খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, তখন বিশ্বকাপে অংশগ্রহণই বড় কথা মনে করত বাংলাদেশ। সময় অনেক গড়িয়েছে এরপর; বাংলাদেশ ক্রিকেটে এসেছে পরিপক্কতা, এসেছে সাফল্য, সেই সাফল্য জুগিয়েছে এগিয়ে চলার রসদ, তৈরি হয়েছে বুক চিতিয়ে লড়ার সাহস। যদিও এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টাইগারদের চাওয়ার জায়গাটাও অনুমিত। খোলামেলা বললে, ঠিকভাবে বাছাইপর্ব পেরোনো। বাকি চিন্তাটা পরে।
তবে আসন্ন বৈশ্বিক আসরে বাংলাদেশের সম্ভাবনার জায়গা কতটুকু? শঙ্কাই বা থাকতে পারে কেমন? এমন শত প্রশ্নের উত্তর মিলবে মাঠের ক্রিকেটে। তবে মাঠের বাইরে বাংলাদেশের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আপনার কি মনে হয়, কতদূর যাবে বাংলাদেশ?
সম্প্রতি বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে এমন একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন,
‘ইনশাআল্লাহ, ভালো কিছু হবে।’
আমাদেরও অপেক্ষা করতে হবে, কতটুকু হয়। তবে কীবোর্ডের বাটনগুলো খুটখুট করে একটা সম্ভাবনা দাঁড় করানো যেতেই পারে। ইতিহাস গড়বে নাকি পুনরাবৃত্তি করবে মাহমুদউল্লাহ বাহিনী? সেটারই একটা ধারণা সাধারণ দর্শক হিসেবে আমরা পাওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
আত্মবিশ্বাস কতটুকু?
গত দুই মাসে বাংলাদেশ যে কয়টি ম্যাচ খেলেছে, তার সবক’টির শেষে দু’টি বিষয় আলোচনায় এসেছে বেশি — একটি আত্মবিশ্বাস, অন্যটি উইকেট নিয়ে মন্তব্য। মিরপুরে অস্ট্রেলিয়া বা নিউ জিল্যান্ড দল যখন বাজে ফর্ম করত, তখন এক দল পিচ নিয়ে প্রশ্ন তুলত। অন্য দল টাইগারদের পক্ষে বলত, ‘আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।’ আদতে, বেড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস কতটা কাজে দিবে বাংলাদেশকে? বিশ্বকাপে এর প্রভাব কতটা পড়তে পারে?
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ-জয়ের পর সাকিবের কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়েছিল। সাকিবও দিয়েছিলেন আশ্বাস, জানিয়েছিলেন এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশর সম্ভাবনা। কারণও দেখিয়েছিলেন তিনি। সাকিবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ।
‘আমার কাছে মনে হয়, এবারের বিশ্বকাপে আমাদের ভালো সুযোগ আছে। আমাদের প্রস্তুতি খুবই ভালো হয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে, গত তিনটা সিরিজ আমরা জিততে পেরেছি। হয়তো উইকেট এবং লো-স্কোরিং ম্যাচ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু জয়ের কোনো বিকল্প নেই। একটা দল যখন জিততে থাকে, জয়ের মানসিকতা থাকে, তা অন্য পর্যায়ের আত্মবিশ্বাস দেয়। আপনি অনেক ভালো খেলে ম্যাচ হারলে এই আত্মবিশ্বাস থাকবে না। এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা বিশ্বকাপে যেতে চাই।’
সাকিবদের মতোই একদল বলছেন, টানা তিনটা সিরিজ জয় খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে দৃঢ় করেছে। জয়ের ধারায় এ প্রভাবটা বৈশ্বিক আসরেও দারুণভাবে কাজে আসবে। অন্যদলের শঙ্কা, বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাঠে নিজের সুবিধামতো বানানো টার্নিং ও মন্থর পিচের পাওয়া জয়গুলো কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেটা। তাদের মতে, ওমান ও আমিরাতের মরুর শহরে শুষ্ক আবহাওয়ায় উইকেট থাকবে ব্যাটিংবান্ধব। আর তখন বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং-বোলিংয়ে গভীরতা পড়বে প্রশ্নের মুখে। প্রস্তুতি ম্যাচগুলো দ্বিতীয় দলের শঙ্কায় ভালোই হাওয়া দিচ্ছে। আয়ারল্যান্ড-শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই থরহরিকম্প অবস্থা, মূল পর্বে কী হবে, সেটা নিয়ে শঙ্কার বিশেষ কমতি নেই বৈকি।
যদিও সাকিবের বিশ্বাস এবারের আসরে বাংলাদেশ ভালো করবে। তার অনুপ্রেরণা ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেবার আসরটিতে অংশ নেওয়ার আগে জিম্বাবুয়ে, কানাডা, স্কটল্যান্ড ও কেনিয়ার বিপক্ষে টানা জয়ের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। সেই ধারায় গ্রুপপর্বে ভারতকে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিল টাইগাররা। সেরা আটে হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকেও। এবারও জিম্বাবুয়ে, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে দারুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওমান-আমিরাতে বাংলাদেশ দল। হিসেবের দাঁড়িপাল্লায় মাপ দিলে এবার টাইগারদের আত্মবিশ্বাস সেবারের থেকে বেশিই থাকার কথা। আর সেটা পুঁজি করে ২০০৭ সালের মতো সাফল্যময় একটি বিশ্বকাপ গড়তেই পারেন মাহমুদউল্লাহ বাহিনী!
ইতিহাস কি বলে?
আইসিসি কর্তৃক আয়োজিত ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ টি-টোয়েন্টির ছয়টি পর্বের সবক’টিতেই খেলেছে বাংলাদেশ। সেখানে অন্যতম সাফল্য বলতে ২০০৭ সালের কথাই বলা যায়। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে শুরুর বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আসরটি শেষ করেছিল সেরা আটে। তবে পরের আসরগুলোতে টাইগারদের সঙ্গী হয়েছে শুধুই হতাশা। সবক’টি আসরের শুরুতে বাংলাদেশকে কোয়ালিফাই করে যেতে হয়েছে পরের পর্বে। আসন্ন সপ্তম আসরেও ভিন্ন হয়নি লাল-সবুজের ভাগ্য। এবারও বিশ্বকাপের মূল পর্বে যেতে মাহমুদউল্লাহ-সাকিবদের পেরোতে হচ্ছে স্কটল্যান্ড, ওমান ও পাপুয়া নিউগিনির প্রথম রাউন্ডের বাধা।
আর পুরো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে টাইগাররা দেখিয়েছেন হতশ্রী পারফরম্যান্স। এখন পর্যন্ত ২৫টি বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ দল, জিতেছে কেবল পাঁচটি। তার আবার চারটিই বাছাইপর্বে। বড় দলগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ লজ্জার হার ছিল হংকং, আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তানের মতো প্রতিপক্ষের কাছে। মূল আসরে লাল-সবুজদের একমাত্র জয় ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
যদিও সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স একদমই ভালো নয়। ১১২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের কাছে হেরেছে ৬৯টি ম্যাচেই। বিপরীতে জয় ছিল ৪১টি ম্যাচে। তবে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ও দলের কম্বিনেশনের বিচারে বলা যায়, এবার হয়তো আগেরবারের সংস্করণগুলোর মতো নেহায়েত শূন্য হাতে না-ও ফিরতে পারে বাংলাদেশ দল।
যাদের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ
ইতিহাস ও পরিসংখ্যানের হিসেবে যে টি-টোয়েন্টি চলে না, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। ক্রিকেটের এই সংস্করণে ফেভারিট বলতেও তেমন কিছু একটা থাকে না সাধারণত। নিজেদের দিনে যেকোনো দল র্যাংকিংয়ের ভারী কোনো দলের বিপক্ষেও জয় ছিনিয়ে আনতে পারে। অনেকের মতে, টি-টোয়েন্টি মূলত ২-৩ ওভারের খেলা। যারা ভালো করবে তারাই জিতবে।
তবুও মাঠের লড়াইয়ে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। যোগ্যতার দিক থেকে ভারী দলটাই সম্ভাবনার পারদে এগিয়ে থাকে। অবশ্য মাঠের লড়াইয়ে চাপ সামলাতে পারা দলটাই হাসে শেষ হাসিটা। আর সেক্ষেত্রে যেকোনো দলকে নিশ্চয়ই এগিয়ে রাখবে অভিজ্ঞতা।
অভিজ্ঞতার পাল্লায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিতে যাওয়া ১৬ দলের থেকে একটু ওপরের দিকেই রাখা যায় বাংলাদেশকে। এখন পর্যন্ত আয়োজিত সবক’টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই খেলেছেন মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম। অন্য সব দলে এমন রেকর্ডধারী প্লেয়ার খুব বেশি নেই। অভিজ্ঞ এই ত্রয়ীর দিকেই মূলত তাকিয়ে থাকবে পুরো বাংলাদেশ। এদের বাইরে বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি প্রত্যাশার জায়গায় থাকবেন মোস্তাফিজুর রহমান। আইপিএল মাতানো ‘দ্য কাটার মাস্টার’-খ্যাত মোস্তাফিজের বোলিংয়ে ধারটার ধারাবাহিকতাই দেখতে চাইবে লাল-সবুজের সমর্থকরা।
টি-টোয়েন্টিতে যদিও ওয়ানডে ক্রিকেটের মতো বাংলাদেশের সফলতার গল্প নেই, তবুও বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীরা আশায় বুক বাঁধতে পারেন, ভালো কিছুর প্রত্যাশা করতেও দোষ নেই। কেননা, যে দলে সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর অলরাউন্ডার থাকেন, সে দলের বিপক্ষে লড়তে একটু হলেও ভাবতে হবে প্রতিপক্ষকে। নৈপুণ্যের বিচারে কিংবা অভিজ্ঞতার ধারেভারে সাকিবের সীমাবদ্ধতা নেই বললেই চলে। সাকিব ক্রিকেটটা শুধু ভালো খেলেনই না, ভালো বোঝেনও। ক্রিকেটীয় স্মার্টনেস ও মাঠের ছায়া অধিনায়কের ভূমিকায় সাকিবের ষোল আনাই চাইবে বাংলাদেশ।
সাকিবের মতো বাংলাদেশকে ভালো কিছু স্মৃতি এনে দেওয়ার দায়িত্বও নিয়ে রেখেছেন মাহমুদউল্লাহ। এক সময় বাংলাদেশকে অধিনায়কত্ব করার স্বপ্ন দেখা মাহমুদউল্লাহর কাঁধে চড়েই আজ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ, দেখছে স্বপ্নও।
মাহমুদউল্লাহর কাছে অধিনায়কত্বের পাশাপাশি দলের ব্যাটিংটাকে আরো ভালো কিছু এনে দেওয়ার প্রত্যাশা তো থাকবেই। দুই ভূমিকার সাথে সাথে বল হাতেও কার্যকরী ভূমিকা রাখবেন, এমন বিশ্বাস রাখতেই পারেন সমর্থকরা। মাঠের-ভেতরে বাইরে অনুপ্রেরণাদায়ী, টেকনিক্যালি, শান্ত ও সিদ্ধান্তগ্রহণে সিদ্ধহস্ত এক মাহমুদউল্লাহকেই দেখতে চাইবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশকে আরো বড় করে স্বপ্ন দেখাতে বাকি যে দু’জনের নাম আসতে পারে, তারা হলেন অভিজ্ঞ ব্যাটার মুশফিকুর রহিম ও পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই মুশফিক, সাম্প্রতিক ফর্মটাও তার হয়ে কথা বলছে না। বিশ্বকাপে ২৫ ম্যাচে ব্যাট করে মুশফিকের ব্যাট থেকে এসেছে ১০.৩২ গড়ে সাকুল্যে ২৫৮ রান। অবশ্য ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ হিসেবে খ্যাতি কুড়ানো মুশফিক নিজেকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়েই আছেন। মানসিক বাধাটা পার করতে পারলে আসন্ন বিশ্বকাপে তার অভিজ্ঞতা, ডেডিকেশন, মনঃসংযোগ, এবং আরো ভালো করতে চাওয়ার তাড়না বাংলাদেশকে দারুণ কিছু দেবে বলেই প্রত্যাশা সকলের। আর মোস্তাফিজের বোলিংয়ের ব্যাপারে যেকোনো অধিনায়ক তো বটেই, বিরোধী দলের পাড় ভক্তরাও মানবেন, ‘সে ভয়ানক’। সাম্প্রতিক কয়েকটা ম্যাচ ঠিক ভালো যায়নি তার, তবে তাকে ঘিরে যেকোনো প্রতিপক্ষেরই লম্বা কোনো প্ল্যান নিয়েই নামতে হবে বৈকি।
মাহমুদউল্লাহ-সাকিবদের ওপর ভর করে স্বপ্ন দেখাটা অযৌক্তিক নয়। কারণ বিশ্বকাপের জন্য এবার বাংলাদেশ দলে যাদের রাখা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের জায়গা থেকে সেরা। টাইগার অধিনায়কের ভাষায়,
‘আমাদের বিশ্বকাপ দলটা সবদিক থেকেই ভারসাম্যপূর্ণ। ব্যাটিং-বোলিং সব দিক থেকেই ভারসাম্যপূর্ণ একটা দল। চেষ্টা করব যেন দলের মাঝে এই ভারসাম্যটা ধরে রাখতে পারি এবং সবাই পারফর্ম করতে পারি।’
শঙ্কা এবং ঘাটতি
অভিজ্ঞতা-আত্মবিশ্বাস ছাপিয়ে পরিসংখ্যানে আতশকাঁচের নিচে আসবে মাঠের ক্রিকেটে পারফরম্যান্স। সেক্ষেত্রে টাইগার ক্রিকেটের একটি বিষয় অবশ্যই আপনার দৃষ্টিগোচর হতে বাধ্য, সিঙ্গেল-ডাবল নিতে অপরাগতা বা অনীহা। আপনি যদি সবশেষ সিরিজ গুলোর দিকে তাকান, তাহলেও দেখবেন ওপেনার থেকে মিডল কিংবা লোয়ার মিডল অর্ডার — পুরো সিরিজ জুড়ে বলার মতো রানিং বিটুইন দ্য উইকেট তো ছিলই না, মারমার—কাটকাট এই সংস্করণেও ছিল ডট বলের আধিপত্য। বাংলাদেশের হয়ে পুরো অস্ট্রেলিয়া সিরিজে সবেধন নীলমণি একটি ফিফটি করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ, তাও ধীরগতির। বড় শট দূরে থাকুক, বাজে শটের মহড়া দিচ্ছিলেন ব্যাটাররা। ঘরের মাঠের সুবিধা নিয়ে বোলিংয়ে দারুণ করা দল ব্যাটিংয়ে ছিল পুরোপুরিই হতশ্রী।
অনেকে বলতে পারেন, মিরপুরের পিচে ব্যাটিং পারফর্ম বিবেচনায় না ধরাই ভালো। তাহলে তো প্রশ্ন উঠবে সেখানকার বোলিং পারফরম্যান্স নিয়েও। যে বোলিং আশা দেখাচ্ছে, সেটার সাম্প্রতিক ভালো ফর্মটাও যে এই মিরপুরের স্লো পিচেই! আর ওমানের মাঠে আজতক খেলা প্রস্তুতি ম্যাচগুলোও তো বোলিং নিয়ে শঙ্কার দিকটাই দেখাচ্ছে।
আসলে, টি-টোয়েন্টি পিচ মানেই ব্যাটসম্যানদের স্বর্গ। সেটা না হোক, অন্ততপক্ষে স্পোর্টিং উইকেট তো হবেই — যেখানে বোলার ও ব্যাটসম্যান সমান সুবিধা পাবেন। ব্যাটে বল আসবে, স্ট্রোকও খেলতে পারবেন ব্যাটাররা, চার-ছক্কার ফুলঝুরিও ছুটবে। কেউ কেউ স্কোর গড়বেন ২০০+ স্ট্রাইকরেটে, দলীয় স্কোরও হবে বেশ বড় এবং লড়াকু। অন্যদিকে বোলাররা নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ঘায়েল করবেন, অপেক্ষা করবেন ব্যাটসম্যানের ভুলের। ওত পেতে থাকবেন ফিল্ডাররা, হাফ-চান্সকেও চান্স বানিয়ে মাতবেন উদযাপনে। বলতে তিক্ত লাগলেও এটাই সত্যি, প্রতিটি জায়গাতেই আছে চরম ঘাটতি। এটা একটা বড় শঙ্কার জায়গা।
বিশ্বকাপে ভালো কিছু করতে হলে অবশ্যই ব্যাটিংয়ে পুরো দলকে ভালো করতে হবে। অন্য প্রায় সব দলের মতো বাংলাদেশ দলে তেমন একটা বিগ হিটার নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে টাইগারদের অন্যতম সমস্যার জায়গা হতে পারে টোটাল স্কোর। মিরপুরের ধীর ও নিচু উইকেটের চেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের বিশ্বকাপের উইকেটগুলো অনেকটাই আলাদা থাকবে। আইসিসির বৈশ্বিক ইভেন্টগুলোতে প্রায় সবসময়ই ব্যাটিং-বান্ধব উইকেট তৈরি করা হয়। সেখানে নিয়মিতই ইনিংসপ্রতি রানও হয় ১৮০ থেকে ২২০, কিংবা তার চেয়েও বেশি। সেক্ষেত্রে কম রানের পুঁজিতে লড়াই করা বাংলাদেশ বোলারদের অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে।
মূলত টাইগার দলে ওপেনিংয়েই শঙ্কা বেশি। তামিম ইকবাল জুনিয়রদের ‘ফেয়ার’ করতে দল থেকে নাম প্রত্যাহারের পর আরো বেশি সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে টাইগারদের ওপেনিং। তামিমের বদলি হিসেবে দলে সুযোগ পাওয়া নাঈম স্টাইক রোটেট করতে খুব একটা পারদর্শী নন। জিম্বাবুয়ে সফরটা রানের হিসেবে দারুণ কাটলেও অস্ট্রেলিয়া সিরিজটা বুঝিয়ে দিয়েছে, সৌম্য সরকারও ঠিক ছন্দে নেই। পাওয়ারপ্লের সুযোগটা কাজে লাগাতে দক্ষতার অভাবও রয়েছে ওপেনারদের। দ্রুত উইকেট হারানোও সমস্যার কারণ হতে পারে দলে। মিডল অর্ডারে ব্যাটিংয়ে ভালো করার ক্ষেত্রে আশাজাগানিয়া আফিফ হোসেন ধ্রুব, তবে তিনিও ঠিক ধারাবাহিক নন। মুশফিকুর রহিমও নেই ছন্দে। শেষের দিকে দ্রুত রান তোলার জন্যও ধারাবাহিক কোনো নাম নেই, সোহান কিছুটা ভরসা দিচ্ছেন অবশ্য।
ফিল্ডিংয়ে সুযোগ মিস করার ক্ষেত্রেও মিতব্যায়ী হতে হবে টাইগারদের। ছোট ফরম্যাটের কোনো একটি সুযোগ কাজে লাগিয়ে একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারেন বিপরীত দলের কোনো খেলোয়াড়। সব থেকে বেশি চ্যালেঞ্জের হবে বড় মঞ্চে তরুণদের বোলিং। অবশ্য মনোযোগ ঠিক রেখে ঠিকঠাক বল করতে পারলে দারুণ কিছু সম্ভাবনা এনে দিতে পারবেন শরিফুল-নাসুম আহমেদরা, এমন প্রত্যাশা করতেই হবে।
ক্রিকেটে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ বলতে যে কথাটা আছে, সেটা এবারের বাংলাদেশ স্কোয়াডের সঙ্গে খুব একটা যায় না। টাইগারদের কেউ নির্দিষ্ট একজন নয়, পুরো দলটাকেই ম্যাচজয়ের জন্য ভালো খেলতে হবে। শক্তিমত্তার বিচারে বড় হোক বা ছোট দল, বাংলাদেশকে জিততে হলে ব্যাটিং-বোলিংয়ে সম্মিলিত পারফরম্যান্সের বাইরে আর উপায় নেই।
শক্তি ও সম্ভাবনা
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের শক্তির জায়গা বলতে যেটা সবার আগে আসবে, তা হলো দলীয় কম্বিনেশন। বর্তমান সময়ে মাহমুদউল্লাহর নেতৃত্বে দারুণ উজ্জীবিত দল। সবার লক্ষ্য ও চাওয়ার জায়গা একটিই, জিততে হবে। সিনিয়র-জুনিয়রদের রসায়নটাও দারুণ। বিশ্বকাপের মূল পর্বের ভেন্যুতে সাকিব-মোস্তাফিজদের আইপিএলে দারুণ পারফর্মও আশা জাগায় দলের।
ব্যাটিংয়ে বিশ্বকাপে ‘এক্স ফ্যাক্টর’ ঠিক তেমন কেউ না থাকলেও দারুণ কিছু করে দেখাতে পারেন লিটন কুমার দাস। মিডল ও শেষের দিকে দ্রুতগতির রান তোলার দায়িত্বটা বুঝে নিতে পারেন নুরুল হাসান সোহান ও আফিফ হোসেন ধ্রুব। সুযোগ পেলে শেষের দিকে বল ও ব্যাট হাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা রয়েছে সাইফউদ্দিন ও মেহেদি হাসানেরও। মোস্তাফিজকে দারুণ সঙ্গত দিতে পারেন তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম। সব থেকে বড় শক্তি ও সম্ভাবনা খুব সম্ভবত দলের তরুণ খেলোয়াড়েরা, যারা শতভাগ উজাড় করে দিতে প্রস্তুত রয়েছে। আর সাথে পেসার মোস্তাফিজুর রহমান, অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা যেকোনো মুহূর্তে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারেন, সেটা তো বলাই বাহুল্য।
চাওয়ার জায়গা কতটুকু?
শক্তি ও সামর্থ্যের বিচারকে বাইরে রেখে বাংলাদেশ তাদের আত্মবিশ্বাস ম্যাচে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলেই সাফল্য আসার সুযোগ বেশি। প্রথম ধাপে বাছাইপর্ব পার করাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই বাধা পার করে গেলে লাল-সবুজ জার্সিধারীদের সেমিফাইনাল খেলতে দেখলেও অবাক হবার কিছু নেই।
চাওয়াটার সর্বনিম্ন আর সর্বোচ্চ নিয়ে খাতা-কলমে হিসেব কষে বললে প্রথমে তাই অপেক্ষা করতে হবে গ্রুপপর্বে স্কটল্যান্ড, ওমান ও পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত। গ্রুপসেরা হতে পারলে আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, এবং নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াইয়ে নির্ধারিত হবে টাইগারদের এবারের ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে দৌড়।
বাংলাদেশ দলের প্রাণ-তুল্য সাকিব আল হাসানের মতে,
‘এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আর ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে আমাদের ভালো করার সম্ভাবনা বেশি। এমন না যে ২০২২-এরটায় নেই। ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়াতে খেলা হওয়ায় আমাদের জন্য একটু কঠিন হওয়া স্বাভাবিক। সে তুলনায় ইউএই (সংযুক্ত আরব আমিরাত) ও ভারত আমাদের পরিচিত জায়গা। সুতরাং আমাদের জন্য ভালো করার সুযোগ এই দুই বিশ্বকাপে বেশি, সুযোগ একটু বেশি থাকবে।’
বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দল
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (অধিনায়ক), লিটন দাস, নাঈম শেখ, সৌম্য সরকার, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, আফিফ হোসেন, নুরুল হাসান সোহান, শেখ মেহেদী হাসান, শামীম হোসেন পাটোয়ারী, নাসুম আহমেদ, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ ও রুবেল হোসেন (স্ট্যান্ডবাই)।