দেশের হয়ে জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে বসতে পারা, বড় বড় ক্রিকেটারদের সাথে ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করা একজন পেশাদার ক্রিকেটারের জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্তের একটি। কিন্তু যদি এই মুহূর্তটা নিজের ভাইয়ের সাথে উপভোগ করা যায় তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। ক্রিকেট ইতিহাসে এমন অনেক ভ্রাতৃদ্বয় বা ক্ষেত্রবিশেষে ভ্রাতৃত্রয় রয়েছেন যারা নিজ দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সম্মানের সাথে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আজকের দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে থাকছে এমন কিছু জুটিকে নিয়ে আলোচনা।
পাঠান ভ্রাতৃদ্বয় (ইউসুফ ও ইরফান)
ইরফান পাঠান ২০০৭ এর ওয়ার্ল্ড টি-২০ জয়ী ভারত দল ও ইউসুফ পাঠান ২০১১ বিশ্বকাপজয়ী ভারত দলের সদস্য। একই পরিবারে দুটি পৃথক আইসিসি টুর্নামেন্টজয়ী সদস্য।
ইরফান পাঠান ১৯ বছর বয়সেই ভারত জাতীয় দলে জায়গা পান। সেসময় তার অসাধারণ পারফরম্যান্স আর বল হাতে সুইং দেখে তাকে তুলনা করা হচ্ছিল ওয়াসিম আকরামের সাথে। ২০০৬ সালে করাচিতে প্রথম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ওভারে হ্যাটট্রিক করেন ইরফান। ২৯ টেস্টে ১০২ উইকেটের পাশাপাশি ১,১০৫ রান করেন। ১২০ ওয়ানডেতে ১৭৩ উইকেটের পাশাপাশি রান করেন ১,৫৪৪। এছাড়া ভারতের হয়ে ২৪ টি-২০-ও খেলেছেন ইরফান।
ইরফানের বড় ভাই ইউসুফ ভারতের হয়ে ৫৭টি ওয়ানডে ও ২২ টি-২০ খেলেছেন। ইউসুফ তার প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করার পথে নিউজিল্যান্ডের করা ৩১৫ রানের কঠিন স্কোর তাড়া করে ভারতকে জেতান। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) তিনি বর্তমানে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে খেলছেন।
ইকবাল ভ্রাতৃদ্বয় (নাফিস ও তামিম)
একসাথে খেলা হয়নি দুজনের। তবে উঠে এসেছেন পুরোদস্তুর ক্রিকেটীয় পরিবার থেকে। চাচা আকরাম খান বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব।
ডানহাতি নাফিস ইকবাল খান বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন ১১ টেস্ট ও ১৬ ওয়ানডে। একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিটি ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে যার সাহায্যে বাংলাদেশ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ড্র করে প্রথমবার টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ পায়।
নাফিসের ছোট ভাই তামিমের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগমন ঘটে জহির খানকে পোর্ট অফ স্পেনের গ্যালারিতে আছড়ে ফেলে। ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ বিশ্বকাপে ৫৩ বলে ৫১ রানের ইনিংসের পর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তামিমকে। একে একে খেলেছেন ৪টি বিশ্বকাপ ও ৬টি ওয়ার্ল্ড টি-২০। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রায় সব ব্যাটিং রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন তিনি।
তিন ফরম্যাটেই সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে তিন ফরম্যাটে শত রান করেন তামিম। বাংলাদেশি কোনো ক্রিকেটারের পক্ষে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণীর স্কোরের মালিকও তামিম। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক মাঠে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও তার দখলে।
মরকেল ভ্রাতৃদ্বয় (এলবি ও মরনে)
৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার দানবীয় ফাস্ট বোলার মরনে মরকেল খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সকল ফরম্যাটে। ৮৬ টেস্ট, ১১৭ ওয়ানডে ও ৪৪ টি-২০-তে দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। টেস্টে ৩০৯, ওয়ানডেতে ১৮৮ ও আন্তর্জাতিক টি-২০-তে ৪৭ উইকেট নিয়েছেন তিনি। ২০১২ সালে মরনে মরকেল, ডেল স্টেইন ও ভারনন ফিল্যান্ডারের সমন্বয়ে গড়া পেস আক্রমণকে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বকালের সেরা বলে আখ্যা দেন অ্যালান ডোনাল্ড।
মরনের ভাই, জোহানে এলবার্টাস মরকেলও খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে। লোয়ার মিডল অর্ডারে বিধ্বংসী ব্যাটিং এবং ডানহাতি ফাস্ট বোলিংয়ের জন্য পরিচিত ‘এলবি’ দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১ টেস্ট ও ৫৮টি ওয়ানডে খেলেছেন।
ও’ব্রায়েন ভ্রাতৃদ্বয় (নায়েল ও কেভিন)
২০১১ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড বনাম আয়ারল্যান্ড ম্যাচ। ক্রিকেটপ্রেমীরা কখনোই ভুলতে পারবে না কীভাবে গোলাপি চুলের কেভিন ও’ব্রায়েন ইংল্যান্ডের বাঘা বাঘা বোলারদের বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। ৫০ বলে শতক তুলে নেয়া কেভিন সেদিন থেমেছিলেন ১১৩-তে। অবিশ্বাস্য এক জয় আর অবিস্মরণীয় অঘটনের জন্ম দিয়েছিলেন সেদিন। বিশ্বকাপে দ্রুততম শতকের রেকর্ডটা আজও অক্ষুণ্ন। পাকিস্তানের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলের টেস্ট অভিষেকে দলের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে শতক হাঁকান কেভিন। আয়ারল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন তিনি।
তার বড় ভাই নায়েলও দীর্ঘ সময় উইকেট সামলেছেন। আয়ারল্যান্ডের হয়ে ১০৩ ওয়ানডে ও ৩০টি আন্তর্জাতিক টি-২০ খেলেছেন নায়েল। দলের অভিষেক টেস্টেও গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে ছিলেন। এই টেস্টের পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে যান তিনি।
পান্ডিয়া ভ্রাতৃদ্বয় (হার্দিক ও ক্রুনাল)
লোয়ার মিডল অর্ডারে বিধ্বংসী ব্যাটিং, এক্সপ্রেস পেস বোলিং, অসাধারণ ফিল্ডিং- কমপ্লিট প্যাকেজ বলা যায় হার্দিক পান্ডিয়াকে। ভারতের হয়ে তিন ফরম্যাটেই খেলা এই অলরাউন্ডার চতুর্থ ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে অভিষেকেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পান। ভারতের হয়ে ১১ টেস্ট, ৪৫ ওয়ানডে আর ৩৮টি টি-২০ খেলেছেন তিনি। আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলছেন হার্দিক।
ছোট ভাই হার্দিকের মতো ক্রুনাল পান্ডিয়াও আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলেন। বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার আর মিডল অর্ডারে ব্যাট করা এই আগ্রাসী ব্যাটসম্যান ভারতের হয়ে খেলেছেন ১১টি আন্তর্জাতিক টি-২০।
লি ভ্রাতৃদ্বয় (শেন ও ব্রেট)
অস্ট্রেলিয়ার দোর্দন্ড প্রতাপশালী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন ব্রেট ‘বিঙ্গা’ লি। খেলোয়াড়ি জীবনে ব্রেট লি ছিলেন তার সময়ের অন্যতম দ্রততম ফাস্ট বোলার। তার করা ১৬১.১ কিলোমিটার/ঘন্টা বেগের ডেলিভারিই তার গতির পরিচায়ক। টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ বলেই ভারতের সাদাগোপ্পান রমেশকে আউট করেন ব্রেট। টেস্ট অভিষেকেই ৫ উইকেট নেয়ার কীর্তি অর্জন করেন তিনি। ২০০৩ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২ উইকেট নেন ব্রেট লি। সেই আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। ৭৬ টেস্টে ৩১০ ও ২২১ ওয়ানডেতে ৩৮০ উইকেট নেন ব্রেট লি।
তার বড় ভাই শেন লি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৪৫ ওয়ানডে খেলেছেন। রান করেছেন ৪৭৭ ও উইকেট পেয়েছেন ৪৭টি।
পোলক ভ্রাতৃদ্বয় (গ্রায়েম ও পিটার)
গ্রায়েম পোলককে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সেরা ক্রিকেটার এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান মানা হয়। ২৩ টেস্ট ম্যাচে ৬০ গড়ে ৭ শতকের সাহায্যে ২,২৫৬ রান করেন গ্রায়েম পোলক। ১৯৯৯ সালে তিনি বিংশ শতাব্দীর সেরা দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে আইসিসির হল অফ ফেমেও জায়গা পান গ্রায়েম।
তার বড় ভাই পিটার পোলক ছিলেন একজন ফাস্ট বোলার। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ২৮ টেস্টে প্রতিনিধিত্ব করে উইকেট পেয়েছেন ১১৬টি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরো অনেক ভ্রাতৃদ্বয় বা ভ্রাতৃত্রয় খেলেছেন। সবার গল্প একদিনে বলা হয়তো সম্ভব নয়। তবে শেষটা করব একটা ব্যতিক্রমী জুটিকে দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার জেমস প্যাটিনসনকে ভালো করেই চেনেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। কিন্তু তার ভাই ড্যারেন প্যাটিনসনকে ক’জন চেনেন? আপনার চোখ কপালে উঠবে যখন জানবেন- ড্যারেন প্যাটিনসন ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলেছেন! জ্বি, ২০০৮ সালে রায়ান সাইডবটমের চোটের সুবাদে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক হয় ড্যারেনের। তার একাদশে অন্তর্ভুক্তিতে তুমুল সমালোচনা হয়। স্যার ইয়ান বোথাম তো বলেই দেন, “এটা ছিল অত্যন্ত অযৌক্তিক ও বোকার মতো সিদ্ধান্ত।” আর কখনোই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি ড্যারেন।