১২ জুলাই, ২০১৫। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রেস কনফারেন্স শুরু হলো। সাংবাদিকদের সামনে যিনি বসে আছেন, তাকে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সেরা গোলকিপারের খেতাবটা চোখ বন্ধ করেই দিয়ে দেওয়া যায়। প্রেস কনফারেন্সের আগেই অবশ্য বাতাসে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তোতে যোগ দিচ্ছেন তিনি। সামনে রাখা কাগজটার দিকে তাকিয়ে কথা বলা শুরু করলেন।
সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হঠাৎ করেই থেমে গেলেন, কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। গলা শুকিয়ে আসছিল হয়তো, পাশে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেলেন। অনেক কষ্ট করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের সাথে ২৫ বছরের বন্ধন ছিন্ন করার মুহূর্তে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। নিজেকে যেন কোনোভাবেই বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না, রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে অন্য কোনো ক্লাবে তাকে পাড়ি জমাতে হবে!
এতক্ষণ যার কথা শুনছিলেন, তিনি ইকার ক্যাসিয়াস ফের্নান্দেজ। সর্বকালের সেরা গোলকিপারদের একজন।
মাত্র ৯ বছর বয়সে ‘লা ফ্যাব্রিকা’ (রিয়াল মাদ্রিদ ইয়ুথ একাডেমির পূর্বনাম) যোগ দিয়েছিলেন ইকার ক্যাসিয়াস। এরপর রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দলগুলোতে করা পারফরম্যান্সের সুবাদে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগে তার অভিষেক হয়। নিজের ১৯তম জন্মদিনের মাত্র চারদিন পর ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমের অল-স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলতে মাঠে নামেন ক্যাসিয়াস। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদ ৩-০ গোলে জয়ী হলে সবচেয়ে কম বয়সে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলা ও জেতা গোলরক্ষক হওয়ার রেকর্ড গড়েন।
পরবর্তী মৌসুমে দলের প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকলেও ধারাবাহিকতার অভাবে জায়গা হারান সিজার সানচেজের কাছে। তবে ক্যাসিয়াস বিশ্ব ফুটবলে নিজের আগমনী বার্তাটা দেন ২০০১-২০০২ সিজনের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে। গ্লাসগোর হ্যাম্পডেন পার্কে রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিপক্ষ ছিল বায়ার লেভারকুসেন। হাফ টাইম শেষ হওয়ার আগে জিদানের সেই ঐতিহাসিক বাম পায়ের ভলির সুবাদে ২-১ ব্যবধানে লিড পায় মাদ্রিদ। দ্বিতীয়ার্ধে সিজার সানচেজের ইনজুরির কারণে ৬৮ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলতে নামেন ইকার ক্যাসিয়াস।
লেভারকুসেনের টানা আক্রমণে শেষদিকে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু শেষ ২৮ মিনিট ২১ বছর বয়সী ক্যাসিয়াস যেন মানব দেয়াল হয়ে রইলেন। ৯৬ মিনিটে কর্ণার কিক থেকে পাওয়া বলে স্ট্রাইকার বারবেতভ বক্সের ভেতর থেকে গোলে যে শটটা নিলেন, সেটাও ডান পা দিয়ে প্রতিহত করে কর্নারের বিনিময়ে দল রক্ষা করেন ক্যাসিয়াস। অথচ ডান পা ছাড়া ক্যাসিয়াসের শরীরের বাকি অংশটুকু তখন ছিল গোললাইনের ভেতরে। কর্নার থেকে এবার নিচু একটা হেড, আবারও গোল লাইনে ক্যাসিয়াসের প্রতিরোধ। ক্যাসিয়াস-বীরত্বে লেভারকুসেনকে হারিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ সেদিন জিতে নিয়েছিল তাদের নবম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা।
ফুটবলে গোলকিপারদের গড় উচ্চতা ধরা হয় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। ক্যাসিয়াসের উচ্চতা ৬ ফুট ছুঁই ছুঁই, ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। তবে ক্যাসিয়াসের ছিল অসাধারণ রিফ্লেক্স, দুর্দান্ত পজিশনিং সেন্স এবং পা ব্যবহার করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা, যা দিয়ে তিনি তার উচ্চতা ইস্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গেছেন বছরের পর বছর।
চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর ২০০২ বিশ্বকাপে ডাক পড়ল ক্যাসিয়াসের, যা ছিল পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। সান্তিয়াগো ক্যানিজারেসের ইনজুরিতে ২১ বছর বয়সী ক্যাসিয়াসের উপর বিশ্বকাপের মঞ্চে লা-রোজাদের গোলবার সামলানোর দায়িত্ব এসে পড়ে। ১৯৯৯ সালে সুইডেনের বিপক্ষে অভিষেকের পর ২০০০ সালের ইউরোতে ডাক পেলেও কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। ২০০২ বিশ্বকাপ কোয়ান্টার ফাইনালে স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে শেষ হয় স্পেনের বিশ্বকাপ মিশন। কিন্তু সেকেন্ড রাউন্ডের ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি পেনাল্টি সেভ করে জানান দেন, সময়ের সেরাদের কাতারেই উচ্চারিত হবে তার নাম।
২০০২-২০০৩ মৌসুমে থেকে রিয়াল মাদ্রিদ মানেই গোলবারের নিচে ইকার ক্যাসিয়াসের সরব উপস্থিতি। ২০১২-২০১৩ মৌসুমের আগ পর্যন্ত এর ব্যাতিক্রম তেমন ঘটেনি। ক্যাসিয়াসের ক্যারিয়ারের সেরা সময়টায় দল হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদ ছিল কিছুটা ছন্নছাড়া। ঘন ঘন কোচ ছাঁটাই, লা লিগায় বার্সেলোনার আধিপত্য, চ্যাম্পিয়নস লিগে ব্যর্থতা – এসব হাজারও দুর্যোগের সময়েও ক্যাসিয়াস ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তুলনামূলকভাবে অফ ফর্মে থাকা ডিফেন্স লাইন নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন। কখনও আবার স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে চরম লজ্জার হাত থেকে দলকে বাঁচিয়েছেন।
ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০৮-২০০৯ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের সেকেন্ড রাউন্ডের ম্যাচ। অ্যানফিল্ডে লিভারপুলের বিপক্ষে সেকেন্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে রিয়ালের মাদ্রিদের ডিফেন্স অনেকটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। লিভারপুল গুণে গুণে দিয়েছিল ৪ গোল। এমন একটা ফলাফলের পরও সবার মুখে ছিল ক্যাসিয়াস-স্তুতি। ক্যাসিয়াসের অসাধারণ অ্যাক্রোব্যাটিক সেভগুলো না হলে সেদিন হয়তো স্কোরলাইনটা ৭-০ কিংবা ৮-০’তেও রূপ নিতে পারতো!
২০০৯-২০১০ মৌসুমে সেভিয়ার বিপক্ষে লিগ ম্যাচে ডিয়েগো পেরোত্তির সঙ্গে ওয়ান-অন-ওয়ান পরিস্থিতিতে যে অবিস্মরণীয় সেভটা করেছিলেন, তা দেখে গর্ডন ব্যাঙ্কসের পর্যন্ত চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা হয়েছিল। ডান দিক থেকে বক্সে ঢুকে সেভিয়ার নেগ্রিদো যখন বাম দিকে মাটি কামড়ানো ক্রসটি করলেন, ক্যাসিয়াস তখন গোলপোস্টের একপাশ থেকে অপরপাশে লাফিয়ে পড়ে গোটা এরিয়া কভার করে বলতে গেলে পেরোত্তির পা থেকেই বলটা ঠেকিয়ে দেন।
এমন সব সেভের জন্যই রিয়াল ভক্তরা তাকে ডাকত ‘সেইন্ট ইকার’ নামে। ২০১০ সালে ইউরোপা প্রেসের করা এক জরিপে উঠে এসেছিল, গোটা স্পেনে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম খেলোয়াড়। প্রিমিয়ার লিগের বড় বড় দলগুলো প্রায়ই তার সাথে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু শৈশবের ক্লাবটি ছেড়ে অন্য কোনো ক্লাবের জার্সি গায়ে তোলার কথা হয়তো স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেননি ক্যাসিয়াস।
২০০৪ ইউরোতে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয়ে স্পেনকে। এরপর ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদানের ফ্রান্সের কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনালে থামতে হয় লা-রোজাদের। ঠিক এরপরই স্প্যানিশ রূপকথার শুরু। ২০০৮ ইউরোতে প্রথমবারের মতো ক্যাপ্টেন ক্যাসিয়াসের দেখা মেলে। লুইস আরাগোনেসের কোচিংয়ে এক নতুন স্পেনের আবির্ভাব হয়। ভিয়েনায় ফাইনালে ইনিয়েস্তার এক অবিস্মরণীয় গোলে জার্মানিকে ১-০ গোলে হারিয়ে ৪৪ বছর পর ইউরো শিরোপা ঘরে তোলে স্পেন। কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে ইতালির বিপক্ষে দুটো মহামূল্যবান পেনাল্টি সেভ করেন ক্যাসিয়াস।
এরপর স্পেন দলের কোচ হন ভিসেন্তে দেল বস্ক। ২০১০ বিশ্বকাপ মিশনে প্রত্যাশার পারদ উঁচুতে রেখেই সাউথ আফ্রিকার বিমানে উঠেছিল ক্যাসিয়াসের নেতৃত্বাধীন স্প্যানিশ দল। সে চাপেই কি না প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের কাছে ১-০ ব্যবধানের অপ্রত্যাশিত হার দিয়ে শুরু বিশ্বকাপ যাত্রা। অথচ ইউরোপিয়ান কোয়ালিফাইংয়ে ১০ ম্যাচের একটিতেও হারেনি স্পেন। তার মধ্যে গোলবারের নিচে ক্যাসিয়াসের ছোট্ট একটা ভুল চারদিকে যেন সমালোচনার ঝড় তুললো।
সব সমালোচনাকে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে স্পেন পরবর্তী ম্যাচেই জয়ের ধারায় ফিরল, ফিরলেন ক্যাসিয়াসও। বাকি ম্যাচগুলোতে ক্যাসিয়াস নেতৃত্ব আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞার এক নজির স্থাপন করলেন। প্রথম ম্যাচের পর পুরো বিশ্বকাপে ক্যাসিয়াসকে আর একবারই বিট করা সম্ভব হয়েছিল, গ্রুপপর্বে শেষ ম্যাচে চিলির বিপক্ষে। বাকি সবগুলো ম্যাচেই ক্লিনশিট রেখেছিলেন, যার মধ্যে কোয়ান্টার ফাইনালে পেরুর বিপক্ষে ছিল একটি পেনাল্টি সেভ।
বড় বড় ম্যাচে পারফর্ম করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল ক্যাসিয়াসের। নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হয় স্পেন। ৬২ মিনিটে স্পেনের হাই ডিফেন্সিভ লাইনের কারণে মাঝমাঠ থেকে ওয়েসলি স্নাইডারের বাড়ানো বলে ক্যাসিয়াসকে পুরো একা পেয়ে যান আরিয়েন রোবেন। ক্যাসিয়াস নিজের পজিশন ধরে রাখায় বামদিকের ফাঁকা জায়গা দিয়ে শট নেন রোবেন। কিন্তু বাদ সাধে ক্যাসিয়াসের ডান পা, বল ক্যাসিয়াসের পায়ে লেগে গোলপোস্টকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় বাইরে। রোবেনের চেহারা তখন বিস্ময়ে হতবিহ্বল। এরপর আবারও অনেকটা একই রকম অবস্থায় রোবেন যখন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার পুয়োল ও পিকের ট্যাকলকে পরাস্ত করে গোলমুখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ক্যাসিয়াস অনেকটা ছোঁ মেরে রোবেনের পা থেকে বল নিজের কব্জায় নিয়ে নেন।
এই সেভ দু’টিকে স্প্যানিশ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেভ বললেও হয়তো ভুল বলা হবে না। অথচ ক্যাসিয়াস এই সেভ দুটোর ব্যাপারে কথা বলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনয়ী। প্রথমটি তার মতে ৫০-৫০ চান্স ছিল, আর দ্বিতীয়টিতে পিকে আর পুয়োলকে ট্যাকলের জন্য ক্রেডিট দেন।
ঠিক এই জায়গাতেই ক্যাসিয়াস ছিলেন অনন্য। নিজেকে কখনও দলের চেয়ে বড় করে দেখেননি। সেই ফাইনালে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার অতিরিক্ত সময়ের গোলে প্রথমবারের বিশ্বকাপ জিতে নেয় স্পেন। সকার সিটি স্টেডিয়ামে সোনালী ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন ইকার ক্যাসিয়াস, ‘ফুটবলের দুয়োরাণী’ হয়ে থাকার কলঙ্ক থেকে মুক্তি পায় স্পেন। ২০১০ বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপার হিসেবে ‘গোল্ডেন গ্লোভস’ অ্যাওয়ার্ডটাও জিতে নেন ক্যাসিয়াস।
২ বছর পর ক্যাসিয়াসের ঝুলিতে যুক্ত হয় আরও একটি আন্তর্জাতিক শিরোপা। ২০১২ সালের ইউরোর ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ গোলে হারিয়ে আবারও স্পেনের ইউরোপ জয়। লা-রোজাদের হয়ে শুধুমাত্র কনফেডারেশনস কাপটাই জেতা হয়নি ক্যাসিয়াসের। স্পেনের ক্যাপ্টেন হিসেবে যে কাজটা ক্যাসিয়াস করতে পেরেছিলেন, তা হলো পুরো দলকে এক সুতোয় গাঁথা। ক্যাসিয়াসের সময়ে স্পেনের জাতীয় দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ছিল দুই রাইভাল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে দুই দলের রেষারেষির ব্যাপারটাকে তিনি জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে কখনোই প্রভাব বিস্তার করতে দেননি। ঠিক এই কারণেই স্পেনের সোনালী প্রজন্ম সফল হতে পেরেছিল।
২০১১-২০১২ মৌসুমে ৩ বছর পর লিগ শিরোপা ঘরে তোলে রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়াল মাদ্রিদ ক্যাপ্টেন হিসেবে এটাই ক্যাসিয়াসের একমাত্র লিগ শিরোপা। ২০০৮ থেকে ২০১২, এই টানা পাঁচ বছর আইএফএফএইচএস বেস্ট গোলকিপার অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন ক্যাসিয়াস, এবং প্রতিবারই জায়গা করে নেন ফিফপ্রো বিশ্ব একাদশে। ক্যাসিয়াস ছাড়া পাঁচবার আইএফএফএইচএস বেস্ট গোলকিপার অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন শুধুমাত্র জিয়ানলুইজি বুফন।
আর্ন্তজাতিক ফুটবলে রেকর্ড ১০২টি ক্লিনশিটের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগে সবচেয়ে বেশি ৫৭টি ক্লিনশিটের মালিকও ক্যাসিয়াস। এছাড়া ২০০৭-২০০৮ মৌসুমে জিতেছেন জামোরা ট্রফি।
২০১৩ সালে ইনজুরিতে পড়ার পর থেকেই ক্যারিয়ারে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখা শুরু করেন ক্যাসিয়াস। ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফিরলেও ডিয়েগো লোপেজের কাছে নিজের জায়গা হারান। যে দুর্দান্ত রিফ্লেক্সের জন্য ক্যাসিয়াস পরিচিত ছিলেন, তাতে ফাটল ধরতে শুরু করল। ক্যাসিয়াসের পড়তি ফর্মের পালে আরও হাওয়া লাগায় বিভিন্ন ম্যাচে দৃষ্টিকটু কিছু ভুল।
লা লিগায় জায়গা হারালেও ২০১৩-২০১৪ মৌসুমে ক্যাসিয়াস চ্যাম্পিয়নস লিগ ও কোপা দেল রে’তে দলের ক্যাপ্টেন ও নিয়মিত গোলকিপার হিসেবেই খেলতে থাকেন। সেই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও কোপা দেল রে মিলিয়ে ৯৬২ মিনিট কোনো গোল না খাওয়ার নতুন রেকর্ড গড়েন। সেই মৌসুমে ১১ বছর পর নিজেদের দশম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের মাধ্যমে রিয়াল মাদ্রিদের লা-ডেসিমা পূর্ণ হয়, এবং ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ও দিদিয়ের দেশমের পর তৃতীয় ক্যাপ্টেন হিসেবে ইউরো, বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের কীর্তি গড়েন ক্যাসিয়াস।
এত কিছুর পরও তার ফর্ম নিয়ে আলোচনা চলছিলই। ২০১৪ বিশ্বকাপে ক্যাসিয়াস সম্ভবত নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময়টা কাটিয়েছেন। নিজেদের প্রথম ম্যাচেই আবারও নেদারল্যান্ডসের সাথে দেখা হয় স্পেনের। নেদারল্যান্ডসের কাছে ৫-১ গোলে হেরে অনেকটা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল স্পেন। পরের ম্যাচে চিলির সাথে পরাজয়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই স্পেনকে বিদায় নিতে হয়ে। ২০০৮ ইউরো, ২০১০ বিশ্বকাপ এবং ইউরো ২০১২ এই তিন টুর্নামেন্টে যেখানে ক্যাসিয়াস সাকুল্যে গোল হজম করেছিলেন মোটে পাঁচটি, সেখানে ২০১৪ বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচেই ৭ বার পরাস্ত হতে হয় ক্যাসিয়াসকে!
২০১৪-১৫ মৌসুমে আবারও লা-লিগায় নিজের জায়গা ফিরে পান ক্যাসিয়াস। কিন্তু পুরো মৌসুম জুড়ে সেই পুরোনো অপ্রতিরোধ্য ক্যাসিয়াসকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। রিয়াল মাদ্রিদও ছিল শিরোপাহীন। এছাড়া দলে কোস্টারিকান গোলকিপার কেইলর নাভাসের অর্ন্তভুক্তি যেন রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ক্যাসিয়াসের বিদায় অনেকটাই নিশ্চিত করে দিয়েছিল।
শিরোপার সাথে যেন ছিল আজীবন সখ্যতা। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে একে একে জিতেছেন ৫টি লিগ শিরোপা, ২টি কোপা ডেল রে, ৪টি সুপার কোপা ডি স্পানা, ৩টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ২টি উয়েফা সুপার কাপ, একটি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ এবং ১টি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। পোর্তোতে গিয়ে ২০১৭-২০১৮ মৌসুমে জিতে নেন পর্তুগিজ প্রিমেরা লিগা এবং পর্তুগিজ সুপার কাপ।
২০১৯ সালের পহেলা মে, পোর্তোর হয়ে ট্রেনিং করার সময় হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে উঠলেও তার মাঠে ফেরা নিয়ে ডাক্তাররা শঙ্কা প্রকাশ করেন। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন ইকার ক্যাসিয়াস। দীর্ঘ সময় ধরে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স ছাড়াও ব্যক্তি ক্যাসিয়াস ছিলেন সবার জন্য একজন রোল মডেল। প্রতিপক্ষকে সবসময় যেমন প্রাপ্য সম্মান দিয়েছেন, তেমনি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের কাছ থেকেও পেয়েছেন যথার্থ প্রশংসা।
ক্যাসিয়াসের ক্যারিয়ারে আবেগঘন মুহুর্ত কম আসেনি। বিশ্বকাপ ফাইনালে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার গোলের পর সবাই যখন ইনিয়েস্তাকে নিয়ে উল্লাসে মত্ত, গোলবারের নিচে শিশুর মতো কান্নারত ছিলেন ক্যাসিয়াস। এমন অর্জনের দিনে এতটুকু চোখের জল না আসলে কি আর চলে! রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লা-ডেসিমা জয়ের দিনেও রামোসের সমতা ফেরানো গোলের পর অশ্রুসিক্ত ছিল ক্যাসিয়াসের চোখ। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে নিজের বিদায়ী প্রেস কনফারেন্সেও নিজের আবেগটাকে আর ধরে রাখতে পারেননি সর্বকালের অন্যতম সেরা এই গোলরক্ষক। ক্যাসিয়াস জানতেন, নিজের সেরা সময়টা পার করে ফেলেছিলেন। আর তাই হয়তো সময় থাকতেই সম্মান নিয়ে নিজে থেকেই সরে গিয়েছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদের জন্য তার ভালবাসা কতটুকু গভীর ছিল, বিদায়ী প্রেস কনফারেন্সের শেষ কথাটা থেকেই তা বোঝা যায়,
“I’m sure in the future we’ll see each other. I’m not going to say goodbye, because it’s not goodbye. I hope to see you soon. Thank you, to all of you.”
আমরাও তার গলায়ই গলা মিলিয়ে বলতে চাই, থ্যাঙ্ক ইউ, সেইন্ট ইকার! আমরা আপনার অপেক্ষায় থাকবো। কারণ, ‘ইটস নট গুডবাই’!