ছাউনির নিচে ব্যাটগুলো পড়ে আছে অনেকদিন।
কেউ সেগুলো ধরে না, নাড়ায় না। একটু হয়তো ধুলোও জমেছে ব্যাটের গায়ে। সেদিন সকালে তিনি একবার ব্যাটগুলো একটু নেড়ে দেখলেন, পরিষ্কার করলেন; যদি ফটোশুটে দরকার হয়।
কিন্তু এই নাড়াচড়া করতে গিয়েও তার একবার মনে হলো না, এগুলো নিয়ে আবার মাঠে নামা দরকার। এই মাঠে নামার আগ্রহটাই যেন কোথায় চলে গেছে। ক্রিকেট আর তাকে টানে না। যে জীবন কাটাচ্ছেন, তাতে তিনি দারুণ খুশি। এই জীবনে কোথাও চাপ নেই, এই জীবনে কোথাও দ্রুত ছোটার তাড়া নেই। এই জীবনে তিনি মিস্টার ‘থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি’ নন, এই জীবনে তিনি বিশ্বজয়ী ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্স নন।
তিনি এখন কেবলই এবি কিংবা কেবলই ‘বাবা’।
হ্যাঁ, এভাবেই এখন দিন কাটছে কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্সের।
৩৪ বছর বয়সে, পুরোদস্তুর ফর্মে থাকা অবস্থায় মে মাসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছেন। তারপর থেকে একেবারেই পারিবারিক একজন মানুষ হিসেবে দিন কাটাচ্ছেন। স্ত্রী ড্যানিয়েলেকে নিয়ে ইউরোপে একটা লম্বা সফর করে এসেছেন। বাগান করছেন ইদানিং। সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন বাচ্চাদের। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেট বলতে কেবলমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ‘এসএ২০’-এর প্রোমোশনের কাজ করছেন মাঝে মাঝে। এ ছাড়া ক্রিকেটের সাথে আপাতত আর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
ডি ভিলিয়ার্স বলছিলেন, এই জীবন তার কাছে যেকোনো চ্যাম্পিয়নের জীবনের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে। তিনি চিরকাল একরকম স্পটলাইটের বাইরে থাকতে চেয়েছেন। অবশেষে সেটা পাচ্ছেন,
“আমি সবসময় স্পটলাইটের বাইরে থাকতে পছন্দ করি। সবসময় আমি মানুষ হিসেবে এরকমই। যখন প্রোটিয়া দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হলাম, তখন একটু ব্যাপারটা বদলে গেলো। নইলে আমি খেলার বাইরে সবসময় এরকম নিজের জগতে থাকতে পছন্দ করি। এই জীবনই আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি।”
স্কুলে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার সময় এখনও কী লোকেরা চিনে ফেলে?
ডি ভিলিয়ার্স একটু লাজুক হাসেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হ্যাঁ।”
এরপরই ডি ভিলিয়ার্স তার অবস্থানটা একটু বুঝিয়ে বলেন। এই যে লোকেদের চিনে ফেলা, তাকে নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করা; এতে তিনি বিরক্ত হন না। ক্রিকেট তাকে এই যে ভালোবাসাটা দিয়েছে, এটাকে জীবনের সম্পদ মনে করেন। কিন্তু যেহেতু একটু অন্তর্মুখী মানুষ, তাই ব্যাপারটাতে একটু বিব্রত হন।
নিজেই বলছিলেন, উপভোগ করা আর বিব্রত হওয়াটা কেমন পাশাপাশি আসে,
“আমি সবসময় একটু লাজুক। আমি সত্যিই লোকেদের মনোযোগ কাড়তে চাই না বেশি একটা। এটা খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার। আমি একইসাথে এটা উপভোগ করি আবার বিব্রতও হই।”
শচীন টেন্ডুলকারের মতো অবস্থা।
এই একই ধরনের অবস্থা ছিলো ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তী শচীনের। তিনিও ব্যক্তি জীবনে খুব অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাকেও কোটি কোটি মানুষের নায়ক হতে হয়েছে।
এই একইসাথে বিব্রত হওয়া এবং উপভোগ করা দিয়েই আপনি বুঝতে পারবেন, কেন ডি ভিলিয়ার্স এত আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন। আবার কেনই বা তিনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে থেকে গিয়েছিলেন।
ডি ভিলিয়ার্স ক্রিকেটটা এখনও আগের মতোই মিস করেন। কিন্তু ক্রিকেটের যে চাপ, বাড়ির বাইরে থাকার যে যন্ত্রণা, সেটা আসলেই আর নিতে পারছিলেন না তিনি। নিজেই বলছিলেন, এই যন্ত্রণা থেকে অবশেষে একটা মুক্তি মিলেছে তার,
“বিরাট মুক্তি। অবশ্যই। এটা সত্যি কথা যে, আমি সবসময় ক্রিকেটটা মিস করবো। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যেসব খেলোয়াড় বলে যে, তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপ টের পায় না বা বাড়ি থেকে মাসের পর মাস দূরে থেকে কষ্ট হয় না, তারা মিথ্যে বলে। তারা নিজেদের সাথে এবং সবার সাথে মিথ্যে বলে।”
তিনি আরো বলেছিলেন,
“আমার জন্য ওটা অসহ্য একটা সময় হয়ে গিয়েছিলো। যে চাপ প্রতিদিন নিতে হয়, প্রতিদিন পারফর্ম করার যে চাপ; এটা অসহ্য। নিজের ওপরে নিজের তৈরি করা প্রত্যাশা আছে, ভক্তদের, দেশের, কোচের; সবার প্রত্যাশা আছে। এটা বিশাল একটা ব্যাপার। একজন ক্রিকেটার হিসেবে এটা সবসময় আপনার মনের মধ্যে ঘুরতে থাকবে। আর এই যে চাপ, প্রত্যাশা, এগুলো আমি অবশ্যই মিস করবো না। আমি এর থেকে সরে আসতে পেরে খুব খুশি। এ নিয়ে আমার এক বিন্দু আফসোস নেই।”
ডি ভিলিয়ার্সের জন্য চাপটা অবশ্য আসলেই অন্য যে কারো চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছিলো। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেকের পর থেকে আস্তে আস্তে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের ‘সবকিছু’ হয়ে উঠছিলেন তিনি। তিনি দলের উইকেটরক্ষক, সেরা ফিল্ডার, সেরা ডিফেন্সিভ ব্যাটসম্যান, সেরা আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান, সবচেয়ে চোখে পড়া তারকা, দলের সবচেয়ে উদ্ভাবনী তারকা এবং সবশেষ দলটির ক্যাপ্টেন; মাঝে মাঝে বোলারও বটে। এত এত ভূমিকায় কাজ করতে গিয়ে অন্য যে কারো চেয়ে একটু বেশি অসহনীয় মনে হওয়ার কথা খেলাটাকে।
এর সাথে তার কাঁধে যুক্ত হলো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অসম্ভব প্রত্যাশা, দক্ষিণ আফ্রিকার জটিল রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার এবং দক্ষিণ আফ্রিকার আজও অবধি অধরা সেই বিশ্বকাপ ট্রফি জেতার আকাঙ্ক্ষা।
ডি ভিলিয়ার্স বলছেন, তিনি চেষ্টা করেছেন, যতদিন সম্ভব চাপটাকে নিজের করে নেওয়ার। তিনি এর সাথে লড়াই করেছেন। কিন্তু আর পেরে উঠছিলেন না,
“আমি এই চাপকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলাম। এর সাথে লড়াই করতেই এসেছিলাম। আমি খুশি যে, আমি সেটা করতে পেরেছি। কিন্তু একটা সময় পর থেকে তো এটা জীবনকে শুষে নিতে থাকে। আমি মনে করি, খেলোয়াড়দের এ নিয়ে সততার সাথে কথা বলার একটা জায়গা থাকা উচিত। এমন একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে খেলোয়াড়রা সতেজ থাকতে পারে এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে। আমি বলছি না যে, আমি ঐ সময় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছিলাম যে, এই চাপ আমাকে তলিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এটা আমাকে একদম ক্লান্ত করে দিতে পারে।”
ডি ভিলিয়ার্স যে চাপটা ভালোই হজম করে একটা সময় অবধি চলতে পেরেছেন, তার প্রমাণ তার ক্যারিয়ার। আপনাকে দেখতে হবে, এ মানুষটি প্রায় ২০ হাজার রান করেছেন। টেস্ট গড় ৫১, ওয়ানডে গড় ৫৪। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে স্ট্রাইক রেট প্রায় ১৫০। দ্রুততম ওয়ানডে সেঞ্চুরি আছে। যে পরিমাণ ম্যাচ তিনি জিতিয়েছেন, যে পরিমাণ খেলা তিনি বাঁচিয়েছেন সেটা বিস্ময়কর। বহু ম্যাচে বাকি ২১ জন ক্রিকেটারকে ছাপিয়ে একাই হয়ে উঠেছেন একমাত্র নায়ক।
তবে এসবকে এখন পেছনে ফেলে এই অবসর জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চান এই ক’দিন আগেরও দুনিয়া কাঁপানো ব্যাটসম্যান। এখন তিনি নিজের বাগান, স্ত্রী আর সন্তান নিয়েই থাকতে চান। বাচ্চাদের স্কুলে নেওয়া আনা আর বাগানের যত্ন নেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নয়। ইদানিং তো ক্রিকেট খেলাটাও ছেড়ে দিয়েছেন। ডান চোখে অস্ত্রোপচারের পর ব্যাট-গ্লাভস তুলে রেখেছেন। সেই ২০২১ সালে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে খেলেছেন, এরপর আর পেশাদার ক্রিকেটে দেখা মেলেনি তার। ব্যাটটায় আরও একটু ধুলো জমেছে।
গত অক্টোবরে জানিয়েছিলেন, ২০২৩ আইপিএলে হয়তো ফিরতেও পারেন। তবে খেলোয়াড় হিসেবে নয়, কোচ হিসেবেও হয়তো নয়। কে জানে, হয়তো দর্শক হিসেবেই! যেই খেলাটায় ব্যাটার হিসেবে ছড়ি ঘুরিয়েছেন ইচ্ছেমতো, হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তীতুল্য, স্বয়ং বিরাট কোহলি যেখানে বিনা বাক্যে তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছেন, সেই খেলাটা মাঠের বাইরে থেকেই হয়তো উপভোগ করবেন।
কিছুটা কি আক্ষেপও জমাট বাধবে কোথাও একটা? কোনো এক ভক্ত হয়তো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলবে, এই ব্যাট একদিন থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ঘুরে শট করতো। আর সেই ব্যাটসম্যান একটু লাজুক হাসবেন।
এভাবেই চলবে।