বার্সেলোনার মাঝমাঠের প্রাণভোমরা ইভান রাকিটিচ। নেইমারের পর পিএসজির নজরে ছিলেন এই ক্রোয়েশিয়ান তারকা। একটা গুঞ্জনও উঠেছিলো যে, রাকিটিচ বার্সা ছেড়ে পিএসজিতে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু শেষ অবধি থেকে গেছেন তিনি।
কেন বার্সেলোনায় থেকে গেলেন, বার্সেলোনার এখন কী অবস্থা এবং বার্সেলোনার লক্ষ্য কী; এসব নিয়ে স্পোর্ট ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে কথা বলেছেন রাকিটিচ।
পিএসজির প্রস্তাব থাকার পরও শেষ অবধি বার্সেলোনায় থেকে গেলেন। কেন এবং কখন এই সিদ্ধান্তটা নিলেন?
কোনো নির্দিষ্ট একটা সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। বরং এটা অনেক কিছুর প্রতিফলন। এর মধ্যে কয়েকটা দিন গেছে, লোকেরা যখন আমাকে নিয়ে অনেক বেশি কথা বলছিলো। আর সত্যি বলি, কিছু সময় এসেছে আমার যখন এ নিয়ে আর কিছু শুনতে, দেখতে বা পড়তে ভালো লাগছিলো না। আমি নিজে এটা নিয়ে চিন্তা করেছি। আমি আমার স্ত্রী ও এজেন্টের সাথে কথা বলেছি। আমরা সবাই এই পরিস্থিতি নিয়ে একমত হয়েছি।
আপনার কাছে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ- পরিবার, ফুটবল, নাকি অর্থ?
আমি আমার স্ত্রী ও আমার হৃদয়ের কথা শুনেছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে, বার্সেলোনার জার্সি পরাটা আমার জন্য একটা বড় প্রাপ্তি। এই ব্যাজকে ধারণ করাটা একটা বড় সম্মান। পৃথিবীতে আর কোনো ক্লাব আমাকে এর চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারে না; অর্থের কথা আলাদা। আমার বড় সন্তান দুই বছর ধরে স্কুলে যায় এবং তারও কিছু বন্ধু তৈরি হয়েছে। ছোটজন প্রি-স্কুল শুরু করতে যাচ্ছে। আমরা এখানে সুখে আছি। আর সেদিক থেকে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ ছিলো। আমি বার্সেলোনায় চালিয়ে যেতে পেরে গর্বিত।
যদি ক্লাব (বার্সেলোনা) পিএসজির প্রস্তাব মেনে নিতো, সেটা কি আপনি মেনে নিতে পারতেন?
তেমন কিছু হলে আগেই আমরা কথা বলতাম। আমাদের দেখতে হতো যে, সবার জন্য সেরা কোনটা। ক্লাব যদি ওভাবে আমাকে প্রস্তাব দিতো, তখন হয়তো আমার প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমরা একসাথে কাজ করতে পারি এবং ঠিক করতে পারি যে, কোনটা আমার জন্য ভালো এবং কোনটা ক্লাবের জন্য খারাপ। তবে এখন বড় ব্যাপার হলো, আমরা দুই পক্ষই চেয়েছি, একসাথে কাজ চালিয়ে যাবো। আমি অনুভব করেছি এই ক্লাব ও সমর্থকরা আমাকে চায়। এজন্যই আমি এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
মৌসুম মাত্র শুরু হলো। কিন্তু মনে হচ্ছে যে, বার্সেলোনার এবার মূল লক্ষ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ; বিশেষ করে ইউরোপের বড় মঞ্চে আবার ভালো করা।
হ্যাঁ। কিন্তু আমরা যদি কোয়ার্টার বা সেমিফাইনালে বাদ পড়ে যাই, তাহলে কোনো চেষ্টারই অর্থ থাকবে না। মূল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এটা জিততে হবে। প্রতি বছরই বার্সেলোনায় মূল উদ্দেশ্য থাকে, আমরা সবগুলো প্রতিযোগিতা জিততে চাই। গত বছর আমরা চ্যাম্পিয়নস লিগে সেরা দল ছিলাম না। এই কারণে আমরা এবার এটা জেতার জন্য এত আগ্রহী হয়ে আছি। কিন্তু আমরা জানি, আমরা যদি লা লিগাও না জিতি তাহলে সেটা (কাঙ্খিত সাফল্য) আসবে না। আমাদের এবার অসাধারণ একটা স্কোয়াড আছে। কিন্তু মৌসুম মাত্র শুরু হলো। আমরা চেষ্টা করবো আমাদের সর্বোচ্চটা করার জন্য, নিজেদের উপভোগ করার জন্য এবং মৌসুম এগোনোর সাথে সাথে উন্নতি করার জন্য।
দলে আপনার ভূমিকা কি আগের মতোই থাকবে? নাকি আমরা এবার সাধারণভাবে আপনাকে আরেকটু রক্ষণাত্মক ভূমিকায় দেখতে পাবো?
এটা কোচের ওপর নির্ভর করে। উনি দলকে একেবারে নিখুঁতভাবে ভালো করে চেনেন। উনি জানেন, কে কোথায় খেলতে বেশি পছন্দ করে এবং কোনটা দলের জন্য বেশি ভালো হবে। বড় ব্যাপার হলো, আমাদের যে কাজই দেওয়া হোক, সেটা আমাদের ভালোভাবে করতে হবে। আমরা প্রতিটা ম্যাচ জিততে চাই। তার মানে হলো, প্রতি ম্যাচে প্রত্যেককে যার যার সেরাটা দিতে হবে। আমার ব্যাপার বলি, যদি আক্রমণাত্মক বা রক্ষণাত্মক ভূমিকায় খেলি, খুব একটা সমস্যা হবে না। আমরা ৪-৪-২ বা ৪-৩-৩ ফরম্যাটে খেললে খুব একটা পার্থক্য হয় না। এগুলোতে খুব একটা পরিবর্তন আসে না। কারণ, আপনি যখন লিওনেল মেসির সাথে খেলবেন, এর প্রতিটা অংশই আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। সে পুরো আক্রমণভাগে স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলবে। সে মূল স্ট্রাইকারের পেছনে থাকতে পারে, বা উইংয়ে থাকতে পারে। এমনকি সে অনেক নিচে নেমে আসতে পারে এবং ডিফেন্ডারদের কাছ থেকে বল নিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের নিজস্ব ভারসাম্য ও শারীরিক ক্ষমতা ঠিক রাখতে হবে। কারণ আমরা সবাই যেন ঠিকমতো পারফর্ম করতে পারি।
আপনার বার্সেলোনায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে এরনেস্তো ভালভার্দের ভূমিকাটা কী?
সবার ওপরে। কারণ উনি আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। উনি জানেন যে, আমি এমন একজন, যাকে গণনা করা যায়। যদি দরকার হয় মাঠে আমার একটা হাড় ভেঙে রেখে আসার, আমি সেটা করবো। আর তাতে যদি আমার দল ও আমার কোচিং স্টাফের কোনো উপকার হয়, এ নিয়ে আমি কখনো অভিযোগ করবো না। এই বিশ্বাসটা সবার প্রতি থাকাটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। অবশ্য কোচ আমাদের সহায়তা করেন। একজন খেলোয়াড়ের জন্য কোচের সমর্থনটা খুব জরুরি।
এখন মনে হয় আপনাকে বার্সেলোনার একটা পুনর্বিবেচিত চুক্তি উপহার দেওয়া উচিত। ক্লাব কি সেটা করতে যাচ্ছে?
দেখুন, আপনি যদি প্রেসিডেন্টের একটা সাক্ষাতকার নিতে পারেন, তাহলে এটা ভালো জানা যাবে। নইলে এটা তার অফিসের ওপর ছেড়ে দিন। বড় ব্যাপার হলো, উনি জানেন, আমি এখানে আমার বাড়িতেই আছি। সত্যি বলি, এটা সত্যি যে, বেতন বাড়াটা কখনোই খারাপ ব্যাপার নয়। কিন্তু বেতন বাড়ানোর জন্য আমি এখানে থাকিনি। আমি চাই সেই সময়টা এমনিতেই আসুক। কারণ, আমি সেটার যোগ্য। আর কারণ, আমি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখি।
মৌসুমের শুরুতে নতুন চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়রা কেউ লা লিগায় শুরুর একাদশে ছিলো না। নতুন এসব খেলোয়াড়দের নিয়ে আপনার চিন্তাটা কী?
বার্সেলোনার হয়ে খেলাটা সোজা ব্যাপার নয়। বাইরে থেকে সবকিছু সুন্দর মনে হয়; ভিডিও গেমের মতো। কিন্তু একবার যখন আপনি ভেতরে চলে আসবেন, আপনাকে অনেক কিছু বুঝতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে, আপনি এর আগে যেসব দলে খেলে এসেছেন, এই দলটা সেরকম নয়। আপনাকে এসব নতুন খেলোয়াড়কে তাদের প্রয়োজনীয় সময়টা দিতে হবে। তবে এরা সবাই আমাদের খুব উপকার করতে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। আর্থার, ল্যাংলেট, ম্যালকম, আর্তুরো- এরা সবাই যতটা সম্ভব পরিশ্রম করছে। আর পুরো দল ওদের খুব ভালো স্বাগত জানিয়েছে।
অ্যাকাডেমি নিয়ে আলোচনাটা চলছেই। আপনার কী মনে হয় এ নিয়ে?
আমি সবসময়ই চাই এরকম কিছু প্রজন্ম উঠে আসুক এক-দুই বছরে, এটা পছন্দ করি- পুওল, জাভি, ইনিয়েস্তা, ভালদেস, মেসির মতো খেলোয়াড়রা উঠে আসবে। কিন্তু এরকম হওয়াটা সোজা ব্যাপার না। বার্সেলোনা এমন একটা উচ্চতায় পৌঁছে গেছে যে, কাউকে এখানে এনে পরীক্ষা করা এবং কী হয়, দেখার জন্য অপেক্ষা করার সময়টা আসলে নেই। তাদের আসলে অবশ্যই বিশেষ প্রতিভার অধিকারী হবে হবে। এই প্রথম দলটা যদি কম যোগ্যতার হতো, তখন এটা সহজ ছিলো। কিন্তু এখন যে ছেলেরা আসছে, এদের দেখে অসাধারণ মনে হচ্ছে। তাদের ধৈর্য ধরতে হবে এবং সময় দিতে হবে। কোচ ওদের সুযোগ দিতে আগ্রহী আছেন। এটা ভালো ব্যাপার।