বিংশ শতকের শেষভাগ, নব্বই দশক — ক্রিকেটে পরিবর্তনের জোর হাওয়া। সনাতনী ছাঁচ বদলে যুগের চাহিদামতো ক্রিকেট যোগানে মনোযোগ সবার। একে একে ভেঙে পড়ছে গৌরবময় আভিজাত্যের দেয়াল, সংযোজিত হচ্ছে আভিজাত্যের নব সংজ্ঞায়ন। নাক উঁচু অনেকেই ‘গেল গেল জাত গেল’ রব তোলেন, অহঙ্কারের অন্ধকারে মাথা কুটে মরেন অনেকেই। সাদা বল, রাতের ক্রিকেট, রঙিন জার্সি, ওডিআই ক্রিকেটে ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন; নানামুখী পরিবর্তনে আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি রঙিন হয়ে গেছে ক্রিকেটের উপস্থাপনা। ওডিআই ক্রিকেটের নব উচ্চতায় উত্তরণের সঙ্গে ক্রিকেটের আবেদনও যেন বেড়ে যায় বহুগুণ।
একঝাঁক প্রতিভাবান ও তুখোড় ক্রিকেট তারকার একসঙ্গে আবির্ভাব। বিস্ময়বালক শচীন টেন্ডুলকার, এক খেয়ালি শিল্পী ব্রায়ান লারা, গ্লেন ম্যাকগ্রার ঘোষণা দিয়ে শিকার ধরা, ওয়াসিম আকরামের বাঁ হাতে কত জাদু, মুত্তিয়া মুরালিধরন — যিনি বাঁধার পাহাড় টপকে যাবেন বলে সংকল্পবদ্ধ, লেগস্পিনের চূড়ান্ত পরিণতি যার হাত ধরে — শেন ‘দ্য ম্যাজিশিয়ান’ ওয়ার্ন; প্রত্যেকেই এক-একজন অসম্ভব শক্তিশালী ক্রিকেট চরিত্র। আরো আছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্যাবর্তন। সব মিলিয়ে নব্বই দশক ঘোরগ্রস্থ প্রহর যেন! ধুন্ধুমার ক্রিকেট, ঝাঁঝালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সঙ্গে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা — ক্রিকেটের সুবর্ণ সময় যেন বয়ে চলে।
এই বয়ে চলা সময়ের ভেতর দিয়ে অবসান হয় একটি প্রবল প্রতাপশালী রাজশাসন। পতন হয় ক্রিকেট সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাটের। একইসঙ্গে উত্থান হয় নতুন এক শাসক ও অধিপতির। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগে যতিচিহ্ন বসিয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার গৌরবময় সোনালী যাত্রার সূচনা হয় এই সময়ে।
অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পালাবদলের এই প্রক্রিয়া ও সময়টাকে ধরার চেষ্টা করা যাক আমাদের এবারকার প্রচেষ্টায়।
কাহিনীসংক্ষেপ
দেড় যুগ ধরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য। ১৯৭৬ সালের পর থেকে অস্ট্রেলিয়া একবারমাত্র সিরিজ ড্র ব্যতীত কোনো সিরিজ জিততে পারেনি। পাঁচটি টেস্ট সিরিজ হেরেছে। ২৬টি টেস্ট থেকে জয় তুলে নিতে পেরেছে মোটে ৪টিতে, আর হেরেছে ১৫টিতে।
নব্বই দশকে প্রথম সিরিজটি অনুষ্ঠিত হয় ক্যারিবিয়ানে। আগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ জেতে সেবারও। তবে অস্ট্রেলিয়া শেষ টেস্টটা জিতে নিয়ে জানিয়ে রাখে, লড়াইটা আগের মতো একতরফা হবে না আর। পরের সিরিজ অস্ট্রেলিয়ায় হলেও ফলাফল সেই ২-১; ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিরিজ জয়। এখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমিয়ে তোলে অস্ট্রেলিয়া, পরিবর্তনের পয়গাম দিয়ে রাখে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
তারপরের সিরিজে প্রায় দুই দশক পর ক্যারিবিয়ানে ওড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিজয় পতাকা। ঠিক ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফি ফিরে পায় অস্ট্রেলিয়া। পল রাইফেল যেই সিরিজ জয়কে উল্লেখ করেছিলেন “এটা অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ছিল” বলে।
পরেরবার অস্ট্রেলিয়ার মাঠেও সিরিজ হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পাঁচ টেস্টের প্রতিটিই দেখে ফলাফল। প্রবল দাপট দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়া স্রেফ উড়িয়ে দেয় অতিথিদের। পরের সিরিজ আবার ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। সেখানে শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের ফলে সিরিজ ২-২ ড্র হয়, ফলে ট্রফি থেকে যায় অস্ট্রেলিয়াতেই।
এক দশকের পাঁচটি সিরিজে ২৩ ম্যাচে মুখোমুখি হয়ে দুই দলের জয় সমান নয়টি করে। দুই দলেরই সিরিজ জয় সমান দুইটি করে। দশকের প্রথমভাগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আধিপত্য থাকলেও শেষটায় অস্ট্রেলিয়ার নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিশ্বক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছেড়ে সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় উড়াল দেয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
ক্যারিবিয়ান লেগ্যাসি
সময়: ১৯৯০-৯১; স্বাগতিক: ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ফলাফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়
প্রায় দেড় দশকে একটু একটু করে গড়ে তোলা হয়েছে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট সাম্রাজ্য। এক-একজন দানবীয় পেসার, ব্যাটিংয়ে স্টাইল-আভিজাত্য আর রাজকীয়তার সংমিশ্রণ। ভয়ডর নেই। পাইপলাইন থেকে উঠে আসছে একের পর এক দুর্দান্ত সব ক্রিকেটার। স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস ক্যারিয়ার-সায়াহ্নে প্রায়; রাজার মতো চলন-বলন তার, মাঠের ভেতর তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত সম্রাট। ব্যাটিংয়ের সময় বিপক্ষ দলের বোলারদের প্রতি নিদারুণ ঔদাসীন্য ও অবহেলা স্পষ্ট তার চোখেমুখে। সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই তিনি অপ্রতিরোধ্য দলটির সারথী। গোটা আশির দশকে একটিও সিরিজ হারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেলের পর ক্লাইভ লয়েডের হাত ধরে যে সাম্রাজ্যের উত্থান বিশ্বক্রিকেটে, ভিভ রিচার্ডস তার উজ্জ্বলতর উত্তরাধিকার।
অ্যালান বোর্ডার রাফ এন্ড টাফ চরিত্রের। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের গুরুভার তার কাঁধে। দলটাকে একটু একটু করে মুকুট পরিধানের উপযুক্ত করে তোলার মহান দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। একঝাঁক দারুণ ক্রিকেটার তার দলে, পাইপলাইনও মজবুত। ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফির মালিকানা ফিরে পেতে মরিয়া অস্ট্রেলিয়ার নেতা হয়ে ক্যারিবিয়ানের অতিথি তার দল।
প্রথম ও তৃতীয় টেস্ট ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র হলেও দ্বিতীয় ও চতুর্থ টেস্টের প্রবল দাপটে জয়ে ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফির মালিকানা নিশ্চিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের। স্রেফ উড়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া। সময়ের সবচেয়ে পরিচিত ও নিয়মিত দৃশ্যপট — ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং ও বোলিং দলের সম্মুখে নিতান্ত অসহায় ও করুণ আত্মসমর্পণ প্রতিপক্ষের।
তবে অস্ট্রেলিয়া হাল ছাড়তে নারাজ। ‘অসহায় আত্মসমর্পণ’ যদি হয়ও, তবুও পরেরবার দেখে নেয়ার হুঙ্কার তারা রাখবেই। স্টিভ ওয়াহ পঞ্চম টেস্টে উপহার দিলেন অনবদ্য মাস্টারক্লাস, ১৮৮ বলে অপরাজিত ১৩৯। প্রায় চার রানরেটে প্রথমদিনের অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ৩৫৫/৫। আরো বেশ ক’বছর পরে স্টিভ ওয়াহর নেতৃত্বে খুনে অস্ট্রেলিয়ার কিঞ্চিৎ নমুনা দেখালেন কি?
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং ব্যর্থতা ও দ্বিতীয় পালার ব্যাটিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার আরেক ‘পরবর্তী অধিনায়ক’ মার্ক টেলরের অনবদ্য ১৪৪-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফিরে আসার পথও রুদ্ধপ্রায়। শেষ পর্যন্ত পঞ্চম ও শেষ টেস্টে বড় ব্যবধানে পরাজিত হলেও খুব একটা ‘ভীত’ হওয়ার কারণ খুঁজে পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার জন্য তা ছিল পরবর্তী লড়াইয়ের জ্বালানী।
সেয়ানে সেয়ানে লড়াই
সময়: ১৯৯২-৯৩; স্বাগতিক: অস্ট্রেলিয়া; ফলাফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়
অ্যালান বোর্ডার ক্যারিয়ার সায়াহ্নে হলেও দাঁড় করিয়েছেন দলটাকে। অন্যদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে তখন ‘রাজা’ ভিভ রিচার্ডস নেই। নেতৃত্বের দায়িত্ব রিচি রিচার্ডসনের কাঁধে। ভিভ রিচার্ডস ছিলেন অ্যান্টিগার, রিচার্ডসনও অ্যান্টিগা থেকে উঠে আসা আরেকজন রাজা যেন; ভয়ডরহীন, প্রতিপক্ষকে ধুমড়ে-মুচড়ে দেয়াতেই সব আনন্দ।
প্রথম টেস্টই জমে ক্ষীর। সেই ঐতিহাসিক ‘টাই’ টেস্টের মঞ্চ ব্রিসবেনেই জমায়েত যত অনিশ্চিত সৌন্দর্যের নাটকীয়তা ও উত্তেজনা। প্রায় ৭৮ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামা অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার বুক চিতিয়ে লড়াই করলো। ওয়ালশ-অ্যামব্রোস-প্যাটারসন-বিশপ সামলে শেষদিনে প্রায় দুই সেশনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য লক্ষ্য দাঁড় করালো ২৩১। সেই ‘টাই’ টেস্টের স্মৃতি উঁকি দিয়ে গেলে দোষ নেই কিছু। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনেকটা একইরকম।
ম্যাকডারমট-আঘাতে ৯ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নেই চার উইকেট। রিচি রিচার্ডসন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন। তিনি জানেন, বীর-লড়াকুর প্রথম পরাজয় নিজের কাছে হেরে যাওয়া। সুতরাং হারা যাবে না নিজের কাছে। প্রায় চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে প্রতিকূল পরিবেশ ও প্রতিপক্ষ সামলে সিংহ-হৃদয় রিচার্ডসন যখন ফিরছেন, তখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চোখ রাঙাচ্ছে পরাজয়। তবে বিশপ ও অ্যামব্রোস-ওয়ালশ মিলে কোনোমতে সামলে দিলেন তা। ম্যাচ বাঁচালো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে আর সম্ভব হলো না। বিশাল ব্যবধানে বিজয় দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে গেল সিরিজে। দুইজন মহাতারকার মুখোমুখি সাক্ষাতও ঘটে গেল মেলবোর্নে। ব্রায়ান লারা প্রথম টেস্ট খেললেও ছিলেন না শেন ওয়ার্ন। দ্বিতীয় টেস্টে ফিরতেই মুখোমুখি দু’জন। ওয়ার্ন-ম্যাজিকে তছনছ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শেন ওয়ার্নের প্রথম ঘূর্ণি-জাদু, ৫২ রানে ঝুলিতে পুরলেন ৭ উইকেট।
ওয়ার্নের ক্ল্যাসিক লেগস্পিনের জবাবটা পরের টেস্টে দিলেন ব্রায়ান লারা। সিডনির ‘প্রথম’ মাস্টারক্লাসে লারা করলেন ৭৪ স্ট্রাইকরেটে ২৭৭ রান। ম্যাচ ড্র হলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ নড়েবড়ে হওয়া আত্মবিশ্বাসে জ্বালানী পেল। রিচি রিচার্ডসন হুঙ্কার ছাড়লেন পরের টেস্টে। অ্যাডিলেইডে চতুর্থ টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে মাত্র ১৮৬ রান টার্গেট দিলেও— অধিনায়ক রিচার্ডসন বললেন, “আরে, এই রানই ওদের করতে দেব না।”
ঠিকই ক্যারিবিয়ান বোলিং-তোপে অস্ট্রেলিয়া ৭৪ রানে হারিয়ে ফেলল ৭ উইকেট। ১০২ রানে ৮ ও ১৪৪ রানে ৯ উইকেট হারালে শুরু হলো ‘বার্থডে বয়’ টিম মে ও ক্রেইগ ম্যাকডারমটের প্রতিরোধ। প্রায় দেড়ঘন্টা ব্যাপী এই লড়াইয়ের অবসান হলো ওয়ালশের বাউন্সারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতল ‘এক’ রানে। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষুদ্র ব্যবধানে জয়। যদিও অস্ট্রেলীয়দের আপত্তি ছিল, আছে এখনও। সিরিজে এলো সমতা।
দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরে আসা ওয়েস্ট ইন্ডিজ পঞ্চম ও শেষ টেস্টে দেখা দিল সেই পুরনো রূপে। খুনে, আগ্রাসী ও ভয়ঙ্কর। কার্টলি অ্যামব্রোস ১ রানে ৭ উইকেটের ঐতিহাসিক এক স্পেলের জন্ম দিলেন। ইনিংস ও ২৫ রানের জয় দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বজায় রাখল নিরঙ্কুশ আধিপত্য। সেই ১৯৮০ হতে সিরিজ না হারা এবং ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফিটার একচ্ছত্র মালিকানার রেকর্ড রইলো অক্ষুণ্ন। বিশ্বক্রিকেট জানলো, বিশ্বক্রিকেটের অবিসংবাদিত সম্রাটের আসন তখনো অলঙ্কৃত করছে ওয়েস্ট ইন্ডিজই।
এসেছে নতুন সম্রাট, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান…
সময়: ১৯৯৪-৯৫; স্বাগতিক: ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ফলাফল: অস্ট্রেলিয়ার ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়
অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে মার্ক টেলর। অ্যালান বোর্ডারের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যটাকে বিশ্বক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসিত করার দায়ভার তার কাঁধে। প্রথম টেস্টে ‘দশ’ উইকেটের দুর্দান্ত জয় দিয়ে অস্ট্রেলিয়া জানিয়ে রাখলো, ইতিহাস ভিন্ন হতে পারে এবার। প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের আছে। ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফির আগের সিরিজেই দেখা গেছে সেই রূপ। সুতরাং, তখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে।
দ্বিতীয় টেস্ট ড্র হলেও তৃতীয় টেস্টে বোলারদের দাপট। ওয়ালশ ও অ্যামব্রোস মিলে ১৫ উইকেট সাবাড় করলেন। নয় উইকেটের জয় দিয়ে সিরিজে সমতায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চতুর্থ ও শেষ টেস্ট কিংস্টনে, যেখানে ফয়সালা হবে ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফিটার।
অধিনায়ক রিচার্ডসনের সেঞ্চুরির পরও ২৬৫ পর্যন্ত পৌঁছল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অস্ট্রেলিয়ার ৭৩ রানে ৩ উইকেট হারালে মধ্যমাঠে প্রবেশ করেন পাথুরে মুখের স্টিভ ওয়াহ। অপর প্রান্তের সঙ্গী কয়েক মিনিটের ছোট্ট যমজ ভাই মার্ক ওয়াহ। দু’জনের ব্যাটে ২৩১ রানের পার্টনারশিপ। স্টিভ ওয়াহর প্রথম দুইশো, মার্ক ওয়াহর ১২৬; অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ৫৩১। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় পালায় ২১৩ রানে গুটিয়ে গেলে নিশ্চিত হয় অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস ব্যবধানে বিজয়। ফলে প্রায় দুই দশকের বিরতি পেরিয়ে ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফির অস্ট্রেলিয়ায় উড়াল এবং ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের দাপট প্রতাপে আনুষ্ঠানিক ‘দাঁড়ি’ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার নতুন যুগের সূচনা।
অস্ট্রেলিয়ার গৌরবময় অধ্যায়ের যাত্রাপথে…
সময়: ১৯৯৬-৯৭; স্বাগতিক: অস্ট্রেলিয়া; ফলাফল: অস্ট্রেলিয়ার ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ জয়
রিচি রিচার্ডসন শুধুমাত্র একটি সিরিজেই পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন। সেটা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের দাপট-শাসনের মধ্যেই তার নেতৃত্ব ও ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে। তবে জেনে গিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ রাজত্বের সূর্যটা প্রায় অস্তাচলে। দারুণ সব ক্রিকেটার তখনো আছে, তবে কিছু একটা মিসিং যেন! তাছাড়া অন্যরাও এগিয়ে গেছে অনেকটা। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার যে ধারা ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে দুই দশক ধরে বিদ্যামান ছিল, তা আর নেই।
কোর্টনি ওয়ালশের নেতৃত্বে তাসমান পাড়ে ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফি পুনরুদ্ধারে হাজির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অস্ট্রেলিয়া পেয়ে গেছে দুর্দান্ত একটা প্রজন্ম, যারা প্রতিপক্ষকে ছিড়েখুঁড়ে ফেলতে প্রস্তুত। প্রথম দুই টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার লীড ২-০, তৃতীয় টেস্টে ঘুরে দাঁড়ালো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু চতুর্থ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস ও ১৮৩ রানের বিশাল জয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিশ্চিত বুঝলো— এবারও ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফিটা হারিয়ে ফেললো তারা। পঞ্চম ও শেষ টেস্টে সান্ত্বনার জয় পেল সফরকারী দল। ব্রায়ান লারা ও ওয়ালশ-অ্যামব্রোস যেন জানিয়ে দিলেন, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট এখনো মরে যায়নি!
শতাব্দীর শেষ ক্ল্যাসিক
সময়: ১৯৯৮-৯৯; স্বাগতিক: ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ফলাফল: অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে সমতা, ২-২ ড্র
ক্যাপ্টেন্সির ব্যাটন তখন কোর্টনি ওয়ালশ হতে পরিবর্তিত হয়ে ব্রায়ান লারার তরুণ কাঁধে। অস্ট্রেলিয়ারও নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটে গেছে। মার্ক টেলরের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হয়েছেন স্টিভ ওয়াহ, দ্য স্টীল ম্যান। সিরিজটা যেন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার লড়াই। যদি ‘বুনো ওল’ হন স্টিভ ওয়াহ, তাহলে ‘বাঘা তেঁতুল’ হবেন ব্রায়ান লারা।
প্রবল প্রতাপ কোনো সাম্রাজ্যের পতনের পরও কিছুকাল যেমন রাজকীয় স্বভাব অবশেষ রয়ে যায়, বনেদিয়ানার চূড়ান্ত বিনাশ হলেও যেমন রয়ে যায় ঠাটবাঁট, ব্রায়ান লারা ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে যেন তেমন কিছু। ক্রিকেটের রাজপুত্র, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের গৌরবময় সময়ের শেষ উত্তরাধিকার।
প্রথম টেস্টে খুব বাজেভাবে হারল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ৫১ রানে অলআউটও হলো; তা-ও আবার ব্রায়ান লারার ঘরের মাঠ। অধিনায়কের জন্য কী ভীষণ লজ্জা ও বেদনার ব্যাপার! দ্বিতীয় টেস্টে ‘প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ’ জ্যামাইকার কিংস্টনে উপহার দিলেন ‘ক্ল্যাসিক’ ২১৩। সেই ক্ল্যাসিকে ভর দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ফেরাল সমতা। আর পরের টেস্টে তো লারার এক আউটস্ট্যান্ডিং মাস্টারক্লাসে ভর দিয়ে সিরিজে এগিয়েই গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইনিংস। কেউ কেউ অতসব অন্যতম-টন্যতম বলেন না, বলে দেন ‘ইতিহাসের সেরা’। ৩০৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১০৫ রানে নেই ৫ উইকেট, প্রথমে জিমি অ্যাডামসকে সঙ্গী করে ১৩৩ রান জুড়লেন, ২৪৮ রানে ৮ উইকেট হারালে লারার পরের ৫৪ রানের সঙ্গী কার্টলি অ্যামব্রোস। ৩০২ রানে ৯ উইকেট হারালে আরো একটি ‘টাই’ উঁকি দিয়ে যায়, আরো একটি ‘অ্যাডিলেইড ওভাল’ বা ক্ষুদ্রতম ব্যবধানে জয়-পরাজয় মীমাংসার সম্ভাবনা হাতছানি দিয়ে ডাকে। তবে সব ছাপিয়ে ব্রায়ান লারার সপাটে হাঁকানো বাউন্ডারিতে নিশ্চিত হয় ক্যারিবিয়ান-রূপকথা। একই সঙ্গে ব্রায়ান লারার অমরত্বও। স্কোরবোর্ডে মলিন হয়ে পড়ে থাকে গ্লেন ম্যাকগ্রার অদম্য বোলিং।
চার বছর পর ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফির সুবাস নাকে লাগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। সিরিজে এগিয়ে থেকে এবং সুউচ্চ চূড়া ডিঙানোর হিম্মৎ সাথে নিয়ে অ্যান্টিগায় উপস্থিত হয় অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ, চতুর্থ ও শেষ টেস্ট খেলবে দুই দল। স্টিভ ওয়াহ হাল ছাড়ার পাত্র নন, হার মানতে রাজি নন। ব্রায়ান লারার ঝড়ো সেঞ্চুরির পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরাজয় বিশাল ব্যবধানে। দুটো টেস্ট অতিমানবীয় ব্যাটসম্যানশিপ দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উতরে নিয়েছিলেন, এবার ছিলেন খানিকটা উদাসী ও খেয়ালী শিল্পী। ১৫টি চার ও ৩টি ছয়ে ১০০ মিনিটেরও কম সময়ে পূর্ণ করেন সেঞ্চুরি। ৮৪ বলে ঠিক ১০০ রানে আউট হয়ে ফেরেন। সঙ্গীদের আর কেউই তার ব্যাটিংয়ের কিয়দংশ নিয়েও হাজির হন না। ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ললাটে জোটে ১৭৬ রানের বিশাল পরাজয়। ‘ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল’ ট্রফি হস্তগত তো হয়ই না, উলটো ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ভাগ্যকাশ দিনে দিনে ঢেকে যায় কালো মেঘের নিঃসীম চাদরে। কতবার বজ্রপাতসহ বর্ষণ হয়, তারপরও ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট আর সূর্যের মুখ দেখতে পায় না। মেঘ কেটে আলোর দিন আসে না আর।
উপসংহার
একটি সাম্রাজ্য যেমন তিলে তিলে ধ্বংস হয়, ঠিক তেমনি অন্যটি গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। বিংশ শতকের গোটা নব্বই দশক ছিল তেমনই। একদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিপত্তি ক্ষয়িষ্ণু থেকে ক্ষয়িষ্ণুতর হয়েছে, অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট মহীরূহ হয়ে বেড়ে উঠেছে ডাল-শাখা-প্রশাখা চারদিক ছড়িয়ে। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর যেমন বিরল প্রজাতির দেখা মেলে, সেরকমই ব্রায়ান লারা ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে। অসম্ভব প্রতিভার বলে বহুবার মনে করিয়েছেন, একসময় ক্রিকেটটা শাসন করতো ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটই। পরিকল্পনাহীনতা, কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্য, দ্বীপপুঞ্জের ক্রিকেটারদের ঐক্যের অভাব, বা একসুতোয় গাঁথার মতো চরিত্রের অনুপস্থিতি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটকে দিনে দিনে নিয়ে গেছে অতলের গহ্বরে। আর সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট ছক-আয়োজন, ক্রিকেটার পরিচর্যা এবং একই সময়ে একঝাঁক বিশ্বমানের ক্রিকেট চরিত্রের উপস্থিতি… সব মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট এগিয়ে গেছে তরতর করে।
দুটো দলের দুইমুখী যাত্রার পরতে পরতে নানান শিক্ষা ও নির্দেশনা বিদ্যামান। আপনি যদি সুউচ্চ চূড়া ছুঁতে চান, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার মতো হতে হবে অদম্য ও নিয়মতান্ত্রিক। আর যদি উদাসীন ও বর্তমান নিয়ে থাকেন তাহলে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের পরিণতিই আপনার ভবিষ্যৎ। এখন পছন্দ আপনার। তবেই বলুন, ক্রিকেট কি তবে আর শুধু খেলা রইলো? জীবনদর্শনও নয় কি?