সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিলো দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। এই দু’দলের দ্বৈরথ সবসময়ই বাড়তি উন্মাদনা সৃষ্টি করে, কিন্তু আর্জেন্টিনা দলে মেসি, ডি মারিয়া, আগুয়েরোর মতো সিনিয়র খেলোয়াড়েরা না থাকায় ম্যাচের উত্তেজনায় কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছিলো। তবে এবারের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচকে ‘সুপার ক্ল্যাসিকো’ ট্রফির অন্তর্ভুক্ত করায় সেই উত্তেজনা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। নিজেদের স্কোয়াডে যা শক্তি ছিল তার সেরাটা নিয়েই দুই দল ম্যাচ শুরু করে।
ব্রাজিল কোচ টিটে তার প্রিয় ৪-৩-৩ ফর্মেশনেই দল সাজান। তবে রাইট উইঙ্গার হিসেবে গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে খেলানোটা বড় চমক হিসেবে আসে। এছাড়া ক্যাসেমিরোর সাথে তরুণ তুর্কি আর্থারকে সুযোগ দেওয়াটাও ইতিবাচক একটা পরিবর্তন ছিল। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার কোচ স্কালোনিও তার দলকে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে সাজান। বাট্টাগ্লিয়াকে মাঝে রেখে লো সেলসো ও লিওনার্দো প্যারাদেসকে দু’পাশে রেখে তিনি তার মাঝমাঠ সাজান। আর স্ট্রাইকার হিসেবে ইন্টার মিলানের হয়ে দুরন্ত খেলতে থাকা মাউরি ইকার্দিকে রেখে দুই উইংয়ে পাওলো দিবালা ও অ্যাঞ্জেল কোরেয়াকে সুযোগ দেন তিনি।
ম্যাচের শুরু থেকেই ছোট ছোট পাসে খেলে নিজেদের আয়ত্তে বল রাখতে শুরু করে ব্রাজিল। টিটের দলকে এমন ভঙ্গিতে খুব কমই খেলতে দেখা গেছে, সাধারণত দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাক ও গোলমুখে বেশি শট নিতেই তার দলকে দেখা যায়। কিন্তু এই ম্যাচে এসব কিছুই ছিল না, প্রতিটা কাউন্টার অ্যাটাক শুরু হয়েছে ধীর গতিতে আর গোলমুখে শট নেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েকবার নিজেদের মধ্যে বল আদান-প্রদান করে সেই সুযোগ হেলায় হারিয়েছে দলটি। বিশ্বকাপে স্পেনের সেই ‘বোরিং’ তিকিতাকাই কাল আবার যেন ব্রাজিলের জার্সিতে ফিরে এসেছিলো।
অন্যদিকে শক্তিমত্তায় কিছুটা ‘পিছিয়ে’ থাকা আর্জেন্টিনা শুরু থেকেই কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে থাকে, তাদের আক্রমণে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল মাঝমাঠ থেকে ডি-বক্সের দিকে উড়িয়ে মারা সব লং পাস আর দূরপাল্লার কিছু শট। তবে সেগুলোর কোনোটাই তেমন কাজে লাগছিলো না। দু’দলের এমন ট্যাকটিক্সের কারণে খেলা শুরু থেকেই বেশ মন্থরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো।
ম্যাচের ২৭ মিনিটে প্রথম গোল করার মতো বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়, ডি-বক্সে একদম আনমার্কড অবস্থায় থাকা মিরান্ডা ক্যাসেমিরোর পাস থেকে বল পেয়ে গিয়েছিলেন। গোলমুখে জোরালো শট নেওয়ার যথেষ্ট সময় তার কাছে ছিল বটে, কিন্তু সেলেসাও সেন্টারব্যাকের নেওয়া শট গোললাইন থেকে দারুণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দেন আর্জেন্টিনার সেন্টারব্যাক নিকোলাস ওটামেন্ডি। ২৯ মিনিটে ডি-বক্সের খানিকটা বাইরে ফ্রি-কিক পেয়েছিলো আর্জেন্টিনা, কিন্তু পাওলো দিবালার নেওয়া সেই ফ্রি-কিক গোলপোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে যায়। প্রথমার্ধে ব্রাজিলও বেশ সুবিধাজনক জায়গায় ফ্রি-কিক পেয়েছিলো, তবে নেইমারের সেই শট প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। দু’দলের কেউই প্রথমার্ধে আর বলার মতো কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ার্ধের ৫০ মিনিটে ডি-বক্সে দারুণভাবে ঢুকে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার মাউরো ইকার্দি, তবে তার নেওয়া শটও প্রতিহত হয়ে গোললাইনের বাইরে দিয়ে চলে যায়। পুরো ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকা দিবালাকে ম্যাচের ৫৮ মিনিটে উঠিয়ে নেওয়া হয়, নামানো হয় আরেক তরুণ তুর্কি লাউতারো মার্টিনেজকে। ম্যাচের ৬৫ মিনিটে ব্রাজিল ‘বস’ টিটে গ্যাব্রিয়েল জেসুসের বদলে এভারটনের ফরোয়ার্ড রিচার্লিসনকে নামান।
ম্যাচের ৬৮ মিনিটে বাম প্রান্ত দিয়ে দারুণভাবে বল টেনে ভালো একটি থ্রু পাস দিয়েছিলেন নেইমার, তবে সেই পাস থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন রিচার্লিসন। এর পরের মিনিটেই নেইমারের ফ্রি-কিকে বল পেয়ে ডি-বক্সের ভিতর থেকে শট নেন আর্থার, তবে তার সেই শটও দারুণভাবে ঠেকিয়ে দেন সার্জিও রোমেরো। ৮৪ মিনিটে ক্যাসেমিরোর দূরপাল্লার এক ফ্রি-কিক আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের গায়ে লেগে অল্পের জন্য পোস্টের বাইরে দিয়ে চলে যায়।
এরপর সময় যত গিয়েছে, আর্জেন্টিনা তত বেশি রক্ষণাত্মক হয়েছে, আর ব্রাজিল গোলের জন্য আরো মরিয়া হয়েছে। তবে আর্জেন্টিনার দৃঢ় রক্ষণভাগ দেখে যখন মনে হচ্ছিলো, এবারের সুপার ক্ল্যাসিকোর ভাগ্য বুঝি টাইব্রেকারের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। ঠিক তখনই এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দ্বিতীয়ার্ধের ইনজুরি সময়ের ২ মিনিটের মাথায় নেইমারের নেওয়া কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে সেলেসাওদের মহাকাঙ্খিত গোল এনে দেন মিরান্ডা। এই গোলের ফলে আবারও সুপার ক্ল্যাসিকোর ট্রফি নিজেদের ঘরে তুললো ব্রাজিল।
দুই দলের দলগত পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে আর্জেন্টিনার চেয়ে অবশ্যই এগিয়ে ছিল ব্রাজিল, তবে শক্তিমত্তা অনুযায়ী যতটা তারা এগিয়ে ছিল তার প্রমাণ খেলায় দিতে পারেনি। এর মূল কারণ হতে পারে টিটের পরিচিত ট্যাকটিক্স বাদ দিয়ে অতিরিক্ত শর্ট পাসিংয়ের উপর খেলা। বলের দখল ৬২ ভাগ সময়ে রাখলেও আক্রমণে সেভাবে ভয় ধরাতে পারেনি সেলেসাওরা।
তাছাড়া নিয়মিত রাইট উইঙ্গার হিসেবে খেলে এমন কাউকে না খেলিয়ে জেসুস কিংবা রিচার্লিসনকে রাইট উইংয়ে খেলানোয় খেলার ধারটাও অনেকটা কমে গেছে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা তাদের খর্বশক্তি নিয়েও দারুণ লড়েছে, বিশেষ করে তাদের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা নিজেদের সেরাটা দিয়েই খেলেছে। শেষ মুহূর্তে কর্নার থেকে গোল হজম না করলে তারা ফুলমার্কসই পেতো।
এবার দু’দলের খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স নিয়ে অ্যানালাইসিসে আসি।
প্রথমেই আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের নিয়ে আলোচনা করা যাক। আর্জেন্টিনার গোলবারে সার্জিও রোমেরোর পারফরম্যান্স বেশ ভালোই ছিল; তবে মিরান্ডার গোলে তিনি বলের ফ্লাইট বুঝতে পারেনি, এটা একটা নেতিবাচক দিক। রক্ষণভাগের চারজনই কাল দারুণ খেলেছেন, ওটামেন্ডি যেভাবে মিরান্ডার শট গোললাইন থেকে ফিরিয়ে দিলেন, সেটা তো দুর্দান্ত। তবে আলাদা করে বলতে হয় ‘আলবিসেলেস্তে’ রাইটব্যাক রেঞ্জো সারাবিয়ার কথা। আর্জেন্টাইন ক্লাব রেসিংয়ে খেলা এই খেলোয়াড় পুরোটা সময় যেভাবে নেইমারের ড্রিবলিংগুলো আটকে দিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয় ছিল।
মাঝমাঠে প্যারাদেস, বাট্টাগ্লিয়া এবং লো সেলসো তিনজনকেই অধিকাংশ সময়ে রক্ষণের কাজে সাহায্য করতে হয়েছে, তারা সেই কাজ ভালোভাবেই করেছেন। অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলায় আক্রমণভাগের তিন খেলোয়াড় দিবালা, ইকার্দি ও কোরেয়া সেভাবে সুযোগ পাননি। তবে দিবালার খেলা সম্ভবত একটু বেশিই হতাশ করেছে। শুরুর দিকে তিনি যখন ভালো করতেন না, তখন বলা হতো মেসি তার পজিশনে খেলেন বলে তিনি সুবিধা করতে পারছেন না। এখন তাকে মেসির পজিশনে খেলানো হচ্ছে, তারপরও তিনি দলের হয়ে প্রভাব রাখতে ব্যর্থ। জাতীয় দলের হয়ে ১৬টি ম্যাচ খেলে ফেললেও এখনো গোলের খাতাই খুলতে পারেননি জুভেন্টাসের এই ফরোয়ার্ড!
এবার আসা যাক ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে। আর্জেন্টিনা অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক খেলার ফলে ব্রাজিলের গোলরক্ষক অ্যালিসনকে তেমন পরীক্ষায় পড়তেই হয়নি। তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখাতে গিয়ে ২২ মিনিটে যেভাবে বল হারাতে বসেছিলেন তিনি, তাতে দল বড় বিপদে পড়ে যেতে পারতো। এসব ব্যাপারে নিঃসন্দেহে আরো সচেতন হতে হবে অ্যালিসনকে। রক্ষণভাগের চারজন মিলে আর্জেন্টিনার কাউন্টার অ্যাটাক বেশ ভালোভাবেই ঠেকিয়েছেন, এদের মধ্যে মিরান্ডা তো দলের হয়ে একমাত্র গোলটিও করেছেন। তবে শুরুর একাদশে থাকা দানিলোর চেয়ে ফ্যাবিনহোই রাইটব্যাক পজিশনে বেশি আলো ছড়িয়েছেন।
মাঝমাঠে ক্যাসেমিরোর মতো একজন সেনা থাকা সত্যিই যেকোনো কোচের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেপশন করে তিনি একাই আর্জেন্টিনার অনেকগুলো আক্রমণ অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিয়েছেন। মাঝমাঠের আরেক খেলোয়াড় আর্থার এ ম্যাচে অসাধারণ খেলেছেন ; কেন তাকে স্প্যানিশ লিজেন্ড জাভি হার্নান্দেজের সাথে তুলনা করা হয়, তার প্রমাণ তিনি এ ম্যাচেও দিয়েছেন। দুর্দান্ত বল নিয়ন্ত্রণ, নিখুঁত পাসিং – সব মিলিয়ে দারুণ পারফরম্যান্স ছিল তার। তবে থ্রু পাসের ব্যাপারে আরেকটু মনোযোগী হতে হবে তাকে, তাহলেই খেলায় তার প্রভাব আরো বাড়বে।
মাঝমাঠে হতাশ করেছেন কৌতিনহো। আর্থার যখন ‘জাভি’র রোলে খেলেছেন, তখন কৌতিনহোর ‘ইনিয়েস্তা’ হয়ে ওঠার দরকার ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি, পুরো ম্যাচে তাকে ভীষণ বিবর্ণ লেগেছে। আসলে এক ম্যাচে উইঙ্গার এবং আরেক ম্যাচে মিডফিল্ডার হিসেবে খেলানোয় তিনি নিজেও হয়তো তার দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিত নন। সমস্যা হচ্ছে, শুধুমাত্র জাতীয় দল নয়, বার্সেলোনাতেও তিনি কোনো স্থায়ী পজিশনে খেলতে পারছেন না। এরকমটা হলে ব্রাজিল দলে কৌতিনহোর জায়গাটাই হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে, কারণ এমন পারফর্মেন্স দিয়ে ফ্রেড কিংবা পাকুয়েতাদের মতো মিডফিল্ডারদেরকে খুব বেশিদিন টপকানো যাবে না।
পরিসংখ্যান কিংবা ম্যাচ রেটিং দেখলে মনে হবে, নেইমার বুঝি পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত ছিলেন। তবে আসল চিত্রটা মোটেও সেরকম ছিল না। পুরো ম্যাচে অহেতুক বল নিয়ে কারুকাজ দেখানোর চেষ্টা করে অনেকবার বল হারিয়েছেন এই তারকা খেলোয়াড়। তাছাড়া অতিরিক্ত সময়ে বল নিজের কাছে ধরে রেখে খেলার গতিও কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। এটাও ঠিক যে দলের সিংহভাগ আক্রমণ তার পাস থেকেই গড়ে উঠেছে, মিরান্ডার গোলেও তার অ্যাসিস্ট ছিল। কিন্তু নেইমারের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক বেশি। নিজের সেরা সময়ে এভাবে খামখেয়ালিপনা করে নিজের সেরাটা না দিতে পারলে কীভাবে তিনি বিশ্বসেরা হবেন?
রাইট উইঙ্গার হিসেবে অনেকদিন না খেললেও জেসুস এ ম্যাচে খুব একটা খারাপ খেলেন নি, তার বদলি হিসেবে নামা রিচার্লিসনও একজন লেফট উইঙ্গার। তার পারফরম্যান্সও গড়পড়তা ছিল। হতাশ করেছেন রবার্তো ফিরমিনো, শুরুর একাদশে সুযোগ পেয়ে পুরোটা সময় মাঠে থেকেও লিভারপুলের এই স্ট্রাইকার সেরকম কোনো প্রভাব রাখতে পারেননি। সবমিলিয়ে ব্রাজিলের পারফরম্যান্স প্রত্যাশার তুলনায় বেশ বিবর্ণ ছিল।
তবে একটা তথ্য পেয়ে সেলেসাও ভক্তরা তৃপ্ত হতেই পারেন। ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া সুপার ক্ল্যাসিকো ট্রফির মোট চারটি আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে, আর প্রতিবারই এই ট্রফি সেলেসাওদের ঘরেই গিয়েছে! এই সময়ের মাঝে আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে প্রীতি ম্যাচে ঠিকই হারিয়েছিলো, তবে সেসব ম্যাচ সুপার ক্ল্যাসিকো ট্রফির অন্তর্ভুক্ত ছিল না বলে জয়ী দল আর্জেন্টিনাকে কোনো ট্রফিও দেওয়া হয়নি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে মর্যাদার এই আসরে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখায় ব্রাজিল ভক্তরা কিছুটা হলেও সন্তুষ্ট হতেই পারেন।