বার্লিন, ১৯৩৬। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিরা জার্মানির সর্বেসর্বা অবস্থা। সেই বছর অলিম্পিকের আয়োজক তারাই, আর গোটা বিশ্বের কাছে নিজেদের প্রোপাগান্ডা প্রচারের জন্য মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নেয় অলিম্পিককে। আর্যরা শ্রেষ্ঠ জাতি প্রমাণের জন্য উঠে-পড়ে লেগে যায় জার্মানরা। শুরু থেকেই প্রচন্ড বর্ণবিদ্বেষী জার্মানরা বিভিন্ন দেশের কালো খেলোয়াড়দের কোনো পাত্তাই দিত না। তারা ভেবেছিল অলিম্পিকেই তারা প্রমাণ করে দেবে আর্যরাই শ্রেষ্ঠ, অন্যরা তাদের সামনে একদমই দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু নাৎসিদের দম্ভ ভেঙ্গে দিয়ে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে চারটি সোনা জিতে নেন এক আমেরিকান ‘কালো’ খেলোয়াড়। তাঁকে নিয়েই আজকের লেখা।
১৯১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অ্যালবামায় হেনরি ক্লিভল্যান্ড ওয়েনস এবং ম্যারি এমা ফিৎজগেরাল্ড এর ঘরে জন্ম জেমস ক্লিভল্যান্ড ওয়েনস এর। দশ ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট জেমসকে সবাই ‘জে.সি.’ (J.C.) নামে ডাকত। নয় বছর বয়সে যখন জে.সির পরিবার ওহাইওতে চলে যায়, তখন স্কুলে নিজের নাম ‘জে.সি.’ বলায় তার শিক্ষক মনে করে তার নাম জেসি (Jesse), সেই থেকে তার নাম জেসি হয়ে যাই। এই নামেই খ্যাতি পান পরবর্তীতে।
হাই স্কুলে থাকাকালীন সময়ে তার বাবা আর বড় ভাইয়েরা একটি স্টিল মিলে কাজ করত। কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার জন্য স্কুলের পর জেসিকেও কাজ করতে হতো। স্কুলের পর বিকেলে কাজ করার জন্য বিকেলে প্র্যাকটিসের সময় পেতেন না, তাই তার কোচ চার্লস রিলে সকালে স্কুলের আগে তার প্র্যাকটিসের ব্যাবস্থা করে দেন। জেসি তার কোচের এই উৎসাহের কথা পরবর্তীতে সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে বলেছেন সবসময়।
পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভাল হলে জেসি ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। সেখানে কোচ ল্যারি স্ন্যাইডারের অধীনে তার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। স্ন্যাইডার ১৯২৪ সালে প্যারিস অলিম্পিকে সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু প্লেন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তার অলিম্পিকে খেলার আর হয়ে ওঠেনি। খেলাধুলার বাইরেও তিনি তার অবদান রেখেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি পাইলট প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নৌ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে আমেরিকান অ্যাথলেট টিমের প্রধান কোচ হিসেবে রোমে যান। নিজের অলিম্পিক খেলতে না পারার আক্ষেপ তিনি মিটিয়েছেন কোচিং ক্যারিয়ারে তার অধীনে থাকা অ্যাথলেটদের দিয়ে, ১৪টি বিশ্বরেকর্ড এবং আটটি অলিম্পিক সোনা জয় দিয়ে।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন আমেরিকায় বর্ণবাদ খুবই বাজে অবস্থায় ছিল। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হবার প্রায় ৭০ বছর হলেও সাদা চামড়ার আমেরিকানরা কালো আমেরিকানদের নিচু দৃষ্টিতে দেখত। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেও জেসিতে থাকতে হত অন্যান্য কালো চামড়াদের সাথে, ক্যাম্পাসে থেকে দূরে। অ্যাথলেটিক টিমের সাথে কোথাও গেলে তাকে থাকত হত ‘ব্ল্যাক অনলি’ হোটেলে, খেতে হত ‘ব্ল্যাক অনলি’ রেস্টুরেন্টে। এমনকি জেসি কোনো বৃত্তিও পান নি। ফলে পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য তাকে বাইরে কাজও করতে হত।
এত প্রতিবন্ধকতার পরেও জেসি তার উদ্যম হারান নি। এর পেছনে রয়েছে তার কোচ স্ন্যাইডারের অনুপ্রেরণা। স্ন্যাইডার শুরু থেকেই জেসির বিভিন্ন টেকনিকের উন্নতির জন্য কাজ করেন, উৎসাহ দিয়ে গেছেন তার খেলাধুলায়। আর এর ফল গোটা আমেরিকা দেখে ১৯৩৫ সালের ২৫ মে মিশিগানে বিগ টেন ইভেন্টে। মাত্র ৪৫ মিনিটের ব্যবধানে সেদিন জেসি তিনটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভেঙ্গে দেন, আরেকটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের সাথে টাই করেন!
১০০ গজ দৌড়ে বিশ্বরেকর্ড গড়া না হলেও ৯.৪ সেকেন্ড দৌড়ে টাই করেন। অন্য তিনটি বিশ্বরেকর্ডের মধ্যে লং জাম্পের ৮.১৩ মিটারের রেকর্ডটি ২৫ বছর তার নামেই ছিল। অন্য দুটি রেকর্ড ছিল ২২০ গজ স্প্রিন্টে ২০.৩ সেকেন্ড এবং ২২০ গজ লো হার্ডলে ২২.৬ সেকেন্ডের রেকর্ড।
এই একদিনই জেসির ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে বছর ৪২টি ইভেন্টে লড়াই করে প্রতিটিতেই জয়লাভ করেন জেসি! ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরের বছর অলিম্পিক দলে সুযোগ পাওয়াটা কোনো ব্যাপার ছিল না জেসির জন্য। কিন্তু বাস্তবে পুরো ব্যাপারটি এতোটা সহজও ছিল না। শুরুতেই বলেছিল নাৎসিদের আর্য তত্ত্বের কথা। আমেরিকা কালো অ্যাথলেটদের দলে রাখায় আমেরিকাকে কটাক্ষ করে জার্মানরা। জার্মানিতে ইহুদি আর অনার্যদের উপর নানা রকম বিধিনিষেধ আর অত্যাচারের কথাও ততদিনে পৃথিবী জেনে গেছে।
এসব কারণে অনেক কালো অ্যাথলেট বার্লিন অলিম্পিক বয়কটের ঘোষণা দেয়। এরপরও যারা যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিল, তাদের নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। গোটা দেশজুড়েই অলিম্পিক বয়কটের একপ্রকার আন্দোলনই শুরু হয় বলা যায়। শেষ পর্যন্ত আমেরিকান অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে শান্তিপূর্ণভাবেই সবাই অলিম্পিকে যোগদান করে। দলের সবার সাথে বার্লিন পৌঁছেন জেসি এবং অন্যান্য কালো খেলোয়াড়রা। খেলা শুরুর কিছুদিন আগে অ্যাডিডাসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডি ডাসলার অলিম্পিক ভিলেজে জেসির সাথে দেখা করতে আসেন। সেদিন প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান অ্যাথলেট হিসেবে স্পন্সর পান জেসি।
জেসির অলিম্পিক শুরু হয় ২ আগস্ট, ১০০ মিটার স্প্রিন্ট দিয়ে। সেদিন ১০০ মিটার স্প্রিন্টের ফাইনালের ট্রায়ালের পরদিন ছিল ১০০ মিটারের ফাইনাল। গ্যালারিতে অন্যান্য নাৎসি নেতাদের সাথে হিটলারও উপস্থিত ছিলেন। সেদিন জেসির প্রতিপক্ষ শুধু তার মাঠের প্রতিযোগীরাই ছিল না, গ্যালারিতে বসে থাকা নাৎসি নেতারাও ছিল। প্রথমদিন হিটলার শুধু জার্মান বিজয়ীদের সাথে দেখা করার পর আইওসির প্রেসিডেন্ট হিটলারকে বলেন যদি তিনি একজনের সাথে দেখা করেন, তো সবার সাথেই করতে হবে, নাহলে কারো সাথেই করতে পারবেন না। এরপর হিটলার গোটা অলিম্পিকেই আর কোনো বিজয়ীর সাথে দেখা করেন নি। ১০.৩ সেকেন্ডে মাঠের ভেতর এবং বাইরের সবাইকে হারিয়ে প্রথম সোনা জিতে নেন জেসি।
পরদিন লং জাম্পে সোনা জেতেন জেসি। সেদিন তৎকালীন বর্ণবিদ্বেষী জার্মানিতে রচিত হয় বন্ধুত্বের চমৎকার এক উদাহরণ। লং জাম্পের ট্রায়ালে জেসি তিনবারের প্রথম দু’বারই ফাউল করেন। এসময় তার জার্মান প্রতিযোগী লুজ লং জেসির সাহায্যে এগিয়ে আসেন, কিছুটা পিছিয়ে লাফ দেবার জন্য মার্ক করে দেন। মাত্র আধা সেন্টিমিটারের জন্য কোয়ালাফাই করেন জেসি। এরপর ফাইনালে লং আর জেসির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। শেষ পর্যন্ত লংকে হারিয়ে লং জাম্পে সোনা জিতে নেন জেসি। জেসি এবং লংয়ের বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই যার শেষ হয় ১৯৪৩ সালে সিসিলিতে লং মারা যাবার দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে লং জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেও দুজনের বন্ধুত্বে কোনো ফাটল ধরেনি।
জেসির তিন নম্বর সোনা আসে ৫ আগস্ট ২০০ মিটার স্প্রিন্টে। ২০.৭ সেকেন্ডে সবাইকে হারিয়ে সোনা জিতে নেন তিনি। জেসির সোনা জয়ের গল্প হয়ত এখানেই শেষ হত যদি না সেবারের অলিম্পিক জার্মানিতে হত। ৯ আগস্ট ৪ x ১০০ মিটার রিলেতে দু’জন ইহুদী দৌড়বিদের জায়গায় সুযোগ হয় জেসির। অফিসিয়ালি নিজেদের সেরা প্রতিযোগী নামানোর কথা বললেও প্রচন্ড ইহুদী বিদ্বেষী জার্মান সরকারের চাপে এই কাজ করতে বাধ্য হয় আমেরিকা এমন বিতর্কও আছে। ৩৯.৮ সেকেন্ডে বিশ্বরেকর্ড গড়েই সেদিন সোনা জিতে নেয় আমেরিকা, জেসি জিতে নেন নিজের চতুর্থ সোনা।
জেসি ওয়েনস অলিম্পিকে নাৎসি নেতাদের গর্ব ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিলেন। তারা ভেবেছিল সবগুলো সোনা জিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করবে। কিন্তু যে কালোদের তারা মানুষই মনে করত না, তাদেরই একজন একাই চারটি সোনা জিতে তাদের পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দেন। ১৯৩৬ অলিম্পিকে আমেরিকা মোট ১১টি সোনা জেতে, যার মধ্যে ৬টিই জেতে কালোরা। এটি যে শুধু নাৎসিদের জন্য এক শিক্ষা ছিল তা না, খোদ বর্ণবাদী আমেরিকার জন্যও একটি শিক্ষা ছিল।
অলিম্পিকের পর জেসি দেশে ফিরলেন নায়ক হয়ে, সব জায়গায় তাকে নিয়ে মাতামাতি- গল্পটা এমন হলে হয়ত ভাল হত। কিন্তু আগেই একবার বলেছি, আমেরিকা তখন ছিল প্রচন্ড বর্ণবিদ্বেষী। চারটি অলিম্পিক সোনা জেতা অ্যাথলেট চাইলেই বাসের সামনে বসতে পারতেন না, এমনকি সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতেও পারতেন না। রেস্টুরেন্টে ঢুকতে হলে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হত। তবে জেসিকে সবচেয়ে বেশি অপমান করেন তার দেশের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট।
অলিম্পিক গেমসের পর হোয়াইট হাউজে অলিম্পিক দলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে জেসি ওয়েনসের কোনো জায়গা হয়নি! বর্ণবিদ্বেষী জার্মানিতে জেসি এবং অন্যান্য আফ্রিকান-আমেরিকানরা সাদাদের সাথে একই হোটেলে ছিলেন, একই রেস্টুরেন্টে খেয়েছেন। অথচ নিউ ইয়র্কের ওয়ালডর্ফ এস্টোরিয়াতে তাকে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেয়া হয়নি, যেখানে তারই সম্মানে একটি পার্টি হচ্ছিল!
শুরু থেকেই বর্ণবাদের শিকার হওয়ায় কিছুটা ক্ষোভেই অ্যাথলেটিকস ছেড়ে দেন জেসি। এরপর বিভিন্ন ব্যবসা করেন, বিভিন্ন কোম্পানির হয়ে লেকচার দেন। শেষ বয়সে তিনি ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার ব্যাবসা করতেন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে চেইন স্মোকিংয়ের কারণে ১৯৭৯ সালে ফুসফুসের ক্যান্সের আক্রান্ত হন এবং ১৯৮০ সালের ৩১ মার্চ ৬৬ বছর বয়সে অ্যারিজোনায় মারা যান জেসি ওয়েনস।
সম্প্রতি জেসি ওয়েনস এবং লুজ লং এর বন্ধুত্বের সূচনা নিয়ে কিছু বিতর্কের সৃষ্টি হলেও তাদের বন্ধুত্বের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মূলত লং জাম্প ট্রায়ালের সময় লং আসলেই জেসিকে সাহায্য করেছিল কিনা এটাই বিতর্কের মূল বিষয়। এছাড়া ২০১৪ সালে ব্রিটিশ পাইলট এরিক ব্রাউন দাবি করেন তিনি হিটলার এবং জেসিকে হ্যান্ডশেক করতে দেখেছেন, সাথে হিটলার জেসির সাফল্যের জন্য তাকে অভিনন্দনও জানিয়েছে। তবে জেসি সবসময়ই হিটলারের সাথে হ্যান্ডশেকের দাবি অস্বীকার করেছেন, সাথে এটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন হিটলারের মতো রুজভেল্টও তার সাথে হ্যান্ডশেক করেননি।
ব্যক্তিগত জীবনে ওয়েনস বেশি সুখীই ছিলেন বলা যায়। ১৯৩৫ সালের জুলাইয়ে তিনি বিয়ে করেন তার কিশোর বয়সের প্রেমিকা মিনি রুথ সলোমোনকে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা দুজন একসাথেই ছিলেন। তাদের ঘর আলো করে এসেছিল তিন মেয়ে।
২০১৬ সালে জেসি ওয়েনসকে নিয়ে একটি সিনেমা হয়েছে Race নামে। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন স্টিফেন্স হপকিন্স এবং জেসি ওয়েনসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্টেফান জেমস।
শেষ করছি জেসি ওয়েনসের একটি উক্তি দিয়ে,
“আমার গোটা জীবনটাই কেটে গেছে আমার বাবা-মা-ভাই-বোনদেরকে স্বগোত্রীয় হিটলারের হাত থেকে পালাতে দেখে, প্রথম আলাবামা থেকে, এরপর ক্লিভল্যান্ড। আর চেয়েছিলাম, যত জোরে সম্ভব দৌড়ানোর যে সুযোগটা পেয়েছিলাম, সেটা লুফে নিতে। এত বড় একটা লাফ দিতে চেয়েছিলাম, যেন আর কোনোদিন পিছনে ফিরে তাকাতে না হয়। গোল্ড মেডেলগুলো শুধু জিততে পারলে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম, এই পৃথিবীর হিটলাররা এখন আমার কাছে নিরর্থক। শুধু আমিই নই, হয়তো সবার কাছেই।“