বর্তমান সময়ের সেরা তিন সেন্টারব্যাকের তালিকা করলে সেখানে কলিদু কৌলিবালির নাম চলে আসবে। তবে তার এই উত্থানের পথটা মোটেও সহজ ছিল না। ইউরোপে একজন অভিবাসীকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেগুলোর সম্মুখীন তাকেও হতে হয়েছে। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ গোষ্ঠীর হওয়ায় তাকে অনেকবার বর্ণাবাদী আচরণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে তিনি আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছেন, সেসব কঠিন লড়াইয়ের কথাই দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে বলেছেন কৌলিবালি।
আমার মনে হয় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরাই এই পৃথিবীকে ভালো বুঝতে পারে, বিশেষ করে অন্য মানুষের সাথে কীরুপ আচরণ করতে হবে সেই ব্যাপারে শিশুদের কার্যক্রম অনেক বেশি পরিণত।
বিভিন্ন বর্ণবাদী আচরণে আমার ঠিক কেমন অনুভূতি হয় সেই ব্যাপারে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, তবে এই ব্যাপারে কিছু বলাটা আসলেই কঠিন কাজ। সত্যি বলতে কী, আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে এই বর্ণবাদী আচরণের শিকার না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত এর ভয়াবহতা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারবেন না। কিন্তু শিশুদের কাছে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে যাতে একটি শক্ত বার্তা পৌঁছে যায় তাই আমি পুরো ব্যাপারটা ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।
কয়েক মৌসুম আগে ল্যাজিওর মাঠে খেলতে গিয়েই আমি বর্ণবাদী আচরণের শিকার হই। সেই ম্যাচে আমি যখনই বল পাচ্ছিলাম তখুন গ্যালারি থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম হয়তো পুরো দলকে দুয়ো দিতে এমন শব্দ করা হচ্ছে, কিন্তু পরে আমি বুঝতে পারলাম বানরের ডাককে অনুকরণ করে এই অদ্ভুত সব শব্দ শুধুমাত্র আমার জন্যই করা হচ্ছে! তখন এতটাই বিষণ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে মনে হচ্ছিলো এখনই খেলা ছেড়ে মাঠ থেকে বের হয়ে যাই। কিন্তু তখনই মনে হলো আমি যদি এই কাজ করি তবে উপরন্তু তাদের উদ্দেশ্যই সফল হবে।
আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম ঠিক কী কারণে তারা আমার সাথে এমন আচরণ করছে? শুধুমাত্র আমার গায়ের রঙ কালো বলেই এমন আচরণ? কালো হয়ে জন্মানোটা কি স্বাভাবিক কিছু না? যে খেলাটাকে আপনি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন সেটি খেলতে গিয়ে যখন এমন কিছুর সম্মুখীন হবেন তখন আপনি নিজেকে নিয়েই নিজে লজ্জিত হবেন।
এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর সেদিনের রেফারি জনাব ইরাত্তি আমার কাছে এসে বললেন, “কলিদু, আমি তোমার সাথে আছি। তুমি যদি চাও তবে এখনই আমি খেলা বন্ধ ঘোষণা করবো।” কিন্তু আমি তাকে ম্যাচটি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেই সম্মতি জানালাম। তিন মিনিট পর খেলা আবার শুরু হলো, কিন্তু বর্ণবাদী চিৎকার চলতেই লাগলো।
ম্যাচ শেষে যখন টানেলে হাঁটছিলাম তখন পুরো ঘটনার কথা মনে করে অসম্ভব রাগ হছিলো। কিন্তু ঠিক তখনই ছোট্ট একটা ঘটনা আমার এই দুঃখে প্রলেপ লাগিয়ে গেলো। ম্যাচ শুরুর আগে মাস্কট হিসেবে একটা ছোট বাচ্চা আমার হাত ধরেই মাঠে গিয়েছিলো। সে আমার কাছে আমার জার্সিটা চেয়েছিলো। তাই ম্যাচশেষে জার্সিটা দেওয়ার জন্য আমি তাকে খুঁজছিলাম। তার হাতে যখন জার্সিটা দিলাম তখন সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ”আজ যা হলো তার সবকিছুর জন্য আমি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।”
এই ঘটনাটা সত্যিই আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছিলো, কিছু পূর্ণবয়স্ক মানুষের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছে এই বাচ্চা ছেলেটি! বাচ্চাদের এই সহজ সরল আদর্শটার অভাবই বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। অবশ্য এসব ঘটনা যে শুধুমাত্র শরীরের রঙের জন্য হচ্ছে সেটাও কিন্তু না। আমি আমার সতীর্থদের কাছ থেকেই ভিন্ন রকমের ঘটনা শুনেইছি। সার্বিয়ান খেলোয়াড়দের অনেকে ‘ভবঘুরে’ বলে ব্যঙ্গ করে, এমনকি আমার ইতালিয়ান সতীর্থ লরেঞ্জো ইনসিনিয়েকে এদেশের মানুষেরাই ‘নেপোলিটান শীট’ বলে ব্যঙ্গ করে!
এই ব্যাপারে আমাদের আরেকটু কঠোর হওয়া প্রয়োজন। একটা ঘটনা ঘটে, এরপর সেই ক্লাব ক্ষমা চেয়ে সুন্দর একটা বিবৃতি দেয় এবং কিছুদিন পর আবারো সেই একই ঘটনা ঘটে। এ যেন এক অদ্ভুত দুষ্টচক্র! অথচ ইংল্যান্ডে বর্ণবাদী ঘটনার ব্যাপারে কঠোর সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, কেউ এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকলে তাকে আজীবনের জন্য স্টেডিয়ামে নিষিদ্ধ করা হয়। আমি আশা করি ইতালিতেও এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অবশ্য এটাও ঠিক শুধুমাত্র শাস্তি দিয়ে তো আপনি সমগ্র পৃথিবীর মানুষের মনে পরিবর্তন আনতে পারবেন না।
এসবের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই, তবে আমি আপনাদের এই ব্যাপারে একটা গল্প বলতে পারি। আমাকে দেখে কিছু মানুষ হয়তো একজন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারের বেশি ভাবেন না, কিন্তু আমার জীবনে ফুটবল ছাড়াও আরো অনেক গল্প আছে। ফ্রান্সের সেন্ট দিয়ে শহরে আমি বড় হয়েছি যেখানে আমার মতো মতো আরো অনেক অভিবাসী থাকতো। এই শহরে আমার বাবা প্রথমে একাই এসেছিলেন, তখন তিনি একটা টেক্সটাইল মিলে কাজ করতে। আমার মায়ের ফ্রান্সে আসার টাকা যোগাড় করার জন্য তিনি টানা পাঁচ বছর সপ্তাহের প্রতিটি দিন কাজ করে গেছেন। এরপর আমার মা এই শহরে এলেন এবং এই শহরেই আমি জন্মগ্রহণ করি।
আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন আমি প্রথমবারের মতো সেনেগালে আমার আত্মীয়দের দেখতে যাই। পৃথিবীর আরেক প্রান্তের ওই অবস্থা দেখে আমি সত্যিই ভীষণ বিস্মিত হয়েছিলাম। রাস্তায় বাচ্চারা দলবেঁধে ফুটবল খেলছে অথচ তাদের কারো পায়ে কোনো জুতা নেই! মানুষের এই দারিদ্র্য দেখে আমি সত্যিই ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে করজোরে মিনতি করেছিলাম যাতে তিনি সেখানকার সবগুলো বাচ্চাকে জুতো কিনে দেন। জবাবে আমার মা বলেছিলেন, ”সেটা করার সামর্থ্য আমাদের নেই কলিদু, এর চেয়ে বরং তুমিও জুতা খুলে ওদের সাথে খেলা শুরু করো”
মায়ের কথামতো আমি জুতা খুলে খালি পায়ে আমার চাচাতো ভাইদের সাথে খেলা শুরু করি আর এভাবেই আমার ফুটবল অভিযাত্রার সূচনা ঘটে। এরপর ফ্রান্সে যখন ফিরলাম তখন সেখানকার একটা ছোট্ট পার্কে প্রতিদিন ফুটবল খেলতে যেতাম। আগেই বলেছি, আমাদের আশেপাশে অনেক অভিবাসী থাকতো আর সেকারণে আমরা সেনেগাল বনাম মরক্কো, তুরস্ক বনাম ফ্রান্স কিংবা তুরস্ক বনাম সেনেগালের মতো ম্যাচেও অংশ নিতে পারতাম। ম্যাচগুলো ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো, প্রতিটি ম্যাচই যেন বিশ্বকাপের আমেজ নিয়ে আসতো।
আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশিরা খুবই সাহায্যপরায়ণ ছিল। আমার মায়ের হুট করে কিছু দরকার হলে মুদির দোকানে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না, পাশের বাড়িতে গেলেই সেটা পাওয়া যেতো। আমার বাসায় প্লে স্টেশন ছিল না, কিন্তু আমি চাইলেই পাশের বাসায় গিয়ে প্লে স্টেশন দিয়ে খেলতে পারতাম। এমনকি যখন আমার বন্ধু বাসায় থাকতো না তখনো সেই বাড়ির দরজা আমার জন্য খোলা ছিল। আবার কোনো বাড়ির মা যদি অন্য বাড়ির ছেলেকে দোকান থেকে কিছু নিয়ে আসতে বলতো, তবে সেই ছেলেও বিনা বাক্যব্যয়ে দোকান থেকে সেই জিনিস কিনে আনতো।
আপনি যখন এমন পরিবেশে বড় হবেন তখন আশেপাশের সবাইকেই আপনার নিজের ভাই বলে মনে হবে। আমরা কালো, আরব, আফ্রিকান, মুসলিম, খ্রিস্টান– বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হলেও আমার সবার মূল পরিচয় ছিল আমরা ফরাসি। সবার ক্ষুধা লেগেছে, চলো সবাই মিলে কোনো তুর্কি রেস্টুরেন্টে যাই। কিংবা রাতে সবাই মিলে একত্র হতে চাইলে সবাই মিলে আমার বাসায় চলে আসো যেখানে সেনেগালের খাবার দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করা হবে।
২০০২ বিশ্বকাপ কোরিয়া-জাপানে হওয়ায় সময়টা আমাদের জন্য ঠিক সুবিধাজনক ছিল না, খেলা যখন শুরু হতো তখন আমাদের ক্লাসে থাকতে হতো। এদিকে সেবারের উদ্বোধনী ম্যাচেই মুখোমুখি হয়েছিলো ফ্রান্স আর সেনেগাল। তাই স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচটা নিয়ে বাড়তি উত্তেজনা কাজ করছিলো। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই। তাই বুকে পাথর বেঁধে ক্লাসেই গিয়েছিলাম। ম্যাচ শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা দুটোয়, ঠিক এক মিনিট আগে স্যার আমাদের কক্ষে এসে সবাইকে বই খুলতে বললেন।
সবাই বই খুললেও মনটা পড়েছিলো ফ্রান্স বনাম সেনেগালের ম্যাচের দিকেই। এদিকে তিন মিনিট পর আমাদের স্যার বলে উঠলেন, ”সবাই নিজেদের বই ব্যাগে রেখে দাও, এখন আমরা একটা শিক্ষামূলক ছবি দেখবো।” ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, হুট করে দেখি স্যার টিভি চালু করে সবাইকে ম্যাচটা দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন! সেটি ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত।
সেনেগাল যখন সবাইকে অবাক করে ম্যাচটা জিতে নিলো তখন আমার যত সেনেগালিজ বন্ধু ছিল তাদের সবার বাবা-মা আনন্দে রাস্তায় নাচতে শুরু করলো। আমরা এতটাই খুশি ছিলাম যে আমাদের আনন্দ দেখে ফরাসি ও তুর্কি প্রতিবেশিরাও আমাদের সাথে যোগদান করে। আমার মনে হয় ফুটবলের জয়-পরাজয়ের চেয়েও বন্ধুত্ব, পরিবার ও ভ্রাতৃত্ব অনেক বেশি মূল্যবান, এগুলো আপনি টাকা দিয়ে কিনতে পারবেন না। এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটাই আমি আমার পরিবার থেকে পেয়েছি।
আমার পরিবার কিন্তু কখনোই আমার ফুটবল খেলা নিয়ে সেভাবে আগ্রহ দেখায়নি, আমার বাবা শুধুমাত্র একবার আমার ম্যাচ দেখতে এসেছিলো আর মা তো কখনোই আসেনি। তবে তারা টেলিভিশনে বড় বড় ম্যাচগুলো বাসায় বসে ঠিকই দেখতো। তাই আমার সবসময় মনে হয়েছে, যেহেতু তারা নিজেরা স্টেডিয়ামে আসবে না তাই আমাকে দায়িত্ব নিয়ে স্টেডিয়ামটা তাদের কাছে নিয়ে আসতে হবে। আমাকে এমন পর্যায়ে যেতে হবে যাতে তারা আমার খেলা টেলিভিশনে দেখতে পায়।
এই ফুটবল আমাকে বিশ্বের নানা জায়গায় নিয়ে গেছে। প্রথমেই বেলজিয়ামের গেঙ্কে গেলাম এরপর এলাম ইতালির নাপোলিতে। ফুটবলের কারণে বিভিন্ন ভাষা শিখতে হয়েছে, নানা ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। যখন আপনি সব ধরনের ভাষা শিখবেন তখন সব দরজাই আপনার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এখন একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন আমি বেলজিয়ামের গেঙ্কের হয়ে খেলি, আমার বন্ধু আহমেদ কিছুদিনের জন্য আমার বাসায় আসবে বলেছিলো। কথা ছিল সে রেলস্টেশনে এলেই আমাকে ফোন করবে, আমিও সেই ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। এমন সময় এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো।
আমি ইংরেজিতেই জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যালো, কে বলছেন?” ওপাশ থেকে উত্তর এলো, “আমি রাফা বেনিতেজ বলছি।” আমি ভাবলাম হয়তো আহমেদ আমার সাথে মজা করছে তাই প্রত্যুত্তরে বললাম, “মজা করা বন্ধ করো আহমেদ, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।” এই কথা বলেই ফোন কেটে দিলাম। আবার ফোন এলো এবং আবারো একই কথা বললো, এবার আমি আরো বিরক্ত হয়ে বললাম, “এসব বন্ধ করো আহমেদ, কখন আসছো সেটা দয়া করে জানিয়ো।” আমি আবারো ফোন কেটে দিলাম।
কিছুক্ষণ পরেই আমার এজেন্ট আমাকে ফোন করলো, সে বললো, “কৌলি, তুমি শুনতে পাচ্ছো? নাপোলির রাফা বেনিতেজের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছো, সে কিছুক্ষণ পর তোমাকে ফোন করবে।” আমি সাথে সাথে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমার এজেন্টকে সব খুলে বললাম, সে রাফাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললো। এরপর রাফার সাথে আবারো কথা হলো, শুধুমাত্র তার সাথে কথা বলে নেপলস শহরের ব্যাপারে তেমন কিছু না জেনেই আমি নাপোলিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।
তবে শীতকালীন দলবদল শেষ হতে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা বাকি থাকায় সেবার আর আমার নাপোলিতে যোগ দেওয়া হয়নি, কিন্তু পরের দলবদলে রাফা ঠিকই তার কথা রেখেছিলো। আমি যখন ডাক্তারি পরীক্কগার জন্য ইতালি যাই তখন ইতালিয়ান ভাষা না জানার কারণে আমি ভীষণ নার্ভাস ছিলাম। তবে নাপোলির চেয়ারম্যান হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে আমাকে দ্রুত মানিয়ে নিতে সাহায্য করেন। তিনি আমাকে দেখে বলেন, “তোমাকে আমি যত লম্বা ভেবেছিলাম তার চেয়ে দেখি তুমি একটু খাটো। তোমার উচ্চতা কত?” আমি বললাম, “আমার উচ্চতা ১.৮৬ মিটার।” “কিন্তু আমাকে তো বলা হয়েছিলো তোমার উচ্চতা ১.৯২ মিটার। এই ০.৬ মিটারের জন্য আমাকে তো কিছু টাকা তোমার পুরনো ক্লাব থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে।” মুচকি হেসেই তিনি কথাগুলো বলছিলেন। আমিও হেসে হেসে জবাব দিয়েছিলাম, “চিন্তা করবেন না প্রেসিডেন্ট, আমি মাঠে খেলে আপনাকে বাকি ০.৬ মিটারের দাম পুষিয়ে দিবো।”
রাফার কাছ থেকে আমি ট্যাকটিকাল ব্যাপারগুলো অনেক ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। সবসময় ভালো খেলার দিকে না ঝুঁকে কিছুটা ট্যাকটিকাল হতে হবে- এটা আমি ইতালি আসার আগে মানতে চাইতাম না। তবে এসব তো খেলার মাঠের কথা, মাঠের বাইরেও আমি খুব দ্রুত একজন নেপোলিটান হতে পেরেছি। নাপোলির সবাই খুব মিশুক, এখানে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সবসময় বিরাজমান। এখন আমি ফ্রান্সে গেলে আমার কোনো বন্ধুই আমাকে সেনাগালিজ বা ফরাসি ডাকে না, সবাই আমাকে নেপোলিটানই ডাকে।
আমার ছেলের জন্ম নেওয়াটা আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত। সেদিন আমাদের সাসুলোর সাথে ম্যাচ ছিল, সেই ম্যাচের ট্যাকটিস নিয়েই আমরা সবাই ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময়ে আমার মোবাইল ভাইব্রেট করতে লাগলো, কিন্তু অন্যদের অসুবিধা হবে বিধায় আমি কল কেটে দিলাম। এরকম প্রায় পাঁচ-ছয়বার হলো আর আমি প্রতিবারই কল কেটে দিলাম। যখন আমি বাইরে বের হলাম তখন কল ধরলাম এবং সাথে সাথে আমার স্ত্রী আমাকে বললো, “তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো, আমাদের ছেলে আজকেই পৃথিবীতে আসবে।”
তখন আমাদের কোচ ছিলেন মাউরিজিও সারি, আমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে সব খুলে বললাম। সারি সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বললো, “না, না, না! আজ আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তোমার থাকাটা ভীষণ জরুরি, তুমি যেতে পারবে না।” জবাবে আমি বললাম, “আপনি আমাকে জরিমানা বা নিষেধাজ্ঞা– যে শাস্তিই দিন না কেন, আমার প্রথম সন্তান জন্মের সময়ে আমি অবশ্যই আমার স্ত্রীর পাশে থাকবো।’ সারি অসহায়ের মতো বাইরে তাকিয়ে সিগারেট টানতে টানতে বললো, “আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি হাসপাতালে যাও। কিন্তু প্লিজ কৌলি আজ ম্যাচের আগেই তুমি চলে এসো। আজকের ম্যাচে তোমাকে সত্যিই প্রয়োজন।”
আমি ঝড়ের বেগে হাসপাতাল ছুটে গেলাম। আমি দুপুরের দিকে হাসপাতাল পৌঁছাই আর দেড়টার দিকে আমার ছেলে পৃথিবীতে আসে। আমরা আমাদের ছেলের নাম দিই সেনি। এটি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।
বিকাল চারটার দিকে সারি আবার আমাকে ফোন করে মাঠে আসার জন্য চাপ দিতে থাকে। তখন আমার স্ত্রী বিশ্রাম নিচ্ছিলো, হয়তো তখনো আমার উচিত ছিল তার পাশে থাকা। কিন্তু আমার জন্য আমার ক্লাব বিপদে পড়ুক সেটা আমি চাইনি, কারণ আমি নাপোলিকে সত্যিই ভালোবাসি। আমার স্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়ে স্টেডিয়ামে চলে গেলাম এবং গিয়ে দেখি মূল একাদশে আমাকে রাখা হয়নি!
আমি সারির কাছে গিয়ে বললাম, “এটা কোন ধরনের রসিকতা?” সারি হেসে জবাব দিলো, “এটা আমার সিদ্ধান্ত।” আমি আরো রেগে গিয়ে বললাম, “আপনার আমাকে দরকার এটা শুনেই আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানকে ফেলে খেলতে চলে এসেছি।” এটা শুনে সারি আরেকগাল হেসে বললো, “হ্যাঁ, বেঞ্চেই তোমাকে দরকার আমাদের।”
এখন হয়তো এই ঘটনার কথা ভেবে আমি হাসছি কিন্তু সেদিন সত্যিই খুব রাগ হয়েছিলো। আপনাদের অনেকের কাছে হয়তো এই গল্পটাকে নেতিবাচক বলে মনে হবে। কিন্তু আমার কাছে সেদিনের ঘটনার পুরোটাই ছিল নাপোলির প্রতি আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এটা আসলে বলে বোঝানো সম্ভব না, নাপোলিতে এলেই পুরো ব্যাপারটা বোঝা যাবে। শহরটা কিছুটা পাগলাটে, কিন্তু সেই পাগলামির মধ্যেও একটা উষ্ণতা আছে।
পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরে বেশ কিছু ভাষা শিখে অনেক কিছুর সাথে আমি পরিচিত হয়েছি, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় আমি অনেক টাকাও উপার্জন করতে পেরেছি। কিন্তু আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পৃথিবীতে এমন তিনটা জিনিস আছে যা কোনোকিছু দিয়ে কেনা সম্ভব না– বন্ধুত্ব, পরিবার ও শান্তি। এই ব্যাপারটি মনে রাখলে পৃথিবীর অনেক সমীকরণই খুব সহজ হয়ে যাবে। বেশ কিছু দিকে আমাদের মাঝে ভিন্নতা থাকলেও আমরা সবাই একে অপরের ভাই।