মেহেদী হাসান মিরাজের বয়স মাত্র ২১। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছেন বছর দুই আগে। সে তুলনায় এখনও এই অঙ্গনে ‘নতুন’ বলা যায়। কিন্তু মিরাজের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরিচয়টা অনেক কালের।
১৩-১৪ বছর বয়স থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলছেন। ক্রিকেটের অন্দরমহলের সাথে সেই সময় থেকেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অ্যাকাডেমি ভবনে এসে থাকার সুবাদে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। তবে জাতীয় পরিচিতিটা পেয়ে গেলেন ২০১৬ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। রীতিমতো তারকা হয়ে গেলেন সেই আসরের এই বাংলাদেশ অধিনায়ক।
কয়েক দিনের মধ্যেই টেস্ট অভিষেক হয়ে গেলো, আর অভিষেকেই ‘জাতীয়’ থেকে হয়ে উঠলেন ‘আন্তর্জাতিক’ তারকা। ইংল্যান্ডকে কুপোকাত করে দিলেন প্রায় একাই। ছিলেন ব্যাটিং অলরাউন্ডার, হয়ে গেলেন নিখাঁদ স্পিনার। সেই থেকে জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ মিরাজ। আস্তে আস্তে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে, সেখানেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। একটু একটু করে বোঝা যাচ্ছিলো, মিরাজ তার অলরাউন্ডার সত্ত্বাকে খুঁজে পাচ্ছেন। টেস্টে ২টি ও ওয়ানডেতে একটি ফিফটিও করে ফেলেছেন। কিন্তু আবার বল হাতেই নিজেকে তুলে ধরলেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ হওয়া সিরিজে প্রবল প্রতাপে তুলে নিলেন ১৫ উইকেট। এর মধ্যে শেষ ম্যাচেই নিলেন ১২ উইকেট। বাংলাদেশের পক্ষে ম্যাচে সেরা বোলিংয়ের নতুন রেকর্ড করলেন, ছাপিয়ে গেলেন নিজেকেই।
ফিরে দেখা যাক মিরাজের এই পারফরম্যান্সের মাহাত্ম।
স্পিন স্বর্গ নয়
মিরপুরের উইকেট চট্টগ্রামের মতো স্পিন স্বর্গ ছিল না, এখানে ব্যাটসম্যানদের জন্য বেশ সহায়তা ছিল। তার প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সময়, বাংলাদেশ ওই একই উইকেটে পাঁচ শতাধিক রান করেছে। স্পিনাররা টার্ন পেলেও সেটা ছিল অনুমিত পরিমাণে, অসমান বাউন্সও ছিল না। ফলে এখানে স্পিনারদের জন্য উইকেট নেওয়াটা একেবারে মুখের কথা ছিল না। আর এই উইকেটেই মিরাজ প্রথম তিনটা উইকেট নিলেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করে।
এমন উইকেটে ভালো বোলিং করতে না পারলে উল্টো যে মার খাওয়ার ভয় ছিল, সেটা ম্যাচশেষে স্বীকার করছিলেন মিরাজ নিজেই। বলছিলেন, ভালো জায়গায় বল করতে পারারই পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি,
‘ভালো জায়গায় ধারাবাহিকভাবে বল করেছি। এইজন্য উইকেট পেয়েছি। যদি ভালো জায়গায় বল না করতাম, তাহলে উইকেট তো পেতাম না, রানও হয়ে যেতো।’
হেটমেয়ারের সাথে লড়াই
ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে এই সিরিজের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন মারকুটে ব্যাটসম্যান সিমরন হেটমেয়ার। এই হেটমেয়ারকে এই সিরিজে প্রতিবার মিরাজই আউট করেছেন, দুই ইনিংসে চারবারই তার উইকেট নিয়েছেন। পাল্টা হেটমেয়ারও আউট হওয়ার আগে সিরিজের সর্বোচ্চ রান করে গেছেন।
এই তরুণ ক্যারিবিয়র সাথে মিরাজের লড়াই আজকের থেকে নয়। সেই ২০১৩ সালে অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো হেটমেয়ারের বিপক্ষে খেলেন মিরাজ। এরপর থেকে ওই বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেই দু’জন পরষ্পরের বিপক্ষে ১১টি ম্যাচ খেলেছেন।
এর মধ্যে একটি ম্যাচ কখনোই মিরাজের ভুলতে পারার কথা নয়। ২০১৬ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে এই হেটমেয়ারের কাছে হেরেই বাংলাদেশের শিরোপা স্বপ্ন শেষ হয়েছিলো। সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হেরেছিলো বাংলাদেশ। তখন হেটমেয়ার ও মিরাজ ছিলেন যার যার দলের অধিনায়ক। সেই ম্যাচে দু’জন যার যার দলের সেরা পারফরমারও ছিলেন।
মিরাজের ৬০ রানে ভর করে বাংলাদেশ ২২৬ রান করেছিলো। পরে মিরাজ বল হাতে ২ উইকেট পেলেও হেটমেয়ার ৬০ রান করে নিজের দলের জয় নিশ্চিত করে ফেলেন। ফলে হেটমেয়ারের সাথে হিসাব চুকানোর একটা ব্যাপার যে মিরাজের থাকবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
অবশেষে সেই হিসেবটা চুকানোর পর মিরাজ বলছিলেন, হেটমেয়ারকে আগে থেকে চেনা থাকায় এই টেস্ট সিরিজে তার বিপক্ষে পরিকল্পনা করতে অনেক সহজ হয়েছে,
‘ওর সঙ্গে আমি অনেক দিন খেলেছি। দুইটা যুব বিশ্বকাপ খেলেছি, তারপর জাতীয় দলে ঢুকেও খেললাম। ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই আমি জানি। কাজেই ওর সময় পরিকল্পনা করা সহজ হয়েছে। এজন্য সাফল্যও এসেছে।’
ম্যাচসেরা বোলিং
মিরাজ এই ঢাকা টেস্টে দুটো রেকর্ডের খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন। একটা করতে পেরেছেন, একটা অল্পের জন্য একটা মিস করেছেন। অর্জন করেছেন নিজেরই রেকর্ড পার করে এক ম্যচে দেশের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড, আর মিস করেছেন এক ইনিংসে দেশের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড।
ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিং তাইজুল ইসলামের। ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকায় ৩৯ রানে নিয়েছিলেন তিনি ৮ উইকেট, এবার মিরাজ নিতে পারলেন ৫৮ রানে ৭ উইকেট। মিরাজের চেয়ে ভালো বোলিং আরও একটা আছে অবশ্য, সাকিব আল হাসান ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৬ রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন। আর বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এনামুল হক জুনিয়রের, ২০০৫ সালে তিনি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ জেতার ম্যাচে ৯৫ রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন।
তবে মিরাজ ম্যাচসেরা বোলিংয়ে অনেকদিন ধরেই সবার ওপরে আছেন। ২০১৬ সালে তিনি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে ১৫৯ রানে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন। এবার সেটাকে ছাড়িয়ে গেলেন রান খরচের দিক থেকে, এবার ১১৭ রান দিয়ে নিয়েছেন ১২ উইকেট। এছাড়া এনামুল হক জুনিয়রেরও ২০০৫ সালের সেই টেস্টজয়ের ম্যাচে ১২ উইকেট আছে। বাংলাদেশের হয়ে ম্যাচে ১০ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন আর দুইজন, সাকিব ২ বার এবং তাইজুল একবার।
চার স্পিনারের লড়াই
বাংলাদেশ এই ম্যাচের ভেতর দিয়ে একটা বৈশ্বিক কীর্তি করে ফেললো-এই প্রথম কোনো টেস্ট দল টানা দুই টেস্টে চারজন করে স্পেশালিস্ট স্পিনার নিয়ে মাঠে নামলো। চার জন স্পিনার নিয়ে মাঠে নামা মানে স্পিনারদের মধ্যে উইকেটের জন্য লড়াইটা আরও বেড়ে যাওয়া। প্রথম টেস্টে প্রথম ইনিংসে নাঈম হাসান, দ্বিতীয় ইনিংসে তাইজুল কেড়ে নিলেন সব আলো। এ অবস্থায় দ্বিতীয় টেস্টে তাদের কাছ থেকে আলোটা কেড়ে নেওয়া মিরাজের জন্য সোজা কাজ ছিল না।
মনে হতে পারে, এমন অবস্থায় স্পিনাররা নিজেরা বুঝি এত প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে চান না মাঠে। কিন্তু মিরাজ নিজে বলছেন, এটা তাদের স্পিনারদের জন্যই ভালো। চারজন স্পিনার থাকায় তাদেরই যে সুবিধা হয়েছে, সেটা বলার চেষ্টা করলেন মিরাজ,
‘একটা জিনিস দেখেন যে দুইদিক থেকেই কিন্তু বোলিং করতে হয়। দু’জন বল করতে থাকলে একটা সময় কিন্তু একজন টায়ার্ড হয়ে যায়। কাজেই চারটা স্পিনার নেওয়ার কারণ হলো, ঘুরেফিরে একজন বিশ্রাম দিয়ে আবার বল করানো যায়। তাহলে যোগাযোগ ভালো হয়। এইজন্যই হয়তো অধিনায়ক পরিকল্পনা করছে।’
তারপরও ইংল্যান্ড-পারফরম্যান্স এগিয়ে
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিয়েছিলেন ১২ উইকেট। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও ১২ উইকেট, এবার বরং তুলনামূলক কম রানে। তাই তুলনার কথাটা চলেই এলো। কোন পারফরম্যান্সটা এগিয়ে?
মিরাজ দুটোকেই প্রথমে এক কাতারে রাখতে চাইলেন। পরে অবশ্য স্বীকার করলেন, এরপরও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই পারফরম্যান্সই এগিয়ে,
‘দুইটা কিন্তু ভাল হয়েছে। কিন্তু প্রথমটা আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অবশ্যই ওইটা এগিয়ে থাকবে। কারণ এক্সপেরিয়েন্সের দিক থেকে এখন অনেক পরিপক্ক হয়েছি, ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে এই দুই বছরে। কোন উইকেটে বা কীভাবে কি করলে হবে। কাজেই ওইটাকে এগিয়ে রাখবো, যদিও এইটাও কম না।’