গোলশূন্য ড্রয়ে শেষ ম্যানসিটি-লিভারপুলের নাটকীয় দ্বৈরথ

অষ্টম রাউন্ডে শীর্ষস্থান দখলের লড়াইয়ে লিভারপুল বনাম ম্যানচেস্টার সিটির ম্যাচটি মহাগুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ম্যাচ জিতে এককভাবে শীর্ষে ওঠার সুযোগ দু’দলের সামনেই ছিল। তবে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ শেষ হয়েছে অমীমাংসিতভাবেই। চূড়ান্ত নাটকীয় এক ম্যাচে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ৩-২ গোলে জিতেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। এই জয়ের ফলে হোসে মরিনহোর চাকরিটা কিছুদিনের জন্য হলেও টিকে রইলো। এদিকে নতুন কোচদের অধীনে নিজেদের ভালো শুরুটা ধরে রেখেছে লন্ডনের দুই ক্লাব চেলসি ও আর্সেনাল। 

অষ্টম রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে শুক্রবার ঘরের মাঠে ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের মুখোমুখি হয় ব্রাইটন। ২৫ মিনিটে গ্লেন মারের করা একমাত্র গোলে এবারের লিগে নিজেদের দ্বিতীয় জয় তুলে নেয় ব্রাইটন।

শনিবার মোট ছয়টি ম্যাচ ছিল। ঘরের মাঠ ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে দুর্বল কার্ডিফ সিটিকে আতিথ্য দেয় টটেনহ্যাম। ম্যাচের ৮ মিনিটে কার্ডিফ ডিফেন্ডারদের ভুলে পেনাল্টি বক্সের জটলায় বল পেয়ে গোলে স্পার্সকে এগিয়ে দেন এরিক ডায়ার। 

গোলের পর উল্লসিত ডায়ার; Image Source : Evening Standard

ম্যাচের ২২ মিনিটেই অবশ্য সমতা ফেরাতে পারতো কার্ডিফ। প্যাটারসনের শট স্পার্স গোলরক্ষক হুগো লরিসকে ফাঁকি দিলেও গোললাইন থেকে তা ফিরিয়ে দেন টবি আল্ডারওয়েরেল্ড। তবে ম্যাচের ৫৮ মিনিটে লুকাস মৌরাকে ফাউল করে জো র‍্যালস লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে কার্ডিফের ম্যাচে ফেরার আশা শেষ হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত ১-০ গোলেই ম্যাচটি জিতে নেয় টটেনহ্যাম। একই সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া অন্য ম্যাচগুলোতে লেস্টারকে ২-১ গোলে এভারটন, ক্রিস্টাল প্যালেসকে ১-০ গোলে উলভারহ্যাম্পটন এবং ওয়াটফোর্ডকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছে বোর্নমাউথ। 

শনিবারের সবচেয়ে বড় নাটকটা মঞ্চস্থ হয়েছে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। মরিনহোর চাকরি এমনিতেই সুতোর উপর ঝুলছিলো। নিউক্যাসলের বিপক্ষে এই রাউন্ডের ম্যাচে হারলেই দ্য স্পেশাল ওয়ান  বরখাস্ত হবেন এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছিলো। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শুরুতেই হোঁচট খায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ৭ মিনিটে কেনেডির গোলে পিছিয়ে পড়ে দলটি। এর ৩ মিনিট পরেই মুতোর গোল রেড ডেভিলদের জন্য গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে আসে। পুরো ওল্ড ট্র্যাফোর্ড তখন হতভম্ব হয়ে গেছে। অনেকে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মরিনহোর বিদায়ী বার্তাও লেখা শুরু করে দিয়েছেন। 

প্রথমার্ধের হালচাল দেখে মরিনহোর বরখাস্ত হওয়াটাকে অবশ্যম্ভাবী মনে হচ্ছিলো। ছন্নছাড়া ফুটবলে প্রথমার্ধে কোনো গোলই শোধ দিতে পারেনি রেড ডেভিলরা। ২২ মিনিটে লুকাকুর অসাধারণ ক্রস রাশফোর্ড যেভাবে নষ্ট করেছিলেন, তাতে দিনটা নিউক্যাসলের বলেই মনে হচ্ছিলো। তবে বিরতির সময়ে শিষ্যদের কানে মরিনহো কী জাদুমন্ত্র দিয়েছিলেন কে জানে, দ্বিতীয়ার্ধে এসে একদম অন্য ধরনের খেলা উপহার দিতে থাকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। বেশ কিছু সুযোগ মিস করলেও ৬৯ মিনিটে ফ্রি-কিক থেকে হুয়ান মাতা গোল করলে ব্যবধান ২-১ হয়।

৭৬ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় অ্যান্থনি মার্শিয়ালের দুর্দান্ত এক গোলে খেলায় সমতা ফেরায় রেড ডেভিলরা। এরপর জয়সূচক গোলের জন্য টানা আক্রমণ চালাতে থাকে ম্যানইউ। নির্ধারিত সময়ের একদম শেষ মিনিটে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত, অ্যাশলি ইয়াংয়ের ক্রসে মাথা ছুঁয়ে রেড ডেভিলদের জয়সূচক গোলটি এনে দেন অ্যালেক্সিস সানচেজ। শেষপর্যন্ত ৩-২ গোলের এই নাটকীয় জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। 

জয়সূচক গোলটি করে মরিনহোর চাকরি বাঁচানোর সাথে নিজেকে নিয়ে সমালোচনাটার জোয়ারটাও বন্ধ করলেন সানচেজ; Image Source : Najiaextra

অনেক দিক থেকেই রেড ডেভিলদের জন্য এই জয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ম্যাচ জেতার ফলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ হিসেবে মরিনহোর স্থায়িত্বকাল আরেকটু দীর্ঘ হলো। গোলখরায় ভুগতে থাকা সানচেজ এই জয়সূচক গোল করে ফর্মে ফেরার আভাসও দিয়ে রাখলেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে দ্বিতীয়ার্ধে ইউনাইটেডের খেলোয়াড়েরা যেভাবে জান-প্রাণ দিয়ে খেলেছেন, তাতে এটা নিশ্চিত যে খেলোয়াড়দের উপর মরিনহোর কর্তৃত্বটা বেশ ভালোভাবেই আছে।

রবিবার ইপিএলে মোট তিনটি ম্যাচ ছিল। দিনের প্রথম ম্যাচে ফুলহ্যামের মাঠে আতিথ্য নেয় আর্সেনাল। খেলার শুরু থেকেই ফুলহ্যামের উপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে গানাররা, তার ফলও খুব দ্রুত চলে আসে। ২৯ মিনিটে অ্যালেক্সান্দ্রে ল্যাকজাত্তের গোলে এগিয়ে যায় আর্সেনাল। বিরতির আগেই ব্যবধান দ্বিগুণ হতে পারতো, কিন্তু গানার ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতায় তা হয়নি। উল্টো প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ১ মিনিট আগে আন্দ্রে শার্লের গোলে সমতা ফেরায় ফুলহ্যাম। 

এই মৌসুমে দারুণ ছন্দে আছেন ল্যাকাজাত্তে; Image Source : Daily Express

লিড ফিরে পাওয়ার জন্য দ্বিতীয়ার্ধে পুরোপুরি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে থাকে আর্সেনাল। ৪৯ মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে ল্যাকাজাত্তের নেওয়া দারুণ এক শটে আবারো এগিয়ে যায় দলটি। ৬৭ মিনিটের গোলটি পুরোপুরি ছিল র‍্যামসিময়, সুযোগ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখার পর দুর্দান্ত এক ব্যাকহিল শটে নিজেই গোলটি করেন। এরপর শুরু হয় অবামেয়াং শো, বদলি হিসেবে নেমে জোড়া গোল করে গানারদের ৫-১ গোলের বড় জয় নিশ্চিত করেন এই স্ট্রাইকার।

এই নিয়ে নতুন কোচ উনাই এমেরির অধীনে টানা ছয় ম্যাচ জিতলো আর্সেনাল। আর সব প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ ধরলে এটা আর্সেনালের টানা অষ্টম জয়। ওয়েঙ্গারের অধীনে গত দুই মৌসুম একদমই ভালো কাটেনি দলটির, টানা জয়ের এই ধারা গানার ভক্তদের নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। এখন দেখার বিষয় এই ভালো ফর্ম দলটি কতদূর টেনে নিতে পারে। 

লন্ডনের আরেক ক্লাব চেলসিরও ছিল অ্যাওয়ে ম্যাচ, প্রতিপক্ষ ছিল সাউদাম্পটন। আগের রাউন্ডে ঘরের মাঠে লিভারপুলের সাথে ড্র করায় এ ম্যাচে জেতাটা চেলসির জন্য ভীষণ জরুরি ছিল। সেই লক্ষ্যে খেলার ৩০ মিনিটে ব্লুজরা এগিয়ে যায়, রস বার্কলির দারুণ এক পাসে গোল করে দলটিকে এগিয়ে দেন ইডেন হ্যাজার্ড। লিগে এটা হ্যাজার্ডের সপ্তম গোল, এখন পর্যন্ত এবারের ইপিএলে সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনটাও হ্যাজার্ডের দখলে।  

সারির অধীনে এ যেন এক অন্য হ্যাজার্ড; Image Source : The Independent

খেলার ৫৭ মিনিটে অলিভার জিরুডের দর্শনীয় এক পাসে গোল করে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন রস বার্কলি। এরপর অবশ্য খেলায় ফিরে আসার জোর চেষ্টা চালিয়েছিলো সাউদাম্পটন, কিন্তু ব্লুজ গোলরক্ষক কেপার দৃঢ়তায় তা আর হয়নি। উল্টো ৯৩ মিনিটে হ্যাজার্ডের পাস থেকে গোল করে চেলসির ৩-০ গোলের বড় জয় নিশ্চিত করেন আলভারো মোরাতা। নতুন কোচ মাউরিজিও সারির অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে হারের মুখ দেখেনি লন্ডনের এই ক্লাবটি। 

অষ্টম রাউন্ডের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ম্যাচে অ্যানফিল্ডে লিভারপুলের মুখোমুখি হয় ম্যানচেস্টার সিটি। এ ম্যাচ জিতে এককভাবে শীর্ষে ওঠার লক্ষ্যে দু’দলই শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে থাকে। ম্যাচের ৩ মিনিটেই এগিয়ে যেতে পারতো অলরেডরা। সালাহর নেওয়া শট সেই যাত্রায় গোলবারের বাইরে দিয়ে চলে যায়। প্রথমার্ধে রাহিম স্টার্লিংয়ের নেওয়া শট গোলবারের উপর দিয়ে চলে গেলে সিটিজেনদেরও আর এগিয়ে যাওয়া হয়নি।

দ্বিতীয়ার্ধের ৬৮ মিনিটে আবারো সুযোগ পেয়েছিলেন সালাহ, কিন্তু এবারো তার শট গোলবারের উপর দিয়ে চলে যায়। ৮৪ মিনিটে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগটা পায় ম্যানসিটি, বদলি খেলোয়াড় লিরয় সানেকে লিভারপুলের ডিফেন্ডার ভার্জিল ভ্যান ডাইক ফাউল করলে পেনাল্টি পায় দলটি। 

পেনাল্টি মিসের পর বিমর্ষ মাহারেজ; Image Source : Metro

কিন্তু হায়! এই মৌসুমে নতুন যোগ দেওয়া রিয়াদ মাহারেজের নেওয়া পেনাল্টি গোলবারের অনেক উপর দিয়ে চলে যায়। চরম নাটকীয় এ ম্যাচ শেষপর্যন্ত গোলশূন্য ড্রয়ের মাধ্যমেই শেষ হয়। গত মৌসুমে এই অ্যানফিল্ডে দুবার হেরেছিলো ম্যানসিটি, সেই প্রতিশোধ নেওয়ার এত ভালো সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় নিশ্চয়ই আফসোসের আগুনে পুড়ছেন পেপ গার্দিওলা। 

অষ্টম রাউন্ড শেষে ম্যানসিটি, চেলসি ও লিভারপুল- তিন বড় দলের পয়েন্টই ২০। তবে গোল ব্যবধানে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি। চেলসি রয়েছে দুইয়ে আর লিভারপুলের অবস্থান পয়েন্ট টেবিলের তিন নাম্বারে। লন্ডনের দুই ক্লাব টটেনহ্যাম ও আর্সেনালের সংগ্রহ সমান ১৮ পয়েন্ট। এক্ষেত্রে গোল ব্যবধানে এগিয়ে দেখে বহুদিন পর নিজেদের চেনা চার নাম্বার জায়গাটা ফিরে পেয়েছে আর্সেনাল। আর ১৩ পয়েন্ট নিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অবস্থান পয়েন্ট টেবিলের আট নাম্বারে। আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জন্য সামনের সপ্তাহে কোনো খেলা নেই, এই বিরতির পর পয়েন্ট টেবিলে আবার কোন নতুন অদল-বদল হয় সেটাই দেখার বিষয়।     

 

Featured Image: Daily Mirror

For references please check the hyperlinks inside the article.

Description: This article is in Bangla language. It's a weekly review of EPL. 

Related Articles

Exit mobile version