অল্প কিছুদিন পরেই বিশ্বকাপ আসর, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে না, তবুও বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে সারা দেশ। ক্যাম্পাসের আড্ডায়, চায়ের দোকান, এমনকি অফিসের বিরতিতেও জমে উঠে বিশ্বকাপ বিতর্ক। ফুটবলের নিয়মিত দর্শক তো বটেই, ফুটবলের তেমন ভক্ত নয়, তারাও বিশ্বকাপের সময়ে ঝড় তোলে আড্ডায় কিংবা বিশ্বকাপ আলোচনায়। বিশ্বকাপকে ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ সমর্থক থেকে শুরু করে ফুটবল কিংবদন্তিদের মধ্যেও। বিশ্বকাপ নিয়ে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে জিকিউ (GQ) ম্যাগাজিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পর্তুগিজ কোচ হোসে মরিনহো।
ক্লাব ফুটবলের ব্যস্ততা শেষে মরিনহোও জমেছেন বিশ্বকাপের আমেজে। সাক্ষাৎকারে মরিনহো কথা বলেছেন কেন বিশ্বকাপ বিশেষ কিছু, বিশ্বকাপের প্রিয় মুহূর্ত, বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়, কেন এখনো পর্তুগাল দলের কোচের দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত নন সহ আরও নানাবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে। পাঠকদের বিশ্বকাপ নিয়ে বিশিষ্ট ফুটবল ব্যক্তিত্বদের ভাবনার সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস হিসেবে আজকে তুলে ধরা হলো ‘স্পেশাল ওয়ান’ মরিনহোর সাক্ষাৎকার।
জিকিউ: বিশ্বকাপ কি এখনো এমন একটি টুর্নামেন্ট, যা আপনাকে আলোড়িত করে?
মরিনহো: হ্যাঁ, অবশ্যই। ফুটবলপ্রেমী সবাই বিশ্বকাপ নিয়ে উদ্দীপিত। আমি বলি যে, বিশ্বকাপ ফুটবলের চেয়েও বেশি কিছু। আমার জন্য, সামাজিক পর্যায়ে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক গেমস বিশ্বের সবচেয়ে চমৎকার দুটি আসর এবং আমি এমনটাই মনে করি। যদিও আমি বিশ্বাস করি না যে, এই টুর্নামেন্টে সেরা ফুটবল খেলা হয়। আমার কেন এটা মনে হয়? কারণ ক্লাব ফুটবলে খেলোয়াড়দের সাথে কাজ করার জন্য আপনি অনেক সময় পাবেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক ফুটবলে এই সুযোগটা নেই।
জিকিউ: এবারে টুর্নামেন্ট কে জিততে পারে বলে মনে করেন আপনি?
মরিনহো: মেসি ও রোনালদোর মতো খেলোয়াড়েরা এতটাই দুর্দান্ত যে, তারা নিজেদের দলকে কাগজে-কলমের যতটা, তার চেয়েও সেরা করে তুলতে পারে। সেজন্য আমি মনে করি আর্জেন্টিনা ও পর্তুগাল ভালো করতে পারে। ম্যানেজার টিটের কারণে ব্রাজিল কৌশলগত ও রক্ষণের দিক দিয়ে ভালো খেলতে পারে, কিন্তু এখনো তাদের সহজাত ব্রাজিলিয়ান প্রতিভা আছে। তারা হবে দেখার মতো একটি দল। ইউরোপিয়ান দলগুলোর মধ্যে, বাছাইপর্বে স্পেন সত্যিই শক্তিশালী ছিলো। ভালো অভিজ্ঞ ও মানসম্মত খেলোয়াড়ের সমন্বয় আছে তাদের। কিন্তু আপনি কখনোই জানেন না… বিশ্বকাপে সবসময়ই একটি বিস্ময় থাকতেই পারে।
জিকিউ: আপনার মতে বিশ্বকাপের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় কে?
মরিনহো: আমি এই উত্তর দিতে পারি না। এটা আসলে খুবই কঠিন। আমার জন্ম ১৯৬৩ সালে, তাই ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ আমার জন্য খুবই দ্রুত চলে আসে, কিন্তু আমি আমার ফুটবল ইতিহাস জানি এবং তৎকালীন সময়ে স্যার ববি চার্লটন এবং ইউসেবিওর মতো খেলোয়াড়েরা সেরাদের একজন ছিলেন। ১৯৭০ সাল থেকে সকল দল ও খেলোয়াড়দের আমার মনে আছে এবং বেছে নেওয়ার মতো অনেক বেশি খেলোয়াড় রয়েছে… যেমন- বেকেনবাওয়ার, পেলে, ম্যারাডোনা, ব্রাজিলিয়ান রোনালদো। আসলে অনেকেই আছে এবং প্রত্যেক চার বছরে একজন নতুন তারকার উত্থান হয়। ভিন্ন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে তুলনা করা আমার জন্য অসম্ভব।
জিকিউ: আপনি বলেছিলেন আপনার বাবা-মা’র মনে আছে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পর্তুগাল ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হওয়া ম্যাচটি দেখেছিলেন। কী মনে হয়, পর্তুগাল এর চেয়ে বেশি দূর কখনো যেতে পারবে?
মরিনহো: আচ্ছা, ২০০৬ সালে পর্তুগাল আবারো সেমিফাইনালে উঠেছিলো এবং আমরা ২০১৬ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপও জিতেছিলাম। অর্থাৎ আমরা বিশ্বের সেরা দলগুলোর একটি। পর্তুগাল হচ্ছে এমন এক দেশ যেখানে নতুন প্রতিভা সবসময়েই উঠে আসছে এবং আমার মনে হয় দুই বছর আগের চেয়ে বর্তমান জাতীয় দলে আরও ভালো খেলোয়াড় আমাদের রয়েছে। তাই পর্তুগাল যেকোনো কিছু করতে পারে। আমরা কি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারবো? আমি তা বলার সাহস করছি না, কিন্তু আমাদের দিনে যে কাউকে হারাতে পারি।
জিকিউ: আপনার ফুটবল ক্যারিয়ার গড়তে অনুপ্রাণিত করেছে এমন কোনো বিশ্বকাপ মুহূর্ত কি আছে?
মরিনহো: আমি ঐ মুহূর্তের কথা বলব যখন দলের অধিনায়ক কাপটি উত্তোলন করে এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও বিশ্বকাপ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শিরোপা। আপনি যখন শিশু, অথবা তরুণ ফুটবলার, এমনকি একজন তরুণ কোচ এবং আপনি যখন একজন খেলোয়াড়কে বিশ্বকাপ তুলে ধরতে দেখবেন, তখন আপনি তা নিয়ে এবং এই পর্যায়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবেন। যখন আমি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি তুলে ধরেছিলাম, তখন এই ব্যাপারে অনেক চিন্তা করেছিলাম।
জিকিউ: টিভিতে এত ফুটবল এবং ক্লাব ফুটবলের একটি উচ্চপর্যায় থাকার পরেও বিশ্বকাপ কি এখনো “বিশেষ টুর্নামেন্ট”?
মরিনহো: হ্যাঁ, কারণ এটি এখনো স্বতন্ত্র। এটি দেশগুলো জন্য, ভক্তদের জন্য বিশেষ কিছু এবং এটি গ্রীষ্মকালে অনুষ্ঠিত হয়। আমি সবসময় মনে করি, যখন জাতীয় দল বিশ্বকাপে খেলছে তখন গোটা দেশ থেমে যায়। আমার মনে হয়, বিশ্বকাপে খেলছে এমন কোনো দেশের রাস্তা দিয়ে যদি আপনি হাঁটতে থাকেন, তখন পুরো একটি দোকান চুরি করে নিতে পারবেন এবং কেউ খেয়ালও করবে না। বিশ্বকাপ এমনই এক আশ্চর্যজনক টুর্নামেন্ট যেখানে ফুটবলের ভক্ত নয় এমন লোকও তাদের জাতীয় দলকে ভালোবাসে।
জিকিউ: বাসেলে অনুষ্ঠিত ১১-১১ তে শেষ হওয়া হাবলট “ম্যাচ অব ফ্রেন্ডশিপে” একটি দলের কোচ ছিলেন। আপনি কি মনে করেন উসাইন বোল্টের সেরাটা বের করে আনতে পেরেছিলেন?
মরিনহো: [হাসি] ম্যাচের পূর্বেই আমরা একমত হয়েছিলাম যে, ম্যাচটি ড্র হতে হবে। উসাইন বোল্টের জন্য মাঠের আকার ছোট ছিলো মনে হয়। মনে হয়, এটি পরিকল্পনা করা হয়েছিলো বয়স্ক খেলোয়াড়দের কথা মাথায় রেখে যারা খুব একটা দৌড়াতে পারে না, কিন্তু অনেক দক্ষতা রয়েছে তাদের। আমি মনে করি, উসাইনের সেরা শক্তিমত্তা তার শারীরিক সক্ষমতা, গতি এবং আগ্রাসী গতিবিধি। আসলে সে এগারোজনের সাথে পূর্ণ আকারের মাঠে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।
জিকিউ: কয়েক বছর পূর্বে বলেছিলেন যখন ক্লান্ত হয়ে যাবেন তখন পর্তুগাল দলের দায়িত্ব নিতে পারেন আপনি… ক্লান্তির তেমন কাছাকাছি আছেন কি?
মরিনহো: না, না! একদমই নয়। ক্লাবের কোচ হওয়াই আমার কাজ বলে মনে করি। কারণ প্রতি সপ্তাহে আমার ম্যাচ খেলা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। আমি বলবো যে, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ক্লান্ত হওয়ার পথে আমি আরও অনেক দূরে রয়েছি।
ফিচার ইমেজ- gq-magazine.co.uk