শচীন টেন্ডুলকার, সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। কারো কারো মতে সর্বকালেরই সেরা। একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করেছেন। এর মধ্যে টেস্টে করেছেন ৫১টি। এমন কোনো প্রতিপক্ষ নেই, যার বিপক্ষে তিনি সেঞ্চুরি করেননি। এমন কোনো মহাদেশ নেই, যেখানে তার সেঞ্চুরি নেই। জিম্বাবুয়ের মাঠ ব্যতীত প্রতিটি প্রতিপক্ষের মাঠেই সেঞ্চুরি করেছেন। এতসব সেঞ্চুরির মাঝে সবচেয়ে কঠিন ছিল কোন ইনিংসটি? শচীন টেন্ডুলকারের নিজের ভাষায়, সেটি ছিল ১৯৯৯ সালের পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৩৬ রানের ইনিংসটি।
নানা কারণেই পাকিস্তান-ভারত সিরিজটা কাঙ্ক্ষিত ছিল। রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে ১৬ বছর পর টেস্ট সিরিজে মুখোমুখি হচ্ছিল এই দুই দল। এক দলে ছিল বিশ্বের সেরা ব্যাটিং লাইন আপ, আরেক দলে বিশ্বের সেরা বোলিং লাইন আপ। সিরিজটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, সে ব্যাপারে সবাই নিশ্চিতই ছিল। তার উপর ভারত সেই সিরিজের আগে টানা ১০ বার ঘরের মাঠে সিরিজ হারেনি। এই পরিসংখ্যান ভারতের পক্ষে কথা বলে। আবার আরেকটি পরিসংখ্যান পাকিস্তানের পক্ষে বলে। সর্বশেষ যে সিরিজটি তারা ঘরের মাঠে হেরেছিল, সেটি পাকিস্তানেই বিপক্ষে।
একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক সেই ইনিংস এবং একইসাথে সেই ম্যাচটির দিকে, যেটি কিনা শচীনের মতো ব্যাটসম্যানের কাছে সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছিল।
প্রথম ইনিংস
টস জিতে পাকিস্তান ব্যাটিং করতে চাইল। বিষয়টা অনুমিতই ছিল। এ ধরনের সিরিজগুলোতে সাধারণত কোনো দলই পরে ব্যাটিং করার চাপ নিতে চায় না। ব্যাটিংয়ের শুরুটাও পাকিস্তানের চমৎকার হলো। মাত্র ৮ ওভারেই ৩২ রানের একটি জুটি গড়ে ফেললেন সাঈদ আনোয়ার আর শহীদ আফ্রিদি। ৯ম ওভারের প্রথম বলে আফ্রিদি আউট হলেন, সাথে সাথেই যেন ভারতীয় বোলাররা ম্যাচে ফেরত আসলেন। পরবর্তী চারটি জুটিতে সর্বোচ্চ জুটি হলো ২৫ রানের। ফলাফল সাঈদ আনোয়ার, ইজাজ আহমেদ, ইনজামাম-উল হক আর সেলিম মালিকের মতো ব্যাটসম্যানরা অল্প রানেই আউট এবং মাত্র ৯১ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান বিপদগ্রস্ত। সেই মুহূর্তে পুরো দলের দায়িত্ব যেন কাঁধে তুলে নিলেন মাত্র ৮ম টেস্ট খেলতে নামা ইউসুফ ইয়োহানা।
সঙ্গী হিসেবে পেলেন উইকেটকিপার হিসেবে খেলতে নামা মঈন খানকে। এই জুটিতে ৬৩ রান এল, যা পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসের সর্বোচ্চ। আরো কিছু রান হয়তো আসত, কিন্তু বাধ সাধলেন টেন্ডুলকার। নিরীহ দর্শন একটা বল ইউসুফের প্যাডে আঘাত হানল, শচীন এল.বি.ডব্লিউয়ের আপিল করলেন। আম্পায়ারও আউট দিয়ে দিলেন। তখন পাকিস্তানের রান মাত্র ১৫৪। ২০০ রানের নিচেই হয়তো পাকিস্তান অল আউট হয়ে যেত, কিন্তু মঈন খান খেললেন ৬০ রানের এক কার্যকরী ইনিংস। ৩৮ রানের ইনিংস খেলে যোগ্য সঙ্গ দিলেন অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম। তাদের ৬০ রানের জুটির সুবাদেই শেষ পর্যন্ত ২৩৮ রানের পুঁজি পায় পাকিস্তান। অনিল কুম্বলে পান ৬ উইকেট আর শ্রীনাথ ৩ উইকেট।
দ্বিতীয় ইনিংস
ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ বরাবরই বিখ্যাত। সেই সময়েও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তবে লাইন আপের মাঝে ওপেনার দুজনই ছিলেন তুলনামূলক বিচারে কম আলোকিত। ভিভিএস লক্ষ্মণ (তখনো তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেননি) আর অভিষেক হওয়া সদাগোপন রমেশ। পরের চারজন ছিলেন যথাক্রমে রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার, মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন আর সৌরভ গাঙ্গুলি। পাকিস্তানের বোলিং লাইন আপও দুর্দান্ত ছিল। ওয়াসিম আর ওয়াকারের সাথে স্পিনার সাকলাইন মুশতাক এবং অভিষিক্ত নাদিম খান। পাকিস্তানি বোলারদের লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব উইকেট ফেলে ম্যাচে ফিরে আসা। কারণ, তাদের ব্যাটসম্যানদের সংগ্রহ খুবই কম।
কিন্তু সবাই যা ভেবেছিল, ঘটলো তার উল্টো। রমেশ আর লক্ষ্মণ মোটামুটি মারমুখী ব্যাটিং করে স্কোরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকল। ১২.৫ ওভারে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন লক্ষ্মণ আউট হলেন, তখন ভারতের সংগ্রহ ৬৭ রান। কিছুক্ষণ পরেই আউট হলেন রমেশ, আউট হবার আগে তিনি করেছিলেন ৪১ বলে ৪৩ রান। প্রথম দুটো উইকেটই ওয়াসিম আকরামের। মাঠে নামলেন শচীন টেন্ডুলকার। বল করছেন সাকলাইন মুশতাক। তৃতীয় বলেই ডাউন দ্য উইকেটে এসে মারতে চাইলেন শচীন। ঠিকমতো টাইমিং না হওয়ায় ক্যাচ উঠে গেল। শচীন আউট হলেন শূন্য রানেই। খুব দ্রুতই ম্যাচে ফেরত আসলো পাকিস্তানিরা।
কিছুক্ষণের মাঝেই আজহার উদ্দিনও মাত্র ১১ রানে ফিরে গেলে ভারতের স্কোর দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ১০৩ রান। রাহুল দ্রাবিড় আর সৌরভ গাঙ্গুলির দুটো অর্ধশতক আর লোয়ার অর্ডারে সুনীল যোশির অপরাজিত ২৫ রানের এক কার্যকর ইনিংসের বদৌলতে ভারত অলআউট হয় ২৫৪ রানে। সাকলাইন ৫ উইকেট পান, সাথে অনিয়মিত বোলার আফ্রিদি ৩ উইকেট। যে ভারতের সম্ভাবনা ছিল ২০০ রানের লিড নেওয়ার, তাদেরকে মাত্র ১৬ রানের লিড দিয়েই ম্যাচে ফেরত আসে পাকিস্তান।
তৃতীয় ইনিংস
পাকিস্তানিদের লক্ষ্য ছিল টার্গেটটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে নিতে। সেজন্য ওপেনারদের বিশেষ করে সাঈদ আনোয়ারের উপর প্রত্যাশা ছিল বেশি। কিন্তু মাত্র ৭ রান করেই ফিরে গেলে পাকিস্তান প্রথম হোঁচটটা খায়। ইজাজ আহমেদও অল্প রানে ফেরত আসলে জুটি বাঁধেন আফ্রিদি আর ইনজামাম। ইনজামামকে আউট করেন শচীন, এরপর ইউসুফকেও অসাধারণ একটি ডেলিভারিতে ফেরত পাঠান তিনিই। লেগ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে বলটা পড়ে অসাধারণ টার্ন করে। বোল্ড হয়। এক প্রান্তে আফ্রিদি মোটামুটি একাই পাকিস্তানকে টানতে থাকেন। পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি।
সেলিম মালিকের সাথে যখন আফ্রিদি জুটি গড়ে তুলছিলেন তখন মনে হচ্ছিল যে, পাকিস্তান খুব বড় টার্গেটের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু ভারত খুব দ্রুত ম্যাচে ফেরত চলে আসে। ভেংকটেশ প্রসাদের এক অসাধারণ জাদুতে ৪ উইকেটে ২৭৫ রান থেকে পাকিস্তান অলআউট হয় মাত্র ২৮৬ রানে। প্রসাদ সেই স্পেলের ৫ উইকেটসহ পুরো ম্যাচে ৬ উইকেট পান। ভারতের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৭১ রান।
চতুর্থ ইনিংস
লক্ষ্যমাত্রা খুব বেশি ছিল না। তৃতীয় দিনের শেষ ২০ ওভার, সাথে পরের দুই দিনের আরো ১৮০ ওভার। এর মানে ২০০ ওভারে টার্গেট ২৭১ রান। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে রান করা সবসময়ই কঠিন, এর সাথে যুক্ত হবে পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণ। শুরুতেই দুর্দান্তভাবে আক্রমণ শুরু করলেন আগের ইনিংসে কোনো উইকেট না পাওয়া ওয়াকার ইউনুস। নিজের দ্বিতীয় ওভারেই মাত্র ৫ রানে ফিরিয়ে দিলেন আগের ইনিংসে সাবলীল খেলতে থাকা সদাগোপন রমেশকে। এরপর নিজের তৃতীয় ওভারে শূন্য রানে ফেরালেন আরেক ওপেনার লক্ষ্মণকে। মাঠে তখন ভারতের দুই ভরসা দ্রাবিড় আর শচীন।
সেই দিনটা নির্বিঘ্নেই কাটিয়ে দিলেন এই দুই ব্যাটসম্যান। পরের দিনটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবাই জানত, বড় কিছু না হলে ম্যাচের নিষ্পত্তি চতুর্থ দিনেই হতে যাচ্ছে। দিনের শুরুতেই দ্রাবিড়কে অসাধারণ এক বলে বোল্ড করলেন ওয়াসিম আকরাম। যতটুকু ছোঁয়া লাগলে অফ স্ট্যাম্পের বেল্ট পড়বে, ঠিক ততটুকুই লাগল। আজহার আর গাঙ্গুলিকেও যখন সাকলাইন মুশতাক অল্প রানে আউট করলেন, তখন ভারতের সংগ্রহ ৫ উইকেটে ৮২। সৌরভ গাঙ্গুলির আউটটা অবশ্য দুর্ভাগ্যজনক ছিল। মঈন খান ক্যাচ ধরার আগে সেটি মাটি স্পর্শ করেছিল, কিন্তু লেগ অ্যাম্পায়ারের নজর এড়িয়ে যায়। জিততে হলে করতে হবে আরো ১৮৯ রান, শচীন বাদে নেই আর কোনো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান।
এর সাথে পাকিস্তানিরা করছেন আগুন ঝরানো বল। লক্ষ্যটা তাই অনেক বড়ই মনে হচ্ছিল। শচীন টেন্ডুলকার সম্ভবত একটু দূরের দিকে তাকালেন। লক্ষ্যটা বুঝতে চাইলেন প্রথমে, তারপর সেদিকে এগোলেন। সাথে থাকা উইকেট কিপার নয়ন মঙ্গিয়াও যোগ্য সমর্থন দিলেন। ৪৪ ওভারে এই জুটির ১৩৬ রান ভারতকে আবার ম্যাচে ফিরিয়ে নিয়ে এল। আর মাত্র ৫৩ রান বাকি, ম্যাচে আছেন দুর্দান্ত ব্যাটিং করা শচীন আর অর্ধশত করা নয়ন মঙ্গিয়া। পাল্লাটা ভারতের দিকেই হেলে ছিল। কিন্তু ভুলটা সম্ভবত করে ফেললেন নয়ন মঙ্গিয়াই। ওয়াসিম আকরামকে পুল করতে গিয়ে ক্যাচ উঠিয়ে দিলেন। সেই সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো। মাঠে নামলেন আগের ইনিংসে ২৫ রান করা সুনীল যোশি।
শচীনের সাথে তিনিও ভালোই খেলতে লাগলেন। সাকলাইনকে বিশাল একটা ছয় মেরে বুঝিয়ে দিলেন যে দিনটা ভারতেরই। ঠিক এই মুহূর্তে শচীন টেন্ডুলকার পিঠের ব্যথায় মাঠে শুয়ে পড়লেন। পুরো ভারতবাসী আতঙ্কে অস্থির। আর মাত্র কয়েকটা রান। ওয়াসিম আকরামকে অসাধারণ এক স্ট্রেইট ড্রাইভে চার মেরে টার্গেট নামিয়ে নিয়ে আসলেন ৩০-এ। পাকিস্তানিদের ম্যাচে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাটসম্যানদের একটা ভুল। অবশেষে সেই সুযোগটা তাদেরকে দিলেন শচীন নিজেই। সাকলাইনের একটি ওভারে পরপর দুই বলে দুই চার মেরে টার্গেট নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ১৭-তে। সেই ওভারে ততক্ষণে উঠে গিয়েছে ১০ রান।
সাকলাইনকে আরো একটা চার মারতে গিয়ে ক্যাচ উঠিয়ে দিলেন শচীন। ব্যস, এতটুকুই প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের। লোয়ার অর্ডারের লেজ কাটতে সিদ্ধহস্ত পাকিস্তানিরা, বিশেষ করে ওয়াসিম আকরাম। এই সুযোগ কি তারা আর হাতছাড়া করবে? ভারতীয়দের কাছে ১৭ রানের লক্ষ্যকেও তখন মনে হচ্ছে অনতিক্রম্য। পরবর্তী ৪ রানেই শেষ ৩ উইকেট ফেলে দিলেন ওয়াসিম আর সাকলাইন, পেলেন ১২ রানের এক অসাধারণ জয়। সাকলাইন আবারও ইনিংসে ৫ উইকেট পেলেন, ম্যাচে ১০ উইকেট।
এমন অসাধারণ ইনিংস খেলার পরেও পরাজিতদের দলে থাকতে হলো শচীন টেন্ডুলকারকে। তবে দুই ইনিংসেই ৫ উইকেট পাওয়া সাকলাইন কিংবা অসাধারণ ১৪১ রানের ইনিংস খেলা আফ্রিদিকে হারিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার ঠিকই জিতে নিলেন শচীন টেন্ডুলকার।
বোলাররা দুর্দান্ত বোলিং করে উইকেট পাচ্ছে, সঙ্গী ব্যাটসম্যানরা একের পর এক মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, টার্গেট ধীরে ধীরে কঠিন হচ্ছে- এমন পরিস্থিতিতে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদেরকে নিয়ে লড়াই করে ম্যাচে ফিরে আসাটা আসলে কঠিনই ছিল। আর একারণেই নিজের কঠিনতম ইনিংস বাছাই করাটা শচীনের জন্য আর কঠিন হয়ে ওঠেনি। আসলে এই টেস্টটা ছিল টেস্ট ক্রিকেটেরই এক কঠিন অধ্যায়।
Featured Image Source: ESPNcricinfo