গল্পটা যেন ঠিক সিনেমাকেও হার মানায়।
ছয় ভাইয়ের সংসার। বাবা রেগি রানাতুঙ্গা রাজনীতিবিদ, মা স্কুল শিক্ষক। ছয় ছেলেকে মানুষ করতে অনেক চড়াই-উৎড়াই পারি দিতে হয় বাবা-মাকে।
আর্থিক টানাপোড়েন বলতে যা বোঝায়, সেটা না থাকলেও প্রায়ই রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হতে হয় ছয় ভাইকে। একবার শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচনের পর তো পুরো পরিবারকে রীতিমতো রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হয়েছিল।
না, পরিবারটা এত সহজে ভেঙে পড়ার পাত্র ছিল না। স্বামী-স্ত্রী মিলে অসংখ্য বন্ধুর পথে লড়াই করে ছেলেদের বড় করেছেন। রেগি রানাতুঙ্গা নিজে সরকারের একজন সম্মানিত প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর পদও পেয়েছিলেন।
এর মধ্যেই ১৯৬৩ সালের এক ডিসেম্বরে তার জন্ম। ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবার রাজনৈতিক জীবন, ছয় ভাইকে নিয়ে মায়ের সংগ্রাম- সবটাই তিনি দেখেছেন চোখের সামনে থেকে।
হয়তো কখনো আক্ষেপ করেছেন। ভেবেছেন, জীবনটা আরো সহজ হতে পারতো। কিন্তু, দমে যাননি। বরং শৈশব-কৈশোরের কাঠিন্য তাকে ভবিষ্যতের একজন সত্যিকারের সিংহ হিসেবেই গড়ে তুলেছে।
তাই তো, যে ছেলের পরিবারকে একদিন রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হয়েছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে, সেই ছেলেই একদিন দেশকে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় একটা আনন্দে ভাসান। দেশকে এনে দেন নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা।
অথচ, ১৯৯৬ সালের সেই বিশ্বকাপের আগে শ্রীলঙ্কার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনাই ছিল না, আলোচনা যা ছিল তা ঐ শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে অনেক জল ঘোলার পর গ্রুপ পর্বে লঙ্কায় অনুষ্ঠিত ম্যাচগুলো খেলতে অস্বীকৃতি জানায় অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ভাগ্যের কী পরিহাস!
সেই অস্ট্রেলিয়াকেই ফাইনালে হারায় শ্রীলঙ্কা। সেই শ্রীলঙ্কা, যাদের বিশ্বকাপ শুরুর আগে কেউ সেমিফাইনালেও দেখছিল না। লঙ্কানদের সেই বিশ্বকাপ দলটা শক্তিমত্তায় মোটেও বাকিদের চেয়ে এগিয়ে ছিল না। লঙ্কানদের শক্তি ছিল একটাই- সাহস আর আত্মবিশ্বাস। আর এর সবটুকুই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দলের সেনাপতি রানাতুঙ্গা।
এমনিতে ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিসংখ্যানটা তাঁর সাদামাটাই বলা যায়। ৩৬২টির মতো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন, সব মিলিয়ে করেছেন সাড়ে ১২ হাজারের মতো রান। ব্যাটিং গড় ৩৫ এর সামান্য ওপরে। মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে পেয়েছেন ১০০’রও কম উইকেট।
লঙ্কান ক্রিকেটে, বা বলা উচিত বিশ্ব ক্রিকেটে রানাতুঙ্গার গুরুত্ব অন্য জায়গায়। শ্রীলঙ্কাকে বড় দল হিসেবে তিলে তিলে গড়ে তোলার পেছনেও সবচেয়ে বড় অবদান বিরাট শরীরের এই ভদ্রলোকের। ১৮ বছরের লম্বা ক্যারিয়ারটা রানাতুঙ্গা যখন শুরু করেন, তখন স্রেফ নামেই সিংহ ছিল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল। কিন্তু, যখন শেষ করেন, তখন আসল সিংহ হয়ে উঠেছিল দলটি। রানাতুঙ্গার হাত ধরেই একগাদা কিংবদন্তির আবির্ভাব দেখে শ্রীলঙ্কা। অরবিন্দ ডি সিলভা, সনাৎ জয়াসুরিয়া, মুত্তিয়া মুরালিধরন, চামিন্দা ভাসদের বড় করেছেন তিনি। কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনেদের শুরুটাও রানাতুঙ্গা যুগেই।
রানাতুঙ্গার ক্যারিয়ারের শেষটা হয়েছিল একটু নেতিবাচকভাবেই। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে তিনি শ্রীলঙ্কাকে যে অবস্থানে উঠিয়েছিলেন, তার ধারাবাহিকতা রাখা যায়নি ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে। এবার ইংল্যান্ডেও রানাতুঙ্গাই অধিনায়ক ছিলেন। দল ভাল করতে পারেনি, রানাতুঙ্গা হারান অধিনায়কত্ব। আর তাঁর ফিটনেস নিয়ে তো সব সময়ই একটা অস্থিরতা ছিলই। এরপর আর মাত্র এক বছরই স্থায়ী হয় তাঁর ক্যারিয়ার।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ বছরই তিনি অবিস্মরণীয় এক কীর্তি করে বসেন। ২০০০ সালের জুনে শ্রীলঙ্কা নিজেদের ইতিহাসে শততম টেস্ট খেলতে নামে। রানাতুঙ্গা ছিলেন সেই ম্যাচে, যেমন তিনি ছিলেন শ্রীলঙ্কার অভিষেক টেস্টেও। তিনি হলেন ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি দেশের অভিষেক ও শততম দুই টেস্টের দলেই ছিলেন।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে রাজনীতিতে নামতে খুব বেশি দিন সময় নেননি রানাতুঙ্গা। ২০০১ সালে তিনি ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। এরপর দ্রুতই যোগ দেন শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টিতে। কলম্বো থেকে সেই বছরই সংসদ নির্বাচন করেন তিনি। ২০০৪ সালে এই ফ্রিডম পার্টি ক্ষমতায় আসলে রানাতুঙ্গাকে ইন্ডাস্ট্রি, ট্যুরিজম অ্যান্ড ইনভেস্ট প্রমোশন মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রানাতুঙ্গা ক্রিকেট রাজনীতির সাথেও নিজের নাম জড়িয়েছেন। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে তাকে দেশটির ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের (এসএলসি) সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই সময় লঙ্কান ক্রিকেট প্রশাসনে বেশ রদবদল চলছিল। রানাতুঙ্গা ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো পরিবর্তনে ছিলেন বেশ সরব। যদিও, বেশি দিন তিনি বোর্ডে স্থায়ী হতে পারেননি। ওই বছর ডিসেম্বরেই সেই কমিটি ভেঙে দেয় দেশটির ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। বরখাস্ত হন রানাতুঙ্গা। তৎকালীন ক্রীড়া মন্ত্রী গামিনি লকুগে বলেছিলেন, “খেলোয়াড় বা বোর্ডের অন্যান্যরা- কারো সাথেই বনিবনা নেই রানাতুঙ্গার। আমরা ব্যাপারটা মিটমাট করার চেষ্টা করেছিলাম। হয়নি, তাই ওকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।“
রানাতুঙ্গা বরাবরই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের কড়া সমালোচক ছিলেন। আর বোর্ড সভাপতি হিসেবে তিনি রীতিমতো ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। আইপিএলের দ্বিতীয় আসরের সময় ইংল্যান্ড দল এসেছিল শ্রীলঙ্কা সফরে। এমন ঘটনা ক্রিকেটে আজকাল আর ঘটে না।
একবার তিনি বলে বসলেন, “টি-টোয়েন্টি হলো তিন মিনিটে বানানো ম্যাগি নুডলস। একটু ব্যাঙ ব্যাঙ, আর শেষ। আমার জন্য এটা কোনোভাবেই ক্রিকেট নয়। এটা কেবল কিছক্ষণের ক্ষমতা প্রদর্শন। গ্রেট খেলোয়াড়রা কী করে এর সাথে নিজেদের মানিয়ে নেবেন?” একই সাক্ষাৎকারেই “আইপিএল ক্রিকেটের জন্য ভাল নয়” এমন বেফাঁস মন্তব্য করে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) চক্ষুশূলে পরিণত হন রানাতুঙ্গা।
২০১০ সালে রানাতুঙ্গা ফ্রিডম পার্টি ছেড়ে দেন। যোগ দেন ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের (ডিএনএ) দল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে। তিনি ছিলেন এই রাজনৈতিক দলটির দ্বিতীয় নেতা। ২০১২ সালের নভেম্বরে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টি ছাড়েন, যদিও তখনও তার সাথে ডিএনএ’র ভাল বোঝাপড়া ছিল। ২০১৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রানাতুঙ্গা মৈথিরিপালা সিরিসেনার পক্ষে ছিলেন। সিরিসেনার জয়ের পর তিনি হাইওয়ে, পোর্টস অ্যান্ড শিপিং মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন।
২০১৫-১৬ মৌসুমেও রানাতুঙ্গা বোর্ডে আসার চেষ্টা করেছিলেন। তবে, তিনি ও তাঁর ভাই নিশান্থ রানাতুঙ্গা বোর্ড নির্বাচনে হেরে যান থিলাঙ্গা সুমাথিপালার বিপরীতে। বোর্ডের সাথে সরাসরি সম্পর্ক এখন না থাকলেও লঙ্কান ক্রিকেটের কঠিন দিনে প্রায়ই তার নাম শোনা যায়। গেল নভেম্বরেই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর আইন পাশ হয় দেশটির সংসদে। আর এর সবচেয়ে বড় সমর্থকদের একজন ছিলেন বর্তমানে মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা রানাতুঙ্গা।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে রাজনীতিতে যাওয়ার অসংখ্য নজীর দেখা যায়। পাকিস্তানের ইমরান খান, ভারতের শচীন টেন্ডুলকার, আজহারউদ্দিন, নভজোৎ সিং সিধু- অসংখ্য নজীর পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মাশরাফি বিন মুর্তজা কিংবা শ্রীলঙ্কার সনাৎ জয়াসুরিয়া তো খেলোয়াড়ী জীবনের মাঝেই রাজনীতির পথে হেঁটেছেন।
তবে, এতসব কিংবদন্তির কারো সাথেই মেলানো যাবে না রানাতুঙ্গাকে। কারণ, রানাতুঙ্গার জন্মই আসলে হয়েছে রাজনীতির জন্য। রাজনীতির রক্ত তাঁর শরীরে, আর রাজনীতির ময়দানে লড়াই করার শক্তিটা তিনি পেয়েছেন ক্রিকেট মাঠ থেকে।
রানাতুঙ্গা নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি মনে করি, ক্রিকেট আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছে। আর সেটা শুধু পরিচিতিই নয়, এটা আমাকে অনেক লোকের সাথে সামঞ্জস্য রাখার সক্ষমতাও দিয়েছে। ক্রিকেট থেকেই আমি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছি। আমি সব সময়ই বলি, সংসদে আসার আগে রাজনীতিবিদদের ক্রিকেট খেলা উচিত। এর ফলে তারা খেলা শিখবে, শিখবে কী করে একটা গোষ্ঠীতে কাজ করতে হয়।“
রাজনীতিবিদ হিসেবে রানাতুঙ্গার জীবনটা পুষ্পসজ্জার নয়। অবৈধ গোলাগুলির সাথে জড়িত থাকার কারণে বছরখানেক আগেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। আবার ছাড়াও পেয়েছেন। অনেক ঝড়ঝাপ্টাই যায় তার ওপর দিয়ে। কিন্তু, সব কিছুর পরও তিনি অবিচল দাঁড়িয়ে থাকেন, ঠিক যেমনটা থাকতেন বাইশ গজে!