বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়েছিল ভারত। কিন্তু ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এই টুর্নামেন্টে তারা যোগ দিয়েছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যেই। সেই হতাশা এখনও কাজ করে বিরাট কোহলির মনে। ভারত দলের এই অধিনায়ক এতকিছুর পরও থেমে থাকতে চান না। এগিয়ে যেতে চান সামনের দিনগুলোতে। সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে তিনি কথা বলেছেন বিশ্বকাপ, আসন্ন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, ভারত দল এবং ফিটনেস নিয়ে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাতকারের একাংশ তুলে ধরা হলো-
লাখো মানুষের কাছে আপনি রোল মডেল। লোকে আপনাকে অনুসরণ করে। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়াটা আপনার জন্য কতটা হতাশাজনক ছিল?
আজীবন আমি ব্যর্থতা এবং বাঁধা থেকে শিক্ষা নিয়েছি। এসব বাধাবিপত্তি আমাকে শুধু অনুপ্রাণিতই করেনি, একজন মানুষ হিসেবেও নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সাফল্যের চেয়েও যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু আছে সেগুলো বুঝতে শিখিয়েছে। এগুলো আপনাকে আপনার নিজের জন্য ভাবতে শেখাবে, জীবনের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করতে শেখাবে। তাছাড়া, এসব ব্যর্থতার মুহূর্তগুলোতেই আপনি টের পাবেন কোন মানুষগুলো আপনার পাশে দাঁড়ায় আর কে আরও অনেকের মতোই আপনাকে নিয়ে সমালোচনার জাহাজে লাফ দেয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি নিজেকে সেভাবেই তৈরি করে থাকেন যেভাবে আপনি চাইবেন। তারপরও অনেক সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী সব হয় না। এটা সত্যিই খুব কঠিন যে সবাই ভালো খেলল, তারপরও আপনি হুট করে টের পেলেন আপনার সফর এখানেই শেষ হচ্ছে। এটা হজম করা আরও কঠিন যে আপনি জানেন আপনি খুব বেশি ভুল করেননি, তারপরও আপনি বাদ পড়ছেন। সেদিক থেকে হতাশ তো বটেই।
এই সময়গুলোতে আপনি কিভাবে দলের সাথে মানিয়ে নেন?
আমরা এই সময়ে দলকে যেটা বলি তা হলো, তোমরা যেভাবে খেলেছ তাতে তোমাদের গর্বিত হওয়া উচিত এবং সেটা কখনই তোমরা ভুলে যেও না। আপনি যা করবেন তা নিয়ে অবশ্যই নম্র ও নতমুখ থাকবেন, একই সাথে নিজের তারিফ করতেও ভুলবেন না। দুই জায়গাতে এই ব্যালান্স করাটা খুব জরুরী।
সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ ক্রিকেটাররা পারফরম্যান্সের দিক থেকে সামনে এগিয়ে আসছে। সেদিক থেকে বলতে গেলে এই মুহূর্তে ভারতীয় দলে দলে আপনার অবস্থানটা নেতার পাশাপাশি পরামর্শকের মতোও বটে। নিজের লম্বা এই সফরটা কীভাবে দেখছেন?
আপনি যদি হাল ছেড়ে দেন, তাহলেই আপনি শেষ। আপনি হারবেন, পরিশ্রম করবেন এবং আবার উঠে দাঁড়াবেন; এ ছাড়া সামনে এগোনোর আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। এটাই আপনি বারবার করতে থাকবেন। ধারাবাহিকতা ও সাফল্য আসলে একই জিনিস বারবার প্রতিদিন করার মাধ্যমেই আসে। যদিও এটা বেশ বিরক্তিকর। আমার কাছে ধারাবাহিক সাফল্যও বিরক্তিকর, ব্যর্থতাও বিরক্তিকর। এটা আসলে খুব কঠিন। অনেকটা একই জায়গায় বারবার একই কাজ করার মতো। উদাহরণস্বরূপ, গলফে যেভাবে ‘ওয়ান শট’ অনুশীলন করা হয়। তারা ইউএস ওপেনে বলেন, আর যেখানেই বলেন; একই জিনিস বারবার করতে থাকে। কারণ তারা জানে এগুলোই তাদেরকে চাপের পাড় থেকে বের করে আনবে।
এখন পর্যন্ত ক্রিকেটই আপনার জীবন। এখনও ক্রিকেটের বাইরে কিছু ভেবেছেন? আপনি কি ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করেন?
আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি যে, আপনি যদি ভালো মন নিয়ে নির্দিষ্ট কোনোকিছু শুরু করেন, তাহলে আপনি এর মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করতে পারবেন। … কিন্তু আপনি যদি খ্যাতি কিংবা নিজের ইমেজের জন্য করেন, তাহলে দ্রুতই ধরা পড়বেন।
আমি সবসময়ই এই ব্যাপারটা মেনে চলি যে অন্তত আমি তাদের একজন যে কি না গঠনমূলক কিছু করতে চায়। আমি কখনই কাউকে হতাশ কিংবা খুশি করতে করিনি। আমি এমনই। কাউকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া বা কারো ক্ষতি করার মতো নোংরা চিন্তা আমার কখনোই ছিল না।
দিনশেষে আপনি নিজেই টের পাবেন যে ক্রিকেটের চেয়ে জীবন অনেক বড় ব্যাপার। একজন পেশাদার ক্রিকেটারের কাছে কিছু সময় ক্রিকেট সবকিছু। কিন্তু আমার লক্ষ্য হলো আমার পরিবার, স্ত্রীকেও ততটাই সময় দেওয়া; যতটা আমি ক্রিকেটকে দিতে পারছি। সবকিছুকেই গুরত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, মনে রাখতে হবে এগুলো একদিন শেষ হয়ে যাবে।
আমি ধার্মিক নই। আমি কখনই কোনো ধর্মের কাছে আবদ্ধ চিলাম না। সব ধর্মের লোককে আমি গ্রহণ করি, সব ধর্মই আমার কাছে সমান। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষই আধ্যাত্মিক। তারা টের পায় না, কিন্তু আমরা সবাই এক।
তো, আপনার কি মনে হয় শুরুর দিকে আপনার সময়টা খারাপ ছিল?
হ্যাঁ, আমি শুরুতে অনেক ভুল করেছি। আমি পথ হারিয়েছিলাম, শুরুতে ফোকাসও করতে পারিনি। তারপর আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমি আমার বর্তমান অবস্থা নিয়ে কৃতজ্ঞ। সবকিছু চলে যাবে, থাকবে কেবল আপনার কঠোর পরিশ্রম।
সামনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আসছে। যে টুর্নামেন্টের ফলাফল আসবে কয়েক বছর পর, সেটি নিয়ে আপনার কী পরিকল্পনা?
এটা খুব রোমাঞ্চকর (টুর্নামেন্ট)। আমার মনে হয় টেস্ট ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী, সঠিক সময়েই এটা শুরু হতে যাচ্ছে। যদিও আপনাকে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে হবে, যার গুরুত্ব আরও অনেক বেশি। আপনাকে সিরিজ ধরে ধরে এগোতে হবে। যখন প্রথম এটি জানতে পারি, তখন থেকেই রোমাঞ্চিত ছিলাম। এখন সেটি বাস্তব হতে যাচ্ছে।
আপনি ভারতীয় দলে ফিটনেস নিয়ে এক বিপ্লব শুরু করেছিলেন। আপনি ঠিক কী কী পরিবর্তন করেছিলেন? বোলিং মাসলের উন্নতির জন্য টানা বল করে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন সাবেক গ্রেট ফাস্ট বোলাররা। জিমে কী ধরনের ট্রেনিং খুব জরুরী বলে আপনি মনে করেন?
এটার আসলে কোনো বাঁধাধরা নয়ম নেই। আমি ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় খেলার পর অনুধাবন করতে পারি যে বিশ্ব ক্রিকেটের হালচাল খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর অজিরা প্রতিনিয়ত আরও বেশি ফিট হচ্ছে। ওরা টানা বল করে যেতে পারে, অনেক সময় ধরে ব্যাট করতে পারে। লুজ বল করেই না। আমি অবাক হতাম যে ওরা চার টেস্ট ম্যাচের মতো টানা সিরিজে কীভাবে এত সময় নিয়ে বল করে যাচ্ছে!
আবার আমরা যখন ব্যাট করতাম, তখন আমাদেরকে তিনগুণ বেশি কষ্ট করতে হতো। তারপর আমি টের পেলাম, প্রশ্নটা আসলে ফিটনেস লেভেল নিয়ে। আমি আগে নিজের ফিটনেস ঠিক করা শুরু করলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম, যেভাবে ক্রিকেট এগোচ্ছে, তাতে আমি আমার বর্তমান অবস্থায় থাকলে কখনোই উন্নতি করতে পারবো না। তাই নিজেই নিজেরটা নিয়ে আগে কাজ শুরু করি এবং ফলাফল প্রমাণ করি।
আমার ফিটনেস নিয়ে প্রথম চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন আমাদের ট্রেনার শঙ্কর বসু। তিনি বলেছিলেন, তুমি যদি তোমার ফিটনেস লেভেল আরও সামনে নিয়ে না যেতে পারো তাহলে বর্তমান তরুণদের সাথে কোনোভাবেই পেরে উঠবে না। আমি তার সাথে বছরের পর বছর কাজ করেছি। তিনি দলে আসার পরই সবকিছু বদলে গেছে।
তরুণ ক্রিকেটারদের বলতে শুনেছি, তোমাকে যদি বিরাটের দলে খেলতে হয়, তাহলে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট লেভেলের ফিটনেস থাকতে হবে?
না। আমি কখনই কাউকে বলিনি, ‘এটা করো, ওটা করো’। আমি কখনই দলের কারোর সাথে বস বলিনি যে, তুমি যদি এই দলে খেলতে চাও তাহলে তোমাকে এটা করতে হবে। আমি আমার কাজটা করে যাচ্ছি। আমি জিমে অনেক পরিশ্রম করছি, আমার অনুশীলন ঠিকঠাক করছি। আমি আমার ১২০ শতাংশ দেওয়ার চেষ্টা করছি।
লোকে আমাকে নিয়ে বলে, ‘এই লোকটা ১১ বছর ধরে খেলছে। তাইলেই এখন বসে রিল্যাক্স করতে পারে। কিন্তু সে এখনও টানা পারফর্ম করে যাচ্ছে!’ তখন হয়তো ক্রিকেটারদের মধ্যেও ভাবনা আসে, ‘সে পারলে আমরা কেন পারবো না?’
এখন পর্যন্ত আপনার সাফল্যগুলো কীভাবে দেখেন?
আমি খুবই কৃতজ্ঞ। সত্যি বলতে, আমি যখন দলে এলাম তখন ভাবিইনি যে ঈশ্বর আমাকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে আসবেন। আমি কল্পনাই করিনি এমন কিছু। আমি জানতাম আমার তেমন দক্ষতা নেই। আমার যেটা ছিল তা হলো অন্যদের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করার ক্ষমতা। আমি জানতাম, ঈশ্বর এটা লক্ষ্য করবেন।