ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের দিন গণনা শুরু হয়ে গেছে। এই উপলক্ষে সব দল-ই এখন নিজেদের সেরা একাদশ সাজাতে ব্যস্ত। ভারত এবং ইংল্যান্ড যেখানে কোন পনেরো জনের স্কোয়াড ঘোষণা করবে, সেটা নিয়ে মধুর সমস্যায় আছে, সেখানে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া এখনও নিজেদের সেরা একাদশেরই খোঁজ পায়নি। একের পর এক ম্যাচে পরাজিত হতে হতে রীতিমতো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের।
অস্ট্রেলিয়া নিজেদের সর্বশেষ ২০টি ওয়ানডেতে মাত্র দু’টিতে জয়ের দেখা পেয়েছে। স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নারদের বল টেম্পারিং কেলেঙ্কারির পর যোগ্য অধিনায়কও খুঁজে পাচ্ছেনা তারা। পেইন, ফিঞ্চদের শরণাপন্ন হলেও এখনও কেউ ধারাবাহিক সফলতা এনে দিতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়া যে সময়ে দু’টি ওয়ানডেতে জয় পেয়েছে, একই সময়ে পাপুয়া নিউগিনি এবং হংকং তিনটি করে ওয়ানডে জিতেছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত ছয়টি এবং স্কটল্যান্ড নয়টি ওয়ানডেতে জয় পেয়েছে।
গত কয়েক বছরে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে, কিন্তু পাল্টায়নি তাদের মাঠের পারফরমেন্স। পায়ের নিচে মাটি খুঁজে না পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার সফলতা পাওয়ার জন্য যে দিকগুলোর প্রতি জোর দিতে হবে, সেগুলো সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
মোর দ্যান আ হান্ড্রেড
বর্তমানে ওয়ানডে ক্রিকেটের শীর্ষ দুই দল ভারত এবং ইংল্যান্ডের প্রধান শক্তি হলো, তাদের টপ অর্ডাররা নিয়মিত বড় ইনিংস খেলছেন। কেউ একজন উইকেটে থিতু হয়ে গেলে বড় শতক হাঁকিয়েই তবে সাজঘরে ফেরেন। কিছুদিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মাও সেটাই করে দেখিয়েছেন। যেদিন যে ব্যাটসম্যান উইকেটে সেট হয়েছেন, ঐদিন তিনিই দলকে ভালো সংগ্রহ এনে দিয়েছেন। শতক হাঁকিয়েই নিজেদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসেননি, টিকে থেকে রাজত্ব করেছেন।
বর্তমানে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা শুধুমাত্র শতক হাঁকিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন না, ছোট শতক হাঁকিয়ে আউট হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে নিজেদের ইনিংসকে বড় করছেন। এদিক দিয়েও অস্ট্রেলিয়া পিছিয়ে আছে। ২০১৭ সালের শুরুতে মার্কস স্টইনিস ১৪৬ রান এবং শন মার্শের ১৩১ রানের ইনিংস বাদে আর কোনো ব্যাটসম্যানই ১৩০ রানের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। এই একই সময়ে ভারতের ব্যাটসম্যানরা দশবার ১৩০+ রানের ইনিংস খেলেছেন এবং ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা খেলেছেন ছয়বার।
অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ এই বছর ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনটি শতক হাঁকিয়ে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন। কিন্তু তিনিও একটি ইনিংসকেও বড় করতে পারেননি। তার তিনটি শতক হাঁকানো ইনিংস যথাক্রমে ১০৭, ১০৬ এবং ১০০। ম্যাচগুলোতে তিনি কমপক্ষে ইনিংসের দশ ওভার বাকি থাকতে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন।
এই সমস্যাটা অস্ট্রেলিয়ার জন্য খুব বড় সমস্যা না হলেও বর্তমানে ওয়ানডে ক্রিকেটে সফলতা পাওয়ার জন্য টপ অর্ডারের একজন ব্যাটসম্যানকে দায়িত্ব নিয়ে বড় ইনিংস খেলতে হয়। তাই সফলতা পাওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানদেরও বড় ইনিংস খেলতে হবে।
স্পিনের ঊর্ণাজালে
টেস্ট ক্রিকেটে নাথান লায়ন স্পিন ডিপার্টমেন্ট বেশ দক্ষতার সাথে সামলে রাখলেও ওয়ানডেতে এখনও স্পেশালিষ্ট স্পিনের সন্ধানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। অ্যাস্টন অ্যাগার, অ্যাডাম জাম্পা এবং নাথান লায়ন অজিদের ওয়ানডে দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছেন।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাস্টন অ্যাগার পাঁচ ম্যাচ সিরিজের সব ম্যাচ খেললেও দলের চাহিদা মেটাতে পারেননি। অ্যাডাম জাম্পাও দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছেন, শেষ ২০ ম্যাচের মধ্যে দশ ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়ে স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আট উইকেট শিকার করেছেন তিনি। ইংল্যান্ডের কন্ডিশন বিবেচনায় রেখে হয়তো এই লেগস্পিনারই মূল একাদশে জায়গা করে নেবেন।
টেস্ট স্পেশালিষ্ট স্পিনার হিসাবে পরিচিত নাথান লায়ন ওয়ানডেতে খুব একটা সুযোগ পাচ্ছেন না। ওয়ানডেতে অভিষেকের পর থেকে ছয় বছরে মাত্র ১৫ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তবে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং উইকেট বিবেচনায় তার মতো অভিজ্ঞ বোলার যেকোনো দলের জন্য আশীর্বাদ। কারণ সেখানে পার্ট-টাইমার কিংবা অনভিজ্ঞ বোলাররা খুব একটা সুবিধা করতে না পারারই সম্ভাবনা বেশি।
থরহরিকম্প মিডল-অর্ডার
ডেভিড ওয়ার্নার এবং স্টিভেন স্মিথের নিষেধাজ্ঞার ফলে অস্ট্রেলিয়ার টপ-অর্ডারে বড় শূন্যতা দেখা দিয়েছে। শুধুমাত্র টপ-অর্ডারেই নয়, মিডল-অর্ডারেও যোগ্য ব্যাটসম্যান খুঁজে পাচ্ছেনা তারা। ইংল্যান্ডের মাটিতে সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজে মিডল-অর্ডারে অস্ট্রেলিয়া বেশ কিছু ক্রিকেটারকে রদবদল করে খেলিয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চলতি ওয়ানডে সিরিজে ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফেরা ক্রিস লিন এবং গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মতো বিগ-হিটার ব্যাটসম্যানদেরকে মিডল-অর্ডার সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট। এছাড়া টিম পেইনের বদলে অ্যালেক্স ক্যারিকে লম্বা সুযোগ দিচ্ছে অজিরা। মিডল-অর্ডারের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার একটা দুশ্চিন্তা কমবে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারসাম্য
পরিসংখ্যান অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেট কিংবা ছয় হাঁকানোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। ওয়ানডেতে তাদের অনেক সমস্যার তালিকায় এটা উপরের দিকে জায়গা করে নেবে না। এই বছর তারা পাওয়ার-প্লে’র প্রথম দশ ওভারে গড়ে ৫১.২৫ রান সংগ্রহ করেছে। এইরকম শুরুতে যেকোনো দলই সন্তুষ্ট থাকবে, কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে ইনিংসের শুরুতে কিংবা মাঝপথে তারা বেশি উইকেট হারায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ দশটি ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ৪০ ওভারে গড়ে ২১৩ রানের বিনিময়ে ছয় উইকেট হারায়, যার ফলে শেষ দশ ওভারে রান তোলার দায়িত্ব পড়ে লোয়ার-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের কাঁধে।
এইজন্য টপ-অর্ডারের যেকোনো একজন ব্যাটসম্যানকে বড় ইনিংস খেলতে হবে। যার ফলে শেষ দশ ওভারে সহজেই ১০০ রান তুলতে পারবে তারা। ইংল্যান্ডের জেসন রয়, জনি বেয়ারস্টো এবং জো রুট, ভারতের শিখর ধাওয়ান, রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি তাদের ইনিংস বড় করে শেষদিকে ঝড় উঠিয়ে দ্রুত রান সংগ্রহ করে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিগত কয়েক বছরে ডেভিড ওয়ার্নার এই রোল প্লে করেছিলেন। তিনি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ইতিমধ্যে পাঁচবার ১৫০+ রানের ইনিংস খেলেছেন। তার অনুপস্থিতিতে এই দায়িত্ব কে পালন করবে সেটাও অস্ট্রেলিয়ার জন্য ভাববার বিষয়।
পেসার নির্বাচন
মিচেল স্টার্ক, জস হ্যাজলউড এবং প্যাট কামিন্স – এই ‘পেসত্রয়ী’ দুর্দান্ত পারফর্ম করলেও ইনজুরি-সমস্যায় ভুগছেন। অ্যাশেজের পর থেকে ক্রমান্বয়ে তারা ইনজুরিতে পড়তে থাকেন। অস্ট্রেলিয়ার শেষ ২০টি ওয়ানডের মধ্যে জস হ্যাজলউড আটটি, মিচেল স্টার্ক নয়টি এবং প্যাট কামিন্স ১৩টি ম্যাচ খেলেছেন। তবে তাদের জন্য একটি পজিটিভ দিক হলো, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই তিন পেসারই ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফিরেছেন। তবে অনেকগুলো ‘যদি-কিন্তু’ এবং প্রশ্নের ভিড়ে একটি প্রশ্ন হলো, বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ফিট থেকে তারা কতটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে পারবেন?
তাদের অনুপস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়া দলের আশেপাশে থাকা পাঁচজন পেসারকে বাজিয়ে দেখেছে। এর মধ্যে দীর্ঘদেহী পেসার বিলি স্ট্যানলেক তার গতি এবং উচ্চতার কারণে নির্বাচকদের নজরে থাকবেন। এছাড়া কেন রিচার্ডসনও আশাজাগানিয়া বোলিং করেছেন। তরুণ ঝাই রিচার্ডসন এই বছর চারটি ওয়ানডে খেলে সাত উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়ার পেস ডিপার্টমেন্টের একটি অপশন হিসাবে আছেন। এছাড়া ইনজুরিতে জর্জরিত নাথান কোল্টারনাইল তার বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ের সৌজন্যে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ডাক পেয়েছেন। তিনিও অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ-ভাবনায় রয়েছেন।
এর পাশাপাশি টি-টোয়েন্টিতে দুর্দান্ত বোলিং করা অ্যান্ড্রু টাই এবং ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শুরুতেই বাজিমাত করা বাঁহাতি পেসার জেসন বেহরেনডর্ফ ইনজুরি কাটিয়ে প্রস্তুতি ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। তিনি ওয়ানডে দলে সুযোগ না পেলেও হয়তো টি-টোয়েন্টিতে মূল একাদশে জায়গা করে নেবেন।
নিজেদের শেষ ২০ ম্যাচে মাত্র দু’টিতে জয় পাওয়া অস্ট্রেলিয়া এই ২০ ম্যাচে ৩১ জন ভিন্ন ভিন্ন ক্রিকেটারকে খেলিয়েছেন। কোনো ক্রিকেটারই সবক’টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়নি। সবচেয়ে বেশি ১৯ ম্যাচ খেলা ট্রাভিস হেডও দলে একেকবার একেক ভূমিকায় খেলেছেন। কখনও ওপেনার, আবার কখনও মিডল-অর্ডারে ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসাবে খেলেছেন। স্পেশালিস্ট হিসাবে স্পিনার খেলা অ্যাডাম জাম্পাও নিয়মিত একাদশে সুযোগ পাননি। মিডল-অর্ডার এবং উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানদের অবস্থা তো আরও শোচনীয়। ওয়েড, পেইনের পর বর্তমানে ক্যারির শরণাপন্ন হয়েছে ম্যানেজমেন্ট। মিডল-অর্ডারে ক্যামেরন হোয়াইট, হ্যান্ডসকম্ব, কার্টরাইট, মিচেল মার্শ এবং হেনরিক্সরা লম্বা সময়ের জন্য মূল একাদশে সুযোগ পাননি। বিশ্বকাপের আগে স্থিতিশীল লাইনআপ দাঁড় করানোটাই এখন অজিদের মূল চ্যালেঞ্জ।