সেদিনের কান্নায় ছিল ‘চোকার্স’ তকমার লজ্জা

“Auckland Iden park is hosted so many great sporting encounters.”

ম্যাচ শুরুর পূর্বের দৃশ্য। টিভি পর্দায় ভেসে আসছে সাইমন ডুলের কণ্ঠস্বরে এই লাইনটা। কিন্তু এই উত্তাপ ছড়ানো কণ্ঠের শব্দগুলো যে সেদিন এভাবে অন্য সব ম্যাচকে ছাড়িয়ে যাবে, এবি ডি ভিলিয়ার্স কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন? ডি ভিলিয়ার্স ‘হেড’ বললেন, ম্যাচ রেফারি ডেভিড বুন জানালেন, ‘ইট’স হেড’। টস জয়ের খবরে ব্যাটিং নিলেন এবি। তখনও আত্মবিশ্বাসের চিহ্ন চোখেমুখে। ৪৩তম ওভারের পঞ্চম বলটা যখন গ্রান্ট এলিয়টের ব্যাটে নিঃশ্বাস ফেলে নিউ জিল্যান্ডের বিজয় নিয়ে লং-অন দিয়ে গ্যালারির দিকে ছুটছে, ডি ভিলিয়ার্সের মাথায় হাত… তিনি যে তখন কাঠিন্যে মোড়ানো পৃথিবীর নিঃসঙ্গ বাসিন্দা!

Image Credit: Anthony Au-Yeung-IDI

সাউদির আউটসুইঙ্গিং প্রথম বলটা খুব ভালো ডিফেন্স করলেন হাশিম আমলা। আমলার ডিফেন্স থেকে আসন্ন কোনো আশংকার আঁচ পাওয়া যায়নি। প্রথম ওভার শেষে টিভি পর্দায় স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকা ০-০। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে ট্রেন্ট বোল্ট যেন রীতিমতো ডি ককের ‘সাক্ষাৎ যমদূত’ হয়ে উপস্থিত হলেন। একেকটা ইনসুইং, আউটসুইং ডি ককের ব্যাটের কাছ দিয়ে বিষাক্ত ছোবল মারার ভঙ্গিমা করে বেরিয়ে গেল। যে দুটো ছোবল দিল, সে দুটো অবশ্য উল্টো খরচা করে গেছে আট রান। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে মোক্ষম যে ছোবলটা মারতে পারেনি বল, সেটা মারতে সময় নিল পরবর্তী নয় বল। দশম বলে ছোবল, বিষাক্ত সুইংয়ের সাথে পেইস। আমলার স্ট্যাম্পের জিংক বেল দুটো জ্বলে উঠল। চাপা গর্জনের ইডেন পার্ক তখন সত্যিকারের আওয়াজ তুলে জানান দিচ্ছে, ‘আমরা আছি’।

পরের তিন ওভারে লং-অন, ডিপ-কাভার, মিড-উইকেট আর মিড-অন থেকে কুড়িয়ে যোগ হলো চার রান। ইনিংসের অষ্টম ওভারের শেষ বল – উইকেটে হাঁসফাঁস করতে থাকা ডি ককের অস্বস্তি থামিয়ে দিলেন ট্রেন্ট বোল্ট।

দশম ওভারে ম্যাট হেনরির জন্য স্লিপে চারজন আর গালিতে একজন ফিল্ডার দেখে আপনার মনে হবে, টেস্টে পঞ্চম দিনের শেষ সেশনের শেষ ওভারের খেলা চলছে, যেখানে জয়ের জন্য শেষ উইকেটটা চাই-ই চাই। প্রথম দশ ওভারে শেষে রান ৩৯/২। আক্রমণকেই যিনি জীবনের শেষ মন্ত্র বলে জপেছেন, সেই ম্যাককালাম ব্যাটসম্যানের সাথে একই সংখ্যার স্লিপ-গালি খেলা খেলেছেন ১৫ ওভার পর্যন্ত।

ষোলতম ওভারে চিরসবুজ ড্যানিয়েল ভেট্টোরি এসে রানের লাগাম টেনে রাখতে সক্ষম হলেন। খানিক ঘুমপাড়ানি ব্যাটিংয়ে যদি আপনার বিরক্তি আসে, ক্ষণে ক্ষণে ৪৫০০০ দর্শকের গগনবিদারী আওয়াজ আপনাকে আন্দোলিত করে তুলতে বাধ্য করবে।

Image Credit: Action Plus Sports Images / Alamy Stock Photo

আপনি দেখছেন, রাইলি রুশোর ব্যাটের কানায় চুমু খেয়ে বল ফাইন লেগ দিয়ে সীমানা-দড়ি পেরিয়ে বলবয়ের হাতে উঠছে। ওই চারেই তিনের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা রানরেট ১৯তম ওভারে গিয়ে কানায় কানায় চারের কাটা ছুঁয়ে যায়। ভেট্টোরির পরের ওভারটা টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনের প্রথম ওভারের মতোই দেখেশুনে এক রানে সন্তুষ্ট থাকেন রুশো আর ফ্যাফ ডু প্লেসি। বিশ ওভার শেষে স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে ৭৭/২।

হঠাৎ স্কোরবোর্ডে চোখ পড়ল, আপনি দেখছেন, ডু প্লেসি ৫৪ বলে ২৬ রান। তখন আপনার হয়তো অ্যাডিলেড ওভালে ডু প্লেসির ম্যাচ-বাঁচানো সেই বিখ্যাত ইনিংসটা স্মরণে আসবে। ২১তম ওভারের পরের দুই বল দেখেও একই স্মৃতি রোমন্থন করবেন আপনি। কিন্তু এটা যে আপনার সেই স্মৃতির ম্যাচ না, সেটা জানান দিতে বোধ করি তৃতীয় বলে মিড-অফ দিয়ে সবুজ ঘাসে মাড়ানো ডু প্লেসির চমৎকার চারের মার। ওদিকে আপনি দেখছেন, ম্যাককালাম উইকেটের জন্য ছটফট করছেন। তখন ধারাভাষ্য-কক্ষ থেকে ভেসে আসছে ওয়ার্নের কণ্ঠস্বর:

“Starting to feel like NZ needs two wickets to really break up the SA batting lineup.”

ইডেন পার্কের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে সে বার্তা পোঁছে যায় কোরি অ্যান্ডারসনের কানে। তাই তো ২৭তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে রুশোকে গাপটিলের হাতে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন কোরি। আর সেটা কী দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতায় তালুবন্দি করে নেন গাপটিল!

এর মাঝে নীরব সমুদ্রে ডু প্লেসিসের বিপক্ষে হঠাৎ উত্তাল হয়ে উঠা উইলিয়ামসনের লেগ-বিফোরের আবেদন। সেখানে উইলিয়ামসনের সাথে গলা মিলিয়ে আওয়াজ তুলেও নিষ্ফলতার শোকে খানিক নীরব গ্যালারী। ত্রিশ ওভার শেষে স্কোর গিয়ে দাঁড়াল ১২৯/৩।

ওদিকে অকল্যান্ডের আকাশ তখন বৃষ্টির আভাস দিচ্ছে। ডি ভিলিয়ার্সের ব্যাটও ঝড়ের আভাস দিচ্ছে। ৩৪তম ওভারে কেন উইলিয়ামসের কল্যাণে রানআউট থেকে বেঁচে যান ডি ভিলিয়ার্স। পরের ওভারের দ্বিতীয় বলে আপনি যখন একই চিত্র ভিন্নভাবে দেখছেন – রানআউটের জায়গায় এবার ক্যাচ মিসে বেঁচে যান এবি। ফিল্ডার একই, কেন উইলিয়ামসন। তখন আপনার ১৯৯২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ইডেন পার্ক, ক্যাচ মিস, মার্টিন ক্রো – সব দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠবে।

Image Credit: Duif du Toit/Gallo Images/Getty Images

তখনই পরের তিন বলে আপনি দেখছেন ট্রেডমার্ক ‘এবিডি ক্ল্যাসিক’। কোনোটা লং-অন দিয়ে ইডেন পার্কের গ্যালারিতে, কোনোটা মিড-অফ দিয়ে সীমানা দড়ি ঘেঁষে বলবয়ের হাতে। ডি ভিলিয়ার্স যেন বলতে চাইলেন, ‘বড্ড ভুল সময়ে ক্যাচ মিস করেছো’। আপনি হয়তো ভাবছেন, নানা রঙে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়া প্রোটিয়াদের ভাগ্য এবার খুলবে ওই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়ে। সেই মুহূর্তে আফ্রিকানদের ভাগ্য পরীক্ষা নিতেই কি না ৩৮তম ওভারে দৃশ্যপটে বৃষ্টির আগমন। এতক্ষণ ইডেন পার্কের আকাশে মেঘেদের আনাগোনা চলছিল, সেটাই হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি হয়ে ঝরতে লাগলো। 

দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর তখন ২১৬/৩। ফল্গুধারায় ঝরার পর বৃষ্টি থেমেছে। কমেন্ট্রি বক্স থেকে ‘ওয়েলকাম ব্যাক’ আপনাকে জানান দেবে, কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ময়দানের লড়াই শুরু হচ্ছে। বৃষ্টি বাগড়ায় ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে আসল ৪৩ ওভারে। ওভারের কমতি দেখে স্বাভাবিক খেলতে থাকা এবি ডি ভিলিয়ার্স এবং ডু প্লেসি নিশ্চয়ই থার্ড গিয়ারে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নামছেন। নাহ, খেলা শুরুর দ্বিতীয় বলেই ডু প্লেসির আউট সেটা খানিক বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে হচ্ছে।

আপনাকে ভুল প্রমাণ করে টিম সাউদি আর কোরি অ্যান্ডারসনের উপর দিয়ে আগের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শূন্য রানে আউট হওয়া ডেভিড মিলারের ব্যাট নির্দয় কিলার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে কী তাণ্ডবলীলাই না চালিয়ে যাচ্ছিলেন! পঞ্চাশ থেকে এক কমে মিলার আউট হলেও ‘ইনভ্যালুয়েবল’ ইনিংসটার জন্য অধিনায়ক এগিয়ে এসে পিঠ চাপড়ে দেন। ৪৩ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর গিয়ে দাঁড়ায় ২৮১ রানে। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে নিউ জিল্যান্ডের রিভাইসড টার্গেট হয়ে যায় ২৯৮ রান।

Image Credit: Mark Nolan-IDI via Getty Images

তেতাল্লিশ ওভারে ২৯৮ রানের টার্গেট – সেমিফাইনাল ম্যাচ, ঘরের মাঠে কিউইদের দর্শকের চাপ। আপনি যদি তখন দক্ষিণ আফ্রিকান সর্মথক হন, বিরতিতে নিশ্চয়ই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। ভাবছেন, এই মাঠেই তো পাকিস্তান ২২২ ডিফেন্ড করে ম্যাচ জিতেছে। পরক্ষণেই দক্ষিণ আফ্রিকার নকআউট পর্বের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে আবার মনটা কু ডাক দিচ্ছিল কি? দিলেও ভাগ্যদেবীর আজকে পাশে থাকা দেখে যে আবার প্রথম ভাবনায় ফিরে যাচ্ছিলেন, সেটাও হয়তো বেশ অনুমেয়।

খানিক বাদেই শুরু হবে নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটিং। প্রথম দেখায় দক্ষিণ আফ্রিকা দলটাকে মনে হচ্ছে খুব প্রফুল্ল। আদতে যে পূর্ব ইতিহাস কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে রেখেছে তাদের, সেটা বোঝা যাবে ফিল্ডিংয়ের নাড়াচাড়া দেখেই। ওদিকে আম্পায়ার ‘লেটস প্লে’ বলতেই ডেল স্টেইনের প্রথম বল, মার্টিন গাপটিলের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে ডিপ ব্যাকওয়ার্ডে একটি রান। তখনও কে জানতো, এই ম্যাচ এত চিত্রনাট্যে লিখে নিয়ে বসে আছে!

দুই দলেরই অপয়া সেমিফাইনাল বেষ্টনী কাটানোর তাড়না। পাঁচবার সেমিফাইনাল থেকে পরাজয়ের বেদনা নিয়ে ফিরেছে নিউ জিল্যান্ড। ভাগ্যের সাথে কাঁধ-মিলানো বন্ধুত্ব ছিল না বলে দক্ষিণ আফ্রিকাও একই অনুভূতি নিয়ে ফিরেছে তিনবার। দুইয়ের ব্যবধান ছিল এমনিতেই কম, উপরন্তু মাঠের ৪৫,০০০ দর্শকের চাপ… বেশ জমেছিল পরিস্থিতিটা।

আচ্ছা, ম্যাচে ফেরা যাক। ডেল স্টেইনের চতুর্থ বল – শর্ট বলটা এক্সট্রা কাভার দিয়ে মাসলের পাওয়ারে পাঞ্চ করে ছক্কা। ব্যাটসম্যানের নাম ব্রেন্ডন ম্যাককালাম না হলে অবাক হতেন বৈকি!

তখনও এই ম্যাচে দলে কাইল অ্যাবোটের পরিবর্তে ‘হাফ-ফিট’ ভার্নন ফিলান্ডারের অন্তর্ভুক্তির রহস্য কাটেনি। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভার করতে এলেন সেই ফিলান্ডার। প্রথম বলের মতো দ্বিতীয় বলটাও শর্ট লেংথে ফেললেন। ম্যাককালাম কি আর এসব দেখে দেখেশুনে খেলার ব্যাটসম্যান? বল এবার খুঁজে নিল লং লেগের ঠিকানা, আম্পায়ারের নির্দেশনার অপেক্ষা না করেই আপনি বলে দিতে পারেন, ছক্কা। ফিলান্ডারের ওই ছয়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই পরের বল এক বাউন্সারে স্কয়ার লেগের বাউন্ডারি দড়ি পেরিয়ে যায়।

তৃতীয় ওভারের পঞ্চম বলটা পাঞ্চ করলেন ম্যাককালাম, বল এবার কভারের সীমানা খুঁজে নেয়। ম্যাককালামের এমন তেড়েফুঁড়ে থাকা রূপের মুখে ফিলান্ডারের হাতে পরের ওভার তুলে দিতে সাহস করলেন না এবি ডি ভিলিয়ার্স। চতুর্থ ওভারে তাই আক্রমণে আসলেন মরনে মরকেল। যুদ্ধক্ষেত্রের তলোয়ার বনে যাওয়া ম্যাককালামের ব্যাট থেকে তিনিও রেহাই পেলেন না, এই ওভার থেকে আসলো ১৪ রান। স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে – নিউ জিল্যান্ড ৪৬/০।

Image Credit: Phil Walter/Getty Images

ইনিংসের সপ্তম ওভার- ডেল স্টেইন করতে আসলেন নিজের তৃতীয় ওভার। ৬, ১ (ওয়াইড), ৪, ৬, ৪, ৪, ০ এই সংখ্যাগুলো দেখাচ্ছে, কী বেধড়ক পিটুনিটাই না খেলেন! এক রানের ওয়াইড সংখ্যাটা বাদে বাকি ২৪ রানই এসেছে ম্যাককালামের বারুদের গন্ধ ছড়ানো ব্যাট থেকে। ডি ভিলিয়ার্স চিন্তা করছেন, কাকে দিয়ে থামাবো এই পাগলা ঘোড়া? এমন চিন্তা যখন, মরকেলের নিরীহ এক বলে ক্যাচ খুঁজে নিলো মিড-অনে থাকা স্টেইনকে। ৩২ বলে ২২৬.৯২ স্ট্রাইকরেটে ৫৯ রান করে আউট ম্যাককালাম – সেমিফাইনাল ম্যাচের চাপ তুলে দিয়ে দিলেন আফ্রিকানদের ঘাড়ে। যতক্ষণ ছিলেন, রীতিমতো ছেলেখেলা করে গেলেন বোলারদের নিয়ে। তিনি ভয়ডরহীন ক্যাপ্টেন; তার আগে যে তিনি হৃদয়হীন এক ব্যাটসম্যান, সেটার একটা ঝলক দেখিয়ে গেলেন।

ওয়ান-ডাউনে উইকেটে আসা কেন উইলিয়ামসকে বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ হলো না, ফিরে গেলেন ব্যক্তিগত ৬ রানে। নিউ জিল্যান্ডের স্কোর তখন ৮১/২। টেইলর আর গাপটিল রয়েসয়ে সতের ওভার শেষে স্কোর নিয়ে গেলেন ১২৮/২। আঠারোতম ওভারে ইমরান তাহিরের প্রথম বলে মিরপুরে ২০১১ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল নিউ জিল্যান্ড ম্যাচের দৃশ্য ফিরে এলো যেন। দুই ব্যাটসম্যানের দ্বিধাদ্বন্দ্বে রানআউট হয়ে সাজঘরে ফিরলেন গাপটিল। তখনও জয়ের পাল্লাটা আপনি দক্ষিণ আফ্রিকার দিকেই ঝুলিয়ে রাখবেন।

উইকেটে আসলেন গ্রান্ট এলিয়ট। সেই এলিয়ট, যার কি না এই বিশ্বকাপেই খেলার কথা ছিল না। ব্যাট হাতে আজকে যাদের হারিয়ে বুকে শূল বিঁধতে নেমেছেন, জন্মটা সেই দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে। দলে ঢুকেছেন শেষ মুহূর্তে জিমি নিশামকে পেছনে ফেলে। কে জানে, হয়তো ব্লাক ক্যাপসদের ভাগ্যটাই লেখা ছিল তার হাতে! ঊনিশতম ওভারটা শেষ করেই মাঠ ছেড়ে গেলেন ডেল স্টেইন, সাথে দাঁড় করিয়ে গেলেন অনেকগুলো প্রশ্নের সামনে। নিউ জিল্যান্ডের স্কোর ১৪০/৩।

‘গোল্ডেন আর্ম’ জেপি ডুমিনি ডি ককের ক্যাচ বানিয়ে ফেরালেন রস টেইলরকে। এতক্ষণ পর্যন্ত ভাগ্যদেবী খুব করে চেয়েছে ফাইনালে ওই সোনালী ট্রফির লড়াইয়ে লড়ুক ডি ভিলিয়ার্সের দক্ষিণ আফ্রিকা। দুই দলের জন্যেই প্রথমবার বিশ্বমঞ্চের চূড়ান্ত মঞ্চে পা রাখার মহারণ চলছে। সেজন্যই হয়তো স্নায়ুচাপ নিয়ে দু’দলের একের পর এক মিসফিল্ডিং। ওদিকে প্রশ্নের ডালপালা বেশি মেলতে না দিয়ে ততক্ষণে মাঠে ফিরেছেন ডেল স্টেইন।

বল হাতে বাহাত্তর রান খরচা করা কোরি অ্যান্ডারসন তখন গ্রান্ট এলিয়টকে সাথে নিয়ে সেটি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টায়। দু’জনের জুটি তখন জমে গেছে। সেই উৎকণ্ঠায়ই কি না ৩১তম ওভারের তৃতীয় বলে ডি ভিলিয়ার্স রানআউট মিস করে বসলেন! এহেন রানআউট মিসে তখন মনে হবে, এর আগে গোটা বিশ্বকাপে ডি ভিলিয়ার্সের একেকটা ক্যাচ কিংবা দুর্দান্ত থ্রোতে হয়তো তার উপর সুপারম্যান ভর করেছিলেন।

Image Credit: Hannah Peters /  Getty Images

৩৩ ওভার শেষে নিউ জিল্যান্ডের স্কোর ২১৩/৪। যেমনটা আপনি চিন্তা করছেন, ডি ভিলিয়ার্সও একই চিন্তা করছেন, পঞ্চম বোলারের কাজটা সরিয়ে নেওয়া দরকার। ঠিক তখনই গুটির সেরা চালটা খেলল নিউ জিল্যান্ড। আম্পায়ার হাত ঘুরিয়ে ইশারা করলেন, ব্যাটিং পাওয়ারপ্লে নিয়েছে নিউ জিল্যান্ড। শেষ দশ ওভারে নিউ জিল্যান্ডের দরকার হয় ৮৫ রান। তখনই কমেন্ট্রি বক্সে জানিয়ে দেওয়া তথ্য, ৮৪ রান করে ম্যাচ টাই হলেও গ্রুপপর্বে পয়েন্ট টেবিলের উপরে থাকার সুবাদে ফাইনালে পোঁছাবে কিউইরা।

আপনি দেখছেন, ততক্ষণে ভাগ্যের সাথে লুকোচুরি খেলা শুরু হয়ে গেছে ডি ভিলিয়ার্স-মরনে মরকেলদের। তাই তো অল্পের জন্য ডি ভিলিয়ার্সের বলে আউট থেকে বেঁচে যান কোরি অ্যান্ডারসন। ৩৭তম ওভার শেষে নিউ জিল্যান্ডের রান ২৫১/৪।

হঠাৎ শুনশান নীরবতায় ইডেন পার্কের গ্যালারি। কারণটা অনুমেয়, চাঁদের সাথে গল্প করে আসা অ্যান্ডারসনের আকাশে তুলে মারা বলটা খানিক আগে স্কয়ার লেগ ফিল্ডার ডু প্লেসির তালুবন্দী হয়েছে। দলকে ১৮ বলে ২৯ রানের ব্যবধানে রেখে ফিরেছেন লুক রঞ্চিও। তখনও আফ্রিকানদের গলার কাঁটা আর নিউ জিল্যান্ডের ফাইনালের টিকেট হয়ে টিকে আছেন গ্রান্ট এলিয়ট।

আপনি তখনও জানেন না, নাটকের শেষ মুহূর্তের ঝিম ধরা নাটকীয়তার তখনও শেষ মঞ্চায়ন বাকি। এদিন রানআউট, ক্যাচ মিস, সব একসাথে মিলিত হবে। একেকটা মিস প্রোটিয়াদের শেষ মুহূর্তের বিরহের চিহ্ন রেখে যাবে। আপনি দেখছেন, দুই ফিল্ডারের মুখোমুখি ধাক্কা, আর সেটা দেখতে দেখতে দুই ব্যাটসম্যানের পিচের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাওয়া। কিউইদের ফাইনাল ভাগ্যে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার সুযোগটা হাত ফসকে চলে গেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত কে টিকে থাকবে? এই প্রশ্ন যখন উঁকি দিচ্ছে, ডিপ ব্যাকওয়ার্ড এবং ফাইন লেগের মাঝখানে এলিয়টের ক্যাচটা ধরতে পারলে ততক্ষণে ইডেন পার্কে নেমে আসতে পারতো নিস্তব্ধতা। ব্ল্যাক ক্যাপসদের জন্য ফাইনাল-ভাগ্য দূর আকাশের তারা বানিয়ে প্রোটিয়ারা চলে যেত স্বপ্নের ফাইনালে। নাহ, এ যাত্রায় সব চিন্তা বাতাসে মিলিয়ে গেল।

Image Credit: David Rowland/AP

শেষ ওভারে রানের অঙ্কটা বলের ডাবল। বিজয়ের রাগিণী আর বিয়োগের সুর, দুটোই মাথায় নিয়ে শেষ ওভার করতে আসলেন ডেল স্টেইন। কতবার যে বল হাতে আগুন ঝরিয়েছেন – কখনো সবুজাভ কেপটাউনে, কখনো মেলবোর্ন-এজবাস্টনে, কখনো বা এই উপমহাদেশে। নাভিশ্বাস তুলেছেন কত অগণিত ব্যাটসম্যানের। নাড়িয়ে দিয়েছেন কত ব্যাটসম্যানের আত্মবিশ্বাস। সেই ডেল স্টেইন কি আরেকবার বল হাতে আফ্রিকান জাহাজটা ফাইনালের তীরে ভিড়াতে পারবেন?

প্রথম দুই বল থেকে দুই ব্যাটসম্যান নিতে পারলেন দুই রান। তৃতীয় বলের আগে হ্যামস্ট্রিংয়ের ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে মাঠে শুয়ে পড়লেন ডেল স্টেইন। অনুভবে তখন মাঠ থেকে নিস্তব্ধতার বাতাস বইছে। আর গ্যালারি থেকে শোনা যাচ্ছে ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে নিয়ে উল্লাসস্তুতি। কিন্তু দমে গেলেন না স্টেইন, দেশের জন্য লড়ে তো যেতেই হবে শেষ পর্যন্ত!

তৃতীয় বল, স্ট্যাম্পে ইয়র্কার করলেন ডেল স্টেইন। বলটা কোনোমতে ভেট্টোরির আড়াআড়ি ব্যাট ছুঁয়ে থার্ডম্যান দিয়ে চার হয়ে যায়। কি অদ্ভুতুড়ে! কমেন্ট্রি বক্স থেকে ধেয়ে আসছে,

“What a moment of the game!”

Image Credit: Hannah Peters / Getty Images

ডি ভিলিয়ার্সের মুখাবয়বের দিকে একবারের বেশি তাকানোর সাহস করা গেল না। বলটা সীমানা দড়ি পেরোনোর আগে নিজ পজিশনে লাফিয়ে যেন বাজপাখি হতে চাইলেন। নাহ, ডি ভিলিয়ার্স আজ যে শুধুই সাধারণ একজনের মানুষের মতো!

চতুর্থ বলে এক রান নিয়ে এলিয়টকে স্ট্রাইকে পোঁছে দেন ভেট্টোরি। শেষ দুই বলে দরকার পাঁচ রান। এলিয়ট কি আফ্রিকান হন্তারক হয়ে উঠবেন, নাকি ডেল স্টেইন কেপটাউন কিংবা পার্থে ছোড়া কোনো ক্ষেপণাস্ত্র গোলার মতো উড়িয়ে দিবেন এলিয়টের স্ট্যাম্প? ততক্ষণে এলিয়টকে স্ট্রাইকে দেখে গ্যালারির মতো নিউ জিল্যান্ড ড্রেসিংরুমেও জয়ের সুবাস বয়ে গেল কিছুটা! এলিয়ট কি গ্ল্যামার হিরো হবেন, নাকি রহস্য জমিয়ে রেখে ক্রিকেট ব্যাকরণে আগাবেন? কত প্রশ্ন তখন ঘুরপাক খাচ্ছে!

ন্যানো সেকেন্ডের এই ভগ্নাংশ পরীক্ষায় এলিয়ট কি অতশত ভাবছেন? ডেল স্টেইনের লেংথ বলটা এলিয়টের মাঝ ব্যাটে… ভাবছেন না যে, সেটা বুঝাতে ওই ন্যানো সেকেন্ডই সময় নিলেন। শেষ বল পর্যন্ত অপেক্ষা না বাড়িয়ে লং অন দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার আরেকটি সোনালী প্রজন্মের চিরন্তন আক্ষেপের কারণ হয়ে ছক্কায় ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। গ্রান্ট এলিয়ট গর্জন তুললেন, গর্জন তুললো ৪৫০০০ দর্শকও।

ডেল স্টেইন পিচে শুয়ে পড়ে যেন উত্তর চাইলেন, ‘বারেবারে কেন হয় এমন’! ডি ভিলিয়ার্স আজ আপনার আমার মতোই ভেঙে পড়েন। ওখানে যে আতশবাজি ঝলসে উঠেছে, সে কি জানে, এখানে ডি ভিলিয়ার্স রয়েছেন? সে কি খোঁজ রেখেছে কান্নার অভিযাত্রী মরনে মরকেলের? সে কি জানে, একদলের জন্য তার যে বিজয়মাল্য, সেটা আরেক দলের বুকে কাঁটাতারের মতো বিঁধছে?

Image Credit: Getty Images

ক্রিকেট এমনই; আজ আপনার জন্য মালা নিয়ে হাজির, তো আগামীকাল সে-ই আপনার জন্যই কাঁটা নিয়ে হাজির।

এ দুঃখের ঠেলাগাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়ার সার্মথ্য ডি ভিলিয়ার্সের ছিল না। ওই কান্নাভেজা মুখ ডি ভিলিয়ার্সের হাতের রুমালের সাধ্য ছিল না ঢেকে দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল বানিয়ে দেয়ার। আরেকটা দক্ষিণ আফ্রিকান ট্র‍্যাজেডির সাক্ষী হলো ক্রিকেটবিশ্ব। আরো একবার ‘চোর্কাস’ তকমা গায়ে মেখেই সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হলো দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

 

This article is in Bangla language. It is about the 2015 world cup semifinal, where South Africa lost their chance to step into the final. It's a story of another tragedy for the proteas.

Featured Image: Anthony Au-Yeung-IDI

Related Articles

Exit mobile version