনের পর আবারও ইনজুরিতে পড়ায় ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমের প্রায় পুরো অংশই তাকে এক প্রকার মাঠের বাইরেই থাকতে হয়। ওয়েনকে ছাড়া লিভারপুলের পারফরম্যান্স গ্রাফও ছিল বেশ নিম্নগামী। তবে পরের মৌসুমেই আবার স্বরূপে ফিরে আসেন তিনি, সে মৌসুমে মোট ২৮ গোল করেন তিনি। আর তার এই দারুণ নৈপুণ্যে ভর করেই লিভারপুল ঐ এক মৌসুমে জিতে নেয় উয়েফা কাপ, লিগ কাপ ও এফএ কাপ – মোট তিনটি শিরোপা।
এর মধ্যে এফএ কাপ ফাইনালের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হবে, ফাইনালে লিভারপুলের প্রতিপক্ষ ছিল আর্সেনাল। দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচের প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধের ৭২ মিনিটে জুংবার্গের গোলে ১-০ গোলে এগিয়ে যায় আর্সেনাল। সেখান থেকে একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেন মাইকেল ওয়েন, ৮৩ ও ৮৮ মিনিটে তার করা জোড়া গোলে শিরোপা জিতে নেয় লিভারপুল। এমন দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সের পুরস্কারস্বরূপ ২০০১ সালের ব্যালন ডি অর জিতে নেন এই ইংলিশ স্ট্রাইকার। ১৯৭৯ সালে কেভিন কিগানের ব্যালন ডি অর জয়ের ২২ বছর পর আবারো কোনো ইংলিশ ফুটবলার জিতে নেন এই সম্মানজনক পুরস্কার।
২০০১-০২ লিভারপুলকে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জয়ের রেসে বেশ ভালোভাবেই টিকিয়ে রেখেছিলেন ওয়েন। কিন্তু আর্সেনালের সাথে আর পেরে ওঠেনি তার দল।
২০০২ বিশ্বকাপে দশ নাম্বার জার্সি পরে ইংল্যান্ডকে প্রতিনিধিত্ব করতে যান তিনি। গ্রুপপর্বে নিষ্প্রভ থাকলেও রাউন্ড অফ সিক্সটিনে সুইডেনের বিপক্ষে একটি গোল করে দলের ৩-০ গোলের জয়ে অবদান রাখেন। কোয়ার্টার ফাইনালে সেই আসরে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড। এমন বড় ম্যাচেও গোল পান ওয়েন, কিন্তু রোনালদিনহোর দু’টি জাদুকরী মুহূর্তের কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই ইংলিশদের বিদায় নিতে হয়।
এদিকে ২০০২ সালের দিকে ওয়েনকে দলে এনে নিজের গ্যালাকটিকো সাম্রাজ্যকে আরো সমৃদ্ধ করা ইচ্ছা প্রকাশ করেন রিয়াল মাদ্রিদের সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। তবে স্পেনে পাড়ি জমানোর চেয়ে চিরচেনা ইংলিশ লিগে খেলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেই ওয়েন বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালে দীর্ঘ ছয় বছর লিভারপুলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জেরার্ড হলিয়ার সরে গেলে ওয়েন তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আরেকবার ভাবার সিদ্ধান নেন। শেষ পর্যন্ত ৮ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে শৈশবের ক্লাব লিভারপুল ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন মাইকেল ওয়েন।
রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কোনোভাবেই ভুল বলা চলে না। জিদান, ফিগো, রোনালদো, বেকহ্যামের মতো তারকা খেলোয়াড়ের সাথে একই দলে খেলার ইচ্ছা থাকাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মাদ্রিদে ওয়েনের সময়টা একদমই ভালো কাটেনি। রোনালদো তো ছিলেনই, সাথে জুলিও ব্যাপটিস্তা ও রবিনহোর মতো দুই সম্ভাবনাময় তরুণ ক্লাবে যোগ দেওয়ায় তার ওপর চাপ আরো বেড়ে যায়। আর এই চাপের কারণেই হয়তো নিজের স্বাভাবিক পারফরম্যান্স ছক ধরে রাখতে ব্যর্থ হন এই ইংলিশ স্ট্রাইকার।
এসব কারণে মাত্র এক মৌসুম পরই রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে আবারও ইংলিশ লিগে ফিরে যান ওয়েন। তবে এবার আর লিভারপুলের জার্সিতে নয়, ১৬.৮ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তাকে দলে ভেড়ায় নিউক্যাসল ইউনাইটেড, যা তখনকার সময়ে ক্লাবটির রেকর্ড ট্রান্সফার ফি। কিন্তু নিউক্যাসলে আসার পর ইনজুরি যেন ওয়েনের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় পাঁচ মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান তিনি।
বিশ্বকাপের ঠিক আগে এতদিন মাঠের বাইরে থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন ইংল্যান্ড কোচ সভেন গোরান এরিকসন তাকে বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে দেন। তবে সম্পূর্ণ ফিট না হয়ে মাঠে ফেরাটা তার জন্য হিতে বিপরীত হয়ে আসে। বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে মাত্র চার মিনিটের সময়ে স্বাভাবিক একটি পাস দিতে গিয়েই হুট করে মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকেন তিনি। এসিএলের ওই ইনজুরি ওয়েনকে এক বছরের জন্য ঠেলে দেয় মাঠের বাইরে।
মূলত এই ইনজুরির পরে ওয়েনের অসীম সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার আস্তে আস্তে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে। এরপর আর কখনোই আগের মতো ফিটনেস ফিরে পাননি তিনি। যখনই ফিরে আসতে চেয়েছেন, তখনই নতুন কোনো ইনজুরি তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে চার মৌসুম পার হওয়ার পর আচমকা স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ডাক পেলেন, যোগ দিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ওয়েনের প্রতিভার প্রতি বিশ্বাস ছিল বলেই রেড ডেভিলদের বিখ্যাত সাত নাম্বার জার্সিটি তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্যার ফার্গুসন।
ওয়েন চেষ্টা করেছিলেন সেই বিশ্বাসের মান রাখতে। নিজের প্রতিভার ঝলকানিতে কিছু ম্যাচে জ্বলেও উঠেছিলেন। কিন্তু হায়, শরীর সায় না দিলে কি শুধু প্রতিভা দিয়ে কিছু করা সম্ভব? ওয়েনও পারেননি, তাই চুক্তির তিন মৌসুম পার হওয়ার পর চুক্তি নবায়নের প্রস্তাবটাও ক্লাব থেকে আসেনি। ২০১২ সালে এক মৌসুমের চুক্তিতে যোগ দেন স্টোক সিটিতে, ততদিনে শরীরের সাথে লড়ে বড্ড ক্লান্ত ওয়েন। তাই লড়াইয়ের সেই যাত্রা আর দীর্ঘায়িত করতে চাননি, সেই মৌসুম শেষেই ঘোষণা দেন আনুষ্ঠানিক বিদায়ের।
স্বপ্নীল একটা সূচনার পর মাইকেল ওয়েনের ক্যারিয়ার নিয়ে ছিল অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। কিন্তু কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, সাথে দুর্ভাগ্যজনক সব ইনজুরি – সব মিলিয়ে প্রত্যাশার কাছাকাছিও তিনি যেতে পারেননি। সত্যিকার অর্থে, ২৫ বছর বয়সেই তার ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে গেছিল। তবে আক্ষেপময় ছোট ক্যারিয়ারে অসাধারণ কিছু জাদুকরী মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য ফুটবল ইতিহাসে মাইকেল ওয়েনের নাম স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে।