হুলেন লোপেতেগিকে নিয়ে এখন মহা হইচই। বিশ্বকাপের দুই দিন আগে স্পেনের এই কোচের রিয়ালে যোগ দেওয়ার ঘোষণা এসেছিলো। তাতে চাকরি গেছে তার স্পেন থেকে। এই নিয়ে চলছে মহাবিতর্ক।
এ সময়ে ফিরে দেখা যাক, এমন ঘটনা নতুন কি না। স্প্যানিশ পত্রিকা মার্কা এমন আরও কয়েকটি উদাহরণ টেনে এনেছে, যেখানে কোচ টুর্নামেন্টের মাঝপথে বা শুরুর আগে ক্লাবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাক আরও কয়েকটি লোপেতেগি কান্ড।
আন্তোনিও কোন্তে
হুলেন লোপেতেগের আগে সর্বশেষ এই ধরনের ঘটনার উদাহরণ তৈরি করেছিলেন কোন্তে। ২০১৬ ইউরোতে তিনি ছিলেন ইতালির কোচ। টুর্নামেন্ট শুরুর মাস দুয়েক আগে তিনি চেলসির সাথে চুক্তি করে ফেললেন। ইউরো শুরুর আগে সে ঘোষণাও দিয়ে দিলেন। জানালেন যে, ইউরোর পর তিনি আর ইতালি দলের দায়িত্বে থাকছেন না। চেলসিতে যোগ দেবেন কোন্তে।
এই ঘোষণায় ইতালিয়ান ফুটবল ফেডোরেশন কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
কোন্তে খেলোয়াড়ী জীবনে ছিলেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। খেলেছেন জুভেন্টাস ও ইতালি জাতীয় দলের হয়ে। জুভেন্টাসের হয়ে প্রায় তিনশ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। এছাড়া ইতালি জাতীয় দলের হয়েও ২০টি ম্যাচ খেলেছেন।
খেলা ছাড়ার পর শুরুর দিকে কয়েকটি ছোট ছোট ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন। তবে কোচ হিসেবে নিজেকে বড় করে তোলেন জুভেন্টাসের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। এরপর ২০১৪ সালে ইতালি জাতীয় দল সামলানোর জন্য ডাক পান। দুই বছর পর সেখান থেকে চলে আসেন চেলসিতে।
লুই ফন গাল
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম নামকরা এই কোচ। ২০১৪ বিশ্বকাপের আগে আগে তিনি ঘোষণা দেন, তিনি ফার্গুসন উত্তরযুগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। তখনও তিনি হল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ। অনেকটাই লোপেতেগির মতো অবস্থা। এরপরও তিনি বিশ্বকাপে দায়িত্ব চালিয়ে গেছেন। দলকে সেমিফাইনালে তুলেছেন। তারপর এসে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিয়েছেন।
খেলোয়াড়ী জীবনে ছিলেন মিডফিল্ডার। আয়াক্সের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। কিন্তু খেলোয়াড়ী জীবনে একদমই বলার মতো কিছু করতে পারেননি, যা করেছেন কোচ হিসেবে।
এজেড ও আয়াক্সের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কোচিং জগতে পা রাখেন। এরপর আয়াক্সের পূর্ণ দায়িত্ব পান। সেখান থেকে চলে আসেন খোদ বার্সেলোনায়। মাঝে কিছুকাল নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করে আবার বার্সেলোনায় ফেরেন। বার্সেলোনা থেকে বের হয়ে এজেডের দায়িত্ব পালন করেন। আবার যান বড় ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। সেখান থেকে আরেক দফা নেদারল্যান্ডসের দায়িত্ব পালনের পর এখন আছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে।
বার্সেলোনার হয়ে দুটি লা লিগা, বায়ার্নের হয়ে একটি বুন্দেসলিগা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে একটি এফএ কাপসহ ক্যারিয়ারে জিতেছেন অসংখ্য শিরোপা। তার সহকারী থেকে বিশ্ব কাঁপানো কোচ হয়েছেন হোসে মরিনহো।
লুইস আরাগোনাস
স্পেন নিজেই এর আগে এই ধরনের ঘটনা দেখেছে। ২০০৮ ইউরোর একেবারে মাঝ বরাবর এসে আরাগোনাস জানিয়েছিলেন, তিনি ইউরোর পর তুরষ্কের ক্লাব ফেনারবাচেতে যোগ দিচ্ছেন। সেটা ছিলো রাশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচের ঠিক আগের ঘটনা। এই ঘটনার পরও তখনকার রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ইউরোর বাকিটুকু নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করে গেছেন আরাগোনাস। এমনকি তার দল ইউরো জিতেই বাড়ি ফিরেছিলো।
স্পেনের এই গুনী কোচের খেলোয়াড়ী জীবনও একেবারে ফেলনা ছিলেন না। স্পেন জাতীয় দলেও খেলেছেন সে সময়ের আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড়। খেলেছেন গেটাফে, রিয়াল মাদ্রিদেও। তবে ক্যারিয়ারের সিংহভাগ কেটেছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে। খেলা ছাড়ার পর ঐ অ্যাটলেটিকোতেই কোচিং শুরু। এরপর আরও তিন দফা অ্যাটলেটিকোতে কোচিং করিয়েছেন। এছাড়া বার্সেলোনা, স্প্যানিওল, সেভিয়া, ভ্যালেন্সিয়া, মায়োর্কার মতো ক্লাবে কাজ করেছেন। ২০০৯ সালে কোচিং ছেড়ে দেন। ২০১৪ সালে ৭৫ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই কোচ।
লুই ফেলিপ স্কলারি
স্কলারিও ঘোষণাটা দিয়েছিলেন ২০০৮ ইউরো চলাকালীন সময়ে। তখন তিনি পর্তুগালের কোচ। টুর্নামেন্ট শুরু হতে তখন ঠিক দুই দিন বাকি। সেই সময় ঘোষণা এলো যে, চেলসির কোচ হতে যাচ্ছেন। স্কলারির কপালটা আরাগোনাসের মতো ছিলো না। এই ঘোষণার পর তার দল টুর্নামেন্টে একটি ম্যাচও জেতেনি। জার্মানির কাছে ৩-২ ব্যবধানে হেরে টুর্নামেন্ট শেষ হয় তাদের। এটা ঠিক যে, স্কলারিকে ব্যাপক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিলো ঐ সময়ে ক্লাবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোয়। বিশেষ করে পর্তুগিজ সংবাদমাধ্যম তাকে প্রচন্ড আক্রমণ করেছিলো। তারা মনে করে, ২০০৮ ইউরোতে বাজে ফলাফলের এটাই কারণ ছিলো।
‘বিগ ফিল’ অবশ্য এই একটি ঘটনায় ব্যাখ্যা করার মতো চরিত্র নন। তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে দাপুটে কোচদের একজন। একেবারেই সাধারণ থেকে উঠে এসে দুনিয়া কাঁপানো কোচ হয়েছেন তিনি। ছিলেন সাধারণ মানের এক খেলোয়াড়। খেলা ছাড়ার পর লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ সব ক্লাবে কোচিং করিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। ততদিনে গোটা বিশেক দলের কোচিং করিয়ে ফেলেছেন। এরপর ২০০১ সালে ব্রাজিলের দায়িত্ব পেলেন। আর সেখানেই প্রথম ম্যাজিকটা দেখালেন। ব্রাজিলকে তিন বিশ্বকাপের মধ্যে দ্বিতীয় ট্রফি এনে দিলেন। ২০০৩ সালে চলে গেলেন পর্তুগালে। সেখানে পাঁচ বছর ছিলেন। এরপর চেলসি হয়ে আবার কিছুদিন আলোর বাইরে ছিলেন। ২০১২ থেকে দুই বছর আবার ব্রাজিলের দায়িত্বে ছিলেন।
গাস হিডিংক
২০০৮ ইউরো ছিলো কোচদের চাকরি ছেড়ে ক্লাবে যাওয়ার এক আসর!
এই আসরে আরাগোনাস, স্কলারির পাশাপাশি গাস হিডিংকও ক্লাবে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তখন রাশিয়ার কোচ। রাশিয়ার চাকরি না ছেড়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন চেলসির অন্তর্বতীকালীন কোচ হিসেবে কাজ করবেন। সেই অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে চেলসিকে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালেও তুলেছিলেন।
গাস হিডিংক ইউরোপের নামকরা কোচদের একজন। কিন্তু খেলোয়াড়ী জীবন ছিলো একেবারেই সাদামাটা। ১৯৮৭ সালে পিএসভি আইন্দহোভেনের হয়ে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। এরপর ফেনারবাচে ও ভ্যালেন্সিয়া হয়ে নেদারল্যান্ডে আসেন। সেখান থেকে একেবারে রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব পালন করেন। অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও নেদারল্যান্ডে দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ আরও এক দফা চেলসির অন্তর্বতীকালীন কোচ হিসেবে কাজ করেন।
লাজলো কুবালা
স্পেনের আরেক কান্ড। ১৯৮০ ইউরো শুরুর ঠিক তিন দিন আগে হাঙ্গেরির এই কিংবদন্তী কোচ জানান, তিনি স্পেন ছেড়ে বার্সেলোনায় যোগ দিতে যাচ্ছেন। ১১ বছর স্পেনের দায়িত্ব পালনের পর তিনি এই ঘোষণা দেন। এতে ইউরোর আগে তার চাকরি যায়নি। তবে ইউরোতে একটা ম্যাচও জিততে না পারায় সমালোচনা হয়েছিলো।
অত্যন্ত বৈচিত্রময় ক্যারিয়ারের অধিকারী ছিলেন কুবালা। তিনটি স্বীকৃত জাতীয় দলসহ ৬টি ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও স্পেনের হয়ে খেলেছেন। এছাড়া ইউরোপ একাদশ, কাতালোনিয়ার হয়েও খেলেছেন এই স্ট্রাইকার। বার্সেলোনায় জন্ম নেওয়া এই তারকা খেলেছেন বেশিরভাগ সময় বার্সেলোনাতেই। এছাড়া ছোটখাট কিছু ক্লাবেও খেলেছেন তিনি। বার্সেলোনাতেই কোচিং শুরু করার পর জীবনের পরবর্তী অংশ স্পেন ও বার্সেলোনাতে কাটিয়েছেন।
মিলজান মিলজানিচ
সাবেক সার্বিয়ান এই ডিফেন্ডারকে ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে যুগোস্লোভিয়ার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি রিয়াল মাদ্রিদের নজরে পড়ে যান। রিয়াল তাকে বিশ্বকাপের আগেই চুক্তিতে সই করিয়ে ফেলে। যুগোস্লোভিয়া দল বিশ্বকাপে দ্বিতীয় পর্বে বাদ পড়ে। কিন্তু মিলজানিচ রিয়ালে সফল ছিলেন। ১২ পয়েন্টের পরিষ্কার ব্যবধানে প্রথম মৌসুমেই লিগ জিতেছিলেন।
খেলোয়াড়ী জীবনে সর্বোচ্চ অর্জন ছিলো রেডস্টার বেলগ্রেডের হয়ে খেলা। আর কোচিং জীবনে তিন দফায় যুগোস্লোভিয়ার কোচ ছিলেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফার পরই রিয়ালের কোচ হন। তৃতীয় দফার পর এসেছিলেন ভ্যালেন্সিয়ায়।