বিজয় মার্চেন্টের গল্প শুনবেন? গল্পটা যখন ব্যাটিং গড় নিয়ে, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৭১.৬৪ গড় নিয়ে একজন অতিমানব স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পরই যার অবস্থান। কিংবা সুনীল গাভাস্কারের? প্রথমবারের মতো ক্রিকেট দশ হাজারি ক্লাবে প্রবেশ করেছিলো তো এই মানুষটার হাত ধরেই। আর শচীন টেন্ডুলকারের গল্পটা তো আপনাদের জানাই। ধর্মের নামটা যখন ক্রিকেট, ঈশ্বরকে ছাড়া কি আর পূজো হয়! হালের বিরাট কোহলিকে নিয়ে গল্পের আসর বসালে আপনারাই তো বলবেন, ‘রোজকেরে নয়টা-পাঁচটা জীবনের চেয়েও তো ওনার সেঞ্চুরির খবরে আমরা বেশি অভ্যস্ত!’ হায়দরাবাদের লক্ষ্মণের গল্প বললে, এপাশ থেকে দাদা বলবেন, ‘আমি যে ক্যাপ্টেন ছিলুম!’ রাহুল দ্রাবিড় নিপাট ভদ্রলোক, সেই তিনিও হয়তো মিনমিনে গলায় দাবি তুলবেন, ‘ওরে, ক্রিকেট ব্যাকরণটা যে আমিই ভালো শেখাতাম। আমার গল্পটাই নাহয় হতো!’
নাহ, কোন ব্যাটসম্যানের গল্প বলে কার রোষানলে না পড়ি! তার চেয়ে বরং এক বোলারের গল্প বলালা যাক, বুমরাহর গল্প হয়ে যাক!
১.
আলস্যে ভরা গ্রীষ্মের বিকেলবেলায় সে গল্পের সূচনা। আলস্যটা সবাইকে জড়াতে পারে না অবশ্য, বিশেষ করে জসপ্রীতের মতো ছেলেদেরকে তো একদমই না। বাড়ির মধ্যেকার এক চিলতে ফাঁকা জায়গাটাই যার খেলার বিশাল উদ্যান, ঘরের এমাথা-ওমাথাই যার বাইশ গজ। বল পিচ করবার আওয়াজ তাই বাড়ির নিত্যকার শব্দ।
তবে সারাদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়দায়িত্ব সামলে এসে সেই ঠুকঠুক শব্দ কারই বা ভালো লাগে! দালজিৎ বুমরাহরও লাগেনি। জসপ্রীত বুমরাহর কাছে তাই আদেশ যায়,
‘খেলো, বাধা দেব না। শর্ত একটাই, শব্দ করবে না!”
উপায়? দেয়াল আর মেঝেটা যেখানটায় মিশেছে, সেখানে বল ফেললে শব্দটা কম হয়, এই দিগন্তরেখার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ইতঃমধ্যেই। আর কিছু ভাববার দরকার কি!
ইয়র্কারের সঙ্গে তাঁর প্রেম নিয়ে যে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ ব্যয় হচ্ছে, এই সখ্যতা তো গড়ে উঠেছিলো সেদিনই।
২.
মানুষ নাকি তার স্বপ্নের সমান বড়। অবশ্য অত বড় হলেও স্বপ্নের তারটা বোধহয় এর চেয়েও আরও একটু উঁচুতেই বাঁধা পড়বে। যে ছেলে ঘরের ড্রয়িংরুমে ক্রিকেট খেলার মাঝেই ‘সব পেয়েছি’র আনন্দে ভেসেছিলো এককালে, বছর দুয়েক পরে তার মাথাতেই তাই ভূত চাপে, ‘ক্রিকেটার হবো!’
হ্যাঁ, শব্দটা ভূত চাপাই। যে দেশে প্রতি মিনিটে জন্ম নেয় ৩৪ জন নবজাতক, সে দেশে তিনি এগারো জনের একজন হবেন, মধ্যবিত্তের পরিবারে ছেলেমেয়ের এমন স্বপ্ন দেখা মানেই তো ‘ডাকো কবিরাজ, আনো ওঝা, ভূত ঝাড়াতে হবে ছেলের’!
দালজিৎ বুমরাহও হয়তো বা তাই করতেন। কিন্ত তিনি যে এক প্রাক-প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। সারাদিন বাবা-মায়েদের ‘আপনার ছেলেকে তার মর্জিমতো চলতে দিন, তার স্বপ্নকে তাড়া করতে দিন’ বলা মানুষটি যদি নিজের ছেলের বেলাতেই সেটার অন্যথা ঘটান, তবে যে বিশাল এক কেলেঙ্কারি হয়ে যায়। দালজিৎ বুমরাহ রাজি হন জসপ্রীত বুমরাহকে ক্রিকেটার বানাতে। তার বয়স তখন চৌদ্দ।
৩.
কোনো এক মনীষী বলেছিলেন, ‘যা ভালোবাসো, সেটাই করো!’ বুমরাহ’র ক্ষেত্রেও বোধহয় তাই হয়েছিলো। তাই কাকডাকা ভোরে উঠে প্র্যাকটিসে যাওয়া, এসে খেয়ে-না খেয়ে স্কুলে দৌঁড়ানো, সেখান থেকে এসে আবারও সন্ধ্যেবেলার অনুশীলন, এসবই তো সম্ভব হয়েছিলো খেলাটাকে প্রচণ্ড ভালোবাসার কারণেই।
সাফল্যও আসছিলো তরতর করে। গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের ‘সামার ক্যাম্প’, এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনের ক্যাম্পিং, কিংবা ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির জোনাল ক্যাম্পিং; এত সব বাধা পেরোনোর জন্যে সময় লেগেছে অল্পই।
থামেননি সেখানেই, গুজরাট অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা পেয়েছিলেন যেবার, প্রথম ম্যাচেই দিয়েছিলেন সামর্থ্যের প্রমাণ। বাউন্সার, ইয়র্কারের মিশ্রণে সৌরাষ্ট্রের ব্যাটসম্যানদের নাকাল করে তুলে নিয়েছিলেন সাত উইকেট। প্রথম মৌসুমের সাফল্য সুযোগ করে দিলো সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফির গুজরাট দলে।
৪.
ইংরেজিতে এক বেশ জনপ্রিয় প্রবাদ আছে, ‘Fortune favours the brave.”
সেবারের আসরে বুমরাহর চেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছিলেন ২৩ জন, তার চেয়ে বেশি মিতব্যয়ী বোলিং করা বোলারের সংখ্যাও ছিলো ২৩ জন। কিন্তু আসল বোলিংটা যেন জমিয়ে রেখেছিলেন ফাইনালের জন্যে, যে ম্যাচ দেখতে পুনের মাঠে উপস্থিত ছিলেন জন রাইট, আইপিএলের দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের তৎকালীন কোচ। কিছুদিন বাদে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দলে বুমরাহর জায়গা করে নেওয়াটাকে চাইলে এই ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়াই যায়, সেই লো স্কোরিং ম্যাচে গুজরাটের ম্যাচ জয়ের কারণ তো মূলত বুমরাহ’র ১৪ রান খরচায় ৩ উইকেট তুলে নেওয়াই। সবাইকে ছাপিয়ে কোচের চোখ পড়লো ওই দশ কদমের রানআপওয়ালা বোলারের উপরই।
জীবনের রোলার কোস্টার রাইডে চড়ে হঠাৎই আবিষ্কার করলেন, ক্রিজটা আর বাড়ির ড্রয়িংরুম নেই, উইকেটের সামনে বিরাট কোহলি। আইপিএলে প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষই যে ছিল বিরাট কোহলির রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেকটাও সে বছরই, ২০১৩ সালে।
৫.
আইপিএলে প্রথম ম্যাচটা অবশ্য ভালোয়-খারাপে মিলিয়ে-মিশিয়ে কোনো একরকমে কেটেছে। বিরাট কোহলির হাতে প্রথম ওভারেই তিন চার খাবার অভিজ্ঞতা যেমন হয়েছে, সেই ওভারেই বিরাট কোহলিকে আউট করবার উল্লাসেও মাতার সুযোগ হয়েছে। তার চেয়েও বেশি বোঝা গিয়েছে, এই পর্যায়ের ক্রিকেটটায় স্রেফ অ্যাকশনটা আলাদা হলেই চলবে না, বোলিংটাও হতে হবে আলাদা। আর আলাদা হতে চাইলে লাসিথ মালিঙ্গার চেয়ে যোগ্য শিক্ষক আর কোথায় পাওয়া যাবে! উনিও যে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সেই খেলেন।
তার সান্নিধ্যে আরও কিছু উন্নতি করে দৃষ্টি কেড়েছিলেন নির্বাচকদের। ‘এ’ দলে খেলছিলেনও নিয়মিত। কিন্তু এরপরই ক্রিকেটারদের আজন্মকালের আততায়ী চোটের আঘাত। ফলাফল? সাড়ে চার মাস মাঠের বাইরে, ১৫০ কোটি মানুষের দেশে নির্বাচকদের দৃষ্টির বাইরে যেতে এ সময়টুকুই যথেষ্ট!
৬.
এমন ইনজুরি থেকে ফিরে যা হয়, পেস বোলারদের ছন্দ খুঁজে পেতে পেতেই চলে যায় আরও অনেকটা দিন। চোট থেকে ফিরে খেলেছিলেন বিজয় হাজারে ট্রফিতে, ৯ ম্যাচে ২১ উইকেট পেয়ে বুঝিয়েছিলেন, চোট পেছাতে পারেনি খুব একটা। প্রতিপক্ষ দলে পেয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে, ভারতীয় ক্রিকেটের জহুরী বললেও যাকে অতিরঞ্জনের বাড়বাড়ান্তিতে পড়তে হবে বলে মনে হয় না।
প্রথম দেখায় প্রেম যদি ভুলও হয়, প্রথম দর্শনেই বুমরাহকে চিনে নিতে তার ভুল হয়নি একটুও। সে ম্যাচে ৩০ রান খরচায় ২ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন বুমরাহ, যার মাঝে ধোনির উইকেটটিও ছিল। অতটুকুন দেখেই বুমরাহকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়, আন্তর্জাতিক ম্যাচের অভিজ্ঞতা দিতে।
৭.
পরের গল্পটা স্রেফ ‘এলাম-দেখলাম-জয় করলাম’য়ের। প্রথম টি২০ ম্যাচে বল করেছিলেন ২১টি, বিনিময়ে রান দিয়েছিলেন ২৩টি, উইকেট বাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনটি। সাধে কি আর ধোনি বলেছিলেন, ‘আমরা একটা রত্ন পেয়েছি’!
সে বছরের এশিয়া কাপেও পারফরমেন্স ছিল অতিমানবীয়। ৫ ম্যাচে উইকেট পেয়েছিলেন মোটে ৭টি। কিন্তু ১৮ ওভার বল করে সেই টুর্নামেন্টে রান দিয়েছিলেন মোটে ৯৩, ওভারপ্রতি পাঁচের সামান্য বেশি! এই মারমার কাটকাট ক্রিকেটে অতিমানবীয়ই তো!
এই পারফরমেন্সের সুবাদে মোহাম্মদ শামি, উমেশ যাদবদের মতো পেসারদের হটিয়ে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন কিছুদিন বাদেই নিজ দেশে অনুষ্ঠিত হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ভালোয়-খারাপে মিলিয়ে বিশ্বকাপটা কাটলেও দলে নিজের জায়গা পাকা করতে সে পারফরমেন্স যথেষ্ট ছিল। একজন সত্যিকারের পেস বোলারের সাধ তো ভারতের অনেক দিনের!
এর আগে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বছরে সর্বোচ্চ ২৭ উইকেট নেবার কৃতিত্ব ছিল ডার্ক ন্যানেসের। বুমরাহ সে রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার বছরেই।
বাংলাদেশের জন্য অবশ্য বুমরাহ মানেই এক আক্ষেপের নাম। এই প্রজন্ম তো বটেই, আরও সাত প্রজন্মেও বোধহয় ভারতের কাছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ওই হারের ক্ষত শুকাবে না, জয়-পরাজয়ের মাঝে ব্যবধানটা যে এক রানের! ওই ম্যাচে ১৯তম ওভারটা করেছিলেন বুমরাহ, রান দিয়েছিলেন কেবল ছয়। বাংলাদেশটা ম্যাচ হেরেছিলো সম্ভবত ওখানেই।
বিশ্বকাপের ম্যাচ ছিল বলে ওই ম্যাচ মাহাত্ম্য পেয়েছে আলাদা। বুমরাহ’র জন্যে এটা অবশ্য সপ্তাহের বাকি পাঁচটা দিনের মতোই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচ, নিউজিল্যান্ডের হাতের মুঠো থেকে জয় ছিনিয়ে নেয়া, সুপার ওভারে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আর অ্যারন ফিঞ্চকে বশে রাখা, সবই তো তার সামর্থ্যের প্রমাণ।
শেষের ওভারগুলোতে, নখ কামড়ানো উত্তেজনার ম্যাচগুলোতে নিজের স্নায়ুকে স্বাভাবিক রাখতে পারার রহস্য বোধ করি তার জিনেই ছিলো। তার বড় বোন তো জানাচ্ছেন,
‘আমরা সবাই যখন ‘এটা কি হলো’, ‘এটা কি হলো’ ভেবে মিছে চিন্তায় মরি, জ্যাসি (বুমরাহকে আদর করে বাড়িতে এ নামেই ডাকা হয়) তখন আশ্চর্য শান্ত গলায় বলে, কিছুই তো হয়নি।’
৮.
টি-টোয়েন্টি বোলিং দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকটা ওয়ানডে ক্রিকেটে, ওই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই। ৪০ রান খরচায় উইকেট নিয়েছিলেন ২টি। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্দরমহলে কান পাতলে জেমস ফকনারকে আউট করা ইয়র্কার নিয়ে আলোচনা শুনতে পাবেন এখনও। সেই থেকে এখন অব্দি খেলা ৪৪ ওয়ানডেতে উইকেট নিয়েছেন ৭৮টি; গড়টা চমকজাগানিয়া, ২১.০১। ইকোনমি রেটও ঈর্ষাজাগানিয়া, ৪.৪৪!
৯.
প্রায় দু’বছর একদিবসী ক্রিকেট খেলে দাবি জানিয়েছিলেন নিজেকে লাল বলের ক্রিকেটে দেখার। যদিও ভারত ক্রিকেট দলের ব্যস্ত সূচির ফাঁকে ঘরোয়া চারদিনের ম্যাচ খেলতে পারেননি ততটা, অভিষেকের আগের বছর তো খেলেননি-ই। তাই দক্ষিণ আফ্রিকাগামী টেস্ট দলে তার নাম দেখে নাক শিঁটকেছিলেন অনেকেই। ওয়ানডে আর টেস্ট দলে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিলেও সাদা পোশাকের ক্রিকেটে তার সাফল্যপ্রাপ্তির সুযোগ দেখেননি অনেক ক্রিকেটবোদ্ধাই। তাদের গালিকে তালিতে রূপ দিতে সময় নিয়েছিলেন এক সেশন। প্রথম উইকেটটাই যে ছিল ডি ভিলিয়ার্সের!
তারপর ম্যাচ খেলেছেন আরও ১৩টি, উইকেট নিয়েছেন ৪৯টি। ভারতের হয়ে অভিষেক হওয়া বছরে তার চেয়ে বেশি উইকেট নিতে পারেননি আর কেউ, ভেঙেছেন দিলীপ দোশির ৩৯ বছরের পুরনো রেকর্ড। ম্যাচ জিতিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, ইংল্যান্ডে। সিরিজ জিতিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়, প্রথমবারের মতো।
১০.
অভিষেক টেস্টে প্রথম স্পেলে ৭ ওভার বল করে রান হজম করেছিলেন ৩১টি। আদর্শ টেস্ট বোলিং যাকে বলে, সেটাই যেন পাওয়া যাচ্ছিলো না তার বোলিংয়ে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে এরপরই তুলে নেন ডি ভিলিয়ার্স, ডু প্লেসিস আর ডি ককের উইকেট।
বুমরাহ ঠিক এখানটাতেই আলাদা। জন্মগতভাবেই পাওয়া বাহুর হাইপারএক্সটেনশন, আর আয়ত্ত করা অস্বাভাবিক অ্যাকশন তাকে কিছুটা সাহায্য করলেও তার সাফল্যের মূল রহস্য বোধহয় ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক, আর প্রতি মুহূর্তে ভালো থেকে আরও ভালো হবার তাড়না। একটি উদাহরণেই ব্যাপারটি পরিস্কার হবার কথা।
২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে বুমরাহর একটি নো বল বেশ আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছিলো। যে নো-বলের কারণে জীবন পেয়ে ফখর জামান করেছিলেন ম্যাচ উইনিং সেঞ্চুরি। এমনকি ২০১৮ সালের মাঝামাঝি ইংল্যান্ড সফরেও তিনি দাগ পেরিয়েছেন পাঁচবার। আর মাসখানেক আগের অস্ট্রেলিয়া সফরে? ১৩৪ ওভারে একবারও না!
নিজেকে প্রতিনিয়ত ভেঙেচুড়ে দেখবার যে চেষ্টা, এই চেষ্টার কারণটাতেই অস্বাভাবিক অ্যাকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে পাওয়া চোটপ্রবণতাকে অনায়াসে দূরে ঠেলে রাখতে পারেন, কারণ নিজের ফিটনেস লেভেলকে তিনি ঠিক অতটা উঁচুতেই তুলেছেন।
ফলাফল তো চোখের সামনেই। বর্তমানকালের সমীহ জাগানিয়া বোলিং লাইনআপের নাম নিলে ভারতের নামটাই কেন যেন সবার আগে মনে উঁকি দেয়!
চিরকালই ডেথ বোলিং ছিল ভারতের অধিনায়কদের জন্যে চিন্তাজাগানিয়া এক বিষয়। রসিকতা করে তো এমনও বলা হয়,
‘মহেন্দ্র সিং ধোনির চুলে পাক ধরেছে যতটা না বয়সের কারণে, তার চেয়েও বেশি ধরেছে শেষের ওভারগুলো কাকে দিয়ে করাবেন এই চিন্তায়!’
এখন আর সে ভাবনা নেই মোটেই। শেষের ওভারগুলোতে ব্যাটসম্যানদের হাত খোলার চিন্তায় লাগাম পড়াতে বুমরাহ আছেন যে!
চোখ বন্ধ করেও যিনি ইয়র্কার দিতে পারেন, ব্যাটসম্যানদের বাউন্সারে ভড়কে দিতে পারেন, হয়তোবা ১৪৫ কি.মি গতির পরের বলটাতেই ১০৬ কি.মি গতির স্লোয়ারে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করতে পারেন। ব্যাটসম্যানরা ঠিক কতটা বিভ্রান্ত হন, সেটা বোঝাতে পরিসংখ্যানের আশ্রয় নিলে মন্দ হয় না।
ইএসপিএন ক্রিকইনফো জানাচ্ছে, অভিষেক টেস্ট সিরিজেই ব্যাটসম্যানরা তার ডেলিভারিগুলোতে ‘কি করবো, কি করবো’ জাতীয় সমস্যায় ভুগেছেন ২৭.৪৯%। ইংল্যান্ড সিরিজে যা নেমে দাঁড়িয়েছিলো ২৭%-য়ে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ২৫ শতাংশে। বলা বাহুল্য, গত কয়েক বছরে এত পরিমাণ অনিশ্চয়তায় ব্যাটসম্যানদের আর কেউ ফেলতে পারেননি।
হাইপারএক্সটেনশনের কারণেই হোক কিংবা রপ্ত করা অ্যাকশনের কারণেই, ডেলিভারির সময়ে অদ্ভুত এক কোণ তৈরি করতে পারেন তিনি, সাথে তীব্র গতির কারণে ব্যাটসম্যানদের পক্ষে তাকে মোকাবিলা করা হয় প্রচণ্ড মুশকিলের এক ব্যাপার। এ কারণে এই বোলারদের সংগ্রামের সময়টাতেও তার ওয়ানডে ইকোনমি রেট ৪.৪৪। মাথায় রাখা দরকার, বুমরাহকে বোলিংয়ের সিংহভাগটাই করতে হয় প্রথম দশ ওভার আর শেষের স্লগ ওভারগুলোতে।
অভিষেকের পর থেকে তার খেলা ৪৪ ওয়ানডেতে ভারতের ৩০০ ছাড়ানো স্কোর রয়েছে ১০টি। বিপরীতে প্রতিপক্ষ এ সময়টায় ভারতের বিপক্ষে ৩০০ ছাড়াতে পেরেছে ৬ বার। আর বুমরাহ ওভারপ্রতি ছয়ের বেশি রান দিয়েছেন, এমন ঘটনা ঘটেছে মোটে পাঁচ দিন! বাকি দিনগুলোতে তিনিই দলের বোলিংয়ের প্রাণ।
তাই তো এই ৪৪ দিনে ভারতের জয় করা ম্যাচের সংখ্যা ৩৮, এ সময়কালে জয়ের শতকরা হিসেবে সবচেয়ে ধারেকাছে আছে ইংল্যান্ড, ৮১.০৩ শতাংশ জয়ী হিসেবে।
১১.
বুমরাহর ছোঁয়ায় পেস বোলারদের বাকিরাও যেন হয়েছেন উজ্জীবিত, কেউ বা জেগে উঠেছেন ফিনিক্স পাখির মতো। নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন, ভুবনেশ্বর কুমার আর মোহাম্মদ শামিরা।
কি শুরু, কি শেষ, জসপ্রীত বুমরাহ আর ভুবনেশ্বর কুমার হয়ে উঠেছেন ভারত ওয়ানডে দলের বড় এক ভরসার নাম। ভুবনেশ্বর কুমারের নাকল বল, ইন সুইং-আউট সুইংয়ের জাদুর সাথে বুমরাহর শরীর তাক করা বাউন্সার, পায়ের আঙুল সই ইয়র্কার, দুজনে মিলে গড়ে তুলেছেন একদিবসী ক্রিকেটের ভয়ংকর এক বোলিং জুটি।
এ দু’জনে একত্রে এখন অব্দি ম্যাচ খেলেছেন ২৭টি, এবং তাদের প্রাপ্ত উইকেটসংখ্যা ৭৪। এই ম্যাচগুলোতে ভুবনেশ্বরের বোলিং গড় ৩১.৭৭, যেখানে তার ক্যারিয়ার গড় প্রায় ৩৬ ছুঁইছুঁই!
বুমরাহ এই ম্যাচগুলোতে ওভারপ্রতি রান খরচ করেছেন ৪.৮২ করে। আর এই ম্যাচগুলোতে দু’জনে মিলে ওভারপ্রতি খরচ করেছেন ৫.২১ রান। গত কয়েক বছরে নিজ দেশের সেরা তো বটেই, ২০১৪ পরবর্তী সময়ে গোটা পৃথিবীরই সেরা!
দু’জনে যে একে অপরের সান্নিধ্যটা উপভোগ করছেন, এ তো বোঝা যায় ভুবনেশ্বর কুমারের মন্তব্য থেকেই,
‘ও নেটগুলিতে কী অনুশীলন করে, এবং কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে, সেটি আমি তার কাছ থেকে শিখতে পারি। যখন উইকেট নিতে পারি দু’জনই, দারুণ হয় ব্যাপারটা। আমরা অনেক কথা বলি দু’জনে মিলে।‘
ম্যাচ জয়ের সংখ্যাও তো তারই প্রমাণ, শতকরা ৭৮ ভাগ ওয়ানডে ম্যাচে জয়ের বরমাল্য এনে দিয়েছেন ভারতকে।
টেস্ট দলে বুমরাহর অন্তর্ভুক্তির পরে ১৪ টেস্টে ভারতের পেস বোলারদের দখলে আসা উইকেট সংখ্যা ১৮৪, সর্বকালের সেরা ভারতীয় বোলিং লাইনআপ হিসেবে বর্তমানকেই আখ্যা দিতে রবি শাস্ত্রীর তাই বাধে না একটুও।
বুমরাহর জন্যে এমন প্রশংসাবাক্য আর নতুন কি! বিরাট কোহলি বলছেন ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশ্যে বুমরাহর মুখোমুখি হওয়াটা সহজ হবে না, ওয়াসিম আকরাম অনায়াসেই তাকে সেরার স্বীকৃতি দিচ্ছেন, ডেনিস লিলি তার মাঝে জেফ থমসনের ছায়া খুঁজে পাচ্ছেন।
১২.
গত কয়েক বছরে বোলারদের প্রতি ক্রিকেটের আচরণটা হয়ে গিয়েছে বিমাতাসুলভ। ২০১৫ বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে কেবল ১ম ইনিংসেই ৩০০ ছাড়ানো স্কোর হয়েছে ১১৮টি। ব্যাটসম্যান দাপটের এ যুগে বোলাররা যেন আছেন ব্যাটসম্যানদের প্রতি একটা বল ছুঁড়ে দিতে হবে, কেবল সেজন্যেই। এমন একপেশে অসম লড়াইয়ের দরুণ ক্রিকেটটা বিরক্তিকর ঠেকে মাঝেমধ্যেই।
তবুও যে ক্রিকেট আজও দর্শক টানতে পারছে, মেলবোর্নের মরা পিচেও আগুন ঝরছে, ব্যাটিং-বোলিংয়ে সেয়ানে-সেয়ান টক্কর হচ্ছে, সে তো একজন বুমরাহ আছেন বলেই।
ভাগ্যিস, বুমরাহ এসেছিলেন!