কিংস্টন থেকে শেরউড কনটেন্ট, গাড়িতে চেপে যাত্রা শুরু করলে বন্ধুর এক রাস্তা টপকে জ্যামাইকার এই ছোট্ট গ্রামটাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় লেগে যায় প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার কাছাকাছি। নেহায়েত প্রত্যন্ত অঞ্চল, এখন থেকে আট-দশ বছর আগেও এই গ্রামের নাম হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অন্য কেউ আদৌ জানতেন কিনা এ সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তবে এখন এই গ্রামের নাম ছড়িয়েছে বিশ্বজোড়া, গ্রামের হালও ফিরেছে রাতারাতি। কারণ এই গ্রামেই বেড়ে উঠেছেন একজন কিংবদন্তী, একজন অতিমানব। তাঁর নামটিও এতক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছেন নিশ্চয়ই, উসাইন বোল্ট!
১৯৮৬ সালের ২১ আগস্ট, এই দিনেই জ্যামাইকার ছোট্ট একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বোল্ট। বাবা ওয়েলেসলি ছিলেন ছোটখাটো এক মুদি দোকানদার, কোনোক্রমে মাস চলে যায় তাঁর। তাঁরই সহধর্মিনী জেনিফার, তিনিও সে দোকানেই সহযোগিতা করতেন ওয়েলেসলিকে। তাঁদেরই প্রথম সন্তানের নাম রাখা হয় উসাইন, বংশানুক্রমে সে ধারণ করে ‘বোল্ট’ উপাধি। সেদিনই যেন নিশ্চিত হয়ে যায়, ভবিষ্যতে ট্র্যাকে ‘বোল্ট’ তথা বজ্রের মতোই তীব্রভাবে জানাবেন নিজের আগমনী ধ্বনি। তবে সে রাস্তাটা খুব সহজ ছিলো না।
কোনো স্ট্রীট লাইট ছিলো না গ্রামে, ছিলো না যথেষ্ট পানির সরবরাহও। শুধু পানির আশাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা; কখনও কখনও দিন পেরিয়ে যেত, পানির দেখাও মিলতো না। দূর শহরে পানির সরবরাহ আছে বটে, তবে রাস্তা ছিলো এতটাই বন্ধুর, পারতপক্ষে কেউ যদি সকাল সকাল রওনা করতেন পানি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়েই যেত। আর পাহাড়ের নির্জন পরিবেশে ওঁত পেতে থাকা দুর্বৃত্তদের হাতে ছিনতাই কিংবা ডাকাতির গল্পগুলোও কান পাতলেই শোনা যায়। এমনই এক গ্রাম এই শেরউড, যেখানে ঢোকামাত্রই যে কারও মনে পড়ে যেতে পারে সেই আদিকালের কথা, যখন মানুষ ঘোড়ার পিঠে চড়ে টগবগিয়ে ঘুরে বেড়াতো, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা হুড়মুড় করে সকাল থেকে লাইন দিতো এক বালতি পানির জন্য, আবার কোনো গাড়ি দেখলে চক্ষু বিস্ফোরিত করে তাকিয়ে থাকতো, আর নিরাপদ দূরত্ব থেকে হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানাতো।
বোল্টের জন্মের পর থেকেই সবাই বুঝতে শুরু করে, ছেলেটা আসলে একটু বেশিই চঞ্চলমতি। ডাক্তারি ভাষায়, বোল্ট ছিলেন ‘হাইপারঅ্যাকটিভ’, যার কারণে তিনি বরাবরই ছিলেন দারুণ ছটফটে। তাঁর মা জেনিফার বলেন,
“খুব সম্ভবত আমি গর্ভবতী অবস্থায় এত্ত এত্ত মিষ্টি খাওয়ার জন্যই এটা হয়েছে ওর। তেঁতুলে ‘সুগার’টা নেহায়েত কম নেই। বোধ করি, এই কারণেই ও এতটা চটপটে হয়েছে। একদম স্থির থাকতে পারতো, শুধু ছোটাছুটি। অবশ্য ও জন্মেছিলো দেড় সপ্তাহ দেরিতে, গোটা জীবনে এই একটাবারই দেরি করেছে ও!”
জেনিফার গর্বের হাসি হাসেন, সে হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে। এরপর গল্পের ঝুলি খুলে বসেন আবার, শোনাতে শুরু করেন বোল্টের ছোটবেলার গল্প।
‘ছোট্ট’ উসাইনের বয়স যখন পাঁচ বছর, তাঁকে ভর্তি করা হয় ‘ওয়ালডেনশিয়া প্রাইমারি’ নামের একটি স্কুলে, সেখানেই দৌড়ে প্রথমবারের মতো হাতেখড়ি হয় তাঁর। ছোটবেলা থেকেই দারুণ সপ্রতিভ বোল্ট শিশু অবস্থাতেই ১০-মিটার দৌড়ে কতগুলো পদক যে জিতেছেন, হিসেব নেই। এরপর চলে এলেন ‘উইলিয়াম নিব মেমোরিয়াল হাই স্কুল’-এ, এখানেই ফুটবল-ক্রিকেটসহ আরও অনেক খেলার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। ফুটবলটা দারুণ খেলতেন, মাঠে তাঁর চেয়ে দ্রুততর আর কোনো খেলোয়াড় ছিলো না। আর বল পায়ে তাঁকে আটকানোও ছিলো ডিফেন্ডারদের জন্য রীতিমতো স্বপ্ন। এখনও তিনি বিশ্বাস করেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে চড়িয়ে মাঠ মাতানোর মতো সামর্থ্য ছিলো তাঁর।
ক্রিকেটটাও দারুণ খেলতেন তিনি, ছিলেন স্কুল ক্রিকেট টিমের অন্যতম প্রধান সদস্য। দারুণ প্রাণোচ্ছ্বলতা এবং সূক্ষ্ম রসবোধ তাঁকে খুব সহজেই করে তুলেছিলো দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে। আর এখানেই প্রথমবারের মতো সিনেমাটিক টুইস্ট এলো উসাইনের জীবনে। মেন্টরিং করতে করতেই হঠাৎই ঐ স্কুলের ক্রিকেট কোচ উপলব্ধি করলেন, উসাইন আসলে ক্রিকেটের তুলনায় অ্যাথলেটিক্সেই আরও বেশি ভালো করতে পারবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। কোচের মুখে এই কথা শুনে ঠিক করে ফেললেন, অ্যাথলেটিক্সের দিকেই মনোযোগী হবেন এবার।
“আমি ঠিক করেই নিয়েছিলাম, স্প্রিন্টারই হবো। নাহ, কারণ এটা ছিলো না যে আমিই স্কুলের সবার থেকে দ্রুত দৌড়াতে পারি, বরং আমি জানতাম এতে রাজনীতি কিংবা যোগসূত্র করে-টরে তেমন লাভ নেই। টিম গেমে যেটা হয়, আপনি সেরা কী সেরা নন, তা হয়তো বেশ কিছু মানুষের মতামতের উপর নির্ভর করতে পারে। স্প্রিন্টে এত ঝামেলা-টামেলা নেই ভাই; হয় আপনি সেরা, নতুবা কিছুই না। এতে এতো রাজনীতির জায়গা নেই কোনো।”
অ্যাথলেটিক্সে মাত্র ১৫ দিনের মতো প্র্যাকটিসেই নেমে গেলেন স্কুলের ২০০ মিটার দৌড়ের ইভেন্টে, যেখানে তিনি টাইমিং করে বসলেন ২২.০৪ সেকেন্ড! নাহ, জিততে পারেননি সেই দৌড়ে, হয়েছিলেন দ্বিতীয়। কিন্তু সেদিনই সবাই বুঝে ফেলেছিলেন, ছেলেটা অনেক দূর যাওয়ার ক্ষমতা রাখে! উইলিয়াম নিব হাই স্কুলের হেড অফ স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট লরনা থর্পকে বোল্টের কথা বলতেই তিনি রীতিমতো আবেগী হয়ে পড়েন,
“আমরা ওকে ওর ক্যারিয়ারের প্রথম ট্র্যাক শ্যু কিনে দিয়েছিলাম। ওর যখন যা প্রয়োজন হয়েছে, আমরা সেটাই ওকে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছি। ও যখন বেইজিংয়ে জিতলো, আমি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। ফ্যালমাউথে আমি একটা বিগ স্ক্রিন সেটআপ করেছিলাম, যাতে অন্য অনেকে এসে একসাথে দেখতে পারে ওর দৌড়। আমরা নাস্তা দিয়েছিলাম, দুপুরের খাবার দিয়েছিলাম। সবাই সোল্লাসে চিৎকার করছিলো, আর উসাইনের প্রশস্তি গাইছিলো।”
প্রতিটি কথায় গর্বের ছাপ ছিলো স্পষ্ট!
এই সাফল্যের পর উসাইন এবার প্রবল উৎসাহের সাথে প্র্যাকটিস করতে শুরু করে দেন, এবার তাঁর মেন্টর হিসেবে নিযুক্ত হন সাবেক জ্যামাইকান স্প্রিন্টার এবং সাবেক অলিম্পিয়ান পাবলো ম্যাকনেইল। তাঁর তত্ত্বাবধায়নে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই প্রথমবারের মতো জেতেন ২০০ মিটার স্প্রিন্টে হাই স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপ রৌপ্যপদক, যা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে আরও। পরের বছর, অর্থাৎ মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি কিংস্টনে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ’ টুর্নামেন্টে ২০০-মিটার স্প্রিন্টে অংশগ্রহণ করেন এবং স্বর্ণপদক জেতেন। বলা বাহুল্য, তিনিই ছিলেন এই ইভেন্টে সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ ওয়ার্ল্ড-জুনিয়র স্বর্ণপদকজয়ী অ্যাথলেট। এরপর ৪ x ১০০ মিটার রিলে এবং ৪ x ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে রৌপ্যপদক জিতে নিজের সম্ভাবনার জানান দেন।
কিন্তু সেরাটা বুঝি জমিয়ে রেখেছিলেন পরের আসরের জন্য। ঠিক এর দু’বছর বাদেই জুনিয়র ২০০-মিটার স্প্রিন্টে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টাইমিং নামিয়ে আনেন ২০ সেকেন্ডের নিচে, সেবার তাঁর টাইমিং ছিলো ১৯.৯৩ সেকেন্ড! তিনি যে কতটা অবিশ্বাস্য ছিলেন, সেটা জানা যায় সাবেক ১০০ মিটার বিশ্বরেকর্ডধারী কানাডিয়ান স্প্রিন্টার ডনোভান বেইলীর মুখে,
“একেবারে ছোট্ট থাকতে সে যেই গতি এবং ধৈর্য্য দেখিয়েছে, রীতিমতো অবিশ্বাস্য! ওর জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যাপার ছিলো, শুরু থেকেই দারুণ কোচিং পেয়েছে সে। এজন্য একদম প্রথম দিন থেকেই সে ছিলো ব্যতিক্রমী, অসাধারণ!”
এরপর আর তাঁকে থেমে থাকতে হয়নি, খুব দ্রুতই সুযোগ পেয়ে যান জাতীয় পর্যায়ে। তাঁকে নিয়ে এতোটাই উৎসাহী ছিলো জ্যামাইকান অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন, ইনজুরি থাকা সত্ত্বেও ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিক দলে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। স্বপ্নপূরণের আশায় বিভোর হয়ে বোল্টও সওয়ার হলেন দলের সঙ্গে। তবে মধুর দিনগুলো কাটতে তেমন সময় লাগেনি, হিটেই বাদ পড়লেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ইনজুরিতে পড়ে বেশ কিছুদিনের জন্য ট্র্যাকের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হলেন।
সেখানেই ক্ষান্ত দেওয়ার মতো মানুষ বোল্ট নন, তাই ইনজুরি কাটিয়ে ট্র্যাকে ফিরেই আগুন ঝরাতে শুরু করলেন। ২০০৫-০৬ মৌসুমে উঠে এলেন বিশ্ব র্যাংকিংয়ে শীর্ষ পাঁচে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আবারও ইনজুরিতে পড়ে গিয়ে মৌসুম আর শেষ করতে পারলেন না।
২০০৭ সালে ফেরার পর নিজের তৃতীয় ইভেন্টেই ২০০ মিটার স্প্রিন্টে জাতীয় রেকর্ড ভেঙে ফেললেন, এর আগে ডোনাল্ট কোয়ারির অধিকৃত প্রায় ৩০ বছরের পুরোনো রেকর্ড অনায়াসেই ভেঙে দিলেন তিনি। এরপর জাপানের ওসাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দুইটি রৌপ্যপদক অধিকার করলেন। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে ১০০ মিটার স্প্রিন্টেও নিজের সেরা টাইমিং ১০.০৩ সেকেন্ড থেকে কমিয়ে একবারে নিয়ে আসেন ৯.৭৬ সেকেন্ডে! এই সাফল্য তাঁর স্বপ্নকে আরেকটু বাড়িয়ে দিলো; ঘোষণা দিলেন, বেইজিং অলিম্পিকে ১০০ মিটার এবং ২০০ মিটার, দুইটি ইভেন্টেই দৌড়াবেন। এরপর বাকিটা গোটা বিশ্বের জানা, সকলেই দেখেছে একের পর এক ইতিহাস গড়তে থাকা বোল্টকে।
কিন্তু বাবা-মা ঠিক কবে বুঝতে পেরেছিলেন, উসাইন বোল্ট সত্যিই সম্ভাবনাময়? কিংবা তাঁরা কি আদৌ সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন?
জেনিফারের ভাষ্যমতে, অন্য যে কারও থেকে আগেভাগে উসাইনের সামর্থ্য বুঝতে পেরেছিলেন জেনিফারের বাবা। তিনি বরাবরই বলতেন, “এই ছেলের মধ্যে কিছু একটা আছে!” অবশ্য তিনি নিজেও যে একেবারেই কিছু বুঝতে পারেননি, সেটাও নয়। সেটাকেই তিনি বরং বলেছেন একটি উদাহরণের সাহায্যে,
“ওর বয়স তখন মাত্র তিন সপ্তাহ। আমার মনে আছে, আমি ওকে খাটে শুইয়ে রেখে একটু উঠে গিয়েছিলাম, তখন ও আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিলো। তড়িঘড়ি করে আমি যখন মাত্রই রুমে ঢুকলাম, আবিষ্কার করলাম, সে নিজে নিজেই উঠে আসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে! এত্ত শক্তিশালী ছিলো আমার ছেলেটা, সেই তখন থেকেই!”
ছোট্ট সেই উসাইন এতদিনে হয়ে উঠেছে কিংবদন্তী, হয়ে উঠেছে কোটি প্রাণের হৃৎস্পন্দন। সেই উসাইন, আর এখনকার ‘উসাইন বোল্ট’, পার্থক্যটা কোথায়? “পার্থক্য বলতে, উসাইন সাফল্য পাওয়ার আগে আমি কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারিনি। আর এখন ইতোমধ্যেই আমার জাপান, চীন, ইউরোপ, সব ঘোরাটোরা শেষ! তবে একটা সমস্যা হয়েছিলো মোনাকোতে গিয়ে…” বলেই হাসলেন জেনিফার, “…ওয়ার্মকোট নিতে ভুলে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে দিনরাত ২৪ ঘন্টা দুটো সোয়েটার পরে ঘুরে বেড়াতে হতো!” বোঝা গেলো, রসবোধ ব্যাপারটা জিনগতভাবেই পেয়েছেন বোল্ট!
কিন্তু এখনও কেন গ্রামের বাড়িটি ছাড়েননি তাঁরা? উত্তরটা জেনিফার দিলেন বেশ সুন্দর করেই,
“কোনোদিন এই বাড়ি ছাড়বো না, কোনোদিন না! শুধু ছিঁচকে চোর ছাড়া এখানে অন্য কেউ আপনার ব্যক্তিগত জীবনে অনধিকার চর্চা করতে আসে না। প্রচন্ড গরম পড়লে আপনি নিশ্চিন্তে দরজা খুলে রেখেই ঘুমাতে পারেন, কেউ কিছু বলতে আসবে না!”
ফিরে যাওয়া যাক বোল্টের শৈশবে, এবার দেখা যাক বোল্টের দৃষ্টিকোণ থেকে। বাবা মুদি দোকানের পাশাপাশি একটি কফি কোম্পানিতেও খন্ডকালীন চাকরি করতেন, তবু সংসারে অভাব-অনটন যেন লেগেই ছিলো। তবে কোনোদিন কোনোকিছু থেকে বঞ্চিত করেননি উসাইনের বাবা, বরং যখন যা চেয়েছে ছেলেমেয়ে, হাজির করেছেন হাসিমুখে। এখনও ছোটবেলার কথা মনে করলেই বোল্ট গড়গড় করে বলে চলেন বাবার জীবন সংগ্রামের গল্প।
বাবা-মা কেমন উৎসাহ দিয়েছেন বোল্টকে? বেড়ে ওঠার সময়টুকুতে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা অনুভব করেছেন কি? বোল্টের কাছে উত্তরটা এলো চিরাচরিত রসাত্মক ভঙ্গিমাতেই, “আমার রেসগুলো মা-বাবা একেবারেই মিস করেন না, মাঠে উপস্থিত থেকেই উপভোগ করেন, আমাকে উৎসাহ যোগান। কিন্তু মা আমাকে এখানে আদর দিয়ে বাঁদর বানায়, ওদিকে বাবা গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে আমাকে প্র্যাকটিস করতে পাঠায়!”
বাবা ওয়েলেসলি এখনও সেই মুদি দোকানটাই চালান, সেখানে সেদ্ধ ডিম থেকে শুরু করে গরুর মাংস পর্যন্ত সব পাওয়া যায়। ছেলে বিশ্বজয় করে ফেলেছে, তবু এই ব্যবসাতেই আছেন কেন তিনি? উত্তরটা খুব সাদাসিধে, “কারণ, দিনশেষে আমি একজন মুদি দোকানদার, এটাই আমার জীবিকা। আমার ছেলে হতে পারে নামকরা অ্যাথলেট, কিন্তু আমার পরিবার, বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের কাছে আমার পরিচয় খুব সামান্য – আমি ওয়েলেসলি বোল্ট, একজন ক্ষুদ্র মুদি দোকানদার!” মাটিতে পা রাখতে শেখার জ্ঞানটা যে পেয়েছেন পরিবার থেকেই, সেটাও পরিষ্কার হয়ে গেলো স্রেফ একটা কথাতেই!
বোল্টের শুরুটা হয়েছিলো বেশ অদ্ভুত একটা ঘটনার মাধ্যমে। বোল্ট তখন ১২ বছর বয়সী এক কিশোর। স্থানীয় একজন ধর্মযাজক তাঁর প্রিয় বন্ধু রিকার্ডো গেডেসের সঙ্গে বোল্টকে তর্ক করতে দেখতে পেলেন, বিষয় কে বেশি দ্রুত দৌড়াতে পারে। শুনে মজা করেই ওই যাজক বললেন, “তাহলে হয়ে যাক পাল্লা! দেখা যাক, কে জেতে!” বাজির মূল্যমান হিসেবে ধার্য করা হলো দুপুরের খাবার। যথাসময়ে শুরু হলো দুইজনের দৌড়, পরাজিত হলেন গেডেস। শোনা যায়, প্রতিযোগিতাটির স্থান পরিত্যাগ করার আগে ঐ যাজক বোল্টকে বলেছিলেন, “গেডেসকে হারাতে পেরেছো যখন, তোমার জন্য কাউকে হারানোই অসম্ভব নয়!” সেই সাথেই জন্ম হলো একজন তারকার, উসাইন সেন্ট লিঁও বোল্ট!
এরপর যতদিন গিয়েছে, নিজেকে আরও শাণিত করে তুলেছেন, হয়ে উঠেছেন আরও ধারাবাহিক। নিজেকে এমন উচ্চতায় তুলে এনেছেন, যার কাছাকাছি যাওয়ার স্বপ্নও মানুষ দেখার সাহস পায় না। একই সাথে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন মানুষের সামর্থ্যের সীমা নিয়ে, একজন মানুষ আসলে ঠিক কতটা দ্রুত হতে পারেন? তিনিই কি অবিসংবাদিতভাবে সবার সেরা? যদি না হয়, তবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আর কে হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? সেটার উত্তর দিতে কিছু ব্যাপার জানা থাকা প্রয়োজন।
রেকর্ডের সাথে তাঁর সম্পর্ক বিশেষ রোমাঞ্চকর, ট্র্যাকে তিনি নামতেনই যেন রেকর্ডকে নতুন করে গড়ার জন্য। রেকর্ডের ভাঙা-গড়াটা এতো সহজ করে ফেলেছিলেন, দেখে মনে হতো এর চেয়ে সহজ কাজ বুঝি দুনিয়াতে একটাও নেই! বেইজিং অলিম্পিকে যখন ৯.৬৯ সেকেন্ড টাইমিং করে পূর্ববর্তী ৯.৭২ সেকেন্ড টাইমিংয়ের রেকর্ড গড়লেন, শেষ ২০ মিটার রীতিমতো মার্চ করতে করতে শেষ করেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায়, “শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমি আমার গতি কমিয়ে দিয়েছিলাম, একদমই ক্লান্ত ছিলাম না। আমি এমনকি আবার স্টার্টে ফিরে গিয়ে আরেকবারও শেষ করতে পারতাম।” একইসাথে আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি। বেইজিং ১০০ মিটার ইভেন্টে বিশ্বরেকর্ড গড়ার পথে তাঁর মূল জ্বালানি কী ছিলো জানেন? ম্যাকডোনাল্ডসের চিকেন নাগেটস! অলিম্পিকের মতো একটি আসরে ট্র্যাকে নামার আগে বিন্দুমাত্র ডায়েটিংয়ের প্রয়োজন বোধ করেননি। বোল্টের চরিত্রের এই দিকটিও একেবারেই অনন্য। দৌড়টি শেষ হওয়ার পর ইউনিভার্সিটি অফ অসলো একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে, বোল্টের পক্ষে ৯.৫৫ সেকেন্ডে ওই রেসটি শেষ করা সম্ভব ছিলো! প্রশ্ন উঠলো, সেটাই কি মানুষের সামর্থ্যের সীমা?
খুব সম্ভবত তাতে কিছুটা অপমানিত বোধ করেছিলেন বোল্ট। তাঁকে বাঁধা-ধরা সীমার মধ্যে আটকে দেওয়ার প্রচেষ্টা, তিনি মানবেন কেন? সেই জেদ থেকেই কিনা কে জানে, ২০০ মিটার স্প্রিন্টে করে টাইমিং করে বসলেন ১৯.১৯ সেকেন্ড, আবারও একটি বিশ্বরেকর্ড! পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা ভালো, প্রথম ১০০ মিটারে তাঁর টাইমিং ছিলো ৯.৯০ সেকেন্ড। অর্থাৎ শেষ ১০০ মিটারে তাঁর টাইমিং ছিলো অবিশ্বাস্য, ৯.২৯ সেকেন্ড!
যদি ভেবে থাকেন, এর থেকে দ্রুততর আর কিছু হতে পারে না, লন্ডন বিশ্বকাপে আপনাকে আরেকবার ভুল প্রমাণ করেছেন বোল্ট। ৪ x ১০০ মিটার রিলে দৌড়ে নিজের লেগে তিনি দৌড়েছেন ৮.৭০ সেকেন্ডে! এই মানুষটা আর যা-ই হোক, নিজের সামর্থ্যের সীমাটাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এমন উচ্চতায়, যাতে ওঠার সামর্থ্য আর কারও হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে যথেষ্ট। আর সেটাই নিশ্চিত করেছে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, ইতিহাসে হয়েছেন চিরভাস্বর।
পরিবার, পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থা, টিম স্পিরিট, শৃঙ্খলা, নিরহঙ্কার মনোভাব, পরিশ্রম, প্রতিভা, ধৈর্য্য এবং অধ্যবসায় – বোল্টের উঠে আসার গল্পের পেছনে মূল ভূমিকা এই কয়েকটি কী-ফ্যাক্টরের। তাঁর জীবনের গল্পটুকুই বুঝিয়ে দেয়, তাঁর অবিশ্বাস্য সব কীর্তি কোনোমতেই প্রকৃতির নিছক খেয়াল বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিজ যোগ্যতাতেই তিনি হয়ে উঠেছেন সর্বকালের সেরা দৌড়বিদ, ‘দ্য ফাস্টেস্ট ম্যান অ্যালাইভ অন আর্থ’!
বোল্ট নিজে অবশ্য তাঁর সফল ক্যারিয়ারের পিছনে মূল কৃতিত্ব দেন তাঁর বাবা-মা, শিক্ষকবৃন্দ, কোচ গ্লেন মিলস এবং ম্যানেজার নরম্যান পিয়ার্টকে। পিয়ার্টই তাঁকে রাজি করিয়েছিলেন পেশাদারি জীবনে নাম লেখাতে। এছাড়াও তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সতীর্থ আসাফা পাওয়েল, মরিস স্মিথ এবং ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউনকে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বোল্টকে দারুণভাবে সহায়তা করেছেন তাঁরা।
কিন্তু বোল্টকে কেন মনে রাখবে অ্যাথলেটিক্স বিশ্ব? ২০১৬ অলিম্পিকে ১০০ মিটারে সোনা জেতার পর উত্তরটা বোল্ট দিলেন বেশ মজা করেই, “আমি যেটা প্রমাণ করবো বলে এসেছিলাম, সেটা আমি করেছি। সবার উপরে চড়ে বসতেই বেশি পছন্দ করি আমি, ইউ নো হোয়াট আই মীন?” পরে ২০০ মিটারেও আরেকটি স্বর্ণজয়ের পর একই প্রশ্নের জন্য যেই উত্তরটি দিলেন, খুব সম্ভবত তার চেয়ে ভালো উত্তর আর হতে পারে না,
“আমাকে গ্রেটেস্ট হওয়ার জন্য আসলে আর কী কী করতে হবে? আমি সেরাদের একজন হয়ে উঠতে চেয়েছি সবসময়ই, উঠতে চেয়েছি মোহাম্মদ আলী কিংবা পেলের সমান উচ্চতায়। আমি খেলাটাকে এক্সাইটিং করে তুলেছি, মানুষকে এই খেলা দেখার জন্য উৎসাহী করে তুলেছি। গোটা ক্রীড়াঙ্গনেই স্প্রিন্টকে করে তুলেছি আরও মহিমান্বিত, নিয়ে গেছি অনন্য উচ্চতায়। অ্যাথলেট হিসেবে আমার কাজটা আমি করেছি, এবার আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন খেলাটিতে আমার স্থানটা ঠিক কোথায়! আমার মনে হয়, আমি প্রমাণ করেছি যে আমি অনন্য, অন্যদের থেকে একদম আলাদা। আমার মতো আর কেউ আসবে না কোনোদিন, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।”
সে ব্যাপারে আমাদেরও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শেষটা বিষাদবিধুর হলেও দিনশেষে সেরা যে তিনিই! কিংস্টনের ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা এক লিকলিকে ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা এক যুবককে গোটা বিশ্ব তাই এখন থেকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। সকলেই মনে রাখবে, স্প্রিন্টের শেষ কথা একজনই, উসাইন ‘দ্য লাইটনিং’ বোল্ট!