‘স্বপ্নের ফাইনাল।’
বিশ্বের প্রতিটি ফুটবলপ্রেমীই সম্ভবত স্বীকার করবেন, ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা ফাইনালে মুখোমুখি হলে সেটা দুর্দান্ত একটা ব্যাপারই হয়। ফুটবল যতই দলগত খেলা হোক, সময়ের পরিক্রমায় যতই ফলাফলভিত্তিক খেলার দিকে কোচরা ঝুঁকে যান না কেন – এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ দর্শক লাতিনের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ভরপুর খেলা দেখতেই আনন্দবোধ করেন।
সমস্যা হচ্ছে, বিশ্বের সব দর্শক যতই শৈল্পিক ফুটবলের প্রত্যাশা করুক না কেন, বাস্তবে দুই দলের সমর্থক এবং খেলোয়াড়দের কাছে কিন্তু প্রথম চাওয়া থাকবে শিরোপা জয়ই। বিশেষ করে আর্জেন্টাইন সমর্থক আর খেলোয়াড়দের কথাই ভাবুন। সর্বশেষ আর্জেন্টিনা জাতীয় দল শিরোপা জিতেছিল ১৯৯৩ সালের কোপা। এরপর একে একে ৮টি ফাইনাল খেলে আর্জেন্টিনা – ১৯৯৫ সালের কনফেডারেশন কাপ, ১৯৯৭ সালের কোপা, ২০০৪ সালের কোপা, ২০০৫ সালের কনফেডারেশনস কাপ, ২০০৭ সালের কোপা, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ, ২০১৫ সালের কোপা আর ২০১৬ সালের কোপা। কিন্তু এত প্রচেষ্টার পরও তুলির শেষ আঁচড়টা কেটে স্বপ্নের শিরোপা ছোঁয়ার সৌভাগ্য তাদের হয়ে ওঠেনি। প্রতিটিবারই ব্যর্থতার গ্লানিই তাদের সঙ্গী হয়েছে।
অন্যদিকে, এই সময়কালে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল ব্রাজিল ১৩টি ফাইনাল খেলে ১১ বার চ্যাম্পিয়ন হবার স্বাদ উপভোগ করেছে, যার মাঝে দু’টি বিশ্বকাপের শিরোপাও ছিল। কাজেই স্বপ্নের ফাইনালে নিজেদের মাঠে যে ফেভারিটের তকমাটা ব্রাজিল দলই পাচ্ছে, সেটা হয়তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দুই দলের মধ্যে যে বিষয়টা ব্রাজিলকে এগিয়ে রাখছে, সেটা হচ্ছে ফাইনালের চাপ সামলে নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারার দক্ষতা। ব্রাজিল সর্বশেষ ফাইনাল হেরেছিল ১৯৯৯ সালের কনফেডারেশনস কাপে মেক্সিকোর বিপক্ষে। এরপর ৫টি কোপা, একটি বিশ্বকাপ আর ৩টি কনফেডারেশনস কাপ জিতে নিয়েছে ব্রাজিল।
অন্যদিকে, আর্জেন্টিনার সমস্যা হচ্ছে ফাইনালে গোল করতে না পারা। ২০০৫ সালের কনফেডারেশনস কাপে গোল করার পরও আর্জেন্টিনা হেরেছিল ব্রাজিলের বিপক্ষে। এরপর আরো ৪টি ফাইনাল খেললেও গোলের দেখা পায়নি তারা।
কালকের ফাইনালে সেই কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা কি পাবে আর্জেন্টিনা? আর পেলেও কি সেটা শিরোপা জয়ের জন্য যথেষ্ট হবে?
ব্রাজিলের মাঠে ব্রাজিলকে হারাতে হলে সময়ের সেরা খেলোয়াড় মেসিকে জ্বলে উঠতে হবে, এটা সবাই জানে। আর্জেন্টিনার হয়ে তিনটি ফাইনাল খেললেও তাতে কোনো গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নেই মেসির। হয়তো এই কারণেই গোলবিহীন আর্জেন্টিনা দলও।
ব্রাজিলের বিপক্ষে লিওনেল মেসির রেকর্ডও একেবারে ফেলনা নয়। ১১টি ম্যাচে একটি হ্যাটট্রিকসহ মোট ৫টি গোল রয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে। তবে সমস্যার বিষয় হচ্ছে, এর সবগুলোই প্রীতি ম্যাচে। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে এখন পর্যন্ত ব্রাজিলের বিপক্ষে ৫টি ম্যাচ খেলেও কোনো গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নেই।
এমনকি বিশ্বকাপ কিংবা কোপা আমেরিকার মতো টুর্নামেন্টে নকআউট পর্বে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলগুলোর বিপক্ষে মেসির কোনো গোল নেই, কোনো জয়ও নেই। বিশ্বকাপ বাদ দেওয়া যাক, কোপা আমেরিকার নকআউট পর্বেও বড় দলের বিপক্ষে মেসির পারফরম্যান্স একেবারেই মেসিসুলভ নয়। কেন যেন নকআউট পর্বে বড় দলের বিপক্ষে খেলা পড়লেই মেসি এবং তার বাহিনী তাদের স্বাভাবিক খেলাটা উপহার দিতে পারে না।
কোপা আমেরিকায় ঐতিহ্যগতভাবে আর্জেন্টিনার সবচাইতে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেব করলে সাধারণত কাদেরকে ধরা হবে? নিশ্চয়ই ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর কিংবা কলম্বিয়া নয়। সবচাইতে শক্তিশালী নিঃসন্দেহে ব্রাজিল, এরপর উরুগুয়ে, বড়জোর চিলি।
কোপাতে গত কয়েক আসরে নকআউট পর্বে মেসির প্রতিপক্ষগুলোর দিকে একটু চোখ বুলিয়ে দেখা যাক।
-
২০০৭ সালের কোপা আমেরিকায় কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল যথাক্রমে পেরু আর মেক্সিকো। ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হার মানে তারা।
-
২০১১ সালের কোপা আমেরিকায় মেসিসহ আর্জেন্টিনা হারে উরুগুয়ের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে।
-
২০১৫ সালের কোপা আমেরিকায় কোয়ার্টার আর সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল যথাক্রমে কলম্বিয়া আর পেরু। ফাইনালে চিলির কাছে হার মানে তারা।
-
২০১৬ সালের কোপা আমেরিকায় কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল যথাক্রমে ভেনিজুয়েলা আর যুক্তরাষ্ট্র। ফাইনালে আবারও চিলির কাছে হার মানে তারা।
-
২০১৯ সালের কোপা আমেরিকায় কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল যথাক্রমে ভেনেজুয়েলা। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হার মানে তারা।
এই বিষয়টা এক সময় না এক সময় শেষ হবেই, মানে ফাইনালে আর্জেন্টিনার হারতে থাকার বিষয়টা। কিন্তু আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা অবশ্যই চাইবে যাতে কালকের দিনেই বিষয়টার নিষ্পত্তি ঘটে যাক। সম্প্রতি নতুন কোচের অধীনে যথেষ্ট ভালোই করছে একটা পালাবদলের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে থাকা আর্জেন্টিনা দল। তবে ব্রাজিলের মাঠ থেকে শিরোপা জিতে আসতে চাইলে মেসির সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়েও কাজ করতে হবে। পুরো বিশ্ব যেখানে মেসির এই সীমাবদ্ধতার কথাগুলো জানে, মেসি এবং তার দল নিজেরাও কিন্তু জানে। আর্জেন্টিনার হয়ে আন্তর্জাতিক শিরোপা জয় করার জন্য এই সীমাবদ্ধতাগুলো যে মেসিকে জয় করতে হবে, সেটা মেসির চাইতে ভালো আর কে জানে?
পুরো বিশ্বের বড় একটা অংশ মেসির কথা ভাবলেও তার আড়ালে কেন যেন আরেকজন ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন। ঠিক ধরেছেন, নেইমার। রোমারিও, রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহো, এবং কাকার পরবর্তী সময়ে ব্রাজিল দলে উল্লেখ করার মতো তারকা খেলোয়াড় গত কয়েক বছরে এই একজনই এসেছেন। কোচের পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় খেলোয়াড় হিসেবেও খেলেছেন। তাকে ঘিরেই ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখে আসছিলেন ব্রাজিলিয়ানরা। সেই নেইমারও কিন্তু ব্রাজিলের জার্সি গায়ে উল্লেখ করার মতো কিছু জিততে পারেননি। ব্রাজিলের হয়ে একমাত্র ২০১৩ সালের কনফেডারেশনস কাপ জয়ই তার অর্জন। পরবর্তী বিশ্বকাপ টার্গেট করার আগে ঘরের মাঠে চিরশত্রু আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কোপা শিরোপা জয় অবশ্যই তার মুকুটে আরেকটা পালক যোগ করবে। সেই সুযোগটা কি নেইমার ছাড়তে চাইবেন?
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে নেইমারের রেকর্ডও ভালো। সব মিলিয়ে ১০টি ম্যাচে ৩টি গোল আর ৪টি অ্যাসিস্ট তার পক্ষেই কথা বলছে। এর মাঝে প্রতিযোগিতামূলক দুইটি ম্যাচে একটি করে গোল আর অ্যাসিস্ট। চলতি টুর্নামেন্টেও ভালো খেলে চলেছেন। নকআউট পর্বের দুই ম্যাচেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নেইমার।
কোনো সন্দেহ নেই যে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপা জেতার জন্য বেশ ভালো ছন্দে আছেন নেইমার। ফাইনাল ম্যাচেও সেই ছন্দটা ধরে রাখতে পারলে নিঃসন্দেহে আর্জেন্টিনার অপেক্ষার প্রহর আরেকটু বাড়বে।
‘ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা’ খেলা নিয়ে অনুমান করা বোকামি। এই ধরনের ম্যাচগুলোতে সাধারণত কোনো ফেভারিটতত্ত্ব কাজ করে না। খেলার মধ্যে দুই দলই এতটা স্নায়ুচাপে ভোগে যে রেজাল্ট যে কারো পক্ষেই চলে যেতে পারে।
কোপা আমেরিকার ২০০৭ সালের ফাইনালের কথাটাই ধরুন। তেভেজ, রিকেলমে, মিলিতো, মাশ্চেরানো, আয়ালা এবং তরুণ মেসির মতো তারকাসমৃদ্ধ দল নিয়ে গ্রুপপর্ব এবং নকআউটের প্রতিটি ম্যাচই বেশ দাপটের সাথে জিতে ফাইনালে উঠে আসে আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে, ব্রাজিলে মূল দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে বাদ দিয়েই স্কোয়াড পাঠায়। গ্রুপপর্বে একটি ম্যাচ তারা হারে এবং সেমি ফাইনালটাও জিততে হয় টাইব্রেকারে। কিন্তু ধুঁকতে থাকা এই ব্রাজিলই ফাইনালে গিয়ে উড়তে থাকা আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপা জেতে।
আবার ১৯৯০ বিশ্বকাপের কথা ধরুন। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দল ছিল দুর্দান্ত ফর্মে। গ্রুপপর্বে তিন ম্যাচের তিনটিতেই জয় পেয়ে ফেভারিট হিসেবেই পরের পর্বে যায় তারা। অন্যদিকে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ছিল ক্যামেরুন, রুমানিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রুপ থেকে কোনোক্রমে তৃতীয় হয়ে আসা আর্জেন্টিনা। ম্যাচশেষে পরের দিন পত্রিকার হেডিং কী ছিল জানেন? ব্রাজিল ৮৯ মিনিট, ম্যারাডোনা ১ মিনিট। দলগত বিচার কিংবা সেই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্সে ব্রাজিলের ধারেকাছে না থাকলেও সেই এক মিনিটেই ছিটকে যায় ব্রাজিল।
কালকের ম্যাচেও যে ফেভারিটদের পতন হবে না, সেটাই বা কে বলতে পারবে? আর্জেন্টিনার সমর্থকরা কাল মেসির কাছ থেকে কি সেই এক মিনিটের ম্যজিকের প্রত্যাশাই করবেন না? আগের ৩ ফাইনালের ব্যর্থতা, নকআউটে বড় দলের বিপক্ষে গোলহীন থাকা, জাতীয় দলের হয়ে প্রথম শিরোপা জয়, কিংবা সমালোচকদের মুখ বন্ধ দেওয়ার জন্য কালকের চাইতে মোক্ষম সুযোগ লিওনেল মেসি কি আর পাবেন?
অন্যদিকে ঘরের মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে শিরোপা দেখার ইচ্ছেটাও নিশ্চয়ই নেইমার এবং তার বাহিনীর মাঝে নেই। শেষ পর্যন্ত যে দলই জিতুক না কেন, সব মিলিয়ে ফুটবলপ্রেমীরা আগামীকাল যে একটা রূদ্ধশ্বাস প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচের সাক্ষীই হতে যাচ্ছেন, সেটা আশা করা যায়। দিনশেষে ফলাফল তো স্রেফ একটা বাড়তি পাওনা!