তো… কোথা থেকে শুরু করা যায়?
লেখার শুরুতেই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম পাঠকদের উদ্দেশ্যে। আমাদের জীবনে প্রায়শই এমন অনেক কিছু ঘটে, যেখানে অল্প সময়ের ব্যবধানে জুড়ে যায় নানান উত্থান-পতন, রঙবদলের গল্প। সূক্ষ্ম মার্জিনে টানা নাটকীয়তা আর ঘটনার আকস্মিকতায় বুঝেই উঠতে পারি না, কোথা থেকে শুরু করা যায় এর ভূমিকা। ঠিক তেমনই একদিন এসেছে রাজস্থান রয়েলসের ক্রিকেটার রাহুল তেওয়াটিয়ার জীবনে। তাকে নিয়ে লিখতে বসে, আমিও তাই খাবি খাচ্ছি লেখার ভূমিকা নিয়ে।
শুরুটা হোক তবে শারজাহ থেকেই, যেখানে নায়ক হয়েছিলেন তিনি। তবে নায়ক হওয়ার আগে ধুঁকেছেন প্রচণ্ড, রূক্ষ মরুভূমিরুপী বাইশ গজের ওই পিচে ব্যাট হাতে খুঁজে বেড়িয়েছেন একটুখানি জল। সবাই তখন তাকে ভিলেনের আসনে বসিয়েই দিয়েছেন।
রাহুল ফিরে এলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপে। উড়িয়ে দিলেন তাকে ঘিরে চলতে থাকা একের পর এক ফিসফাস, সমালোচনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। রাহুল শেষ অবধি খুঁজে পেয়েছেন বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই জল, আকণ্ঠ পান করে মিটিয়েছেন তৃষ্ণা। উত্তপ্ত, নির্দয় মরুভূমির দেশে আরেকটা মরুভূমি হয়ে ওঠা শারজাহর ওই সেন্টার পিচে নামিয়েছেন স্বস্তির বারিধারা। সেই জলধারায় নিভে গেছে সমালোচনার উত্তপ্ত স্ফুলিঙ্গ।
ফিরে যাই গত ২৭ সেপ্টেম্বরের শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে, যেখানে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে খেলছিল আইপিএলের প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন রাজস্থান রয়্যালস। ম্যাচ তখন শেষদিকে। ধারাভাষ্যকক্ষে কেভিন পিটারসেন বলে উঠলেন,
We’re standing. What an innings! From where he started, middle of his innings… that Maxwell’s over, and he changed the game!
এতটুকু শুনে পাঠকদের একটা ধারণা হতে পারে, কোনো ব্যাটসম্যানের ভূঁয়সী প্রশংসা করেছেন সাবেক এই ইংলিশ ক্রিকেটার – যেটা ক্রিকেট মাঠে খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। যদি এর আগে মাইকেল স্ল্যাটারের কথাগুলো শুনে থাকেন, তবে একটু চমক তো লাগবেই।
‘It should be out in the deep, but the damage was done.’
‘বাট দ্য ড্যামেজ ওয়াজ ডান’
সাবেক অজি ক্রিকেটার স্ল্যাটারের কথাটা ধরেই শুরু করি। শারজাহতে পাঞ্জাবের বিপক্ষে রাহুল তেওয়াটিয়ার শুরুটা ছিল ভয়াবহ আর দুঃস্বপ্নময়। সেই দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে, পাঞ্জাব শিবিরে পর্যাপ্ত ‘ড্যামেজ’ ঘটিয়েই বিদায় নেন মঞ্চ থেকে নায়ক হয়ে।
সামনে ২২৪ রানের বিশাল লক্ষ্য। দশ ওভারে ১০৪ রানে রাজস্থানের নেই দুই উইকেট। সদ্যই ঝড় বইয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ। আস্কিং রানরেট তখন ১১.২৭! শেষ দশ ওভারে প্রয়োজন আরো ১২৩ রান। এক প্রান্ত আগলে দাঁড়িয়েছেন দারুণ ছন্দে থাকা সাঞ্জু স্যামসন। ম্যাচের পেন্ডুলাম যখন দু’পাশেই দুলছে, তখন ব্যাট করতে যান রাহুল তেওয়াটিয়া। টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনা ছিল তাকে দিয়ে প্রতিপক্ষের লেগস্পিনার রবি বিষ্ণয়কে অ্যাটাক করা। কারণ, রাজস্থানের একাদশে তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। সেই ভাবনা থেকেই রবিন উত্থাপ্পা-রিয়ান পরাগের মতো ব্যাটসম্যান থাকতে তাকে চার নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে পাঠানো।
পাঞ্জাবের অধিনায়ক লোকেশ রাহুলের চোখ এড়ায়নি। সাথে সাথেই বোলিংয়ে পরিবর্তন। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে অফ স্পিনারের চিরাচরিত সুবিধা পাওয়ার গুঁটিটা চাললেন রাহুল, বল তুলে দিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের হাতে। টোটকা কাজে লাগলো, সেই ওভারে চার বল খেলে এক রান করলেন রাহুল। প্রতি ওভারে ১১.২৭ গড়ে যেখানে রান প্রয়োজন, সেখানে রাহুল ঠিকমতো বলগুলো ব্যাটে মিডলই করতে পারছিলেন না… চার-ছক্কা মারা তো দূরের কথা!
পরের ওভারে তিন বল খেলে দুই রান। এর পরের ওভারেও রইলো একই ধারাবাহিকতা। ১৩তম ওভারে বোলিংয়ে গেলেন রবি বিষ্ণয়, যে পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই রাহুলকে চার নম্বরে ব্যাট করতে পাঠিয়েছিল রাজস্থান। সেখানেও তিনি বিবর্ণ, রবির তিন বল খেলে একটাও ব্যাটে লাগাতে পারেননি বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। শুধু চেষ্টা করেছেন উড়িয়ে মারার, একটা বড় কিছু করার; কিন্তু হয়নি। সেই ওভার শেষে মোট ১৩ বল খেলে ৫ রানে দাঁড়িয়ে তিনি। ওদিকে ধারাভাষ্যকক্ষে কেভিন পিটারসেন, সুনীল গাভাস্কার, মুরালি কার্তিকরা তখন ধুয়ে দিচ্ছেন রাহুল আর রাজস্থানের টিম ম্যানেজমেন্টকে। ব্যাটিং করতে পারেন কি না, এমন কথাও ঘুরে বেড়াচ্ছিল ধারাভাষ্যকক্ষে।
অমন পরিস্থিতিতে খাবি খেতে থাকা কোনো ব্যাটসম্যানকে ঘিরে এমন কথা ঘুরে বেড়ানোই স্বাভাবিক লাগছিল তখন। রাহুলের সেই দুঃস্বপ্নের স্থায়িত্ব ছিল আরো সাত বল। স্কোরকার্ডে দেখা গেল, ১৯ বল খেলে রাহুলের আট রান। ২০তম বলে ভাঙলো দুঃস্বপ্ন। সেই লেগস্পিনার বিষ্ণয়কেই উড়িয়ে মারলেন মাথার ওপর দিয়ে। একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন বোধহয় তখন।
হাওয়ার খানিকটা বাঁকবদল তখনই। পরের ওভারে ম্যাক্সওয়েলকে তিন ছক্কার প্যাকেজ উপহার দিলেন স্যামসন। রাহুলের ধীর ব্যাটিংয়ের কারণে তিনিও পড়েছিলেন চাপে। সেই চাপ জয় করলেও স্যামসন টেকেননি আর বেশিক্ষণ। পরের ওভারে, অর্থাৎ ম্যাচের ১৭তম ওভারের প্রথম বলেই আউট হন স্যামসন। ৪২ বলে ৮৫ রানের ইনিংস খেলে শামির বলে প্যাভিলিয়নে ফেরেন তিনি। রাহুলের সঙ্গী হয়ে এসে সেই ওভারেই দুই চার মারেন উথাপ্পা।
আগের অনুচ্ছেদেই বলেছি হাওয়ার খানিকটা বাঁকবদলের কথা। কিন্তু এক ওভার পরই গোটা শারজাহর হাওয়াটাই যে বদলে যাবে, কে ভেবেছিল!
রাজস্থানের রান তখন ১৭৩। শেষ তিন ওভারে প্রয়োজন ৫১ রান। ডেথ ওভারে বলেকয়ে ১৭ গড়ে রান তোলা সহজ কথা নয়। তবে ক্রিকেটে অসম্ভব বলেও কিছু থাকে না। ওদিকে আবার শারজাহর ঘাসে জমা শিশিরগুলোও ছিল এক্স ফ্যাক্টর হয়ে।
রাজস্থানের ডাগ আউটে চিন্তিত অনেকগুলো মুখ। স্ট্রাইকে আছেন নিজের সাথে লড়াই করতে থাকা রাহুল তেওয়াটিয়া। পাঞ্জাব অধিনায়ক বল তুলে দিলেন শেলডন কটরেলের হাতে। স্ল্যাটার বলছিলেন, বড় একটা ওভার হওয়া উচিত রাজস্থানের জন্য। রাহুলও যেন শুনলেন, যেন তৈরিই হয়ে ছিলেন। কারণ, তার আর হারানোর কিছু ছিল না। সামনে রাস্তা খোলা ছিল একটাই, প্রাণপণ চেষ্টা করে পাশার দান ঘুরিয়ে দেয়া। সেই চেষ্টায় উড়িয়ে দিয়েছেন পাঞ্জাবকে একাই। শেষ অবধি মাঠে থেকে ম্যাচ জেতাতে পারেননি, কিন্তু পাঞ্জাবকে উপহার দিয়ে গেছেন একটা ধ্বংসস্তুপ।
‘না ভাই না’ : যুবরাজ সিং’
১৮তম ওভারের প্রথম বল হাতে ছুটছেন কটরেল। ভেতরে ঢোকা বাউন্সার, জায়গা বানিয়ে নিয়ে পুল করলেন রাহুল, লং লেগ দিয়ে ছয়। পরেরটিও প্রায় একই ধরনের ডেলিভারি, ঠিকমতো মিডল হয়নি। তবুও ব্যাটের সুইংয়ের সাথে গতির মিশেলে বলের ঠিকানা স্কয়ার লেগের ওপারে। তখনো টনক নড়েনি পাঞ্জাবের। তৃতীয় ডেলিভারিটা পড়লো একদম স্লটে। ফ্রন্টফুটে ভর দিয়ে লং অফ দিয়ে হাঁকালেন বিশাল এক ছয়। টানা তিন ছয়ের পর নড়েচড়ে বসলো পাঞ্জাব একাদশ।
কটরেলকে অধিনায়ক রাহুল বললেন ওয়াইডিশ ইয়র্কারে যেতে। সেই চেষ্টাও বৃথা গেল চতুর্থ বলে। নিচু হয়ে আসা সেই ফুলটস রাহুল খেললেন অফস্টাম্পের বাইরে সরে, বলের দখল নিয়ে; মিড উইকেট দিয়ে সীমানাছাড়া। কমে আসছে রানরেট, বাড়ছে রাহুলের স্ট্রাইকরেট। চার বলে চার ছক্কা মারার পর তার স্ট্রাইকরেট ৬০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬০! সবাই অপেক্ষা করছিল পঞ্চম বলে আরেকটি ছয়ের। সেই আশার গুড়ে বালি। বলের লাইনে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ব্যাটে-বলে হয়নি। এখানেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন যুবরাজ সিং! কীভাবে? একটু পরেই জেনে যাবেন।
ওভারের শেষ বল। অফস্টাম্পের বাইরের লেন্থ ডেলিভারি। জায়গায় দাঁড়িয়ে অনায়াসে আছড়ে ফেললেন মিড উইকেট দিয়ে। একেকটা ছয় মেরে যেন নিজের প্রায়শ্চিত্ত করছিলেন, খুঁজছিলেন নিজের দায়মুক্তির পথ। সেই পথ খুলে গেল কটরেলের ওভারে।
টি-টোয়েন্টিতে ছয় বলে টানা ছয়টি ছক্কা মারা প্রথম ব্যাটসম্যান যুবরাজ সিং। এই ম্যাচটা দেখেছেন ভারতের সাবেক এই অলরাউন্ডার। ম্যাচশেষে রাহুলকে টুইটারে জানিয়েছেন অভিনন্দন, একই সাথে ফেলেছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। পঞ্চম বলটা মিস না করলে তো যুবরাজের সেই রেকর্ডে ভাগ বসাতেন রাহুলও! তাই টুইটারে যুবরাজের হাঁফ ছেড়ে বাঁচা, ‘না ভাই না, একটা বল মিস করার জন্য ধন্যবাদ।’
রাহুল যখন ১৯ বলে আট রানে ব্যাট করছিলেন, তখন তাকে বিশেষ বিবেচনায় রিটায়ার্ড হার্ট ঘোষণা করে প্যাভিলিয়নে ফেরানো যায় কি না, ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সবখানেই এমন বিদ্রুপাত্মক কথা উড়ে বেড়াচ্ছিল। অথচ শেষ ১২ বলে সাত ছক্কায় ৪৫ রান করার পর সব কথাই পাল্টে গেছে, মোড় নিয়েছে অন্যদিকে।
রাহুল যুদ্ধ করেছেন, লড়েছেন নিজের সাথে। সেই লড়াই, সেই যুদ্ধটা জিতেছেন রাজকীয়ভাবে।
‘রিমেম্বার দ্য নেম’
ক্রিকেট আর জীবনের একটা রোলার কোস্টার রাইড হয়ে গেছে রাহুলের। একই দিনে, ঘন্টাখানেকের ব্যবধানে দেখে ফেলেছেন ক্রিকেটের সকল রূপ। শুরুর অর্ধে দেখেছেন ক্রিকেটের ময়দানি লড়াই কতটা কঠিন, কতটা নির্দয়। শেষ অর্ধে দেখেছেন সেই কঠিন লড়াই জয়ের মাহাত্ম্য। ক্রিকেট নামের একই মুদ্রার দুই পিঠেই চড়ে বেড়িয়েছেন সেই রোলার কোস্টারে বসে।
তার ব্যাটিং দেখে পিটারসেন বলেছিলেন,
‘শারজাহতে অবিশ্বাস্য দৃশ্যের অবতারণা। এই মাঠ আসল ক্রিকেটের যোগান দিচ্ছে আমাদের।’
সেই যোগানের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন রাহুল। বাজে ব্যাটিংয়ের অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হতেও শেষ মুহূর্তে বেরিয়ে এসেছেন আঁধার ফুঁড়ে, হাতে নিয়ে আলোকবর্তিকা। সেই আলোয় মিলিয়ে গেছে শঙ্কা আর হারিয়ে যাওয়ার কালো মেঘ। জীবন আর ক্রিকেটের যোগসূত্রটাও বোধহয় রাহুল এই ইনিংসের পর খুঁজে পেয়েছেন ভালো করেই।
জীবনে এমন কত পরিস্থিতিই আসে আমাদের। সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করার পরেও ফল পক্ষে আসে না। দিনের পর দিন যায়, তবুও অবস্থা বদলায় না। আমরা হতাশ হই, হয় হাল ধরি নতুন করে, নয় ছেড়ে দিই। হয় আশার পাল ছিঁড়ে যায়, নয়তো বাতাস ধরে রেখে এগিয়ে যায় স্রোত কেটে। রাহুল হাল ছাড়েননি, তার আশার পাল ছিড়তে বসেছিল ঠিকই। কিন্তু উত্তাল ওই সাগরে ঝড়ঝঞ্ঝা পাড়ি দিয়ে ঠিকই তরী ভিড়িয়েছেন পাড়ে, প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেয়া মারদাঙ্গা ব্যাটিংয়ে দেখা পেয়েছেন প্রথম আইপিএল হাফসেঞ্চুরির। ব্যাট ঘুরিয়ে জার্সির পেছনে দেখিয়েছেন নিজের নাম। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইয়ান বিশপের বলা সেই ঐতিহাসিক ধারাভাষ্য,
‘রিমেম্বার দ্য নেম…’
টুইটারে রঙবদল
২৭ সেপ্টেম্বর রাতে টুইটারে ট্রেন্ডিং ছিলেন রাহুল তেওয়াটিয়া। অনেকে জানেনই না, কে এই রাহুল তেওয়াটিয়া। আমরাও অনেকেই জানতাম না। অন্যথা হয়নি টুইটারেও। প্রথমে পরিচিত হয়েছেন নিজের ধীরগতির ব্যাটিং দিয়ে, তখন টুইটারের ছিল এক রূপ; কিন্তু সেই বিস্ফোরক ইনিংস খেলার পরই আমূল বদলে যায় টুইটারের চেহারা। আকাশ চোপড়া টুইট করেছিলেন রাহুলকে রিটায়ার্ড হার্ট করে মাঠ থেকে তুলে নেয়ার জন্য।
‘Retiring Out’ should be de-stigmatised. Nothing against the batsman who’s struggling….but if his best efforts to hit aren’t working out, you get the next one in. ‘Sunk Cost fallacy’ #RRvKXIP #RR
— Aakash Chopra (@cricketaakash) September 27, 2020
সেই ইনিংসের পর আকাশ আবারও টুইট করেছেন, তবে সেটা রাহুলকে প্রশংসায় ভাসিয়ে,
What an incredible game of cricket…..Rahul Tewatia, you’ve shown all of us that miracles do happen. Five sixes in an over against an International fast-bowler. Especially after the struggle. A Fairy tale. #RRvKXIP
— Aakash Chopra (@cricketaakash) September 27, 2020
হার্শা ভোগলে শুরুর দিকে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন বটে, তবে শেষটা ছিল আনন্দমাখা।
‘সব ভালো যার শেষ ভালো’
আইপিএলের প্রথম আসরের প্রথম ম্যাচটাতেই বারুদঠাসা ব্যাটিং করেছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে খেলেছিলেন ৭৩ বলে ১৫৮ রানের ইনিংস। সে ধরনের ব্যাটিংই হয়ে গেল আইপিএল তথা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ব্র্যান্ড। অথচ সেই ইনিংসের প্রথম ছয় বলে কোনো রানই করতে পারেননি ম্যাককালাম।
২০১৮ আইপিএলের ফাইনাল; চেন্নাই সুপার কিংস বনাম সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। ১৭৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামে চেন্নাই। ইনিংস ওপেন করতে নেমে শুরুর নয় বলে কোনো রানই করতে পারেননি শেন ওয়াটসন। দশম বলে গিয়ে দেখা পান প্রথম রানের। এরপর ঝড় বয়ে গেছে হায়দরাবাদের বোলারদের ওপর, শেষ পর্যন্ত ইনিংসটা যায় ৫৭ বলে ১১৭* রান অবধি।
এই দুটো ইনিংসের কথা বলার একটাই কারণ, শুরুটাই সব নয়; শেষটাই বুঝিয়ে দেয়, কেমন ছিল পুরো ব্যাপারটা। ঠিক তেমনই বলা যায় রাহুলকে নিয়েও। সেই ম্যাচে শুরুটা যেমন করেছিলেন, কেউ ভাবেইনি শেষটা এমন হতে পারে।
স্যামসন সেদিন ম্যাচসেরা হয়েছেন, কিন্তু স্পটলাইটের আলো পুরোটাই কেড়ে নিয়েছিলেন রাহুল। খেই হারিয়েছেন শুরুতেই, কিন্তু নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন, অপেক্ষায় থেকেছেন সুযোগের। যখনই সুযোগ এসেছে, তার পুরোটাই তুলে নিয়েছেন দু হাতে। সেই ম্যাচের পর রাহুলের ভাষ্য,
‘জীবনের সবচেয়ে বাজে ২০টা বল আমি খেলেছি আজ। হাল ছাড়িনি, চেষ্টা করে গেছি। দলের সবাই জানতো আমি বড় শটস খেলতে পারি, আমার নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল। কেবল একটা ছয়ের ব্যাপার ছিল। এক ওভারে পাঁচ ছয়, দারুণ। লেগ স্পিনারকে অ্যাটাক করার পরিকল্পনা ছিল, দুর্ভাগ্যবশত পারিনি।’
সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন রাহুল এখনো। ১১ অক্টোবর হায়দরাবাদকে পাঁচ উইকেটে হারিয়েছে রাজস্থান। অথচ ১৫৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৭৮ রানেই টপ অর্ডারের পাঁচ ব্যাটসম্যান ফিরেছেন সাজঘরে। নামগুলোও সমীহ জাগানিয়া; বেন স্টোকস, জস বাটলার, স্টিভেন স্মিথ, রবিন উথাপ্পা, সঞ্জু স্যামসন। টিকে রইলেন রাহুল আর তার সাথে রিয়ান পরাগ।
শেষ আট ওভারে প্রয়োজন ছিল ৮১ রান। ওদিকে হায়দরবাদের বোলাররাও চড়ে বসেছেন তাদের ওপর। কয়টা ওভার দেখেশুনে খেললেন দু’জনই। শেষ পাঁচ ওভারে প্রয়োজন ৫০। হাত খুললেন রাহুল। সন্দীপ শর্মাকে ছয় মেরে শুরু। তাকে দেখে ফ্লো পেলেন পরাগও।
পরের ওভারে এলেন টি-টোয়েন্টির বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা রশীদ খান। দারুণ এই লেগ স্পিনারকে একহাত নিলেন রাহুল, যেখানে অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানও তার বিপক্ষে সুবিধা করতে পারেন না। সেই রশীদকে টানা তিন চার মারলেন। তার মধ্যে দুটোই রিভার্স সুইপে! অথচ সেদিন রশীদের চেয়ে ঢের অনভিজ্ঞ বিষ্ণইর বলগুলো ঠিকমতো ব্যাটেই লাগাতে পারেননি! বলের লাইনে গিয়ে শুধু ব্যাট ছুঁড়েছেন, রানের নেশায় সুইপ-রিভার্স সুইপ সবই করেছেন। কিন্তু রানের দেখা পাননি। অবাকই হতে হয়, একটা ইনিংস কিংবা একটা ছয় কীভাবে বদলে দেয় সব।
ভাগ্য সাহসীদের পক্ষেই থাকে। সেদিন সাহস নিয়ে টিকে ছিলেন বলেই নায়ক হয়ে মাঠ ছেড়েছেন।
এই ম্যাচেও তাই হয়েছে। সাহস নিয়েই ব্যাট করেছেন, রশীদ খানের কুইক আর্মের করা লেগস্পিনে রিভার্স সুইপ করেছেন দুটো। এরপর একই বলে হতে পারতেন স্ট্যাম্পিং কিংবা কট বিহাইন্ড; কিন্তু তার ব্যাটে আন্ডারএজ হয়ে বল জমা পড়েনি উইকেটরক্ষক জনি বেয়ারস্টোর হাতে। রাহুল নায়ক হবেন বলেই হয়তো বলটা গিয়ে লেগেছে বেয়ারস্টোর প্যাডে!
এখানেই শেষ নয়। প্যাডে লেগে বল তখন আঘাত হেনেছে স্ট্যাম্পে, রাহুলও পপিং ক্রিজ ছেড়ে দুই হাত বেরিয়ে এসেছেন। জ্বলে উঠেছে এলইডি বাতি, সাথে জিং বেলস। আউট হবার মঞ্চ সাজানোই, কিন্তু বেলসগুলো ভারসাম্য হারায়নি। অথচ বেলসগুলো মাটিতে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু রাহুলের যে নায়ক হবার কথা!
সেই সাহসী রাহুল। নটরঞ্জনের ফুলটসে এগিয়ে এসে দারুণ একটা স্কুপে ছয় মেরেছেন রাহুল। সেই ছয়েই রাজস্থান এগিয়ে গেছে। শেষটা করেছেন পরাগ, দারুণ এক ছয় মেরে।
এই ম্যাচেও রাহুলের শুরুটা ছিল ধীর। কিন্তু শেষটা? হাইলাইটস কিংবা স্কোরকার্ডই বলে দিচ্ছে সবটা। চারটি চার ও দুইটি ছয়ে ২৮ বলে ৪৫* রানের ঝলমলে এক ইনিংস। বলাই যায়, ‘সব ভালো যার শেষ ভালো।’
এত কিছুর ভিড়ে বলাই হয়নি বোলার রাহুলের কথা। ফুলটাইম লেগস্পিনটাও করেন তিনি। প্রতি ম্যাচেই চার ওভারের কোটা তাকে দিয়ে পূরণ করাচ্ছেন অধিনায়ক স্মিথ। এবারের আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই পেয়েছেন তিন উইকেট। কে জানে, খুব জলদিই হয়তো তার তাক লাগানো কোনো বোলিং স্পেল নিয়েও লিখতে হবে!
জীবনের প্রতিটা মোড়েই থাকে চমক। আমরা কেউই জানি না, এরপর কী হতে যাচ্ছে। সেদিন শারজাহতে যখন ব্যাট করতে নামেন, তখন রাহুলও জানতেন না, কী হতে যাচ্ছে। কিংবা হায়দরাবাদের বিপক্ষে এই ম্যাচটাতেও। কিন্তু শারজাহতে সেই ব্যাটিং বীরত্বের পর রাজস্থানের প্রতি ম্যাচেই সবার নজর আলাদা করে থাকে রাহুলের ওপর।
শেষ করছি বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ফরেস্ট গাম্প’ এর সেই বিখ্যাত ডায়ালগ দিয়ে,
“Life was like a box of chocolates. You never know what you’re gonna get.”
কেবল জীবনই না, ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও তাই। ক্রিকেট হয়তো জীবনের চেয়ে বড় না, কিন্তু জীবনের একটা বড়সড় অংশ বটে। তবুও একেকটা ডেলিভারি, শট, ওভারে জুড়ে থাকে আলাদা আলাদা একেকটা গল্প। সবগুলোই আলাদা আলাদা ফ্লেভার, আলাদা স্বাদ, আলাদা টেক্সচার। রাহুলের আইপিএল ক্যারিয়ারটাও অমনই; ২০১৭তে আইপিএল খেলেছেন পাঞ্জাবের হয়ে, এর পরের বছর ডাক পেয়েছেন দিল্লি ডেয়ারডেভিলসে, শেষ অবধি থিতু হয়েছেন রাজস্থানে।
আইপিএলে নিজের ঠিকানা নিয়ে দোলাচলে ছিলেন, চকলেটের বাক্স হাতড়ে বেড়িয়েছেন এতদিন। তবে এতদিনে বুঝি মনমতো চকলেটের বাক্সের দেখা পাওয়া গেছে; রাহুল পেয়েছেন ক্যারিয়ারের নবজন্মের খোঁজ, আর আমরা চকলেটের বাক্সে খুঁজে পেয়েছি পাগলাটে এক রাহুল।
হরিয়ানার সিহি থেকে উঠে আসা রাহুল জীবন নামের গোলকধাঁধা সমাধানের পথে বোধকরি আরেকটু এগিয়ে গেছেন। সময়টা দীর্ঘস্থায়ী হবে নাকি মিইয়ে যাবে সময়ের সাথে, সেটা অন্য আলোচনা। আপাতত এই সময়টা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে তো আর আপত্তি নেই!