লোকে বলে, অর্থ নাকি একজন মানুষের চরিত্রসহ তার চাওয়া-পাওয়ার ধরনকেও বদলে দেয়। লোকমুখে বলা এই কথাটি বাস্তব জীবনে যে কতটা সত্য, তা সবাই বেশ ভালোই জানে। কিন্তু এই কথাটি যদি ফুটবলের সাথে মেলানো যায়? বিশেষ করে স্প্যানিশ কোচ পেপ গার্দিওলার সাথে?
বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ফুটবলের দলবদল প্রক্রিয়া একদম বদলে গেছে। বর্তমানে ‘অর্থ যার খেলোয়াড় তার’ নীতি মেনে অনেক ক্লাবই ইচ্ছামতো খেলোয়াড় দলে ভেড়াচ্ছে। এই ধরনের ক্লাবের ভেতর সবচেয়ে উপরে ভেসে ওঠে প্রিমিয়ার লিগের ম্যানচেস্টার সিটির নাম। সৌদি আরবের অন্যতম ধনকুবের মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এই ক্লাব কিনে নেবার পর, এবং পরবর্তীতে পেপ গার্দিওলাকে কোচ হিসেবে আনার পর ইউরোপের মার্কেটে দেদারসে অর্থ উড়িয়ে যাচ্ছে সিটিজেনরা।
নতুন ক্লাবে এসে পেপ গার্দিওলাকে দল গোছাতে খরচ করেছেন উদারহস্তে। আসলে তিনি এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তার একাদশে যেখানে তিনি খুঁত খুঁজে পেয়েছেন, সেখানেই বিপুল অর্থের বিনিময়ে খেলোয়াড় উড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। তাই বর্তমানে এক ক্লাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ খরচ করা কোচ হিসেবে কোনো যুক্তিতর্ক ছাড়াই তাকে অ্যাখ্যায়িত করা যায়।
কোচ হিসেবে তার নামডাক শুরু বার্সেলোনায়। সেখানে যত শিরোপা জেতা যায়, তার সবই জিতে তিনি পাড়ি জমান বায়ার্ন মিউনিখে। ৫ বছরে বার্সেলোনায় পেপ গার্দিওলা খরচ করেছেন মোট ৩১৫.১ মিলিয়ন ইউরো। বার্সেলোনায় সর্বোচ্চ খরুচে ট্রান্সফার ছিলেন সুইডিশ স্ট্রাইকার জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। এছাড়া আদ্রিয়ানো, দানি আলভেজ, সেইডু কেইটা, জেরার্ড পিকে, মাশ্চেরানো ও অ্যালেক্সিস সানচেজের মতো খেলোয়াড় তিনিই এনেছিলেন বার্সেলোনায়। বায়ার্ন মিউনিখে গিয়ে গার্দিওলা খরচ করলেন মাত্র ১৮৮.৩ মিলিয়ন ইউরো, যা বার্সেলোনায় খরচ করা অর্থ থেকে অর্ধেকের একটু বেশি। যদিও সে সময় বায়ার্ন মিউনিখের খরুচে স্বভাবও তৈরি হয়নি। বায়ার্ন তার আমলে সবচেয়ে বেশি খরচ করেছিল আর্তুরো ভিদাল ও মারিও গোৎজেকে কিনতে। এছাড়াও ডগলাস কস্তা, মেধি বেনাতিয়া, জাবি আলোনসো, কিংসলে কোম্যান বা জশুয়া কিমিখকে কিনতে তাদের তেমন অর্থ খরচ হয়নি বললেই চলে।
এই দুই ক্লাবের হয়ে যা জেতা যায়, প্রায় সবই জিতেছেন গার্দিওলা। এগুলো জিততে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা তার লাগেনি, বার্সেলোনার সেরা ট্রায়ো ক্লাবে আগে থেকেই মজুদ ছিল। আর বাভারিয়ানদের দায়িত্ব নিয়ে তিনি পেয়েছিলেন রোবেন-রিবেরির মতো জুটিকে। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ না জিততে পাবার আক্ষেপ বাভারিয়ানদের হয়ে পিছু ছাড়লো না। প্রিমিয়ার লিগে এসে অগত্যা তিনি তার স্বভাব একবারেই পরিবর্তন করে ফেললেন। ইতিহাদে এসে দেখলেন, তার প্রত্যাশানুযায়ী খেলোয়াড় ক্লাবে নেই। তাই ম্যানসিটিকে নিজের চাহিদামতো বদলাতে তিনি সরাসরি অর্থের আশ্রয় নিলেন। এখানেই তিনি হয়েছেন সবচেয়ে বেশি সমালোচিত। তার অধিকাংশ ট্রান্সফার যেমন কাজে দেয়নি, তেমনই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের পরও যেটুকু সাফল্য আসা উচিত ছিল, তা আসেনি। কারণ, টানা দুবার প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা ঘরে তুললেও ম্যানচেস্টার সিটি কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মঞ্চে বরাবরই ব্যর্থ।
এবার তার ট্রান্সফারগুলোর দিকে নজর দেয়া যাক। গার্দিওলা ‘১৬-‘১৭ মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্ব নেবার পর বিগত মৌসুমের একাদশকে রীতিমতো চোখের পলকে বিদায় করে দিয়েছেন। দীর্ঘদিনের সিটিজেনদের গোলবারের সঙ্গী জো হার্টকে বিদায় করে দিয়ে পেপ কেনেন ক্লাদিও ব্রাভোকে। বার্সেলোনা থেকে তাকে কিনতে সিটিজেনদের গুনতে হয়েছিল ১৫.৬ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু প্রথম সিজনের দুর্বল গোলকিপিংয়ের ফলে গার্দিওলা তার প্রতি আস্থা পুরোদমে হারিয়ে ফেলেন। তাই পরের মৌসুমেই প্রায় ৪০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক এডারসনকে দলে ভেড়ায় ম্যানসিটি।
গার্দিওলা আমলের প্রথমদিকে আরেকটি সাইনিং ছিল স্প্যানিশ উইঙ্গার নলিতো। নতুন ক্লাবের হয়ে প্রথম তিন ম্যাচে তিন গোল করে দারুণ শুরু করেন তিনি। কিন্তু এরপরই পতনের শুরু। নলিতোর ক্রমাগত অফ ফর্মের ফলে গার্দিওলা পরবর্তীতে তাকে সেভাবে আর সুযোগও দেননি। মাত্র এক মৌসুম পরই ১৩.৮ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে আনা খেলোয়াড়কে তারা সেভিয়ার কাছে বিক্রি করে ৭.৯ মিলিয়ন ইউরোতে।
প্রথম মৌসুমের আরও চারটি গুরুত্বপূর্ণ সাইনিং ইল্কায় গুন্দোগান, লেরয় সানে, জন স্টোনস ও গ্যাব্রিয়েল জেসুস। এই চারজনকে কিনতে সিটি খরচ করেছিল প্রায় ১৬০ মিলিয়ন ইউরো। প্রথমদিকে বেশ ভালো শুরু করলেও জেসুসকে এখনও আগুয়েরোর যথাযথ বিকল্প হিসেবে ভাবা হয় না। গুন্দোগানের ক্ষেত্রেও একই কথা, বয়সের কারণে তার দিন প্রায় ফুরিয়েছে। আর সানে সিটিজেনদের হয়ে ভালো খেলে আসলেও ক্লাবের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তাকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে। আর জন স্টোনস? চোট আর নিদারুণ বাজে ফর্মের কারণে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে কেনা এই ডিফেন্ডার এখন দলের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছেন।
দ্বিতীয় মৌসুমে গার্দিওলার দলে আসেন মোট ১৫ জন খেলোয়াড়। এদের কিনতে ক্লাবটি খরচ করে ৩০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি। এবং সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, এই ১৫ জন থেকে দলে হাতগোনা কয়েকজন নিয়মিত সুযোগ পেয়েছেন। আবার ফিলিপ স্যান্ডলার, আন্তে পালাভের্সা, জ্যাক হ্যারিসন বা ডগলাস লুইজের মতো কয়েকজন খেলোয়াড় আছেন, যারা সেভাবে মূল একাদশে সুযোগই পাননি।
সেই বছর গার্দিওলা যাকে চেয়েছেন, তাকেই পেয়েছেন। যেকোনো মূল্যে সেই মৌসুমে শিরোপা জিততে চেয়েছিলেন তিনি। কোচের মনোভাব বুঝে ক্লাবের মালিকও অর্থ খরচ করে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এজন্য রিয়াদ মাহরেজকে সিটিজেনরা কিনেছে প্রায় ৬৮ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে। এছাড়া আরেক উইঙ্গার বার্নাডো সিলভাকে মোনাকো থেকে কেনা হয়েছিল ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে।
তারা এ পর্যন্ত সুযোগ পেয়ে আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আক্রমণের জন্য চারজন বিশ্বমানের উইঙ্গার কি খুব বেশি না? বার্নাদো, সানে, স্টার্লিং ও মাহরেজ ইউরোপের যেকোনো ক্লাবের প্রথম পছন্দের উইঙ্গার হবার যোগ্য। তাই সবাইকে সুযোগ দেবার জন্য পেপ গার্দিওলা ব্যবহার করছেন তার বিখ্যাত ‘রোটেশন’ পদ্ধতি। অন্য ক্লাব যেখানে বদলি হিসেবে খেলানোর জন্য কিছুটা আনকোরা খেলোয়াড়ের কথা চিন্তা করে, সেখানে গার্দিওলা চারজন বিশ্বমানের উইঙ্গার নিয়ে খেলানোর সুযোগ পেয়েছেন। এমন সুবিধা পেয়েও সিটিজেনদের হয়ে তার সর্বোচ্চ সাফল্য ঐ প্রিমিয়ার লিগ। ইউরোপের মঞ্চে, প্রতিপক্ষের মাঠে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আরাধ্য শিরোপা তাকে হারাতে হয়েছে বারবার।
সিটির পুরাতন রক্ষণকে সম্পূর্ণরূপে বিদায় করে গার্দিওলা লাপোর্ত, ওয়াকার, দানিলো ও মেন্ডিকে দিয়ে একদম নতুন রক্ষণ তৈরি করেন। এখানে ক্লাবটির খরচ হয় ১৫০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি। তবে ৬৫ মিলিয়ন ইউরোর মতো চড়া দামে আইমেরিক লাপোর্তকে কেনাটা সিটির জন্য সবচেয়ে লাভজনক ছিল। দানিলো এক মৌসুমের বেশি টেকেননি, ওয়াকার বর্তমানে বুড়িয়ে গেলেও দলের ডানপাশে গত দুই বছর একাই রাজত্ব করেছেন। দারুণ শুরু করেছিলেন ফরাসি লেফটব্যাক মেন্ডিও। কিন্তু সারা বছর ইনজুরির সাথে লড়াই করে ও অদ্ভুত জীবনযাপনের ফলে মেন্ডি তার স্থান থেকে বেশ দূরে সরে গেছেন। আর গার্দিওলা সেই স্থান পূরণ করেছেন কখনও তরুণ মিডফিল্ডার জিনচেঙ্কোকে লেফটব্যাক হিসেবে খেলিয়ে, নয়তো রাইটব্যাক ক্যানসেলোকে রক্ষণের ডানপাশে এনে।
গত মৌসুমের কথা। জুভেন্টাসের পর্তুগিজ ফুলব্যাক জোয়াও ক্যানসেলোর সাথে সিটি দানিলোর একটি অদল-বদল চুক্তি করলো, যেখানে দানিলোকে ৩৭ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করে ৬৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে দ্বিতীয় পছন্দের রাইটব্যাক দলে আনে সিটিজেনরা। আগে থেকেই সে পজিশনে ওয়াকার থাকার জন্য এখন পর্যন্ত ক্যানসেলো সেভাবে সুযোগ পাননি।
গত মৌসুমের আরও একটি চড়া মূল্যের সাইনিং হচ্ছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ থেকে ৭০ মিলিয়ন ইউরো রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করে দলে ভেড়ানো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রদ্রি। যদিও ক্যানসেলোকে কিনেই গার্দিওলা তার পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে খেলোয়াড় কিনতে ১ বিলিয়ন ইউরোর মতো বিশাল অঙ্ক স্পর্শ করে ফেলেছিলেন, রদ্রির ইতিহাদে আসায় সে অঙ্ক আরও বড় রূপ ধারণ করেছে, আর কিছু নয়!
সবই শোনা হলো। কিন্তু… এত খেলোয়াড় কিনে ম্যানসিটি শেষ পর্যন্ত জিতেছে কী? ‘১৭-‘১৮ ও ‘১৮-‘১৯ মৌসুমে সিটিজেনরা টানা দুবার লিগ শিরোপা জিতেছে। সিটির হয়ে এটাই গার্দিওলার সবচেয়ে বড় সাফল্য। এছাড়া ‘১৮-‘১৯ মৌসুমে এফএ কাপ, তিনবার ইংলিশ লিগ কাপ ও দুবার ইংলিশ সুপার কাপ আছে ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে পেপ গার্দিওলার ৫ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে। লিগে সব শিরোপা জিতেও গার্দিওলা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ। ২০১১ সালের পর থেকে শিরোপা তুলে ধরা তো দূরে থাক, ২০১৭ সাল থেকে আগাগোড়া শক্তিশালী একটি একাদশ পেয়েও তার দল কোয়ার্টার ফাইনালই পার করতে পারেনি!
শক্তিশালী একাদশের পাশাপাশি ঈর্ষা জাগানো বেঞ্চ বা কোচের ট্যাকটিক্স, কোনোটিই কাজে আসেনি ইউরোপ-সেরা হবার লড়াইয়ে। আর গার্দিওলা এই চক্রে আটকা পড়ে আছেন ২০১১ সালের পর থেকে। অদূর ভবিষ্যতে তিনি এই চক্র ভেদ করে বের হতে পারেন কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে নিশ্চয়তা একটা আছে বটে, প্রতি মৌসুমে চড়া দামে খেলোয়াড় কিনতে তার জুড়ি মেলা ভার। সেই ধারা বজায় রেখে নতুন মৌসুমে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি খরচ করে কিনেছেন নতুন চার খেলোয়াড়- রক্ষণে ইয়ান কৌতো, নাথান আইক ও রুবেন ডিয়াস; অন্যজন উইঙ্গার ফেনান তোরেস। এরপরও ডেভিড সিলভার উত্তরসূরি ও নতুন লেফটব্যাক খুঁজে চলেছে সিটিজেনরা।
বিলিয়ন ডলার ইউরো তো স্পর্শ করা হলো। এবার দেখা যাক, পেপ গার্দিওলা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামেন!