১.
অবিশ্বাসের উচ্চারণ আরেকবার করার জন্য ইয়ান বিশপ হয়তো ততক্ষণে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন! হয়তো তিন বছর আগের স্মৃতি ক্ষণে ক্ষণে ফিরেও আসছে তার মনে। কে জানে!
তিন বছর আগে, ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হয়েছিল ভারতে। ফাইনাল হয়েছিল কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের মধ্যে। প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ড ১৫৬ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল প্রতিপক্ষের সামনে।
সেই ম্যাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতেছিল। কিন্তু এভাবে বললে যে কিছুই বলা হয় না! রেকর্ড বলবে সেই ম্যাচে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ হয়েছিলেন মারলন স্যামুয়েলস। কিন্তু সেই ম্যাচ যে স্যামুয়েলসের চেয়েও বেশি ছিল কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের!
শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ছিল ১৯ রান। ৬ বলে ১৯ রান, যথেষ্ট কঠিন এক ব্যাপার। তার উপরে নন স্ট্রাইকে ছিলেন স্যামুয়েলস। সবাই ভেবেছিল, এক রান নিয়ে তাকে স্ট্রাইক দেবেন ব্র্যাথওয়েট। কিন্তু তা না করে খেলাটা নিজের হাতে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
ওভারের প্রথম বল করলেন বেন স্টোকস, ফাইন লেগ দিয়ে বলটাকে ছক্কা বানালেন ব্র্যাথওয়েট। দ্বিতীয় বলে লং অন দিয়ে আবার ছক্কা। বল আর রানের ব্যবধান ততক্ষণে নেমে এসেছে তিনে। তৃতীয় বলটা নিজের ইচ্ছেনুযায়ী খেলতে পারলেন না ব্র্যাথওয়েট, তবে তাতে মাঠের বাইরে গিয়ে পড়া আটকালো না। এমনকি চতুর্থ বলটাও মাঠের বাইরে আছড়ে ফেললেন তিনি।
কমেন্ট্রি বক্সে ছিলেন ইয়ান বিশপ। নিজের উত্তরসূরীর এই কীর্তি নিজের চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। অবিশ্বাস ঝরে পড়ছিল তার প্রত্যেকটা কথায়।
কার্লোস ব্র্যাথওয়েট! কার্লোস ব্র্যাথওয়েট! রিমেম্বার দ্য নেম…
২.
নিউজিল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের রিপোর্ট লিখতে বসে ধান ভানতে শিবের গীত কেন গাইছি, তা ভেবে পাঠক বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু না গেয়েও যে উপায় নেই। ব্র্যাথওয়েটকে নিয়ে লেখা হবে, আর তাতে তার টানা চার ছক্কার কথা না থাকাটা অনেকটাই ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ম্যারাডোনাকে বাদ দিয়ে লেখার শামিল।
এবার এই বিশ্বকাপের নিউজিল্যান্ড-উইন্ডিজ ম্যাচে ফেরা যাক।
টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক জেসন হোল্ডার। অধিনায়ক যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি, তা প্রমাণ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন শেলডন কটরেল। খেলার প্রথম ওভারেই ফেরান নিউজিল্যান্ডের দুই ওপেনার গাপটিল আর মুনরোকে। সেই গাপটিল যিনি গত বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে খেলেছিলেন ঝকঝকে ২৩৭ রানের একটা ইনিংস, তিনিই এবার ফেরেন শূন্য রানে। চার বছরের ব্যবধানে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দেখা হয়ে যায় তার।
স্কোরবোর্ডে তখন জমেছে মাত্র ৭ রান।
সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে লাগলো নিউজিল্যান্ড, শুরুটা করলেন কেন উইলিয়ামসন। এবারের বিশ্বকাপটা খুব পয়মন্ত যাচ্ছে এই ভদ্রলোকের, দুই সেঞ্চুরি আর এক হাফ সেঞ্চুরিতে ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন ৩৭৩ রান। এমনিতে তাকে দেখে ক্রিকেটার বলে মনেই হয় না, বড়জোর কোনো বিষয়ের প্রফেসর বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু তার ব্যাটে যে কতটা ধার, তার প্রমাণ পেয়েছে আফগানিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকা। আর সেদিন পেলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
রস টেলরকে সাথে নিয়ে ইনিংস মেরামতের কাজটা শুরু করলেন তিনি, গড়লেন ১৬০ রানের একটা কার্যকরী জুটি। দলের যখন ১৬৭ রান, তখন ফিরে গেলেন টেলর। পরের ব্যাটসম্যান ল্যাথামকে নিয়ে আরও ৪৩ রান যোগ করলেন উইলিয়ামসন।
উইলিয়ামসন আউট হলেন নিজের ১৪৮ আর দলের ২৫১ রানের সময়ে। মোটামুটি নিরাপদ একটা রানে তখন পৌঁছে গেছে তার দল। তিনি যাওয়ার পরে বাকি ব্যাটসম্যানদের প্রচেষ্টায় নিউজিল্যান্ড ইনিংস শেষ করে ২৯১ রানে।
জবাব দিতে নামলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নেমেই পড়লো বোল্টের তোপের মুখে। খুব তাড়াতাড়ি শাই হোপ আর নিকোলাস পুরানকে তুলে নিলেন তিনি, দলের রান তখন মাত্র ২০।
সেখান থেকেই লড়াই শুরু গেইল আর হেটমায়ারের। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে এসেছেন ক্রিস গেইল, এই বিশ্বকাপ খেলেই অবসরে যাবেন ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে জিতেছেন দুটো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, জিতেছেন একটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও। কিন্তু বিশ্বকাপ নামের অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। শেষবেলাটা রাঙিয়ে দিয়ে যাবেন, এমন একটা ইচ্ছে না থাকার কোনো কারণ নেই।
হেটমায়ারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তাই খেলতে লাগলেন, দেখতে দেখতে রানসমুদ্র পারও হয়ে আসলেন প্রায় অর্ধেক। আর তখনই বোল্ড হয়ে ফিরে গেলেন তার সতীর্থ হেটমায়ার।
হেটমায়ার আউট হওয়ার সাথে সাথেই মড়ক লাগলো যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসে। ১৪২/৩ থেকে হুট করেই স্কোর হয়ে গেল ১৬৪/৭! চারজনের মধ্যে আছেন গেইলও। ব্যক্তিগত ৮৭ রানে গ্র্যান্ডহোমের বলে লং অনে বোল্টের হাতে ধরা পড়েন তিনি।
অষ্টম উইকেট হিসেবে কেমার রোচ গেলেন ২১১ রানে, নবম উইকেট হিসেবে কটরেল গেলেন ২৪৫-এ। জিততে হলে তখনও লাগে ৪৭ রান।
কটরেল আউট হওয়ার পরে যতটা সম্ভব নিজে স্ট্রাইক রেখে খেলতে লাগলেন ব্র্যাথওয়েট। তিনি তখনও আছেন বলেই ম্যাচটা শেষ বলে দেয়া যাচ্ছিলো না। আর ফিরে ফিরে আসছিল সেই টি-টোয়েন্টি ফাইনালের স্মৃতি। যদিও দুটো ম্যাচের তুলনা হয় না। আগেরটা ছিল টি-টোয়েন্টি, আর সেদিনেরটা ছিল ওয়ানডে। একটি ছিল ফাইনাল ম্যাচ, আর আরেকটি শুধুই গ্রুপ পর্বের এক ম্যাচ। সবচেয়ে বড় কথা, সেই ফাইনাল ম্যাচে হাতে উইকেট ছিল চারটি। ব্র্যাথওয়েট আউট হলেও কেউ না কেউ নেমে পড়তেন মাঠে, এমনকি স্যামুয়েলসও স্ট্রাইকে আসা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু এই ম্যাচে আর একটি উইকেটই বাকি ছিল।
ইনিংসের ৪৮তম ওভারের কথা। লয়েড, গ্রিনিজদের উত্তরসূরীদের সামনে তখন কঠিন সমীকরণ। ১৮ বলে লাগবে ৩৩। এই টি-টোয়েন্টির যুগে তা এমন কিছু বড় নয় যদিও। কিন্তু মূল সমস্যার নাম উইকেট। কার্লোস ব্র্যাথওয়েট অথবা ওশেন থমাসের একজনকে আউট করলেই খেল খতম।
সেই ওভার করতে এলেন ম্যাট হেনরি। তাকে টানা তিনটে ছক্কা মারলেন ব্র্যাথওয়েট, সেই সাথে মারলেন একটি বাউন্ডারি। সব মিলিয়ে সেই ওভারে এলো ২৫ রান, ফলে সমীকরণটা একেবারেই সোজা হয়ে গেল। ১২ বলে তখন দরকার মাত্র ৮ রান।
৪৯তম ওভার করার জন্য জিমি নিশামের হাতে বল তুলে দিলেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। বল পেয়েই ক্রমাগত শর্ট বল দিতে লাগলেন নিশাম। বিগ হিট তো বটেই, দৌড়েও রান নিতে পারছিলেন না ব্র্যাথওয়েট। এর মধ্যেও ব্যাটে বলে হলো, দৌড়ে ২ রান নিয়ে নিলেন। সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়ে গেল তার। তারচেয়েও বড় কথা, জিততে হলে আর মাত্র ৬ রান নিতে হতো। অর্থাৎ কোনোভাবে একটি ছক্কা মারতে পারলেই জিতে যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
কিন্তু হলো না!
সেঞ্চুরি করায় হয়তো মনোযোগ নড়ে গিয়েছিল ব্র্যাথওয়েটের। আবার এ-ও হতে পারে, জয়ের বন্দর দৃষ্টিসীমায় দেখতে পেয়ে আর সামলে রাখতে পারেননি নিজেকে।
ওভারের শেষ বল করলেন নিশাম। আবার সেই শর্ট বল। এবার গায়ের জোরে মারলেন বটে ব্র্যাথওয়েট, কিন্তু টাইমিঙে একটু গড়বড় হয়ে গেল। বল চলে গেল ঊর্ধ্বাকাশে। টাইমিং ঠিকমতো হলে ছক্কা হওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার, কিন্তু …
… কিন্তু বাউন্ডারি রোপের সামনে অপেক্ষা করছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট। আকাশ থেকে বলটি সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়লো তার হাতে, রোপ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে বলটি দারুণভাবে তালুবন্দী করে ফেললেন তিনি!
হলো না! হলো না! হলো না!
পারলেন না কার্লোস ব্র্যাথওয়েট! পারলো না ওয়েস্ট ইন্ডিজ! জয়ের সূর্য ক্যারিবিয়ান দিগন্তকে উদ্ভাসিত করতে করতেও ডুবে গেল তাসমান সাগরে। যেখানে বেজে ওঠার কথা ক্যালিপসোর মূর্ছনা, সেখানে নেমে এলো এক গাঢ় বিষাদ।
ক্রিকেট আনন্দময়। ক্রিকেট উজাড় করে সবকিছু দেয়।
ক্রিকেট নিষ্ঠুর। ক্রিকেট সবকিছু কেড়েও নেয়।
গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা বারবার খেলোয়াড়দের হাসায়, কাঁদায়। আর ব্র্যাথওয়েট যেন হয়ে যান মহাভারতের কর্ণ, অথবা গ্রিক উপকথার হেক্টর। ট্র্যাজিক হিরো হওয়াটাই যার নিয়তি!