তার পিএফএ’র মৌসুম-সেরা ফুটবলার হবার খবরটা অবাক করেছে অনেককেই, অন্তত কেভিন ডি ব্রুইনাকে তো অবশ্যই।
নিজেই নিজের জন্য বেঁধে দিয়েছেন আকাশছোঁয়া মানদণ্ড। ম্যাচে প্রতিপক্ষের ডি-বক্স লক্ষ্য করে একের পর এক মারণ-ক্রস আর স্লাইড-রুল পাস ছুঁড়তে না পারলে তিনি আর কীসের ডি ব্রুইনা! শেষ মৌসুমে পৌঁছুতে পারেননি ওই মানদণ্ডের ধারেকাছেও। তাই পরপর দুই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের সেরা ফুটবলারের পুরষ্কার জেতার আশা ডি ব্রুইনা করবেন কেন?
তবে তিনি আশা না করলে কী হবে! ২০২০-২১ মৌসুম জুড়ে জমা হওয়া তথ্য-উপাত্ত আর বিশ্লেষণ বলছে, এই মৌসুমটাও ডি ব্রুইনার দুর্দান্তই কেটেছে। সিটির শিরোপাজয়ের পথে তেমন একটা গোল করে অবদান রাখতে পারেননি বলেই সাদা চোখে তার পারফরম্যান্সটা একটু মলিন হয়েই ধরা পড়ছে।
আর এবার তো সিটির শিরোপাজয়টা পুরোপুরি তার একার ‘ওয়ান ম্যান শো’-ও ছিল না। বরং ফিল ফোডেন, জোয়াও ক্যান্সেলো, রিয়াদ মাহরেজ – মৌসুমের মাঝামাঝি সিটির যে পুনর্জাগরণ ঘটল, তাতে এদেরও বেশ ভালোই অবদান ছিল। তবে এর আগ পর্যন্ত সিটি ছিল ডি ব্রুইনা-সর্বস্বই। আমরা যদি সিটির মৌসুমকে বড়দিন-পূর্ব আর বড়দিন-উত্তর সময়ে ভাগ করে নিই, তাহলে ডি ব্রুইনাকেই দেখতে পাই সিটির প্রথমার্ধের রক্ষাকর্তা হিসেবে। গোলমুখ খোলার ৩২.৭ শতাংশ দায়ভারই তখন নিতে হচ্ছিল তাকে, সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা রিয়াদ মাহরেজের চেয়ে যা ৮.২ শতাংশ বেশি। প্রতি নব্বই মিনিটে তার থেকে গোল তৈরি হওয়ার কথা ছিল ০.৩৯টি, রিয়াদ মাহরেজ এখানেও তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ওই সময়টায়। বড়দিনের আগে খেলা ১২ ম্যাচে ম্যাচপ্রতি মাহরেজের এক্সপেক্টেড অ্যাসিস্ট সংখ্যা ০.২৮টি।
তবে বড়দিনের পর থেকে ম্যানসিটিকে একা টানার দায়ভার নেমে গিয়েছে তার কাঁধ থেকে। ফিল ফোডেন-ফেরান তোরেসদের মতো তরুণরাও এগিয়ে এসেছেন সুযোগ সৃষ্টিতে। পরের অর্ধে এক্সপেক্টেড অ্যাসিস্ট মানদণ্ডে সবার ওপরে পাওয়া যায় ফোডেনের নাম। ম্যাচপ্রতি ০.৩২টি গোল হওয়ার কথা ছিল তার অ্যাসিস্টে। ডি ব্রুইনা নেমে গেছেন দুইয়ে, তার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ০.২৯।
তবে তিনি নিজেকে এতটাই সুমহান উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে, দুইয়ে নামাটাও কেভিন ডি ব্রুইনার জন্যে ব্যতিক্রমীই বলতে হবে। আমরা যদি আলোটা বাড়িয়ে বিগত পাঁচ মৌসুমের ওপর ফেলি, তবে তো প্রতি মৌসুমেই ম্যান সিটির সর্বোচ্চ সংখ্যক সুযোগ তার পায়েই তৈরি হতে দেখেছি।
এখন আর ডি ব্রুইনাকে দলের দায়ভার একাই বহন করতে হচ্ছে না। ইলকায় গুন্দোয়ান, রুবেন ডিয়াজ কিংবা রিয়াদ মাহরেজের মতো ফুটবলাররাও এগিয়ে আসছেন প্রয়োজনের সময়ে; যে কারণে পেপ গার্দিওলাও ডি ব্রুইনাকে দিতে পেরেছেন নতুন একটা ভূমিকা। এই নব্য ভূমিকাতে গোল বরাবর লম্বা দৌড়ের কিংবা ডিফেন্সচেরা পাসের ডি ব্রুইনার দেখা মেলে না ততটা।
২০১৯-২০ মৌসুমে ডি ব্রুইনা ২০টি গোলে সহায়তা করে ভাগ বসিয়েছিলেন থিয়েরি অঁরির প্রিমিয়ার লিগ সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের রেকর্ডে। যদিও ডি ব্রুইনা দাবি করেন, তিনি ২১টি অ্যাসিস্ট করে অরিঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই। সে যাই হোক, আমরা দেখেছিলাম, তার সে মৌসুমের অ্যাসিস্টগুলোর বেশির ভাগই এসেছিল পেনাল্টি বক্সের ডানপ্রান্ত থেকে। তিনি নিজেও ডানপ্রান্তে সরে গিয়ে পেনাল্টি বক্সে ক্রস ফেলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এবং সে ক্রসগুলোতে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা কিছু না করতে পারলেও সতীর্থরা ফায়দা লুটে নিতে পারতেন পুরোপুরি।
কিন্তু গত সিজনে আমরা কি তেমন কিছু দেখতে পেয়েছিলাম? এখন তো তাকে ডানপাশের চেয়ে মাঠের বামপাশেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বেশি।
দুই মৌসুমের তুলনাটা আরও ভালো করে বুঝতে নিচের ছবিটা দেখলেও চলছে। যেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, লেফট উইংয়ে তার ম্যাচপ্রতি বল ছোঁয়ার সংখ্যা বেড়েছে এবং ডানপ্রান্তে কমেছে।
তবে এরপরও সৃজনশীলতার প্রশ্নে তিনি আপোষ করেননি একরত্তিও। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে ব্রুনো ফার্নান্দেজের সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২টি গোলে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন তিনি, যেখানে ১৪টি অ্যাসিস্ট করে সবার ওপরে আছেন হ্যারি কেন। তবে আমরা যদি দ্য অ্যাথলেটিকের ‘এক্সপেক্টেড অ্যাসিস্ট মেট্রিক’-কে বিবেচনায় নিই, তবে গোটা মৌসুমজুড়ে কমপক্ষে ৯০০ মিনিট খেলেছেন এমন ফুটবলারদের মধ্যে ডি ব্রুইনাই উঠে যাচ্ছেন সবার ওপরে। প্রতি ৯০ মিনিটে তার বাড়ানো বলে গোল হওয়ার কথা ছিল ০.৩৭টি, যেখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্রুনো ফার্নান্দেজ পিছিয়ে আছেন ০.০৪ ব্যবধানে। প্রকৃত অ্যাসিস্টকারীর তালিকায় সবার ওপরে থাকা হ্যারি কেনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেরা দশেও। মানেটা হচ্ছে, তার বাড়ানো বলগুলোতে যে গোলগুলো হয়েছে, তাতে গোলদাতার কৃতিত্বই বেশি।
ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে খেলা ফুটবলারদের মধ্যেও ডি ব্রুইনা নজর কাড়ছেন আলাদাভাবে। আক্রমণের যতগুলো পরিমাপক এখন পর্যন্ত উদ্ভাবন হয়েছে, সবগুলোতেই ডি ব্রুইনাকে পাওয়া যাচ্ছে সেরাদের কাতারে। দ্য অ্যাথলেটিক তো এমনও বলছে, কী-পাসের ক্ষেত্রে ৯৯ শতাংশ, প্রোগ্রেসিভ পাস আর সামনে এগোনোর ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ আর আক্রমণের শেষভাগে বল নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৯৯ শতাংশ মিডফিল্ডারই পড়ে যাচ্ছেন ডি ব্রুইনার নিচে। সিটি আর আগের মতো খেলোয়াড়দের জায়গা খুঁজে বের করতে বলে না; ডি-বক্সে স্ট্রাইকাররা বসে থাকবেন আর ডি ব্রুইনা একের পর এক পাস ছেড়ে যাবেন – এমন দিনও গত হয়েছে; এই তথ্যগুলো মাথায় রাখলে ডি ব্রুইনার মাহাত্ম্য বেড়ে যাচ্ছে আরও।
শেষ মৌসুমে তাই তার নিজের মানদণ্ডে কিছুটা অফ-সিজন কাটালেও ডি ব্রুইনা এখনো আগের ডি ব্রুইনাই আছেন। একবার নিচের পিৎজা চার্টে চোখ বুলিয়ে নিন, অনেকটা ফিফা রেটিংয়ের মতো মনে হলেও ডি ব্রুইনার ২০২০-২১ মৌসুমের পারফরম্যান্স তাকে দাঁড় করিয়েছে এখানেই। সব মিলিয়ে বলা যায়, ডি ব্রুইনার সঙ্গে গুন্দোয়ানের ভূমিকা অদলবদল হয়ে গেছে। যিনি কি না পেপ গার্দিওলার দলের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে সব সময়ই ছিলেন, তবে নিয়মিত বিরতিতে গোল করতে শুরু করার পরই কেবলমাত্র নজরে এসেছেন।
এমনই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পিঠে চড়ে কেভিন ডি ব্রুইনা এসেছেন এবারের ইউরোতে৷ অবশ্য ক্লাব-মৌসুমের শেষটা জয়ের রঙে রাঙাতে পারেননি, পোর্তোতে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে তার দল হেরে গেছে চেলসির বিপক্ষে। ব্যক্তিগতভাবে ডি ব্রুইনার শেষটা তো আরও যন্ত্রণার। জার্মান ডিফেন্ডার আন্তোনিও রুডিগারের সঙ্গে সংঘর্ষে নাক-মুখের হাড়ে চিড় ধরাতে ম্যাচের অর্ধেক পেরোতে না পেরোতেই উঠে আসতে হয় তাকে। রাশিয়ার বিপক্ষে ইউরোর প্রথম ম্যাচটাও মিস করতে হয়েছিল এ জন্যে।
তবে ডেনমার্কের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামতেই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজটা করেছিলেন তিনি। যে নজরকাড়া ডি ব্রুইনাকে দেখতে চান সবাই, পুরনো ‘নাম্বার এইট’-দের মতো বক্স-টু-বক্স দাপিয়ে বেড়াবেন, হতবুদ্ধি করে দেয়া একের পর এক সব থ্রু-বল বাড়াবেন – সেই ডি ব্রুইনাকেও যে দেখতে পাওয়া যাবে রবার্তো মার্তিনেজের অধীনে, তেমন আভাসই মিলেছে।
বেলজিয়ামের ডি ব্রুইনার সঙ্গে সিটির ডি ব্রুইনার পার্থক্যটা কোথায় হবে, দ্য অ্যাথলেটিকের কাছে কিছুদিন আগেই তা ব্যাখ্যা করেছিলেন ক্রিস্টিয়ান কাবাসেলে। বেলজিয়ামের হয়ে এই ওয়াটফোর্ড ডিফেন্ডার ডি ব্রুইনার সঙ্গেই খেলেছেন, এখন আবার কোচিং লাইসেন্সের কোর্সও করছেন একত্রে – ডি ব্রুইনাকে বিশ্লেষণে কাবাসেলের যোগ্যতা নিয়েও তাই প্রশ্ন নেই কোনো। কাবাসেলে ডি ব্রুইনাকে দিচ্ছেন এই মুহূতের সেরা ‘ভিশনারি’ খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি।
‘তার মতো দেখার দৃষ্টি এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলে আর কারও নেই। পরিস্থিতিটা সবার আগে বুঝতে পারে ও। যখনই খেলা, একটা দলকে জাগিয়ে তুলতে পারে খুব ভালোভাবে, অনেক সময় ম্যানেজাররাও যা পারেন না। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, ওর মতো একটা প্লেয়ারকে পজিশনের চেয়ে আদর্শ কন্ডিশনটা দেওয়া বেশি জরুরি, যেখানে ও নিজের গুণাগুণ মেলে ধরার সুযোগ পায়।’
কাবাসেলের মতে, এই কাজটা বেলজিয়ামে পরিপূর্ণভাবেই করা হচ্ছে। কাবাসেলে বলছেন, বেলজিয়ামকে রবার্তো মার্তিনেজ খেলান ৩-৪-৩ ফর্মেশনে, যেখানে ডি ব্রুইনা থাকেন দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের একজন হয়ে। তবে অ্যালেক্স উইটসেল রক্ষণভাগের সামনে থেকে নাম্বার সিক্সের ভূমিকা পালন করায় ডি ব্রুইনা খেলার গতিপথ নির্ধারণ করে দেওয়ার স্বাধীনতা পান। ম্যানচেস্টার সিটিতে তিনি যে কাজটা করে আসছেন সার্থকতার সঙ্গে।
তবে দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা হচ্ছে, গার্দিওলার সিটি এখন ফলস নাইনের সিস্টেমে খেলতে শুরু করায় ডি ব্রুইনাকে আমরা উইংয়েই বেশি ঘোরাঘুরি করতে দেখি। বিপরীতে বেলজিয়ামের ডি ব্রুইনা মাঠের মধ্যভাগ থেকে খেলা গড়ার চেষ্টা করেন, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের পেছন থেকে দৌড় শুরু করা স্ট্রাইকারদের জন্যে থ্রু-বল বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এদেন আজার, দ্রিস মার্টেনস, আর রোমেলু লুকাকুর মতো দ্রুতগতির ফুটবলার থাকার কারণে ডি ব্রুইনার জন্যে কাজটা করা বেশ সহজও হয়।
আর ডি ব্রুইনা এখনো মাঝেমধ্যে পার্শ্বরেখার দিকে সরে যান, তবে ডি-বক্সে ক্রস ফেলার দায়িত্বটা মূলত থাকে উইঙ্গার কিংবা হাফ-স্পেসে অবস্থান নেওয়া ফুলব্যাকদের কাছেই। ডি ব্রুইনা মাঠের মাঝামাঝি জায়গাটায় বেশি অবস্থান নিয়ে সহজেই ডিফেন্সচেরা পাস বের করতে পারেন। আর ডি ব্রুইনা যখন উইংয়ে সরে বক্সে ক্রস তোলেন, তখন না গ্রহণ করার জন্যে কেবল রোমেলু লুকাকুই নন, বরং বিপরীত প্রান্তের ফুলব্যাকরাও প্রতিপক্ষ ডি-বক্সের আশেপাশে উঠে আসেন।
কাবাসেলেও মনে করছেন,
‘যখন ও ফলস নাইন হিসেবে না, বরং পেছন থেকে খেলাটা গড়ে দেওয়ার কাজ করে, ও আরও বেশি অবদান রাখতে পারে। ফলস নাইনের চেয়ে স্ট্রাইকারের উদ্দেশ্যে ফাইনাল পাস বাড়ানো ডি ব্রুইনাকেই আমার বেশি কার্যকর মনে হয়। যদিও সে দুটোই করতে পারে, তবে কেন যেন মনে হয়, বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের দায়িত্ব পালন করা ডি ব্রুইনাই ভালো।’
মার্তিনেজ তাকে সে দায়িত্বটাই দিচ্ছেন। এবারের ইউরোতে তাই ওই দৃষ্টিসুখকর ডি ব্রুইনারই দেখা মিলবে।
ডি ব্রুইনা নিজে অবশ্য দেখতে সুন্দরের সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরও হতে চাইবেন। পেছনে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে হারের ক্ষত, বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের হয়ে কিছু একটা জেতার শেষ সুযোগও এটাই–তথ্যগুলো ডি ব্রুইনাকে তো তাতিয়ে রেখেছে নিশ্চিত করেই।