বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম আসর মাঠে গড়ায় ১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডে। ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন নিউ জিল্যান্ডের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান গ্লেন টার্নার। তিনি চার ইনিংস ১৬৬.৫০ ব্যাটিং গড়ে ৩৩৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এরপরের আসরে কোনো ব্যাটসম্যান তিন’শ রানের মাইলফলক অতিক্রম করতে পারেননি। গর্ডন গ্রীনিজ চার ইনিংসে ৮৪.৩৩ ব্যাটিং গড়ে সর্বাধিক ২৫৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে পাঁচজন ব্যাটসম্যান তিন শতাধিক রান করলেও কোনো ব্যাটসম্যানই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের এক আসরে চার’শ রান পূর্ণ করতে পারেননি।
এশিয়ায় প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালে। এই আসরে নয়জন ব্যাটসম্যান তিন শতাধিক রান করেছিলেন। যার মধ্যে তিনজন চার’শ রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন। সর্বাধিক ৪৭১ রান করেছিলেন ইংল্যান্ডের গ্রাহাম গুচ। বিশ্বকাপের এক আসরে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে পাঁচ শতাধিক এবং ছয় শতাধিক রান করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। শচীন ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে ৫২৩ রান এবং ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ৬৭৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। শচীনের পর ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত শুধুমাত্র ম্যাথু হেইডেনই এক আসরে ছয় শতাধিক রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। তিনি ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ৭৩.২২ ব্যাটিং গড়ে ৬৫৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপের ফরম্যাট অনুযায়ী প্রতিটি দল গ্রুপ পর্বে নয়টি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এর আগে গ্রুপ পর্বে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার সুযোগ ছিল ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে। ঐ আসরে প্রতিটি দল আটটি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়। এবারের আসরে যেহেতু প্রতিটি দল বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে, তাই এই আসরে ব্যক্তিগত অনেক রেকর্ডে পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এক আসরে পাঁচ শতাধিক রান সংগ্রহের ঘটনা ঘটেছে ১৫ বার (একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে দুটি ভিন্ন আসরে পাঁচ শতাধিক রান সংগ্রহ করেছেন শচীন টেন্ডুলকার)। মোট চৌদ্দজন ক্রিকেটার বিশ্বকাপের এক আসরে পাঁচ শতাধিক রান সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে এই আসরেরই রয়েছে সাতজন ক্রিকেটার।
শচীন টেন্ডুলকার এবং ম্যাথু হেইডেনের পর এই আসরে মোট তিনজন ব্যাটসম্যান ছয় শতাধিক রান সংগ্রহ করেছেন। এই আসরে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ছয়’শ রানের ক্লাবের যোগ দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। এরপর ভারতের ওপেনার রোহিত শর্মা এবং অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ছয়’শ রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন। চলুন জেনে আসা যাক বিশ্বকাপের এক আসরে ছয় শতাধিক রান করা ব্যাটসম্যানদের সম্পর্কে।
শচীন টেন্ডুলকার – ৬৭৩ রান (২০০৩ সাল)
কপিল দেবের হাত ধরে ১৯৮৩ সালে ভারত প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ফাইনাল ম্যাচেই জয়লাভ করে শিরোপা জেতে ভারত। নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে ভারতকে অপেক্ষা করতে হয় ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত। আফ্রিকা মহাদেশে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে ভারতের ফাইনাল খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে বড় ভূমিকা পালন করেন শচীন টেন্ডুলকার। তিনি ১১ ইনিংসে একটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬১.১৮ ব্যাটিং গড়ে ৬৭৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
পুরো আসরে দুর্দান্ত ব্যাটিং করা শচীন টেন্ডুলকার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে মাত্র চার রান করে ফিরে গিয়েছিলেন। এছাড়া পুরো আসর জুড়েই তিনি অসাধারণ ব্যাটিং করেছিলেন। তার ছয়টি অর্ধশতকের মধ্যে দুটি ছিল ৯৮ এবং ৯৭ রানের ইনিংস। নিজে শতক হাঁকাতে না পারলেও দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। ভারত ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার কাছেই পরাজিত হয়েছিল। গ্রুপ পর্বে এবং সুপার সিক্সের নয় ম্যাচের মধ্যে শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে পরাজিত হয়েছিল তারা। ফাইনালেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ হাসি হাসতে না পেয়ে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা হয়েই সন্তুষ্ট থাকে তারা।
ম্যাথু হেইডেন – ৬৫৯ রান (২০০৭ বিশ্বকাপ)
অস্ট্রেলিয়া ১৯৯৯ সাল এবং ২০০৩ সালে টানা দুই বিশ্বকাপ জয়ের পর প্রথম দল হিসেবে হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায়। শেষপর্যন্ত অসাধারণ দলগত নৈপুণ্যে ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে টানা তিনবার বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি গড়েছিল তারা। বল হাতে গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং ব্যাট হাতে ম্যাথু হেইডেন পুরো আসরে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন। হেইডেন ১০ ইনিংসে তিনটি শতক এবং একটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭৩.২২ ব্যাটিং গড়ে ৬৫৯ রান সংগ্রহ করেছেন।
ম্যাথু হেইডেন ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর আগে নিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এরপর বিশ্বকাপেও রানের মধ্যে ছিলেন তিনি। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৬০ রানের ইনিংস দিয়ে বিশ্বকাপের মিশন শুরু করেছিলেন তিনি। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১০১ রান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৫৮ রান এবং নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। ফাইনালে অবশ্য তিনি ছিলেন নীরব দর্শক। গিলক্রিস্টের সাথে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ১৭২ রান যোগ করেছিলেন, যার মধ্যে তার অবদান মাত্র ৩৮ রানের।
রোহিত শর্মা – ৬৪৮ রান (২০১৯ বিশ্বকাপ)
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সময়ের সেরা ওপেনার রোহিত শর্মা ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচজয়ী অপরাজিত ১২২ রানের ইনিংস খেলার মধ্য দিয়ে। এরপরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫৭ রানের ইনিংস খেলার পর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১ রান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৮ রান করে ফিরে গেলেও গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ তিন ম্যাচে তিনটি শতক হাঁকান তিনি। রোহিত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০২ রান, বাংলাদেশের বিপক্ষে ১০৪ রান এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।
কুমার সাঙ্গাকারার পর বিশ্বকাপে টানা তিন ইনিংসে শতক হাঁকানোর পাশাপাশি এক আসরে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি শতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। রোহিত শর্মা গ্রুপ পর্বে আট ম্যাচ খেলে পাঁচটি শতক এবং একটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন। গ্রুপ পর্বে মোট ৬৪৭ রান সংগ্রহ করার পর তার সামনে সুযোগ ছিল স্বদেশী শচীনের এক আসরে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড টপকানোর। কিন্তু সেমিফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১ রান করে সাজঘরে ফিরে যান। তার বিদায়ের পর ভারতের টপ-অর্ডার দ্রুত ভেঙে পড়ে। ফলে সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয় ভারতকে। রোহিত শর্মা ৮১.০০ ব্যাটিং গড়ে ৬৪৮ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে নিজের নাম লিখিয়ে রেখেছেন।
ডেভিড ওয়ার্নার – ৬৪৭ রান (২০১৯ বিশ্বকাপ)
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে দলে ডাক পান ডেভিড ওয়ার্নার। তার উপর দলের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। প্রত্যাশার চাপ কাটিয়ে ধারাবাহিকভাবে রান করেছিলেন তিনি। মিডল-অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ হলেও দুই ওপেনার অ্যারন ফিঞ্চ এবং ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যাটে চড়ে এবং মিচেল স্টার্কের দুর্দান্ত বোলিংয়ে গ্রুপ পর্বে সফলতা পায় অস্ট্রেলিয়া। নয় ম্যাচে সাত জয়ে দ্বিতীয় স্থানে থেকে গ্রুপ পর্ব শেষ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। ডেভিড ওয়ার্নার দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে ছয়’শ রান করেন।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৮৯ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। তিনি গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১০৭ রান, বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৬৬ রান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১২২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এছাড়া ভারতের বিপক্ষে ৫৬ রান এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৩ রান করেছিলেন ওয়ার্নার। আসরে তিনি ১০ ইনিংসে তিনটি শতক এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭১.৮৮ ব্যাটিং গড়ে ৬৪৭ রান করেছিলেন। গ্রুপ পর্বে সফল হলেও সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৯ রান করে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। ফলে সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয় অজিদের।
সাকিব আল হাসান – ৬০৬ রান (২০১৯ বিশ্বকাপ)
বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ এবং আশাজাগানিয়া তরুণদের সমন্বয়ে গড়া দল নিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশ। তবে সাকিব আল হাসান ছাড়া অন্যরা নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বে মাত্র তিনটি জয় নিয়ে আট নাম্বারে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করেছিল। বাংলাদেশের জয় পাওয়া তিন ম্যাচেই ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন সাকিব। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫ রানের ইনিংস খেলার পাশাপাশি এক উইকেট শিকার করেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুই উইকেট শিকারের পর অপরাজিত ১২৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় পাওয়া ম্যাচেও ৫১ রানের ইনিংস খেলার পর পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি।
সাকিব আল হাসান ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে বিশ্বকাপ রাঙিয়ে তোলেন। তিনি ২০১৯ সালের আসরে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ছয়’শ রান করেছিলেন। বিশ্বকাপের এক আসরে সাকিবসহ মোট পাঁচজন ব্যাটসম্যান ছয়’শ রান করেছিলেন, যার মধ্যে সাকিব ছাড়া বাকি চারজন ওপেনার হিসেবে খেলেছিলেন। সাকিব ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে আট ইনিংসে দুটি শতক এবং পাঁচটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। তার সর্বনিম্ন রানের ইনিংস ছিল ৪১ রানের। তিনি ৮৬.৫৭ ব্যাটিং গড়ে এবং ৯৬.০৩ স্ট্রাইক রেটে ৬০৬ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি অসাধারণ পারফর্ম করলেও দল হিসেবে বাংলাদেশ আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। ফলে সাকিব তার পারফরমেন্সের যথাযথ স্বীকৃতি পাননি।