ক্রিকেট একটি দলগত খেলা হলেও এখানে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জায়গাও বেশ ভালোভাবে আছে। কোনো খেলোয়াড় যদি ভালো পারফর্ম করে তবে দর্শকমহলে তার একটা ভালো ইমেজ তৈরি হয়, খারাপ সময়েও তাকে ভক্তরা সমর্থন যুগিয়ে যায়। তবে কিছু কিছু দুর্ভাগা খেলোয়াড় আছে যারা নিজেদের সেরাটা দেওয়া সত্ত্বেও সবার মন জয় করতে সক্ষম হয় না। অদ্ভুত সব যুক্তি টেনে তাদের বারবার টেনে আনা হয় জনতার কাঠগড়ায়, তেমনই একজন খেলোয়াড় হচ্ছেন লাসিথ মালিঙ্গা।
১৯৮৩ সালের ২৮ আগস্ট শ্রীলঙ্কার গলে প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে তার জন্ম, পুরো নাম সেপারামাদু লাসিথ মালিঙ্গা। রাথগামার সেই নির্জন গ্রামে বালুর মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়েই ভালোবেসে ফেলেন ক্রিকেটকে। তখন অবশ্য টেনিস বল দিয়েই ক্রিকেট খেলতেন তিনি। শ্রীলঙ্কায় যত ক্রিকেটার বের হয় তাদের সিংহভাগই আসে স্কুল ক্রিকেট থেকে কিন্তু মালিঙ্গার অস্বচ্ছল পরিবারের সেসব স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শৈশবে স্কুল ক্রিকেটের অংশ হতে পারেননি তিনি। তবে বিদ্যালোকা কলেজে থাকাকালীন সৌভাগ্যক্রমে তিনি শ্রীলঙ্কার সাবেক পেসার চম্পাকা রামানায়েকের নজরে পড়ে যান।
সেই নজরে আসার মূল কারণ ছিল তার অদ্ভুত বোলিং অ্যাকশন, পৃথিবীর অধিকাংশ পেসার যেখানে রাউন্ডআপ অ্যাকশনে বোলিং করেন, সেখানে মালিঙ্গা বোলিং করতেন ১৮০ ডিগ্রি কোণে হাত রেখে। টেনিস বলে খেলতে গিয়েই অদ্ভুতুড়ে এক অ্যাকশন আয়ত্ত্ব করেন তিনি। উইজেডেনের মতে, মালিঙ্গার এই অ্যাকশনের সাথে ক্রিকেটের স্লিঙ্গিং অ্যাকশনের অনেক মিল আছে, আর এই কারণে পরবর্তীতে মালিঙ্গার ডাকনাম হয়ে যায় “স্লিঙ্গা মালিঙ্গা।” এমন বিরল প্রজাতির এক পেসারকে পেয়ে সাথে সাথে লুফে নেন রামানায়েকে, মালিঙ্গাকে তিনি নিয়ে যান মাহিন্দা কলেজে এবং কলেজের মূল একাদশে খেলানোর সুযোগ করে দেন।
এই বোলিং অ্যাকশনের কারণে জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরেও পড়েন তিনি। তাই মাত্র ২১ বছর বয়সেই জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটে তার। ডারউইনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই টেস্ট ম্যাচে দারুণ বোলিং করেছিলেন মালিঙ্গা, দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ছয় উইকেট। তবে লো স্কোরিং ম্যাচে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ম্যাচটা হেরে যায় শ্রীলঙ্কা। সেই বছরের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় এশিয়া কাপে ওয়ামডে ফরম্যাটে অভিষেক ঘটে এই পেসারের, ডাম্বুলার সেই ম্যাচে ৩৯ রানে ১ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নেপিয়ার টেস্টে প্রথম ইনিংসে চার উইকেট ও দ্বিতীয় ইনিংসে তুলে নেন পাঁচ উইকেট। এটি ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট। ম্যাচ ড্র হলেও এমন নজরকাড়া পারফরম্যান্সের জন্য ম্যাচসেরার পুরস্কারটা জিতে নেন মালিঙ্গা। ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদেরই মাঠে অনুষ্ঠেয় ওয়ানডে সিরিজে ৫ ম্যাচে ১৩ উইকেট তুলে নেন মালিঙ্গা। সেই বছরের একদম শেষপ্রান্তে আবারো নিউজিল্যান্ডের মাঠে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স উপহার দেন তিনি। ওয়েলিংটন টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬৮ রানে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে শ্রীলঙ্কার সেই টেস্ট জয়ে বড় অবদান রাখেন।
তবে মালিঙ্গা পুরো বিশ্বের স্পটলাইট পান ২০০৭ বিশ্বকাপে। সুপার এইটে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয়েছিলো শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার ছুঁড়ে দেওয়া ২১০ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ৪৪.৪ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ৫ উইকেটে ২০৬ রান। ৩২ বলে দরকার মাত্র ৪ রান আর হাতে আছে ৫ উইকেট, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রোটিয়াদের জয় তখন একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল। অনেকে হয়তো ম্যাচ শেষ ভেবে স্টেডিয়াম ছেড়ে বাড়ির পথেও রওনা দিয়ে ফেলেছিলো।
এমন সময়ে একটা দুর্দান্ত ম্যাজিক নিয়ে এলেন লাসিথ মালিঙ্গা, ৪৪তম ওভারের শেষ দুই বলে শন পোলক ও অ্যান্ড্রু হলকে আউট করেন তিনি। তখনো মনে হচ্ছিলো এই দুই উইকেট ম্যাচের ফলাফলে কোনো প্রভাব ফেলবে না। চামিন্দা ভাসের পরের ওভার থেকে আসে মাত্র এক রান, ৮৬ রানে অপরাজিত ক্যালিসের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকের আশায় ৪৬তম ওভার করতে আসেন মালিঙ্গা। আউটসাইড অফস্ট্যাম্পে দ্রুতগতির এক বলে ক্যালিসকে কট বিহাইন্ডের ফাঁদে ফেলে হ্যাটট্রিক পেয়ে যান তিনি! স্টেডিয়ামে দর্শক যারা ছিলেন সবাই নড়েচড়ে বসলেন, অবিশ্বাস্য কিছু কি সত্যিই ঘটতে চলেছে?
ইতিহাস রচনা করলেন মালিঙ্গা, দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে এনটিনিকে বোল্ড করে গড়লেন অবিশ্বাস্য এক রেকর্ড। ২০৬/৫ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পরিণত হয় ২০৭/৯ এ। তবে শেষপর্যন্ত দলকে জয় এনে দিতে পারেননি তিনি, ১ উইকেটে ম্যাচটা হেরে যায় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু একজন লাসিথ মালিঙ্গা নিজের দিনে ঠিক কতটা ভয়ংকর তা এই ম্যাচের মাধ্যমে পুরো ক্রিকেটবিশ্বের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচে ১৫.৭৮ গড়ে তুলে নেন ১৮টি উইকেট, তবে তার দলকে ফিরতে হয় রানার্সআপ হয়ে।
এমন একটি বিশ্বকাপ কাটানোর পর ধারণা করা হচ্ছিলো মালিঙ্গা হয়তো নিজেকে বিশ্বসেরা পেসার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলবেন কিন্তু ২০০৮ সালের অস্ট্রেলিয়া সফর সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। সেবার মারাত্মক এক হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন এই পেসার, যার কারণে তার ক্যারিয়ারটাই হুমকির সম্মুখীন হয়ে যায়। তবে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এক বছর পর আবারো ক্রিকেটে ফিরে আসেন তিনি।
২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স উপহার দেন মালিঙ্গা, ১৫.০৮ গড়ে তুলে নেন ১২ উইকেট, যা ওই আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। পাওয়ার প্লে আর ডেথ ওভারে সিংহভাগ ওভার করা সত্ত্বেও সেই আসরে তার ইকোনমি রেট ছিল মাত্র ৭.১৪। তার এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কার ফাইনালে ওঠার অন্যতম বড় কারণ ছিল, যদিও ফাইনালে পাকিস্তানের সঙ্গে আর পেরে ওঠেনি শ্রীলঙ্কা।
২০০৮ সালের ওই ইনজুরির পর শর্টার ফরম্যাটে ফিরলেও টেস্ট ক্রিকেটে ফিরেননি মালিঙ্গা, তবে ২০১০ সালে মুরালির বিদায়ী টেস্টে এই লিজেন্ডের অনুরোধ রাখতে আবারো দেশের হয়ে সাদা জার্সি গায়ে চড়ান তিনি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “মুরালিকে আমরা সবাই অন্য চোখে দেখি, তিনি যখন আমাকে তার বিদায়ী টেস্ট খেলতে বললেন তখন সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সেই টেস্ট ম্যাচ খেলতে গিয়ে যদি আমার পা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো তবুও আমি খেলতাম।”
মুরালির শেষটা রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছিলেন মালিঙ্গা, সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে করেন ৬৪ রান! আসল জাদুটা অবশ্য বল হাতেই দেখান, দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫০ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে দলকে ১০ উইকেটের বড় জয় পাওয়ার ভিত গড়ে দেন। মুরালির বিদায়ী ম্যাচে এমন অনবদ্য পারফরম্যান্সের পুরস্কার হিসেবে ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও তার হাতেই ওঠে।
সেই বছরের শেষদিকে আরেকটি স্মরণীয় ম্যাচের নায়ক হন মালিঙ্গা, তবে এবার আর বল হাতে নয়! মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ২৪০ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ১০৭ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে নিশ্চিত হারের কাছাকাছি চলে গেছিলো শ্রীলঙ্কা। কিন্তু অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের সাথে লাসিথ মালিঙ্গার নবম উইকেটে রেকর্ড ১৩২ রানের জুটিতে শেষপর্যন্ত ১ উইকেটে ম্যাচটি জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। সেই ম্যাচে ৪৮ বলে ৫৬ রান করেন মালিঙ্গা, যা তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের একমাত্র ফিফটি।
নিজের এই ভালো ফর্ম ২০১১ বিশ্বকাপেও টেনে নিয়ে যান মালিঙ্গা, প্রথম দুই ম্যাচ ইনজুরির জন্য মিস করলেও তৃতীয় ম্যাচেই ফিরেন দোর্দণ্ড দাপটের সাথে। কেনিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ তুলে নেন ছয় উইকেট, বিশ্বকাপ ইতিহাসে একমাত্র মালিঙ্গারই দুটি হ্যাটট্রিক আছে। আসরজুড়ে ডেথ ওভারে দারুণ বল করে দলকে ফাইনালে তোলার ক্ষেত্রে রেখেছিলেন বড় ভূমিকা। ফাইনালে ভারতের দুই ওপেনার শেবাগ ও টেন্ডুলকারকে দ্রুত ফিরিয়ে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ের সম্ভাবনা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু অন্য বোলারদের ব্যর্থতায় সেবারও ফাইনাল থেকে আবারো খালি হাতে ফিরতে হয় লঙ্কানদের।
এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো, হাসিখুশি মালিঙ্গাকে নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ ছিল না। এমন সময়ে শ্রীলঙ্কান বোর্ড অবিবেচকের মতো কিছু কাজ করে তার ব্যক্তিত্বে বড় এক কালিমা এঁকে দেয়। ২০১১ বিশ্বকাপের পরপরই আইপিএল শুরু হয়ে যায়, মালিঙ্গাও তার দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলছিলেন। এমন সময়ে ইংল্যান্ড সফরের টেস্ট সিরিজের জন্য অনুষ্ঠেয় ক্যাম্পে যোগদানের জন্য তাকে ডেকে পাঠায় বোর্ড। কিন্তু মালিঙ্গা জানান, তিনি টেস্ট খেলার মতো ফিট নন। বোর্ড এই কথা তোয়াক্কা না করে আবারো জোরাজুরি করলে তিনি টেস্ট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন। আর এতেই মিডিয়ার একটা বড় অংশ তার নামে নানা সংবাদ ছড়িয়ে, অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম জানিয়ে দেয়, মালিঙ্গা নাকি আইপিএলের টাকার লোভেই টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছেন!
সত্যিই কি এমন কিছু ঘটেছিলো? ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যাক, মালিঙ্গা ২০০৮ সালের ইনজুরির পর থেকেই শুধু শর্টার ফরম্যাটে খেলে যাচ্ছিলেন, তার যে ফিটনেস তাতে পাঁচদিনের টেস্ট খেলা তার জন্য বিপদজনক ছিল। তবুও তিনি ২০১০ সালের মাঝামাঝি টেস্টে ফিরেছিলেন শুধুমাত্র মুরালির বিদায়ী ম্যাচ খেলতে। সেটি ছিল তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্ট। সেই টেস্ট খেলার পরই আবার তার পুরনো ইনজুরি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে পারেননি তিনি। আসলে ওই ইনজুরির পর মালিঙ্গার পায়ের যা অবস্থা হয়েছিলো তাতে তিনি যদি নিয়মিত টেস্ট খেলা চালিয়ে যেতেন, তাহলে তার ক্যারিয়ার কিছুতেই দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হতো না। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই টেস্ট থেকে দূরে থাকার কথা ভেবেছিলেন তিনি।
অথচ পুরো ব্যাপারটা জেনেও শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড অহেতুক তাকে ইংল্যান্ড সফরে টেস্ট খেলার জন্য জোরাজুরি করে জলঘোলা করেছিলো। এই ক্রিকেট বোর্ড কিন্তু মালিঙ্গার সেই ইনজুরির সময়ে তার কোনো খবরই নেয়নি। তার আইপিএল ক্লাব মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সই চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছিলো। অথচ সেই বোর্ডই বলতে গেলে অকারণে একজন ক্রিকেটারকে জনতার মঞ্চে কাঠগড়ায় নিয়ে গেছিলো।
টেস্ট থেকে অবসর নিলেও সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে শ্রীলঙ্কার জার্সিতে পুরোদমে খেলে যাচ্ছিলেন মালিঙ্গা। যদিও ২০১১ সালে প্রবর্তিত নতুন নিয়মের ফলে দুই প্রান্তে দুই বল আসায় ওয়ানডেতে তার রিভার্স সুইংয়ের কার্যক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়, তবুও নিজের বাকি অস্ত্র দিয়ে দলকে ভালোই সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
এমনই সময়ে ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি মিলিয়ে টানা তিন ফাইনাল হেরেছিলো লঙ্কানরা, তাই ঘরের মাঠে সেই অতৃপ্তি ঘোচানোর বড় সুযোগ তাদের সামনে ছিল। সেই মিশনে দলকে ভালোই সাহায্য করতে থাকেন মালিঙ্গা, বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় সুপার এইটের দুটি ম্যাচ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানটান উত্তেজনা ম্যাচ সুপার ওভারে গড়ালে সেখানে দুর্দান্ত বোলিং করে দলকে জয় এনে দেন। আর সুপার এইটের শেষ ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে প্রথমবারের মতো পাঁচ উইকেটের স্বাদ পান তিনি।
সেমিফাইনালেও দারুণ বোলিং করেন মালিঙ্গা, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪ ওভারে মাত্র ১৯ রান খরচ করে দলকে নিয়ে যান ফাইনালে। ঘরের মাঠে ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল উইন্ডিজ, যাদের সুপার এইটেই ৯ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিলো শ্রীলঙ্কা। তাই স্বাভাবিকভাবেই ফাইনালেও স্বাগতিকদের জয়ের পাল্লা ভারী ছিল, ১০ ওভার শেষে উইন্ডিজের সংগ্রহ ২ উইকেটে মাত্র ৩২ রান হওয়ায় সেই পাল্লা বলতে গেলে পুরোপুরিই শ্রীলঙ্কার দিকে ঝুঁকে গেছিলো।
তাছাড়া তখনো শ্রীলঙ্কার তুরুপের তাস মালিঙ্গার তিন ওভার বাকি ছিল, তাই শ্রীলঙ্কার আত্মবিশ্বাসী হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিধি বাম! লঙ্কানদের সেরা অস্ত্রটাই এবার তাদের দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে এলো! মালিঙ্গার করা ওই ৩ ওভারে উইন্ডিজ তুলে নিলো ৫০ রান, যেখানে মূল অবদানটা ছিল মারলন স্যামুয়েলসের। ফলে শেষ ১০ ওভারে ১০৫ রান তুলে নির্ধারিত ২০ ওভার শেষে ছয় উইকেটে ১৩৭ রান সংগ্রহ করে ক্যারিবিয়ানরা। কলম্বোর স্লো পিচে এমন সংগ্রহ সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং, শ্রীলঙ্কাও পারেনি সেই চ্যালেঞ্জ উৎরাতে। ফলে ঘরের মাঠে নায়কের বদলে শেষপর্যন্ত খলনায়ক হয়েই মাঠ ছাড়তে হয় মালিঙ্গাকে।
অবশ্য ২ বছর পর সেই দায়শোধের মঞ্চ পেয়ে যান মালিঙ্গা, সেবারের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো বাংলাদেশে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে একই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো এশিয়া কাপ, সেখানেও নিজের ভেলকি দেখিয়েছিলেন এই তারকা। আসরের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে দলকে দারুণ সূচনা এনে দিয়েছিলেন। ফাইনালেও সেই একই প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা, ফ্ল্যাট পিচে মালিঙ্গা আবারো তুলে নেন পাঁচ উইকেট। তার এমন দারুণ বোলিংয়ের ফলেই পাকিস্তানকে ২৬০ রানে বেঁধে রাখতে পারে শ্রীলঙ্কা, ২২ বল বাকি থাকতে সেই রান তাড়া করে এশিয়া কাপের শিরোপাটা জিতে নেয় তারা। দুর্দান্ত বোলিংয়ের জন্য ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন মালিঙ্গা।
এশিয়া কাপের এই ভালো পারফরম্যান্স টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও টেনে নিয়ে যান মালিঙ্গা, আসরের মাঝপথে নিয়মিত অধিনায়ক দিনেশ চান্দিমাল স্লো ওভার রেটে কারণে নিষিদ্ধ হলে অধিনায়কের দায়িত্ব মালিঙ্গার কাঁধে আসে। তার নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচ জিতে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে শ্রীলঙ্কা। সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার ছুঁড়ে দেওয়া ১৬১ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে যখন বেশ ভালো শুরু পেয়ে গিয়েছিলো উইন্ডিজ, তখনই ম্যাজিকাল এক স্পেল নিয়ে হাজির হন এই পেসার। ২ ওভার বল করে মাত্র ৫ রান খরচায় তুলে নেন গেইল ও স্মিথের মহাগুরুত্বপূর্ণ দুই উইকেট। তার তৈরি করা চাপ কাজে লাগিয়ে ক্যারিবিয়ানদের চেপে ধরে লঙ্কানরা। ফলে বৃষ্টি আসার আগে ডি/এল মেথডে ২৭ রানে এগিয়ে থাকায় লঙ্কানরা চলে যায় ফাইনালে।
ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল সেই আসরের অপরাজিত দল ভারত, যাদের কাছে তিন বছর আগে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরেছিলো শ্রীলঙ্কা। টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করতে নেমে ভারতকে শুরুর দিকে বেশ চেপে ধরেছিলো লঙ্কানরা, কিন্তু বিরাট কোহলির দারুণ ব্যাটিংয়ে বড় সংগ্রহের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো ভারত। ইনিংস শেষ হতে যখন ৩ ওভার বাকি তখন ভারতের সংগ্রহ ছিল ১১৫/২, হাতে পর্যাপ্ত উইকেট থাকায় শেষ ৩ ওভারে ধুমধাড়াক্কা পিটিয়ে ৪৫ রান তুলে ১৬০ রানের সংগ্রহ দাঁড় করানোটা অনেক বেশি সম্ভব বলেই মনে হচ্ছিলো। আর মিরপুরের পিচে ফাইনালে যদি ১৬০ রানের মতো স্কোর তাড়া করতে হয়, তবে শ্রীলঙ্কার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যাবে সেটা সবাই বুঝতে পারছিলো।
কিন্তু মালিঙ্গা যে দুই বছর আগের ফাইনালের দায়মোচন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাই নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে অবিশ্বাস্য এক স্পেল উপহার দিলেন। লাইন আর লেংথ ঠিক রেখে শেষ ১২টি বলেই টানা ইয়র্কার আর ফুল লেংথে বল করে গেলেন। এমন অনবদ্য বোলিংয়ের সামনে কোহলি, যুবররাজ, এমনকি সর্বকালের অন্যতম সেরা ফিনিশার হিসেবে খ্যাত ধোনিকেও বড্ড অসহায় লাগছিলো। অপর প্রান্তে কুলাসেকারাও যোগ্য সমর্থন দিয়েছিলেন। তাই আট উইকেট হাতে নিয়ে শেষ তিন ওভার শুরু করা ভারত সেখান থেকে যোগ করতে পারলো মাত্র ১৫ রান!
ডেথ ওভারের মোমেন্টাম শ্রীলঙ্কার আত্মবিশ্বাসের পালে বড় এক হাওয়া যুগিয়েছিলো। তাই টানা চার ফাইনাল হারা লঙ্কানরাই দারুণ আত্মবিশ্বাসের সাথে সেই রান তাড়া করে জিতে নিলো তাদের প্রথম টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ। অধিনায়ক হিসেবে সেই ট্রফি হাতে তুলে মালিঙ্গাও হয়ে গেলেন ইতিহাসের সাক্ষী। এই শিরোপাজয়ের পুরস্কারস্বরূপ চান্দিমালকে সরিয়ে মালিঙ্গাকেই টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটের নিয়মিত অধিনায়ক করা হয়।
কিন্তু সেই বছরই আবারো হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন মালিঙ্গা, যার ফলে তার ২০১৫ বিশ্বকাপে খেলা নিয়েও শঙ্কা দেখা যায়। যদিও সেই বিশ্বকাপ তিনি ঠিকই খেলেছিলেন, কিন্তু ওই ইনজুরি মালিঙ্গার বড় সর্বনাশ করে দেয়। আগে তিনি নিয়মিত ১৫০+ কিলোমিটারে বল ছুঁড়তে পারতেন, কিন্তু ইনজুরি তার গতির অনেকাংশই কেড়ে নেয়। ফলে সেই আসরে বেশ বিবর্ণ ছিলেন এই পেসার। এই ইনজুরি কিছুদিন পরপরই তাকে ভোগাতে লাগলো, ফলে ২০১৬ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও তার খেলা হয়নি। ইনজুরির কারণে অনিয়মিত হয়ে যাওয়ায় টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটের অধিনায়কত্বও ছেড়ে দেন তিনি।
ক্যারিয়ারের পরের অংশে আসলে বলার মতো তেমন কিছু নেই। এরপর ইনজুরির সাথে মালিঙ্গার লড়াইটাই যেন তার জীবনের নিয়মিত অংশ হয়ে গেছিলো। যখন ফিট হয়েছেন তখন আবার তাকে অন্যদের তুলনায় আনফিট বলে জাতীয় দলে ডাকা হয়নি। অথচ যখনই লঙ্কান জার্সিতে সুযোগ পেয়েছেন, তখুনি ঐ তথাকথিত ফিট প্লেয়ারদের চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন এই আনফিট পেসার।
জীবনের শেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাবেন কি না সেটা নিয়েও কিছু সমালোচক সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু সব সন্দেহ উড়িয়ে দিয়ে ঠিকই খেলেছেন। এই আসরে বুড়ো হাড়ের ভেলকিটা ঠিকই দেখিয়েছেন, সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লঙ্কানদের জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল এই আনফিট পেসারেরই! ৪৩ রানে ৪ উইকেট তুলে নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়। উইন্ডিজের বিপক্ষে ৩ উইকেট তুলে নিয়েও জয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন, মূলত এই দুই জয়ে ভর করেই নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম দুর্বল দল নিয়ে এসেও ষষ্ঠ হয়ে আসর শেষ করতে পেরেছিলো শ্রীলঙ্কা।
এই বিশ্বকাপ শেষেই ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে পারতেন, কিন্তু ঘরের মাঠে দর্শকদের সামনেই যাতে বিদায় নিতে পারেন সেজন্য বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচটা খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। বোর্ড তাকে যতই ভুল বুঝুক, ভক্তদের ভালোবাসাটা যে তিনি দু’হাত ভরে পেয়েছেন সেটা শেষম্যাচের গ্যালারি দেখলেই বুঝা যায়। দর্শকভর্তি পুরো স্টেডিয়াম যখনই মালিঙ্গাকে দেখতে পেয়েছে, তখনই তুমুল করতালিতে তাকে অভিবাদন জানিয়েছে।
ক্যারিয়ারের শেষটাও করেছেন রাজসিকভাবে, তামিম আর সৌম্যকে নিজের ট্রেডমার্ক ইয়র্কারে বোল্ড আউট করেছেন। এরপর মুস্তাফিজকে স্লোয়ারে বোকা বানিয়ে আউট করে দলের জয় নিশ্চিত করার সাথে নিজের ১৫ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ইতিও টেনে দিয়েছেন। দীর্ঘ এই সময়ে পাড়ি দিয়েছেন নানা চড়াই উৎরাই, ২২৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ২৮.৮৭ গড়ে শিকার করেছেন ৩৩৮ উইকেট।
শ্রীলঙ্কার ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন আটবার। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় খেলেছেন স্ট্রাইক বোলার হিসেবে, আর সে দায়িত্ব পালনে যে তিনি ভালোভাবেই সফল সেটা তার স্ট্রাইক রেট দেখলেই বোঝা যায়। কমপক্ষে ১৫০ উইকেট নিয়েছেন এমন বোলারদের মাঝে মালিঙ্গার ৩২.৩ স্ট্রাইক রেটই সবার সেরা। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিকের রেকর্ডটাও তার দখলে, তিন হ্যাটট্রিক নিয়ে তালিকায় সবার উপরেই রয়েছেন তিনি।
ব্যতিক্রমী বোলিং অ্যাকশন, নিখুঁত ইয়র্কার, দুর্দান্ত স্লোয়ার, পুরনো বলে দুদিকে রিভার্স সুইং, তুখোড় গতি– একজন পেসার যেসব স্কিলের জন্য আজন্ম স্বপ্ন দেখেন তার সবকিছুই লাসিথ মালিঙ্গার মাঝে ছিল। তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল চাপের মাঝেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বল করার ক্ষমতা। এজন্যই হয়তো ডেথ ওভারে একা হাতে এতগুলো ম্যাচ জেতাতে পেরেছেন তিনি। এমন সব স্কিল থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ইনজুরির কারণে সর্বকালের সেরা পেসারদের ছোট্ট তালিকায় ঢুকতে পারেননি এই তারকা। যা-ই হোক, একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার হিসেবে ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই মহানায়কের নাম।