“আমি বুঝি না, ঘোড়া চালানোর জন্য নিজের ঘোড়া হওয়ার দরকারটা কীসের!”
কথাটা ইতালিয়ান জায়ান্ট দল এসি মিলানে সদ্য নিয়োগ পাওয়া অখ্যাত একজন কোচের প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বলা। ফুটবল ইতিহাসের সেরা কয়েকটা উক্তির কথা বললে এটা আসবেই। ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’-এর মতো কোচদের ওপর ফ্যানদের প্রাথমিক ইম্প্রেশনটা আসে তাঁর প্রথম সংবাদ সন্মেলন থেকে। তাই প্রথম প্রেস ব্রিফিং এ সব কোচই সতর্ক থাকেন। আর সে জায়গায় কি না অখ্যাত একজন চেঁচিয়ে উঠলেন এ কথা বলে! উনি কথা দিয়ে ইম্প্রেশন নিতে পারেননি, তবে রেখে গিয়েছিলেন এমন কিছু যেটা ইতালির অন্যতম সফল ক্লাব মিলানের ইতিহাসে আর কেউ পারেননি।
আজ সেই কোচকে নিয়েই এই লেখাটা যিনি আসলেই আর পাঁচজন কোচের মতো না। অনেক কোচই জেতেন, কিন্তু কেউ কেউ তাঁর দর্শন, খেলানোর স্টাইল দিয়ে খেলার পাশাপাশি সবার মনও জিতে নেন। তেমনই একজন ইতিহাস বদলে দেয়া কোচের কথাই আজ বলব, নাম তার আরিগো সাচ্চি।
নামমাত্র খেলোয়াড়ি জীবন সাচ্চির, বলা চলে পাড়ার খেলা ছাড়া আর কিছুই খেলেননি। ফুটবলটা থিওরিটিক্যালি বুঝতেন তিনি। জুতার সেলসম্যান হয়ে অনেক দিন থাকা এই ভদ্রলোক ফুটবলের দিকে টান থেকেই পার্টটাইম হিসেবে স্থানীয় কয়েকটা টিমের কোচিং করান। স্থানীয় একটা দল নিয়ে ভালো করায় সিরি সি (ইতালির তৃতীয় বিভাগ, নন-প্রফেশনাল লীগ) এর একটা চাকরি পেয়ে যান তিনি। মূলত কাজ ছিল যুবদল নিয়ে। কয়েক বছরে বেশ কয়েকটা যুব দলের দায়িত্ব সামলান তিনি। ওদিকে ইতালির ঐতিহ্যবাহী ক্লাব পারমার তখন বাজে অবস্থা চলছিলো। সাচ্চি রিমিনি নামে অখ্যাত ক্লাবের যুবদলে তখন বেশ ভালো কাজ করছিলেন,ওখান থেকে কয়েকজন ভালো প্লেয়ার তুলে এনেছিলেন। এটা পারমার ডিরেক্টরদের চোখে পড়লো। সবচেয়ে বড় কথা, অখ্যাত যুবদলের কোচ, তাই বেতন চাহিদা কম। এসব দিক ভেবে দেখে সাচ্চিকেই নিয়োগ দিয়ে দিলো পারমা। সাচ্চি পেয়ে যান তাঁর আসল ব্রেক-থ্রো।
দায়িত্ব পাওয়ার পরের বছরই সাচ্চি তৃতীয় বিভাগের চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দ্বিতীয় বিভাগ সিরি বি-তে উঠিয়ে আনলেন পারমাকে। এখানেও সাফল্য-রথ চলতেই থাকলো। পারমা সিরি বি-এর টপে, সিরি আ-তে উঠার দ্বারপ্রান্তে। তখনই কোপা ইতালিয়া (ইতালিয়ান ঘরোয়া কাপ)-তে এসি মিলানের সাথে ম্যাচ। আট বছর শিরোপা বঞ্চিত এসি মিলানে তখন নতুন মালিক হয়েছেন বার্লোসকোনি। কোপা ইতালিয়ায় সাচ্চির পারমা দুই ম্যাচেই হারালো মিলানকে। এসি মিলানের ডিরেক্টরদের মনে ধরে গেল সাচ্চির দলের খেলা। ব্যস, লো প্রোফাইল এক প্রাক্তন অ্যামেচার ফুটবলারকে দেয়া হলো হাই প্রোফাইল প্লেয়ার নিয়ে ধুকতে থাকা জায়ান্ট এসি মিলানের ভার।
মিডিয়া বা ফ্যানবেজ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। প্রথম সংবাদ সন্মেলনে যখন এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে ফ্যানরা নিশ্চিন্ত হবেন যে, তাদের কোচ ভাল প্লেয়িং ক্যারিয়ার ছাড়াই মিলানের মতো ক্লাবে ভালো করবেন? তখনই তার জবাব ছিল,
“আমি বুঝি না, ঘোড়া চালানোর জন্য নিজের ঘোড়া হওয়ার দরকারটা কীসের!”
সবুজ তো সব জায়গায়ই এক, কিন্তু মরুদ্যানের সবুজের মাহাত্ম্য অনন্য। কারণ নিষ্প্রাণেই প্রাণের আসল মহিমা। ঠিক এজন্যই সাচ্চির মাহাত্ম্য বেশি। উনি সুন্দর খেলাটা খেলিয়েছিলেন টাফেস্ট ডিফেন্সিভ লীগ সিরি আ-তে। ম্যান মার্কার (যাদের কাজই ছিল জীবন দিয়ে হলেও তাকে যে প্লেয়ার আটকাতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাকে আটকানো), রেজিস্ট্রা (টাফ ট্যাকলিং করাই যাদের কাজ) আর ডিফেন্সিভ প্লেয়ারদের ভিড়ে কয়েকজন ফরোয়ার্ডের খানিকটা নৈপুণ্যই ছিলো নব্বই মিনিটে চোখের খোরাক। সেই জায়গায় সাচ্চি নিয়ে এলেন ফ্লুইড ফুটবল। গোছানো পাসে সবাই উপরে উঠবে, ফরোয়ার্ডরা তাদের মধ্যে প্রচুর জায়গা পরিবর্তন করবে, সবাই স্বাধীনভাবে স্কিল দেখাবে, আর দলবেধে নিচে নেমে ডিফেন্ড করবে।
ঠিক সোজাসুজি আসেনি এই ফুটবল স্টাইলটা। অদ্ভুত একটা প্র্যাকটিস স্টাইল ছিল উনার। বল ছাড়া ফুটবল ম্যাচ! ২২ জন দুটো ভাগ হয়ে যেত দুই টিমে। সাচ্চি থাকতেন সাইডলাইনে। জোরে যার নাম বলতেন তার কাছে কাল্পনিক বলটা আছে ধরা হত। এবার বাকিদের কাজ হতো সেই মাফিক পজিশন নেয়া। যেমন কোচ হাঁকালো ‘গুলিত’ বলে, অর্থাৎ তার পায়ে বল। এবার তার টিমমেটরা সেই মাফিক পজিশন নেবে যেন সহজে পাস দেয় এবং অপোনেন্ট হিসেবে থাকা ১১ জন সেই মাফিক পজিশন নেবে যেন আটকানো যায়। আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর লাগলেও এটাই ছিল গ্রেটেস্ট মিলান টিমের টেলিপ্যাথিকাল বোঝাপড়ার নেপথ্য কারণ।
রিয়ালের সাথে সেমি ফাইনালের আগেরদিন তাদের ট্রেনিং দেখতে যান রিয়ালের সহকারী কোচ বুত্রাগুয়েনো, প্রতিপক্ষের কৌশল ধরার জন্য। ফিরে এসে কোচকে বলেন,
“আমি বসে থাকাকালীন একমুহূর্তের জন্যও বুঝতে পারিনি ওরা আসলে কী করছে। কখনো তো মনে হচ্ছিল রাগবি টাইপ একটা কিছু খেলছে! বল ছাড়া ট্রেনিং কীভাবে হয়!”
ম্যানমার্কিং এর স্বর্গভূমি ইটালিতে প্রথম জোনাল মার্কিং (দলবেধে ডিফেন্ড করা, আলাদা প্লেয়ার বাই প্লেয়ার না) নিয়ে আসেন তিনি, 4-4-2 তে সবাইকেই অফ দ্য বল ট্র্যাক করতে হতো, অর্থাৎ ফরোয়ার্ডকেও নিচে নেমে ডিফেন্ড করতে হতো। স্ট্রাইকার বাস্তেন বা গুলিত নিচে নেমে এসে যে ডিফেন্সিভ কাজটা করতো, সেই আমলে তা দুর্লভ ছিল। প্রবীন ডিফেন্ডার বারেসি, সাথে তরুণ মালদিনি, কোস্টাকুর্তা আর টাসোত্তিকে নিয়ে গড়া ডিফেন্স লাইনটা ছিল নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা। ভাবা যায়, দুই সিজনে ২০০ ম্যাচে মাত্র ২৩ গোল হজম? আনচেলত্তি-ডোনাডুনির মিডফিল্ড জুটি আর উপরে সৌন্দর্যের আসল রূপকার গুলিত আর বাস্তেন।
মিলানে তার শুরুটা ছিল জঘন্য , দুই ম্যাচ বাজে খেলে জয়হীন। তৃতীয় ম্যাচেই চিরপ্রতিদ্বন্দী ইন্টারের কাছে পর্যুদস্ত। তখন জাত গেল, জাত গেল রব উঠে গেছে! পঞ্চম ম্যাচ থেকেই সব পরিবর্তন শুরু। ইতালিসহ বিশ্ব এমন খেলা দেখতে লাগল যা আগে কখনো দেখেনি। গোছানো, মাপা, শৈল্পিক মন জুড়ানো খেলা। সাথে ফলাফলও আসতে লাগল। ইতালির বাকি দলগুলা তখনো মিলানের স্টাইল আটকানোর কৌশন এঁটে উঠতে পারেনি।
টানা জয়ে পেছন থেকে এসে টেবিল এর শীর্ষে মিলান। ইতালিয়ান লীগে তখন এক পয়েন্ট এগিয়ে মিলান, দু’ম্যাচ বাকি, দ্বিতীয় স্থানে ম্যারাডোনার নাপোলি। তখন নাপোলির সাথে ম্যাচ, নাপোলির মাঠে। যে জিতবে, সে লিগ চ্যাম্পিয়ন। জিতল মিলানই, কিন্তু বড় কথা সেটা ছিল না। শেষ বাঁশির পরে পুরো নাপোলি স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়েছিল মিলানকে তাদের অনবদ্য ফুটবল প্রদর্শনীর জন্য। প্রতিদ্বন্দ্বী দর্শক সারা বছরের কষ্টের ফসল লীগ হারানোর বেদনা ভুলেও যখন স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়, সেই দলের খেলার সৌন্দর্য না বললেও চলে।
এরপর রিয়ালের সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সেমি ফাইনাল ম্যাচ। প্রথম লেগ বার্নাব্যুতে ১-১ এ ড্র, কিন্তু দ্বিতীয় লেগ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে নেক্সট দশকটা কেন মিলানের হবে। গুণে গুণে তারা পাঁচটা গোল দিলো রিয়ালকে। তখন ইউরোপের সেরা দল রিয়াল, সফলতমও। এই ম্যাচটা দিয়ে ব্যাটনটা নিয়ে নেয় মিলান। পরের দশ বছর ইউরোপের সেরা ছিলো মিলান। রিয়ালকে হারানোর পর ফাইনালে আর কে আটকায়? একপেশে একটা ফাইনালে মিলান ৪-০ তে জিতে নেয় বুখারেস্টকে হারিয়ে।
কিছুই থেমে যায়নি। পরেরবার দলে আসে রাইকার্ড, সেন্টার মিডফিল্ডার, পুরো দলকে একা খেলাতে পারতো। টিমে নতুন মাত্রা পায় মোহনীয়তা। টিমের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো, সাথে খেলার সৌন্দর্য। মিলানই তখন ইতালির মুখ। পরেরবার আবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে, সেবার মুখোমুখি বেনিফিকা।
‘৯০-এর সেই ফাইনালটাই সাচ্চির ট্যাকটিকাল নলেজের পরিচয় দেয়। যেটা পরে বারেসি প্রকাশ করেছিলেন। খুব টাফ ডিফেন্সিভ টিম ছিল বেনিফিকা। সাচ্চি ঘেটে ঘেটেও কিছুতেই দুর্বলতা পাচ্ছিলেন না, নিশ্ছিদ্র ডিফেন্স। শেষমেশ একটাই খুঁত পেলেন, বেনিফিকার সেন্টারব্যাক দুইটা ম্যানমার্ক করে অর্থাৎ স্ট্রাইকারকে ফলো করে। ঠিক এটাকেই একিলিস হিল করলেন। রাইকার্ড মূলত সেন্টার মিডফিল্ডার, গোলটোল কম করে, তাই অপোনেন্ট মার্ক করে না। প্ল্যান ছিল মার্কে এ থাকা স্ট্রাইকার বাস্তেন ডিফেন্ডারদের বের করে আনবেন, রাইকার্ড সেই স্পেসটায় রান নেবে। অর্থাৎ যে আজীবন গোল করে, সে পাস দিবে আর যে গোল বানায়, সে গোল দিবে।
বারেসির ভাষায় এই মুভটা ফাইনালের আগে ৩০ বার প্র্যাকটিস করা হয়। হলোও তাই। ঠিক সেইম মুভে গোলটা হয়। ব্যাক টু ব্যাক চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতে নিলো সাচ্চির মিলান, যেটা এখন অবধি আর কেউ পারেনি। ইউরোপে তখন সাচ্চির জয়জয়কার। চার বছরে আটটা ট্রফি জিতিয়ে অবশেষে ক্লাব ছাড়েন তিনি। এত ইনটেন্স ওয়ার্ক আর টু দ্যা পয়েন্ট ট্যাকটিক্যাল এনালাইসিসে প্লেয়াররা তাদের ব্রেকিংপয়েন্টে পৌছে যায়, খেলাও তাই ফিকে হয়ে আসতে থাকে। সমাপ্ত হয় মিলানের স্বর্ণসময়ের।
ইতালির জাতীয় দলের কোচ হিসেবে পরবর্তী জীবন শুরু করেন তিনি। তখন খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই ইতালিয়ান টিম। ছন্নছাড়া, অন্তঃকোন্দল সহ নানা ঝামেলা আক্রান্ত ইতালি। সাচ্চি ছিলেন মোটিভেটর, খুব অল্প সময়ে ভালো কাজ করতে পারতেন। দায়িত্ব নিয়েই দলকে গুছিয়ে নেন। ৯৪ বিশ্বকাপ শুরুর আগে টিমকে জিজ্ঞাসা করেন অনেস্টলি কে কি ভাবছে যে ইতালি কতদূর যেতে পারবে? ২৩ জনের মধ্যে একজন (স্বাভাবিকতই মালদিনি) বলেছিলো ফাইনাল। দুইজন বলেছিল সেমি, আর সবাই কোয়ার্টার। সবার আশার অতীত হিসেবে সেই টিমকে নিয়ে যান ফাইনালে।
ব্রাজিল বনাম ইতালি ম্যাচ, রোমারিও বনাম মালদিনি। জীবনে একটাও পেনাল্টি মিস না করা বাজ্জিও ফাইনালেই টাইব্রেকের সময় মিসটা করলেন। খুব কাছে এসেও সাচ্চি স্পর্শ করতে পারলেন না বিশ্বকাপ। তবে ইতালিজুড়ে তাঁর প্রশংসা চলছিলোই, ছন্নছাড়া একটা দলকে ফাইনালে তোলাটা আশাতীত ছিলো। আর সাচ্চি ঠিক তা-ই করে দেখালেন।
সাচ্চিকে কোচিং এর রোনালদিনহো বলাই যায়। কেন? কারণ ‘৯৪ এর বিশ্বকাপের পরে আর কোনো সাফল্য নেই তার। ‘৮৭-তে যে ধূমকেতুর আগমন ঘটেছিল, ‘৯৪ এই তার অন্ত। কিন্তু মাঝখানে যা দিয়েছেন তা হিরন্ময়। ঠিক রোনালদিনহোর ক্যারিয়ারটার মতো । পাঁচ বছরের মোহনীয় খেলা দিয়ে রোনালদিনহো যেমন আজীবন অমর হয়ে থাকবেন, তেমনি ৮৭-৯৪ এই সময়ে আরিগো সাচ্চি যা দিয়ে গেছেন ফুটবলকে, তার জন্যই চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন।
১৯৭৫-২০০০ সময়টা ছিল ফুটবলে টাফ ট্যাকল, ডিফেন্সের যুগ। আর সেই সময়ে সাচ্চি এমন এক স্টাইল দিয়ে যান যেটা এর আগে বা পরে ইতালি আর কখনো দেখেনি, মিলানও না। সাচ্চি যেদিন অবসর নেন, ইতালির বিখ্যাত গেজেত্তা স্পোর্টস লিখেছিল,
‘‘Beauty retires from Itallian football with Arrigo.’’
ইনি সাচ্চি, ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা কোচ।