‘ওয়ার্নাকুলাসুরাইয়া পাতাবেন্দিগে উসান্তা জোসেফ চামিন্দা ভাস।’ ক্রিকেট বিশ্বে চামিন্দা ভাস নামেই পরিচিত। চামিন্দা ভাসের ক্যারিয়ার তার নিজের নামের মতোই সমৃদ্ধ। উপমহাদেশের পেসার হিসাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে গর্ব করার মতো অনেক ইতিহাস রচনা করেছেন চামিন্দা ভাস।
যাদের ‘ভ’ এবং ‘ব’ উচ্চারণে উচ্চারণগত সমস্যা আছে তারা ভাসকে বাস উচ্চারণ করার মতো ভুল সহজেই করতে পারেন। বাস যানবাহনের নাম হলেও ক্রিকেটার ভাসের সাথে কাজের অনেক মিল রয়েছে। ‘বাস’ যেমন তার যাত্রীদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেয় তেমনি ভাসও নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে শ্রীলঙ্কা দলকে বহুবার জয়ের গন্তব্যে পৌঁছিয়েছেন।
ক্রিকেট ইতিহাসে জুটি বেঁধে প্রতিপক্ষের ইনিংস ধসিয়ে দেওয়া বোলারদের তালিকা করতে গেলে দশ জনের নয়জন পাওয়া যাবে পেসার। ওয়াসিম-ওয়াকার, ওয়ালশ-অ্যামব্রোস, ব্রড-অ্যান্ডারসন, পোলক-ডোনাল্ড ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি, ব্রেট লি – জনসন সহ এরকম অনেক জুটি প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের স্ট্যাম্প উপড়ে দিয়েছেন।
চামিন্দা ভাস নতুন বলে শ্রীলঙ্কার অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন, তার সাথে জুটি বেঁধে প্রতিপক্ষের শিবিরে ধস নামানোর কাজটা করেছে মুত্তিয়া মুরালিধরন। উপমহাদেশের মাটিতে স্পিন সহায়ক পিচে কাজের কাজটুকু করতেন মুরালিধরন আর তাকে যোগ্য সমর্থন দিতেন চামিন্দা ভাস। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবচেয়ে সফল জুটির বোলার মুরালি এবং চামিন্দা ভাস।
১৯৯০-৯১ মৌসুমে মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে কোল্টস ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় চামিন্দা ভাসের। অভিষেকের ৪ বছর পর ১৯৯৪ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় তার। দুর্দান্ত অফ কাটার, ইনসুইংগার আর রিভার্স সুইং এর জন্য তার নামডাক ছিলো অনেক।
অভিষেকের পর নিজেকে প্রমাণ করতে বেশি লাগেনি চামিন্দা ভাসের। তার হাত ধরেই বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচ জয় পায় শ্রীলঙ্কা। নিজের ৫ম ম্যাচে নেপিয়ারে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটে বলে দুর্দান্ত পারফরমেন্সে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেওয়ার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কাকে এনে দিয়েছিলেন ২৪১ রানের বড় জয়।
শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংসে ১৮৩ রানে অল আউট হওয়ার পরেও তার কল্যাণে বড় জয় পায়। চামিন্দা ভাস প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে অপরাজিত ৩৩ রান করার পর ৪৭ রানে ৫ উইকেট শিকার করেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৬ রানের পাশাপাশি ৪৩ রানে ৫ উইকেট নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিদেশের মাটিতে প্রথম জয় নিশ্চিত করেন।
নেপিয়ারের পর ডুনেডিনেও ছিলেন উজ্জ্বল, প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে ৫১ রান করার পর ৮৭ রানের খরচায় শিকার করেন ৬ উইকেট। যার ফলে আবারো ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিজের করে নেন চামিন্দা ভাস।
টেস্টের পর ওডিআইতেও নিয়মিত হন ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে, যেখানে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা। তার ক্রিকেটীয় অর্জন অনেক, তারমধ্যে অন্যতম হলো বিপক্ষ দলের ভালো ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করা। সৌরভ গাঙ্গুলী, রিকি পন্টিং, স্টিফেন ফ্লিমিং, ক্রিস গেইল, অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের বিপক্ষে দুর্দান্ত বল করে তাদেরকে প্যাভিলিয়নের রাস্তা দেখিয়ে দিতেন নিয়মিত।
স্পিনারদের স্বর্গ উপমহাদেশে ২০০১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩ টেস্ট ম্যাচের সিরিজে ২৬ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ভাস। সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ১৪ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। উপমহাদেশের মাটিতে এক টেস্টে ১৪ উইকেট বা তার বেশি উইকেট শিকারের তালিকায় এর আগে মাত্র একজনের নাম ছিলো, পাকিস্তানের ইমরান খান। তিনিও উপমহাদেশের মাটিতে এক টেস্টে ১৪ উইকেট শিকার করেছিলেন।
চামিন্দা ভাসের নামটা বাংলাদেশের মানুষজনের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে। ঐ বিশ্বকাপে ২৩ উইকেট শিকার করে টুর্নামেন্ট সেরা বোলার ছিলেন চামিন্দা ভাস। বাংলাদেশের মানুষদের কাছে তার প্রাথমিক সাক্ষাৎ ছিলো ভয়ানক।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট খেলেছিল, ঐ আসরে পাকিস্তানকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। তারপরের বছর দশম দল হিসাবে টেস্ট স্ট্যাটাসও পেয়ে যায় বাংলাদেশ।
তাই ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে অনেক আশা ছিলো বাংলাদেশের, কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো অতিবাহিত হতে থাকে সাউথ আফ্রিকা সফর। ২০০৩ সালের ভালোবাসা দিবসের মধ্য-প্রহরে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপকে মাত্র ৫ বলেই ধসিয়ে দেন চামিন্দা ভাস। হয়তো তখনো টিভি সেটের সামনে বসে উঠতে পারেননি উৎসুক জনতা।
টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক সনাৎ জয়াসুরিয়া। ব্যাটিংয়ে নেমে পিচের কন্ডিশন না বুঝেই ভাসের ইনসুইংগারকে ড্রাইভ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে ফিরেন হান্নান সরকার। তারপর ক্রিজে আসেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল, কিন্তু চামিন্দা ভাসের বল বুঝতে না পেরে তার হাতে সহজ ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয় তাকে।
ইনিংসের মাত্র তৃতীয় বলে ব্যাট হাতে মাঠে নামতে হবে এমনটা হয়তো কল্পনাতেও ছিল না এহসানুল হকের। ক্রিজে এসে চামিন্দা ভাসের হ্যাট্রিক বল খেলতে গিয়ে জয়াবর্ধনের হাতে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে তিনিও প্যাভিলিয়নমুখী হন। এরপর সানোয়ার হোসেন ক্রিজে এসে প্রথম বলেই চার মারেন। পরের বলটি ওয়াইড হয়। ওভারের ৫ম বলে সানোয়ার হোসেনকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে মাত্র ৫ বলে বাংলাদেশের ৪ ব্যাটসম্যানকে আউট করেন চামিন্দা ভাস।
চামিন্দা ভাস ৯৬ টি টেস্ট খেলার পরেও কোনো শতক হাঁকাতে পারেনি। শতক হাঁকানোর জন্যও বেছে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলকে। ২০০৭ সালে কলোম্বো টেস্টে নিজের ৯৭ তম টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৬৯ বলে অপরাজিত ১০০ রান করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম টেস্ট শতক তুলে নিয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত সবচেয়ে দেরিতে প্রথম টেস্ট শতক পাওয়া ক্রিকেটার ছিলেন চামিন্দা ভাস, এরপর কুম্বলে শতক হাঁকিয়ে তার কাছ থেকে অদ্ভুত এই রেকর্ড ছিনিয়ে নেন।
বিশ্বক্রিকেটের অন্যান্য পেসারদের মতো তারও ক্যারিয়ার ত্রিশের কোঠার মাঝামাঝিতে থেমে যায়, ৩৫ বছর বয়সে। ১৯৯৪ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় চামিন্দা ভাসের, ১৫ বছর পর নিজের শেষ টেস্ট খেলার জন্য প্রতিপক্ষ হিসাবে পাকিস্তানকেই বেছে নেন ভাস।
এই ১৫ বছরের পথচলায় ১১১ টি টেস্টে ৩৫৫ উইকেট শিকারের পাশাপাশি ব্যাট হাতে ২৪.৩২ ব্যাটিং গড়ে করেন ৩০৮৯ রান। একমাত্র শ্রীলঙ্কান হিসাবে ৩৫০+ উইকেট এবং ৩০০০+ রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন চামিন্দা ভাস।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচ খেলেন ওডি’আইতে, এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে প্রথম অবসরের ঘোষণা দেয় ওডি’আই ক্রিকেট থেকেই। ভারতের বিপক্ষে ওডি’আই অভিষেক হয় আবার ভারতের বিপক্ষেই নিজের শেষ ওডি’আই ম্যাচ খেলেন।
নিজের শেষ ওডি’আই ম্যাচে যুবরাজ সিংকে শূন্য রানে আউট করে ওয়াসিম, ওয়াকার এবং মুরালিধরনের পর চতুর্থ বোলার হিসাবে ৪০০ টি ওডি’আই উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন চামিন্দা ভাস।
ওডি’আইতে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করা বোলারের নাম চামিন্দা ভাস। ১৫ বছর আগের করা তার রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। কলোম্বোতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো শ্রীলঙ্কা। ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম বলেই চামিন্দা ভাসের শিকারে পরিণত হয় ইব্রাহিম। এরপর হ্যাট্রিক সহ ৮ ওভারে ১৯ রান রান দিয়ে ৮ উইকেট তুলে নেন চামিন্দা ভাস। ইনিংসের সবকটি উইকেটই হয়ত তার দখলে যেত, যদি না মুরালিধরন তার করা প্রথম ৪ বলেই জিম্বাবুয়ের শেষ ২ উইকেট শিকার না করতেন।
এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই মুরালিধরনের ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড থেকে বঞ্চিত করেন চামিন্দা ভাস। ঐ ম্যাচের এক বছর পর মধুর প্রতিশোধ নেন ভাস। ইনিংসের প্রথম ৯ উইকেট শিকার করে মুরালিধরন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ উইকেটটি ভাসের দখলে যায়।
চামিন্দা ভাস খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন ২০১২ সালে। এরপর নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা এবং আয়ারল্যান্ডের বোলিং কোচের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাকে। চামিন্দা ভাস ছুটেই চলেছেন, বিশ বছর ধরে।