প্রাথমিক দলে না থাকলেও ২০০৫ সালে ইংল্যান্ড সফরের জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান মুশফিকুর রহিম। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলটের বিকল্প তৈরি ও ভবিষ্যতের চিন্তাতেই নির্বাচকরা সুযোগ দিয়েছিলেন তখনকার ওই ১৬ বছরের কিশোরকে। অবশ্য এর পেছনে জিম্বাবুয়েতে ‘এ’ দলের হয়ে তার পারফরম্যান্স, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা বড় ভূমিকা রেখেছিলো।
নির্বাচকদের চিন্তাকে আস্থা-বিশ্বাসে রূপ দিয়েছিলেন ব্যাটসম্যান মুশফিক। বিরুদ্ধ কন্ডিশনে সিনিয়র ব্যাটসম্যানরা যেখানে সংগ্রাম করছিলেন, সেখানে প্রস্তুতি ম্যাচে সাসেক্স ও নর্দাম্পটনশায়ারের বিরুদ্ধে জোড়া সেঞ্চুরি করে বসেন তিনি। সেটাই তাকে এনে দেয় স্বপ্ন পূরণের উপলক্ষ। ক্রিকেটের তীর্থস্থান লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটসম্যান হিসেবেই বাংলাদেশের একাদশে সুযোগ পেয়ে যান মুশফিক।
অভিষেকেই ব্যাট হাতে নজর কেড়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ দলের মাত্র তিন ব্যাটসম্যান ডাবল ফিগারে যেতে পেরেছিলেন, যাদের একজন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ৮৫ মিনিট স্থায়ী ইনিংসে ৫৬ বল খেলে ১৯ রান করেছিলেন। লর্ডসেই মুশফিকের ব্যাটিং সামর্থ্যের স্বরূপটা জেনে গিয়েছিলো ক্রিকেট বিশ্ব।
তারপর কেটে গেছে ১৩ বছর। লম্বা সময় ধরে অধারাবাহিকতাই ছিল মুশফিকের ব্যাটিংয়ের অপর নাম। তবে ২০১১ সালে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বে আসার পর ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ব্যাট হাতে দলের আস্থা এবং ভরসাস্থল হয়ে উঠেন তিনি। নিয়মিত রান পাওয়ায় ধারাবাহিকতার অভাবও কেটে যায়। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্টে দেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করার অসামান্য কীর্তি গড়েন তিনি। বিশুদ্ধ টেকনিক, জমাট রক্ষণ এবং চাপের বিপরীতে খেলার শক্ত মানসিকতার কারণে বাংলাদেশ দলের ‘সেরা ব্যাটসম্যানের’ তকমাটাও জুড়ে যায় মুশফিকের নামের পাশে।
এই তো, নভেম্বরের শুরুতে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিটাও করেছেন তিনি। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ডাবল সেঞ্চুরি এখন তারই। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজার রানের মালিক এখন ৩১ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। টেস্টে দ্বিতীয় স্থানে এবং ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে সাকিব-তামিমের পেছনে থাকলেও দলের সেরা ব্যাটসম্যানের স্বীকৃতির যথার্থতা অনেকবারই ২২ গজে প্রমাণ করেছেন তিনি।
তবে সম্প্রতি ব্যাটিংয়ে ভালো ফর্মে থাকলেও মুশফিকের সদ্য সমাপ্ত চট্টগ্রাম টেস্টটা খুব ভালো যায়নি, দুই ইনিংসে করেছেন ২৩ রান (৪, ১৯)। ডাবল সেঞ্চুরির পরের ম্যাচেই তার ব্যাটে রানের এমন হাহাকারের চেয়ে চিন্তার কারণ তার আউটের ধরন। দুই ইনিংসেই শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের শিকার হয়েছেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান। প্রথম ইনিংসে এলবিডব্লিউ, দ্বিতীয় ইনিংসে বোল্ড হন।
খুব খেয়াল করে দেখলে চোখে পড়বে, দুই ইনিংসের আউটে একটা মিল রয়েছে। আর সেটাই মুশফিকের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে। দুইবারই গ্যাব্রিয়েল টার্গেট করেছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়কের ব্যাট-প্যাডের গ্যাপকে। বলা বাহুল্য, ক্যারিবিয়ান এই গতিদানব উভয় ইনিংসেই লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছেন। মুশফিকের ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলিয়ে বল নিতে পেরেছেন। বাংলাদেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানের রক্ষণদুর্গে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছেন। গতির সঙ্গে সঠিক লেন্থ এবং টার্গেট অনুযায়ী বোলিং করেছেন গ্যাব্রিয়েল, এবং সাফল্যও ধরা দিয়েছে তাকে।
উইকেটের চারপাশে শট খেলতে পারেন মুশফিক। স্লগ সুইপটা ব্যাটিংয়ে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেওয়ার মূল অস্ত্র হলেও তার হাতে এখন অনেক শট রয়েছে। আবার এই স্লগ সুইপ, মিড উইকেট-স্কয়ার লেগে টেনে মারার প্রবণতার কারণে অনেক সময়ই দলকে ব্যাট হাতে রাজ্যের হতাশাও উপহার দিয়েছেন তিনি। একই চেষ্টায় সফলতাও অবশ্য অনেকবার পেয়েছেন।
তার রক্ষণ টার্গেট করে সফল হওয়ার নজিরটা ক্যারিবিয়ানরা দেখিয়ে আসছে গত জুলাই থেকে। সেই অ্যান্টিগা থেকে শুরু করে মুশফিকের ব্যাট-প্যাডের গ্যাপ লক্ষ্য করে বোলিং করে আসছেন ক্যারিবিয়ান পেসাররা। এসব বল খেলতে গিয়ে অনেক সময় সফলও হয়েছেন দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৬৫টি টেস্ট খেলা এই ব্যাটসম্যান। আবার সর্বশেষ কয়েক টেস্টে তার রক্ষণবুহ্য ভেঙে পড়ার ঘটনাও বারবার দেখা গেছে।
অ্যান্টিগা টেস্ট
প্রথম ইনিংসে কেমার রোচের বলে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়েছিলেন মুশফিক। রোচের নবম ওভারের দ্বিতীয় বলটা ছিল ইনসুইঙ্গার, অফ স্ট্যাম্পের একটু বাইরে পড়ে ভেতরে ঢুকছিল। ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে বল আঘাত করে প্যাডে, রিভিউ নিয়েও সে যাত্রা বাঁচতে পারেননি তিনি। বাংলাদেশের ৪৩ রানে অলআউট হওয়ার ব্যাটিং-দুঃস্বপ্নের ইনিংসে শূন্য রানে ফিরেছিলেন তিনি।
রোচের সফলতা যেন উসকে দিয়েছিলো গ্যাব্রিয়েলকে। মুশফিকের জন্য দ্বিতীয় ইনিংসে একই অস্ত্র ব্যবহার করেন তিনি। লেন্থ বল অফ স্ট্যাম্প থেকে ভেতরে ঢুকছিলো। বল ঠেকাতে ব্যাট বাড়িয়েছিলেন মুশফিক। কিন্তু বল ব্যাট-প্যাডের বিশাল ফাঁক গলিয়ে মিডল স্ট্যাম্প ভেঙে দেয়। এবার ৮ রান করে ফিরেছিলেন তিনি।
কিংস্টন টেস্ট
প্রথম ইনিংসে ২৪ রান করে জ্যাসন হোল্ডারের বলে গালিতে শাই হোপের কাছে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন মুশফিক। দ্বিতীয় ইনিংসেও হোল্ডারের শিকার হয়েছেন তিনি, ৩১ রান করে বোল্ড হয়েছেন। কিন্তু দৃশ্যপট সেই একই। ব্যাট সামনে এগিয়ে দিয়েছেন বল ঠেকাতে, কিন্তু বল ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলিয়ে আঘাত করেছে স্ট্যাম্পে। এবং এবারও গ্যাপটা বেশ বড়সড়ই ছিল বটে।
চট্টগ্রাম টেস্ট
প্রথম ইনিংসে উইকেটে নেমেই প্রথম বলে গ্যাব্রিয়েলকে চার মেরেছিলেন মুশফিক। এক বল পরই গ্যাব্রিয়েল হাজির শিকারীর রূপে। লেন্থ বলটা ভেতরে ঢুকছিলো। অফ সাইডে ঠেলে দেয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ মুশফিক, বল আঘাত করে প্যাডে। আম্পায়ার আউট না দিলেও শুধু গ্যাব্রিয়েলের একক চাওয়াতে রিভিউ নেয় উইন্ডিজরা। বোলারের প্রবল আত্মবিশ্বাস বিফলে যায় নি, ৪ রান করে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়ে ফেরেন মুশফিক।
দ্বিতীয় ইনিংসে আবার গ্যাব্রিয়েলের বলে বোল্ড বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান। ঘূর্ণি জাদুতে ভরা উইকেটে ১৯ রান করে ফেলেছিলেন তিনি, কিন্তু গ্যাব্রিয়েল পুরনো অস্ত্র নিয়ে হাজির হন। লেন্থ বল পড়েই ছুটলো ব্যাটসম্যানের দিকে। অবশ্য মুশফিকের প্রত্যাশার চেয়ে বলটা কম উঠেছিলো। কোমর উচ্চতায় থাকা বলটা ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলিয়ে উপড়ে ফেলে স্ট্যাম্প।
জমাট রক্ষণ, চোয়ালবদ্ধ মানসিকতায় দুরূহ উইকেটে ব্যাটিংয়ের জন্য প্রশংসিত মুশফিক। কিন্তু একই বলে শেষ কয়েকবারের আউটগুলোতে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে তার রক্ষণের ঘাটতি, বিশেষ করে এই একটা নির্দিষ্ট বলে। আর প্রতিপক্ষ বোলাররা সেটাকেই বারবার তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন।
জাতীয় দলের সাবেক সহকারী কোচ, ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রসিদ্ধ কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেছেন, মুশফিকের এই সমস্যাটা নাকি নতুন নয়। এটা অনেক পুরনো, আগেও অনেকবার এভাবে আউট হয়েছেন। তবে এসব নিয়েও বড় ইনিংস খেলেছেন তিনি। ইনিংসের শুরুতেই সাধারণত নাকি এ সমস্যা হয়ে থাকে। সেট হয়ে গেলে সব বলই ভালো সামাল দেন তিনি।
মুশফিকের বিরুদ্ধে গ্যাব্রিয়েলদের এই কৌশল চোখে পড়েছে সালাউদ্দিনেরও। জানতে চাইলে তিনি বলেছেন,
‘অনেক আগের থেকেই মুশফিকের এই সমস্যা। আগে থেকেই এই সমস্যাটা আছে। এটা এই সিরিজ বা আগের সিরিজ থেকে নয়। সব বোলাররা ওর এটাকেই টার্গেট করে।’
তিনি আরও বলেন,
‘প্রত্যেক ব্যাটসম্যান টেকনিকের ক্ষেত্রে শতভাগ পূর্ণ থাকে না। এটা নিয়েও তো সে অনেক রান করেছে। এটা আসলে ইনিংসের শুরুতে একটু সমস্যা হয়। পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। নামলেই এমন বল হলে সমস্যা হয়। এটা যেকোনো ব্যাটসম্যানেরই হতে পারে।’
বাংলাদেশ জাতীয় দলের সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটার মুশফিক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলছেন ১৩ বছর ধরে। শেষ কয়েক টেস্টে তার বিরুদ্ধে বোলারদের নির্দিষ্ট একটি অস্ত্র ব্যবহারের চেষ্টা নিশ্চয়ই ব্যাটসম্যান মুশফিকের চোখেও আলাদাভাবে ধরা পড়বে। কোচদের সঙ্গে কাজ করে অচিরেই এসব বল খেলাতেই হয়তো উন্নতি আসবে সাবেক এই অধিনায়কের ব্যাটে। তবে ব্যাটিংয়ে ক্রমাগত নতুন উচ্চতায় উঠার চেষ্টারত মুশফিকের জন্য রক্ষণের এই ঘাটতি সারিয়ে তোলাও খুব প্রয়োজন।