গ্রায়েম পোলক মানুষটা শ্বেতবর্ণই ছিলেন। ষোল বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেঞ্চুরি, ২০ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হয়ে শুরুতেই একটা হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। এই হইচই যে মোটেই ফাঁকা বুলি ছিল না, সেটা ক্যারিয়ার ব্যাটিং গড়ই সাক্ষ্য দেয়। নামের আগে উপমা যোগ হয়, ‘সাদা চামড়ার ব্র্যাডম্যান!’
হয়তো বা সে লড়াইয়ে গ্রায়েম পোলকও থাকতে পারতেন। ‘শচীন, নাকি ব্র্যাডম্যান’ প্রশ্নে অবধারিতভাবে গ্রায়েম পোলকও আসতেন।
কিন্তু, কেবল ২৩ টেস্ট খেলে কি আর সেরার লড়াইয়ে আসা যায়! ষাট ছুঁইছুঁই ব্যাটিং গড়টা কেবলই আক্ষেপ জাগায়, আরও একটু খেলার সুযোগ পেলে কী হতে পারতো!
সুযোগ যে পাননি, তার পেছনে দায় তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বর্ণবাদী নীতির। সে নীতি গত হতে চললো প্রায় তিন দশক। কিন্তু প্রশ্নটা এখনও রয়েই গিয়েছে, আদৌ দক্ষিণ আফ্রিকা কি বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে? রাইলি রুশো, ডুয়ান অলিভিয়েররা কেন তবে দেশান্তরী হচ্ছেন?
১.
বর্ণবাদের অভিশাপ দক্ষিণ আফ্রিকায় গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকেই ছিল। কালোদেরকে একঘরে করে রাখা, কালোদেরকে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখার মতো ন্যক্করজনক ঘটনা ঘটছিলো অহরহ। তবে ষাটের দশকে যেন এই বর্ণবৈষম্য পেয়ে যায় অন্য মাত্রা। কৃষ্ণগাত্রের মানুষেরাও একটু সোচ্চার হয়ে উঠতে শুরু করে এ সময়টাতেই। তবে তাদের জেলে পাঠিয়ে, নির্বাসনে পাঠিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার আরও নির্যাতন-নিপীড়নের পথ পরিষ্কার করে। বাদ যায়নি ক্রীড়াক্ষেত্র, এমনকি ক্রিকেটও। দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের পাশাপাশি চালু হয় দক্ষিণ আফ্রিকা কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয় দল। সে দলের প্লেয়াররা কে কোথায় আছেন, আজ পাঁচ দশক পরে জানা ভীষণ মুশকিল। তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষজনই তো সে দলের খবর জানতেন না।
এখানে থামলেও কথা ছিল। বর্ণবৈষম্য ব্যাপারটাকে আন্তর্জাতিক রূপ দেবার পায়তারা করে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার, ক্রিকেট খেলার ঘোষণা দেয় স্রেফ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের সাথে। প্রশ্নটা যখন গায়ের রঙ নিয়ে, বুঝতে পারা কঠিন নয়, কেবল বেছে বেছে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গেই খেলবার ফন্দি আঁটছিলেন তারা।
আইসিসি অবশ্য মানেনি। ফলাফল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা।
সেই নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ভেঙেছিলো ২২ বছর পর, দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদের কালো থাবা থেকে ‘মুক্ত’ হবার পর। মাঝ থেকে ক্রিকেট হারিয়েছিলো গ্রায়েম পোলক, ব্যারি রিচার্ডসদের।
২.
অবশ্য বর্ণবাদী আগ্রাসন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটকে পিছিয়ে দিয়েছিলো, নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পরের ফলাফল অবশ্য এমন সাক্ষ্য দেয় না। নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে খেলা প্রথম বিশ্বকাপেই সেমিফাইনালিস্ট… ভালোই তো!
মাঝে কয়েকটা বছর বেশ ভালোই চলেছিলো। তবে ক্ষতিটা বোধহয় হয়ে যায় ২০১৬ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের নেয়া ‘জাতীয় দল সবার’ সিদ্ধান্তে। বর্ণবৈষম্য বিলোপে এ আইন করা হলেও এ আইনের ফলে দলে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্রথমেই যে প্রশ্নটা এসে হাজির হয়, ‘তোমার গায়ের রঙ কী?’
৩.
কি ছিল সেই আইনে?
আইন অনুযায়ী, প্রতি মৌসুমে দলে অন্ততপক্ষে পাঁচজন সাদা চামড়ার ক্রিকেটারকে রাখতে হবে। খুবই সরল এই আইনের মারপ্যাঁচটা তাহলে শুনুন, বাকি ছয়জনের দু’জনকে একেবারেই কৃষ্ণগোত্রীয় হতে হবে। বাকি চারজনকে মিশ্র রঙধারী, শ্যামবর্ণ বললেই সহজ শোনায়।
প্রতি ম্যাচের পূর্বে প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে গবেষণা করার আগেই তাই দক্ষিণ আফ্রিকার যেকোনো দলের কোচ-অধিনায়ককে আলোচনায় বসতে হয়, ‘সাদা-কালোর অনুপাত ঠিক আছে তো?’
খুবই হাস্যকর এই নিয়ম যে দক্ষিণ আফ্রিকায় খুবই কড়াকড়িভাবে মানা হয়, সেটা প্রতীয়মান হয় ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। এখনও গুঞ্জরিত হয়, সেদিন ভারনন ফিল্যান্ডারকে খেলানো হয়েছিলো স্রেফ দলে সাদা-কালোর অনুপাত ঠিক রাখতে! নইলে দারুণ ফর্মে থাকা কাইল অ্যাবটকে ছাপিয়ে হাফ-ফিট ফিল্যান্ডার খেলেন কী করে! তখন যদিও সাদা-কালো খেলোয়াড় রাখা নিয়ে কোনো নিয়ম ছিল না, তবে বোর্ড সভাপতি হারুন লরগাতের কাছ থেকেই নাকি শ্যামবর্ণের ফিল্যান্ডারকে দলে রাখার চাপ এসেছিলো।
৪.
এর কিছুদিন বাদেই কাইল অ্যাবট পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে, দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে। এর পেছনেও রয়েছে আরেক অদ্ভুত নিয়মের মারপ্যাঁচ, কোলপাক চুক্তি। গত কয়েকদিনে ক্রিকেটপাড়ায় যা বইয়ে দিয়েছে তুমুল আলোড়ন।
এই কোলপাক চুক্তিটা আসলে কী?
খুব সংক্ষেপে যদি বলা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আওতাভুক্ত দেশগুলোর মানুষরা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত অন্য দেশে যেমন বিদেশি হিসেবে গণ্য হন না, এই চুক্তির কার্যকারীতাও তেমনই। পার্থক্য হচ্ছে, কেবল ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধীন দেশগুলোই নয়, এই চুক্তির সুবিধা পাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়েসহ ক্যারিবিয়ানের আরও কিছু দেশ। তবে ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে, এই চুক্তির পরিপূর্ণ সুবিধা লুফে নিচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররাই।
২০০৩ সালে এই চুক্তি চালুর পরই আফ্রিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানোর হিড়িক পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারদের মাঝে। ক্লড হেন্ডারসন আর ওটিস গিবসনকে ২০০৪-০৫ মৌসুমে দলে ভিড়িয়ে লেস্টারশায়ার সূচনা করে দেয় ক্রিকেটে কোলপাক অধ্যায়ের। ওটিস গিবসন ততদিনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অধ্যায় পেরিয়ে কোচিং শুরু করলেও বিপত্তিটা বাঁধে ক্লড হেন্ডারসনকে নিয়ে। তখন যে তার বয়সটা ৩১। বিপত্তিটা এই কারণে, কোলপাক চুক্তি করা মানে জাতীয় দলে খেলার আশাটা চুক্তির সময়টায় জলাঞ্জলি দেয়া। চুক্তিভুক্ত দিনগুলোতে জাতীয় দল নয়, কাউন্টি দলগুলোই হবে খেলোয়াড়ের কাছে মুখ্য।
এরপর ক্লড হেন্ডারসনের দেখানো পথে দেশ ছেড়েছেন আরও ৪৩ দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারের সংখ্যাটা এক্ষেত্রে কেবল নয়জন, জিম্বাবুয়েরও আছেন ছয়জন।
৫.
শুরুর দিকে অবশ্য ত্রিশ পেরোনো ক্রিকেটার, যাদের ক্যারিয়ারের সোনালি সময়টা গত হয়েছে বেশ আগেই, তারাই কেবল কোলপাক চুক্তি করছিলেন। জিম্বাবুয়ের গ্রান্ট ফ্লাওয়ার যেমন একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে যখন জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হারালেন, কেবল তখনই এই চুক্তি করেছিলেন।
তবে সময় গড়ানোর সাথে সাথে তরুণ ক্রিকেটারদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চুক্তিটি। এমনকি ২০-২২ বছরের তরুণ ক্রিকেটাররাও ঝুঁকছিলেন এ চুক্তিতে। কেবল ২০০৮ সালেই কোলপাক চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার ছিলেন ১৬ জন, যার ১২ জনই দক্ষিণ আফ্রিকান। ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড সে সময় নিয়ম বদলে লাগাম টানে এ চুক্তিতে। মাঝে তাই ভাটা পড়েছিলো ইংল্যান্ডে কোলপাক ক্রিকেটারের জোয়ারে।
৬.
কেন কোলপাক চুক্তি করে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নকে ভেঙে ফেলা? প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই পাওয়া যায় ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচে, যেদিন ইনফর্ম কাইল অ্যাবট জায়গা হারিয়েছিলেন হাফ-ফিট ভারনন ফিল্যান্ডারের কাছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের চাপিয়ে দেয়া সাম্য আইনের চাপে সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যানেজমেন্টকে নিতে হয়েছিলো এমন যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত। এই আইন চালু আছে দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া লিগের প্রতিটি স্তরে। যার কারণে আজকের ম্যাচে ম্যাচসেরা পুরষ্কার পাওয়া ক্রিকেটারটিও যদি পরের ম্যাচে বেঞ্চ গরম করেন, অবাক হবার কিছু নেই।
জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নকে যদি সিস্টেমের বলি হয়ে বিসর্জন দিতে হয়, তার চেয়ে নিজ হাতে সেই স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করাই কি ভালো নয়? বেশিরভাগ ক্রিকেটারই এমনটা ভেবেই কোলপাক চুক্তিতে নাম লেখাচ্ছেন। উপরি হিসেবে যোগ হয় পাশ্চাত্য দেশে সচ্ছল জীবনযাপন, নিজ দেশের ঘরোয়া লিগের চেয়ে অনেক বেশি বেতন। দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রার মানের চেয়ে ইংল্যান্ডের মুদ্রার মানটাও যথেষ্ট বেশি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচির ফাঁকে কাউন্টি দলগুলোর খবরাখবরও আজকাল খুব একজন রাখেন না। ওই ক্রিকেটে চাপটাও খুব একটা নেই।
এত প্রলোভন পেরিয়ে জাতীয় দলে খেলার সাধটাও তাই অনেকের থাকে না।
৭.
আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে, লাভটা সম্পূর্ণই ক্রিকেটারের। আবেগ ঝেড়ে ক্রিকেটাররা তাই আসবেন না কেন?
আর্থিক ক্ষতিটা হচ্ছে অবশ্য কাউন্টি দলগুলোর। একজন কোলপাক চুক্তিভুক্ত প্লেয়ারকে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে নেয়া মানেই ইসিবি থেকে ১১০০ পাউন্ড কম পাওয়া, ঘরোয়া একদিনের ম্যাচে যে ক্ষতির পরিমাণ ম্যাচপ্রতি ২৭৫ পাউন্ড।
তবুও কাউন্টি দলগুলো ক্রিকেটারদের কোলপাক চুক্তির আওতায় আনতে পিছুপা হচ্ছে না। কারণ, আর্থিক ক্ষতির চেয়ে লাভের পাল্লাটাই তাদের কাছে ভারি।
দলে একজন কোলপাক চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটার মানে, ‘বিদেশি, তবু বিদেশি নন’। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচগুলোতে প্রতি ম্যাচে বিদেশি ক্রিকেটার নামতে পারেন মাত্র একজন, সে হিসেবে বিদেশি কোলপাক ক্রিকেটার দলে থাকবার পরও আরও একজন বিদেশি ক্রিকেটার নেবার সুযোগটা থাকছেই। নিয়মের ফাঁকফোকরে ম্যাচে অন্তত দু’জন বিদেশি খেলিয়ে নিচ্ছে দলগুলো। আর বর্তমান নিয়মে একজন ক্রিকেটারকে ন্যূনতম পরিমাণ আন্তর্জাতিক ম্যাচে জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করে তবেই কোলপাক চুক্তি করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্রিকেটারের সঙ্গে একজন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলা ক্রিকেটারের সুস্পষ্ট পার্থক্য তো আছেই!
যদিও কোলপাক ক্রিকেটার আসার কারণে ম্যাচের মান বাড়ছে, তবে ম্যাচে একজন কোলপাক ক্রিকেটার খেলা মানে প্রত্যক্ষ ক্ষতি একজন ইংলিশ ক্রিকেটারের সুযোগ না পাওয়া, আর পরোক্ষে ইংলিশ ক্রিকেটের পাইপলাইনটা দুর্বল হয়ে যাওয়া।
বারবার কোলপাক চুক্তির নিয়মকানুনে বদল এনে চেষ্টা করে যাচ্ছে যত বেশি সম্ভব স্বীয় ইংলিশ ক্রিকেটারদের সুযোগ করে দিতে। কখনো এমন আইন প্রণয়ন করছে, যেখানে বলা হচ্ছে,
‘কেবল এমন ক্রিকেটাররাই কোলপাক চুক্তির আওতাভুক্ত হতে পারবেন, যারা চুক্তি করার আগের বছরে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপায়নি।’
জ্যাক রুডলফের জন্যে এ আইন পরে বাতিল ঘোষিত হয়।
এ ঘটনার পরে আবারও ইসিবি আইন বানায়,
‘দুইজনের বেশি কোলপাক প্লেয়ার নিলে ম্যাচ ফি কর্তন করা হবে।’
আর্থিক ক্ষতির ভয় দেখিয়েও যে লাভ হয়নি, তার প্রমাণ ২০০৮ সালে কাউন্টি ক্রিকেটের ম্যাচে নর্দাম্পটনশায়ার আর লেস্টারশায়ার মাঠে নেমেছিলো ১২ জন কোলপাক ক্রিকেটার নিয়ে।
শেষতক সিদ্ধান্ত হয়, কোনো প্লেয়ারকে কোলপাক অধিভুক্ত হতে হলে, ইংল্যান্ডে কাজ করার জন্যে কমপক্ষে চার বছরের অনুমতি থাকা লাগবে। যদি তা না থাকে, তবে বিগত দু’বছরের মাঝে কমপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা লাগবে।
এই নিয়ম যে কিছুটা হলেও কাজ করছে, তা বোঝা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছরে কোলপাক ক্রিকেটারকে দলে ভেড়ানোর সংখ্যাটা নেমে এসেছে ৩-৪ শতাংশে।
৮.
ক্ষতির ভাগটা অবশ্য সাউথ আফ্রিকারই বেশি। শৈশব থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যেইমাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার জন্যে খেলোয়াড়টি তৈরি হচ্ছেন, তখনই তিনি জাতীয় দলকে না বলে দিচ্ছেন। সাউথ আফ্রিকা পড়ছে ক্রিকেটার সংকটে, খুঁজতে হচ্ছে বিকল্প। পারছে না কাউকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে।
তবে এর পেছনের দায়টা অবশ্য মোটেই ক্রিকেটারদের নয়।
২০১৫ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী, দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলে জায়গা পাবেন তিন ধরণের ক্রিকেটার: সাদা, শ্যামবর্ণ এবং কালো। সাদা খেলোয়াড়ের সংখ্যাটা হবে ৫, শ্যামবর্ণ ৪ এবং কালো ক্রিকেটারদের সংখ্যাটা ২ জন। অর্থাৎ, একই জাতীয় দলে খেলার পরও আমলা কিংবা ডেভিড মিলারের সুযোগ পাওয়ার মানদণ্ড এক নয়।
সমস্যার তীব্রতা আরও বেশি বোঝা যাবে ঘরোয়া ক্রিকেটের দিকে তাকালে। বর্তমানে সাউথ আফ্রিকায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা দলের সংখ্যা ছয়, অর্থাৎ সেরা একাদশে সুযোগ পাওয়া ক্রিকেটারের সংখ্যা ৬৬। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যদিও মৌসুমজুড়ে গায়ের রঙের অনুপাত ঠিক রাখলেই চলছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতি ম্যাচে সংখ্যাটা ধ্রুব রাখা জরুরি। ছয়জন কৃষ্ণবর্ণের খেলোয়াড়কে দলে রাখতেই হবে। মানে, ছয় দলে ছত্রিশজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার। শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারদের জন্যে রইলো ৩০টি আসন।
মধ্য বিশে দাঁড়ানো খেলোয়াড়টি তখনও খেলে যাচ্ছেন জাতীয় দলে কখনো না কখনো ডাক পাবেন এই আশায়, ত্রিশ পেরোনো ক্রিকেটারের সেই আশা কোথায়? তিনি খুঁজে নিচ্ছেন কোলপাক চুক্তি। আফ্রিকার চেয়ে ওই উন্নত পাশ্চাত্য দেশে জীবনযাপন ঢের ভালো।
আর যেই ক্রিকেটার এখনও বিশ ছোঁননি, কিংবা বিশ পেরিয়েও দলে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তার কি হচ্ছে? তিনি হয়ে যাচ্ছেন হিলটন আকারম্যান, কিংবা হারডাস ভিলোজেন। অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেই কিংবা এক টেস্ট খেলেই পাড়ি জমাচ্ছেন ইংল্যান্ডে।
মাঝে তাই সংখ্যাটা কমে গেলেও আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কোলপাক চুক্তি। সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড অবশ্য তাদের নিয়ম মেনেই খুশি। ক্রিকেটাররা কোলপাক চুক্তি করলে তারা হা-হুতাশ করেই দায়িত্ব শেষ করছেন এখন অবধি।
৯.
রাইলি রুশোকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ডের বেশ আশা ছিলো। প্রথম ছয় একদিনের ম্যাচের চারটিতেই শূন্য রানে আউট হবার পরও দক্ষিণ আফ্রিকা আস্থা হারায়নি তার ওপর। অবশ্য তিনি আস্থা হারিয়েছিলেন বোর্ডের ওপর। একবার দল থেকে বাদ পড়লে আবার ফেরাটা বেশ কঠিন হয়ে যাবে, এ চিন্তাতেই খুব সম্ভবত। রাজ্য দলে সাতজন আর ফ্র্যাঞ্চাইজি দলে ছয়জন কালো ক্রিকেটারের ভিড়ে নিজেকে প্রমাণের জায়গাটাই বা কোথায় পাবেন! বেছে নিয়েছেন তাই কাউন্টি দলকে, যেমন নিয়েছেন আরও ৫৯ জন।
প্রশ্নটা তাই থেকেই যাচ্ছে, বর্ণবাদ ভুলতে চেয়ে নিজেরাই বর্ণবাদী আচরণ করছে না তো দক্ষিণ আফ্রিকা?
সব দেখেশুনে ব্যারি রিচার্ডস তাই হতাশ হয়ে মন্তব্য করছেন,
‘এটা অনেকটা রাজনীতি আর খেলার একটা মিশ্রণ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলাফল কখনোই শুভ নয়।’
৭২.৫৭ গড় নিয়েও মাত্র চার টেস্টই খেলতে পেরেছিলেন, অতঃপর বর্ণবাদের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার উপর আইসিসির নিষেধাজ্ঞা। তাই ‘খেলার সাথে রাজনীতি মেশানো, এই নির্মম বাস্তবতাটুকু ব্যারি রিচার্ডসের চেয়ে ভালো কে আর বুঝবেন!