সাল ১৯৪৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত। হৈমন্তিক কলকাতায় খেলতে এসেছে অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস একাদশ। এখানে পূর্বাঞ্চল ক্রিকেট দলের সঙ্গে একটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ এবং ভারত একাদশের সঙ্গে একটি টেস্ট খেলবে দলটি। আন্তর্জাতিক হলেও টেস্টটা অবশ্য বেসরকারি তকমাযুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেন তখন জয়ী, কিন্তু যুদ্ধের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে সর্বশক্তিমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত তখন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। আর যে বেশিদিন ভারতকে পদদলিত করে রাখা যাবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত। তা-ও এখনও স্বাধীনতার কোনো স্পষ্ট ঘোষণা নেই। অগ্নিযুগের গনগনে আঁচ তপ্ততর হচ্ছে। কলকাতায় ব্রিটিশ-সশস্ত্র বিপ্লবী সংঘর্ষ অব্যাহত।
অতিথি দল অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেসের ইতিহাস সম্পর্কে এখানে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। ছ’বছর ধরে সংঘটিত হওয়া এমন মারণলীলার অভিশাপের চরম প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানবজীবনে। সেখানে খেলাধুলোই বা বাদ যাবে কেন? এই ছ’বছর ধরে হয়নি কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। ক্রিকেটবিশ্ব শাসনকারী ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা তো বটেই, বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর আগে টেস্ট খেলার ছাড়পত্র পাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড ও ভারতের ক্রিকেটও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের জন্য। বহু প্রতিভাবান খেলোয়াড়ই নিজেদের চূড়ান্ত সাফল্যের বছরগুলিতে খেলার তেমন সুযোগই পাননি। যুদ্ধ-পরবর্তী বিষণ্ণ জনমানসে আবার ক্রিকেট খেলার আনন্দকে ফিরিয়ে জন্য ৮ই মে নাৎসি জার্মানির আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পরেই ১৯শে মে থেকে ইংল্যান্ডে শুরু হয়ে গেল ক্রিকেট প্রতিযোগিতা।
অংশগ্রহণকারী দল দুটি হলো ইংল্যান্ড ও এই অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস। যুদ্ধজয় উদযাপনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ায় নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ভিকট্রি টেস্টস’, যদিও এই ম্যাচগুলো সরকারিভাবে টেস্ট ম্যাচের স্বীকৃতি পায়নি। অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস দলটি তৈরি হয়েছিল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্স (র্যাফ) ও অস্ট্রেলিয়ান ইম্পেরিয়াল ফোর্সের (এআইএফ) ক্রিকেট-খেলিয়ে সৈন্যদের নিয়ে। অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন দলের একমাত্র টেস্ট-খেলিয়ে ক্রিকেটার আর্থার লিন্ডসে হ্যাসেট, যিনি মূলত লিন্ডসে হ্যাসেট নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ইম্পেরিয়াল ফোর্সে ওয়ার্যান্ট অফিসার ছিলেন লিন্ডসে। ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজ সিরিজে টেস্টে অভিষেক ঘটেছিল তাঁর। লিন্ডসে ছাড়া যাঁরা এই দলে ছিলেন, তাঁরা বেশিরভাগই ছিলেন শেফিল্ড শিল্ড খেলে আসা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার। স্কোয়াড্রন লিডার স্ট্যানলি সিস্মে খেলতেন নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে। ফ্লাইং অফিসার কিথ মিলার, যিনি পরবর্তীকালে তারকা হয়ে উঠবেন, তিনি খেলতেন ভিক্টোরিয়ার হয়ে। একমাত্র আরও দুই ফ্লাইং অফিসার রেজিন্যাল্ড এলিস (স্পিন বোলার) এবং জ্যাক পেটিফোর্ডের (ওপেনিং ব্যাটসম্যান) তখনও কোনো খেলার অভিজ্ঞতা ছিল না। পরে তাঁরা নিজেদের রাজ্যদলে খেলেছিলেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ড দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়েরই ছিল টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা।
খাতায়-কলমে দুর্বল, অনভিজ্ঞ দল নিয়েও পাঁচ ম্যাচের সিরিজ ২-২ ড্র করে অস্ট্রেলিয় দলটি। ম্যাচে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহৃত হয় যুদ্ধের ত্রাণ তহবিলে। এমন অভাবনীয় সাফল্য দেখে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড সার্ভিসেস দলকে নির্দেশ দেয়, সেই মুহূর্তেই দেশে না ফিরে ভারত ও সিংহলেও (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) বেশ কিছু এমন ম্যাচ খেলতে যাতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সাহায্যকারী সংস্থা রেড ক্রসের তহবিলের জন্য আরও অর্থ তোলা যায়। সেই মতো, ভারতে তাদের আগমন ঘটে সেই বছরেরই অক্টোবর মাসে। প্রথম ম্যাচটি হয় অবিভক্ত পাঞ্জাবের লাহোরে উত্তরাঞ্চলের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে আটটি ম্যাচ খেলে দলটি। তার মধ্যে তিনটি ছিল বেসরকারি টেস্ট। প্রথম টেস্টটি হয়েছিল তৎকালীন বোম্বাইয়ের ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে। ম্যাচটি ড্র হয়।
পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ম্যাচের প্রথম দিন পুলিশ-বিপ্লবী সংঘর্ষের কারণে একঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয় খেলা। রক্তস্নাত শহরে সেদিন উভয়পক্ষ মিলিয়ে তেইশ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যেই তার মধ্যেই চলেছিল খেলা। দ্বিতীয় ইনিংসে পূর্বাঞ্চলের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮১। শেষ দিনের খেলা চলছে তখন। পূর্বাঞ্চলের হয়ে ৯৪ রানে ব্যাট করছেন ডেনিস কম্পটন (পরবর্তীকালে চূড়ান্ত সফল টেস্ট ক্রিকেটার ও আর্সেনালের ফুটবলার), এমন সময় নিরাপত্তার ব্যূহ ভেঙে সোজা মাঠে ঢুকে পড়লেন বিপ্লবীরা। বিপ্লবীদের নেতা সোজা চলে গেলেন ডেনিসের কাছে। গিয়ে বললেন, “মি. কম্পটন, আপনি খুব ভাল খেলোয়াড়, কিন্তু এখন খেলা বন্ধ করতেই হবে।” মাথা ঠাণ্ডা ডেনিস তাঁকে সবিনয়ে বললেন, এ ব্যাপারে তাঁর কিছুই করার নেই, অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক যা বলবেন তা-ই হবে। সহাস্য হ্যাসেট তাঁকে বললেন, “আপনার কাছে সিগারেট হবে না বোধহয়, না?” এ কথা শুনে বিপ্লবীরা অবশেষে শান্ত হন ও আবার খেলা শুরু হয়। ডেনিসের ব্যাটে ভর করে সহজেই ম্যাচ জেতে পূর্বাঞ্চল।
এর কয়েকদিন পরেই দ্বিতীয় টেস্ট। কিন্তু এবারও প্রথম দিনের খেলা শুরুতে বাঁধা। তবে এবার আর কোনো সশস্ত্র বিপ্লবী-অনুপ্রবেশ নয়, বাধা এলো উত্তেজিত ক্রিকেট-দর্শকদের তরফ থেকে। যে মাঠে পরবর্তীকালে তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়তে হবে সুনীল গাভাস্কার, মোহম্মদ আজহারউদ্দিন থেকে শুরু করে বিনোদ কাম্বলি, রাহুল দ্রাবিড়দেরও, দর্শকদের এমন আগ্রাসন পরম্পরার শুরু কিন্তু এই ঘটনা থেকেই।
বিক্ষোভের কারণ অবশ্য ক্রিকেটীয়ই। ইডেন গ্যালারিতে আছড়ে পড়ছে প্রতিবাদী স্লোগান ‘নো মুস্তাক, নো টেস্ট’, জ্বলজ্বল করছে ‘ব্রিং ব্যাক মুস্তাক আলি’ লেখা প্ল্যাকার্ড। একসময় নিরাপত্তার বেড়া ভেঙে অবশেষে প্যাভিলিয়নেই ঢুকে পড়ে অধৈর্য জনতা। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য নির্বাচক প্রধান কুমার শ্রী দলীপসিংজি। তাঁর টাই ধরে রীতিমতো হেনস্থা করে কয়েকজন মারমুখী দর্শক। অবস্থা সামাল দিতে এবার এগিয়ে আসেন সেই মানুষটি স্বয়ং, যাঁকে ফিরিয়ে আনতে এতক্ষণ ধরে স্লোগান দিচ্ছিল ইডেন-জনতা। দর্শকদের বোঝালেন, তিনি অবশ্যই খেলবেন, তবে তাঁরা যেন শান্ত হয়ে বসেন। অগত্যা জনরোষের মুখে পড়ে তাঁকে খেলাতে বাধ্য হন নির্বাচকরা। সেই মানুষটির নাম সৈয়দ মুস্তাক আলি, মানুষের বড় ভালোবাসার মুস্তাক। সেই ম্যাচে অবশ্য তেমন বড় রান করতে পারেননি তিনি। দুই ইনিংসে তাঁর রান ছিল ৩১ ও ৩। কিন্তু জনতার চাপে পড়ে শেষ মুহূর্তে এভাবে কোনো খেলোয়াড়কে দলে নেওয়ার নজির বোধহয় খেলার ইতিহাসে খুব কমই আছে। কিথ মিলার এই ঘটনা নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, ক্রিকেটের ইতিহাসে যাঁকে নিয়ে প্রচুর গল্প আছে, সেই ডব্লিউ. জি. গ্রেসও এই সত্য ঘটনা শুনলে অবাক হতেন।
মুস্তাককে বাদ দেওয়ার কারণ হলো, বোম্বাই টেস্টে দলে থাকলেও অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত খেলতে পারেননি তিনি। কলকাতায় এসে সুস্থ হয়ে গেলেও তাঁকে খেলানোর ঝুঁকি নেননি নির্বাচকরা। কিন্তু ততদিনে যে কলকাতার ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের চোখে তিনি আইকন। ১৯৩৭ সালে ইংল্যান্ডের লর্ড টেনিসন একাদশ খেলতে আসে ভারতে, যে দলের অধিনায়ক ছিলেন আটচল্লিশ বছর বয়সী লর্ড লিওনেল হ্যালাম টেনিসন (প্রখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড আলফ্রেড টেনিসনের নাতি)। সেই দলের বিরুদ্ধে এই ইডেনেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন মুস্তাক। ব্যাটিংয়ে ছিল ভরপুর বিনোদন। কলকাতাবাসীর মনে গেঁথে ছিল সেই স্মৃতি। এমতাবস্থায় কীভাবেই বা তাঁরা তাঁদের প্রিয় ক্রিকেটারটির বাদ পড়া বরদাস্ত করেন!
এহেন জনপ্রিয় মুস্তাক আলির জন্ম ১৯১৪ সালের ১৭ই ডিসেম্বর, তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রদেশের হোলকার রাজ্যের রাজধানী ইন্দোরে। নিজের আত্মজীবনী ‘ক্রিকেট ডিলাইটফুলে’ মজা করে লিখেছেন, “এটা বলাই যায় যে যদি আমি রুপোর চামচ মুখে নিয়ে না জন্মাতাম, তাহলে হয়তো ক্রিকেট ব্যাট মুখে নিয়ে জন্মাতাম।” তাঁর বাবা সৈয়দ ইয়াকুব আলি ছিলেন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া এজেন্সির একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। আদ্যন্ত ক্রিকেটভক্ত।
মুস্তাকরা ছিলেন পাঁচ ভাই। মেজদা আলতাফ আলি ও মামা বসির আলি দুজনেই ছিলেন নামকরা খেলোয়াড়। হকি এবং ক্রিকেট দুটোই খুব ভাল খেলতেন। পুলিশ লাইনের রাস্তায় শৈশবের ক্রিকেট শুরু হয়েছিল তাঁর। কিছুদিন পর তাঁর বাবা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। মুস্তাক ও তাঁর ছোট ভাই ইস্তিয়াক ভর্তি হন একটি প্রাথমিক স্কুলে। সেখানে ক্রিকেট খেলার সুযোগ ছিল না বলে তাঁরা হকি আর ফুটবল খেলতেন। পরে প্রধান শিক্ষকের কাছে তাঁরা অনুরোধ করেন ক্রিকেটের জন্য। তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করে ক্রিকেট কিটের ব্যবস্থা করে দেন প্রধান শিক্ষক। এইসময়েই ইন্দোরের মহারাজা স্যার তুকোজি রাও হোলকারের সেনাবাহিনীতে সর্বাধিনায়ক পদে যোগ দেন কোট্টারি কনকাইয়া নাইডু, পরবর্তীকালে যিনি পরিচিত হবেন ভারতের প্রথম টেস্ট ক্যাপ্টেন সি. কে. নাইডু হিসেবে। মুস্তাকদের বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন তিনি। তাঁর দুই ভাই কোট্টারি সুবন্না নাইডু এবং কোট্টারি আর. নাইডু ভর্তি হন যে স্কুলে মুস্তাক পড়তেন, সেই স্কুলেই। অচিরেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁদের। তেরো বছর বয়সী মুস্তাকের ক্রিকেট প্রতিভা আবিষ্কার করেছিলেন এই সি. কে. নাইডুই।
ইন্দোরের ক্রিকেট ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হলো সেইসময়। তুকোজি রাও হোলকারের প্রিয়পুত্র যশবন্ত রাও হোলকারের নামে ক্লাবের নাম রাখা হলো যশবন্ত ক্রিকেট ক্লাব। সেই ক্লাবে অধিনায়ক নির্বাচিত হন সি. কে. নাইডু। সি. কে. নাইডু ছাড়াও এই ক্লাবে খেলতে আসেন জনার্দন নাভলে, লালিয়া যোশী, পেয়ারে খান, শাহবুদ্দিনের মতো তখনকার নামজাদা ক্রিকেটাররা। একই সময়ে মুস্তাক-ইস্তিয়াক ও সি. এস.-সি. আর. ভাইরাও শুরু করেন তাঁদের নিজেদের ক্লাব। তবে তা ছিল কেবলই ক্রিকেটপাগল কয়েকজন কিশোরের পাগলামো। কিছুদিন বাদেই ভাঙা ব্যাট মেরামত করাতে না পেরে তাঁদের সাধের ক্লাবটি উঠে গেল। তবে বেশিদিন ক্রিকেট থেকে দূরে রাখা যায়নি তাঁদের। মেডিকেল কলেজের মাঠে ক্রিকেট দেখতে যেতেন তাঁরা। সেখানকার মাঠ পরিচর্যা করতেন যিনি, সেই নাজিরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় মুস্তাকদের। বাচ্চাদের ভালবাসতেন নাজির। তাঁর সঙ্গে ক্রিকেট পিচ তৈরিতে যোগ দিতেন তাঁরা। এই কাজ করতে গিয়ে মাঠকে ভালবাসতে শিখেছিলেন তাঁরা। এর কিছুদিন পরেই সদ্যগঠিত লয়্যাল ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দিলেন সকলে। এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা জি. আর. পণ্ডিত ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মানুষ। ক্লাবের উন্নতির জন্য নিজের সাইকেল বেচেও অর্থ জোগাড় করেছেন তিনি।
লয়্যাল ক্রিকেট ক্লাবের খেলা পড়ত ইন্দোরের ড্যালি কলেজের মাঠে। এই ড্যালি কলেজে পড়াতেন এম. জি. স্যাল্টার। পরে কলেজের অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। স্যাল্টার ছিলেন একজন প্রাক্তন অক্সফোর্ড ব্লু (বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে কোনো খেলায় সর্বোচ্চ স্তরে সাফল্যের স্বীকৃতি)। ক্রিকেট সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। খেলা শেষে মাঝেমাঝেই তিনি নিজের কলেজের ছাত্রদের তো বটেই, বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দেরও খুঁটিনাটি টিপস দিতেন। পতৌদির নবাব ইফতিখার আলি খান পতৌদি, অর্থাৎ পতৌদি সিনিয়র (মনসুর আলি খান পতৌদির বাবা) হিসেবে যিনি পরিচিত ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে, তিনি এই স্যাল্টারের কাছ থেকে ক্রিকেট সম্পর্কে প্রয়োজনীয় টিপস নিতেন। তবে এই ড্যালি কলেজে বারবার খেলতে যাওয়ার দরুণ মুস্তাককে কঠিন শাস্তির মুখে পড়তে হয়। তাঁর নিজের স্কুলে প্রধান শিক্ষক এই ড্যালি কলেজের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না। মুস্তাকের খেলতে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট যার শয়নে-স্বপনে, তাকে কি আর সাধারণ কোনো শাস্তিতে আটকানো যায়?
লয়্যাল ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ড্যালি শিল্ড টুর্নামেন্টে খেলেছিলেন মুস্তাক। প্রথম রাউন্ডে ম্যাচ ছিল রেলওয়ের দলের বিরুদ্ধে। এই ম্যাচেই বোলার মুস্তাকের হ্যাটট্রিকের সৌজন্যে রেলওয়েকে হারায় লয়্যাল। বস্তুত, পরবর্তীকালে ভারতীয় দলে মুস্তাক আলি জায়গা পেয়েছিলেন বাঁহাতি স্পিনার হিসেবেই। অন্যদিকে এই ম্যাচে সুবন্না নাইডু খেলেছিলেন ব্যাটসম্যান হিসাবে, যিনি আবার ভারতের অন্যতম সেরা গুগলি স্পিনার হয়ে ওঠেন। ড্যালি টুর্নামেন্টের সৌজন্যে বিভিন্ন জায়গায় ভারতীয়-ব্রিটিশ নির্বিশেষে বিভিন্ন ক্রিকেটারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মুস্তাকের। কিছুদিন পরেই সি. কে. নাইডুর উদ্যোগে কৈশোরেই যশবন্ত ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন মুস্তাক আলি, সি. এস.-সি. আর. ভাইরা ও মাধবসিং জাগদালে। এত কমবয়সী ক্রিকেটারদের জায়গা দেওয়া হচ্ছে দেখে ক্লাবের অনেক বয়োঃজ্যেষ্ঠ কর্তাই আপত্তি তোলেন। কিন্তু প্রত্যেকেই তাঁদের ‘গুরু’ সি. কে. নাইডুর বিশ্বাসের যোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন।
এই যশবন্ত ক্লাবে খেলার সময়েই ১৯২৮ সালে সি. কে. নাইডুর সঙ্গে একটি টুর্নামেন্ট খেলতে হায়দ্রাবাদে যান মুস্তাক আলি। হায়দ্রাবাদের ধনীতম ব্যক্তি রাজা ধনরাজগীরের দলের হয়ে বেহরাম-উদ-দৌলা টুর্নামেন্টে তাঁরা খেলেছিলেন। মুস্তাক ছিলেন দলের কনিষ্ঠতম খেলোয়াড়। এই টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়া মুস্তাকের জীবনের এক মোড়ঘোরানো অভিজ্ঞতা। তাঁদের দলের হয়ে খেলেছিলেন পুণার ক্রিকেটার প্রফেসর দিনকর বলবন্ত দেওধরকে (যাঁর নামে দেওধর ট্রফি), যিনি ১৯২৬ সালে ভারতে খেলতে আসা আর্থার গিলিগানের এমসিসি দলের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছিলেন। ডি বি দেওধরের নাম তখন ভারতীয় ক্রিকেটে সকলের মুখে মুখে ফিরত। এছাড়া এই সফরে তিনি দেখেছিলেন দুই ক্রিকেটার ভাই সৈয়দ মহম্মদ হাদি ও হুসেন মহম্মদকে। সৈয়দ মহম্মদ হাদি শুধু ক্রিকেটই নয়, টেনিসেও পেশাদার খেলোয়াড় ছিলেন। উইম্বল্ডনে ডাবলসে কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি যাওয়ার রেকর্ড আছে তাঁর, খেলেছিলেন অলিম্পিকেও। রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান ছিলেন এই হাদি।
টুর্নামেন্টে মুস্তাকের নিজের পারফরম্যান্সও ছিল চোখধাঁধানো। নিজাম স্টেট রেলওয়ের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন, হায়দ্রাবাদ একাদশের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ৬৫ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলে সর্দার ঘোড়পাড়ের সঙ্গে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ করে দলকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচান। টুর্নামেন্টটা জিতেছিলেন তাঁরা। হ্যাটট্রিকের জন্য রাজাসাহেবের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন একটি ক্রিকেট ব্যাট, স্যুট এবং পাঁচশো টাকা। ৬৫ রান করার পুরস্কার হিসেবে ক্রিকেটার কর্নেল মাহমুদ হুসেনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি নতুন সাদা একজোড়া স্পোর্টস-শ্যু। পাঁচশো টাকাটা তিনি ব্যবহার করেছিলেন ক্রিকেট সরঞ্জাম কেনার কাজে। সমস্ত স্থানীয় সংবাদপত্রে তাঁর নামে ঢালাও প্রশংসা হয়েছিল।
ক্রমাগত সাফল্যে মুস্তাক এবার বিজয়নগরমের মহারাজ কুমারের সুনজরে আসেন। মহারাজ স্বয়ং ছিলেন তাঁর রাজ্যদলের অধিনায়ক। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া রোশান আরা ক্রিকেট টুর্নামেন্টে এই দলের হয়ে দ্বাদশ ব্যক্তি হিসাবে খেলতে নেমে তিনটি অসাধারণ ক্যাচ ধরেন মুস্তাক। তাঁর ক্রিকেট প্রতিভা দেখে তাঁর ট্রেনিংয়ের সমস্ত দায়িত্বও নেন মহারাজ কুমার। ইন্দোরে নিজের পরিবারকে ছেড়ে বেনারসে চলে আসতে হয় মুস্তাককে। এখানে এসে ভর্তি হন বাঙালিটোলা হাইস্কুলে। বেনারসের বিজয়নগরম রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে ছিল বিশাল ক্রিকেট মাঠ। এখানেই অনুশীলন করতেন তাঁরা। কিছুদিন পর বিজয়নগরম একাদশে যোগ দেন তৎকালীন সময়ে বিশ্বের দুই সেরা ক্রিকেটার, ইংল্যান্ডের ওপেনারদ্বয় জ্যাক হবস (স্যার জন বেরি হবস) ও হার্বার্ট স্যুটক্লিফ। হবস এবং স্যুটক্লিফের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছিলেন মুস্তাক।
এই বিজয়নগরম একাদশের হয়েই বেঙ্গল গভর্নর একাদশের বিরুদ্ধে প্রথম ইডেন গার্ডেন্সে খেলতে আসেন মুস্তাক। প্রথম দর্শনেই বাংলার চিরসবুজ পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তরুণ মুস্তাক। ইডেন গার্ডেন্সকে দেখে সত্যিই নন্দনকানন মনে হয়েছিল তাঁর। মোহনবাগান ক্রিকেট দলের সঙ্গে ম্যাচ হওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টির জন্য খেলা হয়নি। মোহনবাগানের ফুটবল-জনপ্রিয়তা যে তখন দেশের নানা প্রান্তে, সে বিষয়ে অকপট শ্রদ্ধাশীল স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি আত্মজীবনীতে। বেঙ্গল গভর্নর একাদশের বিরুদ্ধে তাঁরা জিতেছিলেন। দুটি ইনিংসেই বাংলার দলের ব্যাটিং লাইন আপকে প্রায় একাই ধ্বংস করে দেন মুস্তাক। প্রথম ইনিংসে উনিশ ওভারে মাত্র ছত্রিশ রান দিয়ে ছটি উইকেট তুলেছিলেন মুস্তাক। দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর পরিসংখ্যান ১২-৮-১৮-৫। ইডেনের দর্শকদের এমন ক্রিকেট-ভক্তি দেখে প্রথম দিন থেকেই তাঁদের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি।
বিজয়নগরম দলের হয়ে খেলার পর কিছুদিন কোলাপুরের হয়ে খেলেছিলেন। এরপরই ভারতীয় ক্রিকেট দল টেস্ট ম্যাচ খেলার ছাড়পত্র পায়। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লর্ডস টেস্টে দলের অধিনায়ক পোরবন্দরের মহারাজা ও সহ-অধিনায়ক লিম্বদির যুবরাজ ঘনশ্যামসিংজি সরে দাঁড়ালে অধিনায়ক নির্বাচিত হলেন সি. কে. নাইডু। ম্যাচটি হেরেছিল ভারত, কিন্তু সি. কে. নাইডুর অধিনায়কত্ব ও খেলা প্রশংসা কুড়িয়েছিল বিশ্বক্রিকেটের। ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ের টপ অর্ডারে থরহরিকম্প লাগিয়ে দিয়েছিলেন নাইডু। ইংল্যান্ডের প্রবাদ প্রতিম ব্যাটসম্যান ডগলাস জার্ডিন না থাকলে ম্যাচটা হারতেও পারত ইংল্যান্ড।
সফর সেরে দল ভারতে ফিরলে রেস্ট অফ ইন্ডিয়া দলের সঙ্গে একটি ম্যাচের আয়োজন করা হয় সদ্যনির্মিত দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে। রেস্ট অফ ইন্ডিয়া দলে সুযোগ পেয়েছিলেন মুস্তাক। রেস্ট অফ ইন্ডিয়া ম্যাচটি হেরে গেলেও দুই ইনিংস মিলিয়ে দশ উইকেট তুলেছিলেন মুস্তাক। অস্ট্রেলিয়ার ফ্র্যাঙ্ক ট্যারান্ট তখন বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের একজন। সেসময় তিনি ভারতেই থাকতেন। বোম্বাইয়ের জনপ্রিয় কোয়াড্রাঙ্গুলার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ইউরোপিয়ান্স দলের হয়ে খেলতেন ফ্র্যাঙ্ক। এই দলে তিনি খেলেছিলেন টানা একুশ বছর (১৯১৫-১৯৩৬)। মুস্তাকের বোলিং দেখে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। পরে এই ফ্র্যাঙ্ক ট্যারান্টের জন্যেই টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন মুস্তাক আলি।
১৯৩৩ সালে ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দল খেলতে এল ভারতে। সাত বছর আগে খেলতে আসা আর্থার গিলিগানের দলের চেয়ে এই দল অনেক বেশি শক্তিশালী। জার্ডিনের দলে ছিলেন সিরিল ওয়াল্টার্স (ওয়েলসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার), চার্লি বার্নেট (১৯৩৭ সালের উইজডেন-নির্বাচিত বর্ষসেরা ক্রিকেটার), ব্রায়ান ভ্যালেন্টাইন (সাতটি টেস্টে যাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৬৪), জেমস ল্যাংরিজ (সাসেক্সের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যাঁর নামের পাশে তিরিশ হাজারের উপর রান ও দেড় হাজারের উপর উইকেট রয়েছে), হেডলি ভেরিটির (তখনকার সেরা স্পিন বোলার) মতো খেলোয়াড়রা। আর সবার উপরে ছিলেন ধুরন্ধর অধিনায়ক স্বয়ং ডগলাস জার্ডিন, যিনি কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাসেজ সিরিজে বডিলাইন-নীতি আনয়ন করে বিতর্ক ফেলে দিয়েছিলেন।
টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে এমসিসি। তার মধ্যে একটি হয়েছিল অবিভক্ত পাঞ্জাবের লাহোরে। বিপক্ষে ছিল পাঞ্জাব গভর্নর একাদশ। আরও একটি ম্যাচ হয় দিল্লিতে ভাইসরয় একাদশের বিরুদ্ধে। দুটি ম্যাচেই খেলেছিলেন মুস্তাক। তবে প্রথম ম্যাচে ১৮৪ রানে আর্থার মিচেল ও ৫৭ রানে জেমস ল্যাংরিজকে ফেরানো ছাড়া এই দুটি ম্যাচে তেমন উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স ছিল না তাঁর। ফলাফল যা-ই হয়ে থাকুক, দিল্লি থেকে ফেরার পরই বোম্বাইতে টেস্ট দল নির্বাচনের জন্য ট্রায়ালে যাওয়ার আমন্ত্রণপত্র পান বিসিসিআইয়ের (বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া) তরফ থেকে। বোম্বাইতে গিয়ে মুস্তাকের আলাপ হয় লালা অমরনাথ ও বিজয় মার্চেন্টের সঙ্গে। দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁদের। ট্রায়াল ম্যাচে অমরনাথ ও মার্চেন্ট দুজনেই খুব ভাল খেলে নির্বাচকদের নজর কাড়েন।
প্রথম টেস্ট ম্যাচটি হয় বোম্বাইতেই। তবে সেই দলে অমরনাথ ও মার্চেন্ট নির্বাচিত হলেও শিকে ছেঁড়েনি মুস্তাকের। আশাহত হয়ে পড়লেও নির্বাচকরা তাঁকে খেলাটি গ্যালারিতে বসে দেখার নির্দেশ দেন। জিমখানা গ্রাউন্ডের সবুজে বাঘা বাঘা ইংরেজ বোলারদের বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই শতরান করেছিলেন লালা অমরনাথ। ১১৮ রানের ঝকঝকে ইনিংসটি সাজানো ছিল একুশটি বাউন্ডারির সমন্বয়ে। মাঠের সমস্ত প্রান্তে ছুটেছিল চোখধাঁধানো স্কোয়ার কাট ও কভার ড্রাইভগুলো। টেস্টটি ভারত হেরে গেলেও গ্যালারিতে বসে মুস্তাক দেখেছিলেন অন্যতম সেরা একটি টেস্ট সেঞ্চুরি। ডগলাস জার্ডিনের ফিল্ডিং টিমকে পর্যুদস্ত হতে দেখে সেদিন গলা ফাটিয়েছিল সারা গ্যালারি। অমরনাথকে যোগ্য সঙ্গ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন অধিনায়ক নাইডু। তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৬৭ রানের একটি হিসেবী ইনিংস।
পরের টেস্ট কলকাতায়। এক ও অদ্বিতীয় ইডেন গার্ডেন্সে। সেই ইডেন গার্ডেন্স, যা বরাবরই নায়কের থেকে বেশি পয়মন্ত হয়ে উঠেছে লড়াকু পার্শ্বনায়কের জন্য। বিজয়নগরম দলের হয়ে খেলতে এসে প্রথম দর্শনেই ইডেন ও চিরসবুজ বাংলার প্রেমে পড়েছিলেন মুস্তাক। এবারও তাঁকে ফেরাল না ইডেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার পাতায় টেস্ট দলে নিজের নামটা দেখে বিশ্বাস হয়নি উনিশ বছরের তরুণ ক্রিকেটারটির। সত্যিই তাহলে এতদিনের পরিশ্রম সার্থক হলো! বছরের শুরুতেই একরাশ আনন্দ নিয়ে হাজির হলো খবরটা।
ট্রেন ঢুকেছে হাওড়া স্টেশনে। এমন সময় ঘটল এক মজার ঘটনা। লালা অমরনাথ তখনও রাতের পোষাক পরে রয়েছেন। কুলিরা এসে তাঁর ব্যাগ, ক্রিকেট কিট নিতে যেতেই হাঁ-হাঁ করে উঠলেন তিনি। ধমকে উঠলেন তাদের, “তুমলোগ কেয়া কর র্যাহে হো? হাম হিঁয়াপর নেহি উতরেঙ্গে, হাম কলকাত্তা যায়েঙ্গে।” কুলিরা তো অবাক। লোকটা বলে কী! আসলে লালার ধারণা ছিল, কলকাতা আসবার রেলস্টেশনের নাম নিশ্চয়ই কলকাতা স্টেশন হবে। সেজন্যেই হাওড়া স্টেশন দেখে তিনি ভেবেছিলেন এখনও কিছুটা যেতে হবে। ভারতীয় দলকে স্টেশনে নিতে এসেছিলেন বেঙ্গল ও অসম ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা ও বিজয়চন্দ্র সর্বাধিকারী (পরবর্তীকালে নামকরা ক্রিকেট-লিখিয়ে ও ধারাভাষ্যকার বেরি সর্বাধিকারী)। প্রত্যেক ক্রিকেটারের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়। লালা যাঁর বাড়িতে থাকবেন, সেই ভদ্রলোক ও কর্মকর্তারা অবস্থা সামাল দিতে কম্পার্টমেন্টে এসে লালাকে আসল ব্যাপারটা বোঝান। তখন লালা বুঝতে পারেন, কী বেকুবি করছিলেন তিনি। তবে সকলেই খুব মজা পেয়েছিলেন এই ঘটনায়।
নাইডু ভ্রাতৃদ্বয় (কনকাইয়া ও সুবন্না) ও মুস্তাকের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন বেরি সর্বাধিকারী নিজেই। তাঁর কাকা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন তিনজন। বাঙালি বাড়ির আতিথেয়তা মুগ্ধ করেছিল তিন ক্রিকেটারকে। অন্যদিকে এমসিসি দল উঠেছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। একমাত্র ডগলাস জার্ডিনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল খোদ গভর্নরের বাংলোতে।
ইডেনে তখন ব্রিটিশ আভিজাত্যের ছোঁয়া। প্যাভিলিয়নে বার্মা টিকের টেবিল-চেয়ার। চারিদিকে প্রচুর গাছপালায় ঘেরা আবহে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ম্যাচের পরিবেশ পাওয়া যেত। আউটফিল্ড ছিল দ্রুত। ১৯৩৪ সালের ৫ই জানুয়ারি শুরু হল খেলা। জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন বোলার হিসাবেই। ক্যাপ্টেন নাইডু যখন বল তুলে দিলেন হাতে, রীতিমতো নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন মুস্তাক।
প্রথম দু’ওভারে একটিও রান দেননি। সবশুদ্ধ উনিশ ওভার বল করেছিলেন প্রথম দিনে। ৪৫ রান দিয়ে তুলেছিলেন একটি উইকেট। সেই উইকেটটি আর কেউ নন, স্বয়ং ডগলাস জার্ডিন। তবে উইকেটটির নেওয়ার পেছনে যে ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছিলেন, একথা স্বীকার করেছেন নিজেই। বল করার সময় মাথায় সোলার টুপি পরে বল করছিলেন। যে বলে উইকেট পান, সেটা বলটা ছাড়ার হাতটা হঠাৎ টুপিতে লেগে যায়। বলটা হয় শর্ট-পিচড। জার্ডিন এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে কভারে ক্যাচ তুলে দেন। ক্যাচটি ধরেন মুস্তাকের বাল্যবন্ধু সি. এস. নাইডু। ভাগ্যের হাত থাকলেও জীবনের প্রথম মূল্যবান টেস্ট উইকেটটি ছিল সত্যিই স্মরণীয়। সেই ম্যাচেই ওপেনার দিলওয়ার হোসেন প্রথম ইনিংসে চোট পাওয়ায় দ্বিতীয় ইনিংসে মুস্তাককেই ওপেন করতে পাঠানো হয়। ১৮ রান করেন তিনি। ব্যাট করার সময় রান আউট বাঁচাতে একবার ডাইভ দিয়ে বাঁচেন তিনি। তখন এই পদ্ধতি ভারতীয় ক্রিকেটে একেবারেই নতুন। কলকাতা টেস্ট অবশেষে ড্র হয়।
পরের টেস্টটি হয় মাদ্রাজের চিপক স্টেডিয়ামে (এখন যার নাম এম. এ. চিদাম্বরম স্টেডিয়াম)। এই টেস্টেও ওপেন করতে পাঠানো হয় মুস্তাক আলিকে। তবে এখানে তিনি আবারও ব্যর্থ হন। পরবর্তী সময়ে যিনি হয়ে উঠবেন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার, দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে আদর্শ, সেই মানুষটির টেস্ট জীবনের সূচনা কিন্তু হয়েছিল বেশ সাদামাটাভাবেই। মাদ্রাজ টেস্টেও হেরে যায় ভারত। তিন ম্যাচের সিরিজ এমসিসি জেতে ২-০ ফলাফলে। তবে ভারতীয় ক্রিকেটারদের লড়াকু মনোভাবে আপ্লুত হয়েছিলেন এমসিসি অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন। ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “আগামী দশ বছরে ভারত যে একটি বিশ্বসেরা দল হয়ে উঠবে, সে বিষয়ে আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।“
দুর্ভাগ্যবশত, জার্ডিনের এমন ইতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে সম্ভব হয়নি। তার কারণ, দেশীয় রাজনীতির করাল ছায়া। ১৯৩৫ সালে বেসরকারি টেস্ট খেলতে আসেন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা। পাতিয়ালার মহারাজা ফ্র্যাঙ্ক ট্যারান্টের সঙ্গে কথা বলে এই সিরিজের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু যাঁরা খেলতে এসেছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই বয়স ততদিনে চল্লিশ পার হয়ে গিয়েছে। অনেকেই অবসর নিয়ে ফেলেছেন। দলের অধিনায়ক ছিলেন ব্যাটসম্যান জ্যাক রাইডার, যাঁর বয়স তখন ছেচল্লিশ। কিন্তু এত বেশি বয়সী ক্রিকেটাররাও প্রথম পাঁচটি ম্যাচে ভারতীয় দলগুলোকে হেলায় হারিয়ে দেয়। গোটা সিরিজ জুড়ে জ্যাক রাইডার করেন ১,১২১ রান, তেতাল্লিশ বছর বয়সী বোলার রন অক্সেনহ্যাম তুলেছিলেন ১০১টি উইকেট। বোম্বাই ও কলকাতার বেসরকারি টেস্ট দুটি অস্ট্রেলীয়রা জিতলেও লাহোর ও মাদ্রাজের টেস্ট দুটি জেতেন ভারতীয়রা।
এই সিরিজ থেকে নতুন প্রতিভারা উঠে এলেও কিছুদিন পরেই ক্রিকেট প্রশাসকদের নোংরা রাজনীতি চরমে ওঠে। বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত বেসরকারি টেস্টে ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পাতিয়ালার যুবরাজ একুশ বছর বয়সী যাদবিন্দর সিং। দলে অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার থাকা সত্ত্বেও এমন একজন তরুণকে অধিনায়ক করা নিয়ে চাপা অসন্তোষ ছিলই। বিশেষত, সি. কে. নাইডুকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর অগণিত ভক্তরা প্রতিবাদ করেছিলেন। এর পরের কলকাতা টেস্টে আবার নাইডুই অধিনায়ক হন। অসুস্থ থাকায় মুস্তাক খেলেননি কলকাতায়। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন, বহু খেলোয়াড়ই নাইডুর মাথা হেঁট করাতে উঠেপড়ে লেগেছে। লাহোর টেস্টে নাইডুকে আবার অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে অধিনায়ক করা হয় সৈয়দ ওয়াজির আলিকে। এরপর মাদ্রাজ টেস্টে তাঁকে আর দলেই রাখা হয়নি।
অধিনায়কত্ব নিয়ে গণ্ডগোলের মধ্যেই মাথা চাড়া দিতে থাকে প্রাদেশিকতা। দক্ষিণী খেলোয়াড়দের দলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া শুরু হয়। নির্বাচক প্রধান ডক্টর হরমাসজি কাঙ্গা পদত্যাগ করেন। বোম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন এবার আসরে নামে। পরবর্তী ইংল্যান্ড সফরের জন্য অধিনায়ক ঠিক করা হয়েছিল পতৌদির নবাবকে। কিন্তু সংবাদপত্রে তাঁর তীব্র সমালোচনা হওয়ায় অধিনায়ক করা হয় বিজয়নগরমের মহারাজ কুমারকে। সি . কে. নাইডু তো দূর, লাহোর টেস্টে যাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় দল অস্ট্রেলীয়দের হারায়, সেই ওয়াজির আলির কথাও অধিনায়ক পদের জন্য একবারও ভাবা হয়নি। মুস্তাক আত্মজীবনীতে ব্যঙ্গ করেছেন, “হায়, ওয়াজির আলি তো নবাব বা মহারাজকুমার কোনোটাই ছিলেন না!“
এমন ডামাডোলের মধ্যেই ১৯৩৬ সালে ভারতীয় দল টেস্ট খেলতে ইংল্যান্ড যায়। মুস্তাকের প্রথম বিদেশ সফর। দলের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। তাঁকে ডাকা হতো ‘বেবি অফ দ্য টিম’ নামে। এই সেই সফর, যে সফর ভারতীয় ক্রিকেটে অমরত্ব দেবে তাঁকে, ক্রিকেট ইতিহাসে চিরকালের মতো নিজের আসনটি পাকা করে নেবেন সৈয়দ মুস্তাক আলি। কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে, তাঁর এই সফর খেলতে যাওয়া নিয়েই তৈরি হয়েছিল বড় রকমের সংশয়। বিলেতের জাহজে রওনা হওয়ার কিছুদিন আগে হঠাৎ তাঁর মা গুরুতর অসুস্থ হন। তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। একদিকে অসুস্থ মায়ের পাশে থাকার আকুতি, অন্যদিকে ক্রিকেটের আঁতুড়ঘরে খেলতে যাওয়ার হাতছানি। অবশেষে এই তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন তাঁর মা-ই। মা তাঁকে আশ্বাস দেন, তিনি কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। মুস্তাক যেন অবশ্যই বিদেশে খেলতে যান। মায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে বোম্বাই বন্দর থেকে এসএস ভাইসরয় অফ ইন্ডিয়া জাহাজে ভারতীয় দলের সঙ্গে যাত্রা করেন মুস্তাক।
প্রথমবার জাহাজে চড়ে আর পাঁচজনের মতো সি-সিকনেসের শিকার হয়েছিল তরুণ মুস্তাকও। জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বলে ডেকে নেট প্র্যাক্টিসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যাওয়ার পথে মিশরের কায়রো, ফ্রান্সের মার্সেই ঘুরেছিলেন তাঁরা। কায়রোতে হোটেল শেপার্ডে মধ্যাহ্নভোজ, পিরামিড ও সংগ্রহশালা দর্শন, মার্সেইতে ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে টাকা ফাঁকি দেওয়া নিয়ে হাতাহাতি ইত্যাদি নানাবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে ইংল্যান্ডের টিলবেরিতে পৌঁছেন তাঁরা ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে। ভিক্টোরিয়া স্টেশনে তাঁদের নিতে এসেছিলেন এমসিসির কর্মকর্তা স্যার জ্যাক হবস, স্যার পেলহ্যাম ওয়ার্নার, ইংল্যান্ড দলের সদ্য-নির্বাচিত অধিনায়ক জর্জ অ্যালেন বা গাবি অ্যালেন, ডগলাস জার্ডিন প্রমুখ।
ইংল্যান্ডে এসেই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করেন মুস্তাক আলি। তা-ও খোদ ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে। মাইনর কাউন্টির বিরুদ্ধে ১৩৫ রানের একটি ইনিংস খেলেন তিনি। ১৮টি চার মেরেছিলেন তিনি। পরের ম্যাচে কেনিংটন ওভালে সারের বিরুদ্ধে আরেকটি ১৪১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এরপর প্রথম টেস্টটি হয় ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে। অনেক সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করলেও ম্যাচটি জিততে পারেনি ভারত। প্রথম ইনিংসে ১৪৭ রান করলেও মিডিয়াম পেসার অমর সিংয়ের দাপটে ১৩ রানের লিড পায় ভারত। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে সুবিধা নিতে পারেননি ব্যাটসম্যানরা। মাত্র ৯৩ রানে গুটিয়ে যায় দল। ন’উইকেটে ম্যাচটি জিতে নিতে কোনো অসুবিধাই হয়নি ইংল্যান্ডের। আগের দুটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে সেঞ্চুরি করে এলেও এই ম্যাচে মুস্তাকের পারফরম্যান্স ছিল চূড়ান্ত হতাশাজনক। দুই ইনিংসে তাঁর রান ছিল ০ এবং ৮। মজা করে লিখেছেন, “লর্ডস আমার প্রথম সেঞ্চুরি ও শূন্য দুই-ই দেখেছিল।“
পরের টেস্ট ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে রান উঠল মাত্র ২০৩। জবাবে ওয়ালি হ্যামন্ড (১৬৭), থমাস স্ট্যানলি ওয়ার্থিংটন (৮৭), জোসেফ হার্ডস্টাফ জুনিয়র (৯৪), রবার্ট ওয়াল্টার রবিন্স (৭৬) ও হেডলি ভেরিটির (৬৬) ব্যাটিংয়ে ভর করে ৫৭১-৮ এর বড় স্কোর খাড়া করে ইংল্যান্ড। ৩৬৮ রানের লিড মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে নামা ভারতীয় দলের হার তখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী। ওপেন করতে নামলেন মার্চেন্ট ও মুস্তাক। আত্মজীবনীতে মুস্তাক লিখেছেন, “৩৬৮ রানের ঘাটতি মেরামত করা ছিল এভারেস্টে ওঠার সমান।”
কিন্তু সেদিন সেই এভারেস্ট-বিজয়টাই তাঁরা করে দেখিয়েছিলেন। আগের ম্যাচের ব্যর্থতা কুরেকুরে খাচ্ছিল মুস্তাককে। আর আড়ষ্টভাবে খেলা নয়, তাঁর হাত ধরে আমদানি হলো ভয়ডরহীন ক্রিকেট। উল্টোদিকে মার্চেন্ট ছিলেন কিছুটা সাবধানী। ক্রিজে একবার জমে গেলে তাঁর ব্যাট থেকে রান আসবেই। ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টির বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে দুই ইনিংসে তিনি করেছিলেন ১৩৫* ও ৭৭। সি. কে. নাইডুর অসাধারণ বোলিংয়ে ভর করে ম্যাচটা ৮৪ রানে জেতে ভারত। কিন্তু মার্চেন্টের এমন রক্ষণাত্মক ধরনে বিরক্ত ছিলেন দলের অধিনায়ক মহারাজ কুমার। সফরের মাঝখানেই দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান লালা অমরনাথকে বাদ পড়তে হয়েছে রাজপুরুষের সঙ্গে বিরোধিতা করায়। সেই নিয়ে উত্তাল হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। এহেন প্রভাবশালী অধিনায়কটি মুস্তাককে ডেকে বলেন, তিনি যদি মার্চেন্টকে রান আউট করিয়ে দিতে পারেন, তবে মুস্তাককে তিনি একটি সোনার ঘড়ি উপহার দেবেন। একসময় এই মহারাজ কুমারই মুস্তাকের ক্রিকেটের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, কিন্তু দলের অধিনায়কের এমন সংকীর্ণ, নোংরা প্রস্তাবে রাজি হননি আদ্যোপান্ত ভদ্রলোক মুস্তাক। সোজা গিয়ে মার্চেন্টকে বলেন অধিনায়কের এমন হীন নির্দেশের কথা। মার্চেন্ট হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “চেষ্টা করে দেখুক না একবার!“
ভাগ্যিস সেদিন অধিনায়কের কথায় কর্ণপাত করেননি ওপেনারদ্বয়। ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২০০ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপের রেকর্ডটাই যে হতো না তাহলে। দিনটা ছিল ২৭শে জুলাই, ১৯৩৬। টেস্টের দ্বিতীয় দিন। ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে ব্যাট করা শুরু করেন মুস্তাক। ফাস্ট বোলার আলফ গোভারের একটি বলকে তিনি যেভাবে একটি দৃষ্টিনন্দন কভার ড্রাইভের মাধ্যমে বাউন্ডারিতে পাঠান, তা দেখে ব্রিটিশ মিডিয়া লিখেছিল, “ঘাসের উপর দিয়ে এত দ্রুতগতিতে বলটি বেরিয়ে গেল, দেখে মনে হলো বল নয়, আলোকরশ্মি।” মুস্তাকের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই পঞ্চাশ রান পূর্ণ করে ভারত। এই ঘটনা তখন প্রায় অকল্পনীয়। বল করতে আসেন অধিনায়ক অ্যালেন। অফস্টাম্পের বাইরে যত দ্রুত বলই তিনি করতে থাকেন, ততবারই মুস্তাকের পুল সেই বলকে বাউন্ডারিতে পাঠান। রান আটকাতে অ্যালেন এবার নিয়ে আসেন ওয়ালি হ্যামন্ডকে। কিছুক্ষণ ধীরে-সুস্থে খেলার পর তাঁকেও বাউন্ডারি মারা শুরু করেন মুস্তাক। এবার মুস্তাকের দেখাদেখি মার্চেন্টও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং শুরু করেন। ঝড়ের গতিতে রান উঠতে থাকে। মুস্তাক তখন নব্বইয়ের কোঠায়। বিদেশের মাটিতে প্রথম ভারতীয় হিসাবে টেস্ট সেঞ্চুরি করার রেকর্ড তখন তাঁর সামনে। চালিয়ে খেলে দ্রুত সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইছিলেন তিনি। এমন সময় এগিয়ে এলেন অভিজ্ঞ ওয়ালি হ্যামন্ড। তরুণ প্রতিভাবান ভারতীয় ক্রিকেটারটিকে বললেন, “মাই বয়, বি স্টেডি, গেট ইয়োর হান্ড্রেড ফার্স্ট।“
হ্যামন্ডের কথা শুনেছিলেন মুস্তাক। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষের কিছুক্ষণ আগে সেঞ্চুরি করলেন মুস্তাক। বিদেশের মাটিতে প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যানের টেস্ট সেঞ্চুরি। এই অনবদ্য ইনিংসটি খেলতে তিনি সময় নিয়েছিলেন মাত্র দেড় ঘণ্টা। তৈরি হলো এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। গোটা ওল্ড ট্র্যাফোর্ড গ্যালারি দাঁড়িয়ে উঠে অভিবাদন জানালেন স্বপ্নপূরণের কারিগরকে। মাঠ জুড়ে শুধু করতালির আওয়াজ। মুস্তাকের মনে হচ্ছিল, তাঁর সমগ্র জীবন সমস্ত বছরগুলো বোধহয় এই একটা দিনের মধ্যে সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় দিনের শেষে একটিও উইকেট পড়েনি ভারতের। মুস্তাক অপরাজিত ছিলেন ১০৬ রানে ও মার্চেন্ট ৭৯ রানে। ভারতের রান বিনা উইকেটে ১৯০। প্যাভিলিয়নে ফিরতেই ছুটে এলেন চার্লস বার্গেস ফ্রাই। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন মানুষটি। ক্রিকেট তো বটেই, সাফল্য পেয়েছিলেন অ্যাথলেটিক্স, ফুটবল ও রাগবিতেও। পরবর্তীকালে হয়েছেন শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও লেখক-প্রকাশক। সাসেক্স ও ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলার সময় তাঁর সহ-খেলোয়াড় ছিলেন রঞ্জিতসিংজি। ততদিনে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। ফ্রাই মুস্তাককে বলেন, “রঞ্জি তোমার ব্যাটিং দেখলে খুব খুশি হতো।“
ফ্রাই ছাড়াও সেদিন তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন জ্যাক হবস, পেলহ্যাম ওয়ার্নার, ডগলাস জার্ডিনরাও। মহারাজ কুমার তাঁকে সোনার হাতঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। সহজে কারও প্রশংসা করতেন না যিনি, মুস্তাক আলির সেই ক্রিকেটগুরু সি. কে. নাইডু সেদিন তাঁকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে বড় সম্মান বুঝি তিনি পেয়েছিলেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ড স্টেডিয়ামের একজন প্রবীণ দ্বাররক্ষীর কাছ থেকে। প্রবীণ মানুষটি তাঁকে একটি ছ’পেনির কয়েন উপহার দেন। মুস্তাক তাঁর কাছে জানতে পারেন, এর আগে এই বৃদ্ধের কাছ থেকে এই উপহার পেয়েছেন মাত্র দুজন- দলীপসিংজি ও ডন ব্র্যাডম্যান। এই বিশেষ দিন নিয়ে আত্মজীবনীতে একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায়ই লিখেছেন মুস্তাক। সেখানে লিখছেন, “দিনটা আমার কাছে আরও বেশি করে একটি সোনালী দিন কারণ শুধু বিদেশের মাটিতে ভারতীয় হিসাবে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেছি বলেই নয়, সেদিন আমি মনের মতো করে খেলতে পেরেছিলাম, বাঘা বাঘা ইংরেজ বোলারদের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাঁদের মধ্যস্তরে নামিয়ে আনতে পেরেছিলাম।“
পরদিন সেঞ্চুরি করেন বিজয় মার্চেন্টও। ভাগ্যের ফেরে তিনি হয়ে গেলেন দ্বিতীয়। ১১২ রান করে আউট হন মুস্তাক। ২০৩ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপ ভেঙে যায়। মার্চেন্ট করেন ১১৪। তখন টেস্ট হতো তিনদিনের। ফলে ২৮শে জুলাই ছিল টেস্টের শেষদিন। বাকি ব্যাটসম্যানরা ধৈর্যশীল ব্যাটিং করায় ম্যাচটি ড্র হয়। শেষপর্যন্ত ভারতের রানসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯০-৫। কোটার রামাস্বামী ৬০ রান করেছিলেন।
তৃতীয় টেস্ট হয় কেনিংটন ওভালে। ওয়ালি হ্যামন্ডের ডবল সেঞ্চুরি (২১৭) ও স্ট্যান ওয়ার্থিংটনের সেঞ্চুরির (১২৮) উপর ভিত্তি করে ৪৭১-৮ রানের স্কোর তোলে ইংল্যান্ড। প্রথম ইনিংসে মুস্তাক ও মার্চেন্ট দুজনেই ৫২ রান করেন। কিন্তু ফলো-অন হয় ভারত। দ্বিতীয় ইনিংসে সি. কে. নাইডুর ৮১ রানের ফলে কিছুটা ভদ্রস্থ স্কোর হলেও ইংল্যান্ডের সামনে মাত্র ৬৪ রানের লক্ষ্যমাত্রা রাখে ভারত। ম্যাচের সঙ্গে সিরিজও হারতে হলো ভারতকে। সফরের শেষ ম্যাচটি ছিল একটি প্রদর্শনী ম্যাচ। সেখানে স্যার হেনরি লেভেসন-গাওয়ার একাদশের বিরুদ্ধেও একটি সেঞ্চুরি করেন মুস্তাক (১৪০)। দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৪ রানের একটি সাহসী ইনিংস খেলেন। গোটা সফরে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ ও টেস্ট ম্যাচ মিলিয়ে তাঁর রানসংখ্যা ছিল ১০৭৮। সবশুদ্ধ করেছিলেন চারটি সেঞ্চুরি।
প্রথমবার বিদেশে গিয়েই এমন একক চোখধাঁধানো পারফরম্যান্স ঈর্ষণীয় তো বটেই। ক্রিকেট মানচিত্রে ভারতকে যে বিশেষ স্থান দিতে চলেছেন এই ক্রিকেটাররা, সেবিষয়ে আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন অনেকেই। কিন্তু ভারতের দুর্ভাগ্য, ঠিক যে মুহূর্তে আশায় বুক বাঁধছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা, তখনই গোটা বিশ্বের টালমাটাল পরিস্থিতি থাবা বসাল ক্রিকেটের ভবিষ্যতেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগোতে শুরু করেছে মানবসভ্যতা। সর্বশক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অহংকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ফ্যাসিবাদী শক্তি। এই অবস্থায় আর টেস্ট সিরিজ আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৩৭-৩৮ সালে লর্ড টেনিসনের দল খেলতে এসেছিল ভারতে। সেটাই ছিল ভারতের জন্য মহাযুদ্ধের আগে অনুষ্ঠিত শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। পাঁচটি বেসরকারি টেস্ট ও দশটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ মিলিয়ে মোট পনেরোটি ম্যাচ খেলে ইংরেজ দলটি। এই দলের বিরুদ্ধেই ইডেনের সবুজে ১০১ রান করেছিলেন মুস্তাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি কোনো দেশের ক্রিকেটারই। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বহু ক্রিকেটারই যুদ্ধে যোগদান করেন। হেডলি ভেরিটির তো মৃত্যুও হয় যুদ্ধক্ষেত্রেই। ১৯৪০ সালে ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজের আয়োজন করেও যুদ্ধের কারণে তা বাতিল করতে হয়। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট না হওয়ায় ভারতীয় ক্রিকেটারদের খেলার সুযোগ ছিল একমাত্র দেশীয় টুর্নামেন্টগুলোতেই। মধ্য ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো বোম্বাই কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্ট। খুবই জনপ্রিয় ছিল এই টুর্নামেন্ট। প্রথমে ইউরোপিয়ান, পার্সি ও হিন্দুদের মধ্যে ট্রায়াঙ্গুলার টুর্নামেন্ট হিসাবে শুরু হলেও পরে মুসলিমরাও যোগ দেন। ১৯৩৭ সালে আরও একটি দল, যা কি না গঠিত হয়েছিল বৌদ্ধ, জৈন ও ভারতীয় খ্রিস্টানদের নিয়ে, সেটিও যোগ দেয়। ফলে টুর্নামেন্টটির নাম হয় বোম্বাই পেন্টাঙ্গুলার টুর্নামেন্ট। মুসলিমদের হয়ে এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে ইউরোপিয়ানদের বিরুদ্ধে ১৩৫ রানের একটি ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছিলেন মুস্তাক।
মধ্যভারত, রাজপুতানা, কেন্দ্রীয় প্রদেশ ও বেরার, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, হোলকার, যুক্ত প্রদেশ এরকম বেশ কয়েকটি রাজ্যদলের হয়ে খেলেছিলেন সেসময়। ১৯৩৪ সাল থেকে রঞ্জিতসিংজির স্মৃতিতে শুরু হয় রঞ্জি ট্রফি। রঞ্জিতে তিনি হোলকার দলের হয়ে খেলেছিলেন ১৯৪১ থেকে ১৯৫৫। হোলকারকে মোট চারবার চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন মুস্তাক অ্যান্ড কোং। ছ’বার তাঁরা হয়েছিলেন রানার্সআপ। শুরুতেই যে ডেনিস কম্পটনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই ডেনিস ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে তখন মধ্যভারতের মাওতে কর্মরত। হোলকার দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেলেন তিনি। মুস্তাক ও কম্পটনের ওপেনিং জুটি হয়ে উঠেছিল বিপক্ষ বোলারদের ত্রাস। ১৯৪৪-৪৫ রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে বোম্বাইয়ের কাছে হোলকার হেরে গেলেও দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেছিলেন মুস্তাক, দ্বিতীয় ইনিংসে ২৪৯ রান করে অপরাজিত থেকে গিয়েছিলেন ডেনিস। শেঠ হীরালাল নামের এক ধনী ব্যবসায়ী এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুই ব্যাটসম্যানকে। প্রস্তাবতি ছিল, শতরান পূর্ণ হওয়ার পর ডেনিসকে রানপিছু দেওয়া হবে একশো ভারতীয় মুদ্রা ও মুস্তাককে রানপিছু পঞ্চাশ ভারতীয় মুদ্রা। ম্যাচ শেষে দুজনেই হীরালালের খোঁজে গিয়ে দেখেন তিনি বেমালুম গায়েব। অবশ্য প্রথম ইনিংসে মুস্তাক ১০৯ রান করায় বাড়তি ৯ রানের জন্য ৪৫০ টাকা আদায় করেছিলেন হীরালালের থেকে। ধাপ্পাবাজির পর ডেনিসকে মজা করে বুঝিয়েছিলেন, প্রস্তাবটা শুধু প্রথম ইনিংসের জন্য ছিল।
এর কয়েক মাস পরেই খেলতে আসে অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস দল। তাদের বিরুদ্ধে দিল্লিতে প্রিন্স ইলেভেনের হয়ে দিল্লিতে ১০৮ রানের একটি ঝটিতি ইনিংস খেলেছিলেন মুস্তাক। সেই ম্যাচেই তাঁর প্রথম দেখা হয় কিথ মিলারের সঙ্গে। আজীবন দুজনের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। বোম্বাই টেস্টের আগে ঠাণ্ডা লেগে সর্দিকাশি ও বুকে ব্যথা হওয়ার দরুণ খেলতে পারেননি। কিন্তু কাগজে লেখা হয়েছিল, অজানা কারণে মুস্তাক নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছেন। পূর্বাঞ্চলের বিরুদ্ধে ম্যাচটিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ৫৩ রানের ইনিংস খেলেন মুস্তাক। সব মিলিয়ে তখন ভাল ফর্মে। সেই অবস্থায় টেস্ট দল থেকে বাদ দেওয়ায় স্বভাবতই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল ইডেন জনতা। জনতার এমন ভালবাসায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেও দলীপসিংজির মতো খেলোয়াড়কে এভাবে দর্শকদের হাতে হেনস্থা হতে দেখাটা তিনি একেবারেই বরদাস্ত করেননি। তাঁকে বাদ দেওয়ার জন্য দলীপসিংজিকে এমনভাবে অপমানিত হতে হলো, এ ছিল তাঁর কাছে এক লজ্জা।
১৯৪৬ সালে দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফরে যায় ভারত। এই সফরে অধিনায়ক ছিলেন পতৌদির নবাব। দুই বিজয়-মার্চেন্ট ও হাজারে, দুজনেই তখন তুখোড় ফর্মে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এই সফরেও রাজপুরুষ অধিনায়কের চক্ষুশূল হয়েছিলেন মার্চেন্ট। যেনতেন প্রকারেণ মার্চেন্টকে হেয় করতে চাইছিলেন নবাব। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিরুদ্ধে ২৪২ রান করেছিলেন মার্চেন্ট। এক সপ্তাহ পরেই ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে শেফিল্ডে ২৪৪ রান করলেন হাজারে। যে মুহূর্তে মার্চেন্টকে টপকে গেলেন হাজারে, সেই মুহূর্তেই ইনিংস ঘোষণা করে দিলেন অধিনায়ক নবাব ইফতিকার আলি খান পতৌদি। বরাবর এ ধরনের অভ্যন্তরীণ কূট-রাজনীতির বিরোধী মুস্তাক বীতশ্রদ্ধ হয়ে সব কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তাঁর ক্রিকেটগুরু সি. কে. নাইডুকে। অধিনায়কের এমন হীনতার প্রতি তীব্র শ্লেষ ঝরেছিল তাঁর কথায়, “পতৌদি অনেক বদলে গেছেন, তিনি সব ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে। একটি স্কুলছাত্রও অধিনায়ক হিসাবে তাঁর চেয়ে যোগ্যতর হবে। শুধু আমি নই, সকলেই ওনাকে নিয়ে বীতশ্রদ্ধ। আপনি বিশ্বাস করুন স্যার, দ্বিতীয় টেস্টে অত ভাল শুরুর পর ওই ম্যাচটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসতেই পারত। কিন্তু তা হলো না কারণ তিন নম্বরে অধিনায়ক নিজে না গিয়ে আব্দুল হাফিজকে পাঠালেন। আমার মতে, এই লোকটার থেকে মার্চেন্ট অনেক ভালো অধিনায়ক হবেন।” প্রসঙ্গত, যে দ্বিতীয় টেস্টের কথা বললেন মুস্তাক, সেই টেস্টে ইংল্যান্ডের ২৯৪ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে প্রথম উইকেটে মার্চেন্ট ও মুস্তাক ১২৪ রান তুলে দিয়েছিলেন। মুস্তাক ৪৬ রানে আউট হওয়ার পর আব্দুল হাফিজ কার্দারকে ব্যাট করতে পাঠানো হয়। ধস নামিয়ে দেন মিডিয়াম পেসার রিচার্ড পোলার্ড। মাত্র ৪৬ রানে দশ উইকেট পড়ে যায় ভারতের।
১৯৩৬ সফরের সাথে তুলনা করলে সফরটা একেবারেই ভাল যায়নি মুস্তাকের। টেস্ট ও প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ মিলিয়ে মোট ৬৭৩ রান করেন; গড় ছিল ২৪.০৩। সর্বোচ্চ স্কোর ছিল গ্ল্যামারগন কাউন্টির বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো ৯৩। ১৯৪৭-৪৮ অস্ট্রেলিয়া সিরিজে সহ-অধিনায়ক নির্বাচিত হন মুস্তাক। অধিনায়ক ছিলেন লালা অমরনাথ। কিন্তু তাঁর এক দাদা প্রয়াত হওয়ায় তিনি নাম তুলে নেন। পরে শোক কাটিয়ে উঠে, যেতে রাজি হলেও নির্বাচকরা তাঁকে ডন ব্র্যাডম্যানের দেশে পাঠাতে রাজি হননি। সেই দুঃখ সুদে-আসলে তুলে নিলেন রঞ্জিতে। যুক্তপ্রদেশের বিরুদ্ধে খেললেন ২৩৩ রানের একটি মারকাটারি ইনিংস। এই তাঁর ক্রিকেটজীবনের সর্বোচ্চ স্কোর। সেবার হোলকারকে রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন মুস্তাক।
দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। চল্লিশের দশকের শেষ পর্যায়। ক্রিকেট মানচিত্রের বদল ঘটছে তখন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে বর্ণবৈষম্যের আবহাওয়া অনেকটাই কম। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া নতুন দলও যে বিশ্বসেরা ক্রিকেট খেলতে পারে, এই ধারণার জন্ম হচ্ছে তখন। সেই দলটির নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, ক্লাইড ওয়ালকট, এভার্টন উইক্স, জর্জ হেডলিদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জর্জ হেডলির নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’। কিংবদন্তি ক্রিকেট-লিখিয়ে নেভিল কার্ডাস বলেছিলেন, সবরকমের উইকেটে যদি হেডলিকে খেলানো যেত তাহলে হয়ত দেখা যেত প্রকৃত ব্র্যাডম্যানের চেয়েও ভাল ব্যাটসম্যান হেডলি। ওয়ালকট আর ওরেলের ৫৭৪ রানের পার্টনারশিপের কাহিনী তখন বিশ্বও জুড়ে। ত্রিনিদাদের হয়ে খেলতে নেমে বার্বেডোজের বিরুদ্ধে এই নজির গড়েছিলেন দুই বন্ধু ক্রিকেটার। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবার খেলতে এল ভারতে।
ওদিকে বয়স বাড়ছিল মুস্তাকের। তবে ব্যাটিংয়ে তার কোনো প্রভাব ফেলতে দেননি। হোলকারের হয়ে তাঁর টপ ফর্ম অব্যাহত। কিন্তু নির্বাচকদের চোখে তিনি তখন বাতিলের পর্যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিরিজে দিল্লি ও বোম্বাই টেস্টের দলে জায়গা হলো না মুস্তাকের। বাদ পড়লেন মার্চেন্টও। মুস্তাক ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর টেস্ট জীবনের ইতি ঘটে গেল। প্রশাসনের এমন রাজনীতিতে বিরক্তও ছিলেন তিনি। তৃতীয় টেস্টটা ছিল কলকাতায়। সেই কলকাতা, যে কলকাতা তাঁকে কখনও নিরাশ করে না। একদিন সকালে সংবাদপত্রে দলের তালিকায় নিজের নামটা দেখে চমকে উঠেছিলেন। কিন্তু আবার দেশের হয়ে খেলতে পারবেন, তা-ও সুন্দরী ইডেনে, এটা ভেবেই ভরে গিয়েছিল তাঁর মন। ইডেনের প্রতিটি ঘাসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শিকড় যে অনেক গভীরে, সে কথা আর কেউ না জানুক, মুস্তাক তো জানেন।
এভার্টন উইক্সের ১৬২ রানে ভর করে প্রথম ইনিংসে ৩৬৬ রান করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভারত করল ২৭২। ওপেন করতে নেমে ৫৪ রানের একটি নির্ভরযোগ্য ইনিংস খেললেন মুস্তাক। হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন রুশি মোদি (৮০) ও বিজয় হাজারেও (৫৯)। দ্বিতীয় ইনিংসে আবারও সেঞ্চুরি করলেন উইক্স (১০১)। সেঞ্চুরি করলেন ওয়ালকটও (১০৮)। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়াল ৪৩১। হাতে রয়েছে ৪১৫ মিনিট। চতুর্থ দিনের কিছু সময়, সঙ্গে সম্পূর্ণ পঞ্চম দিন। সাড়ে বারো বছর আগের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডকে ফিরিয়ে আনলেন মুস্তাক। সেই ঝড়ো ব্যাটিং, সেই ভয়ডরহীন ক্রিকেট। সঙ্গী খানমহম্মদ ইব্রাহিম। ৮৫ মিনিটে বিনা উইকেটে রান উঠল ৬৬। শেষ হলো চতুর্থ দিনের খেলা।
পঞ্চম দিনের শুরু থেকেই ব্যাটিংয়ের ধরন একই রেখে দিলেন মুস্তাক। উল্টোদিকে ইব্রাহিম ২৫ রানে ফিরে যাওয়ার পরেও দ্রুত রান করা থামাননি। এবার তাঁর সঙ্গে ব্যাটিং করতে এলেন রুশি মোদি। দুদিক থেকেই চালিয়ে খেলা শুরু হলো। দেখে মনে হয়েছিল, ভারত বুঝি খেলছে জেতার জন্যই, ড্রয়ের জন্য নয়। প্রিয় মাঠে অবশেষে তিন অঙ্কের সংখ্যায় পৌঁছতে পারলেন তিনি (এর আগেও যদিও ইডেনে তাঁর সেঞ্চুরি ছিল টেনিসনের দলের বিরুদ্ধে, কিন্তু তা ছিল বেসরকারি টেস্ট)। বিশ্বযুদ্ধ-বিঘ্নিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের টেস্ট কেরিয়ারের দ্বিতীয় ও শেষ সেঞ্চুরি। ১০৬ রান করেছিলেন সেদিন। ডেনিস অ্যাটকিন্সনের একটি সোজা বলকে ফ্লিক করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হয়ে যখন প্যাভিলিয়নে ফিরছেন, তখন হাততালিতে ভরিয়ে দিচ্ছে তাঁর প্রিয় ইডেন। দীর্ঘ সময় পর দলে ফিরেই সেঞ্চুরি, তা-ও তাঁর প্রিয়তম মাঠে। এমন বর্ণিল ক্লাইম্যাক্সের জন্যেই তো অপেক্ষা করা যায় অনেক দিন। ইডেনের দর্শক তাঁকে যে ভালবাসা দিয়েছিল, সেই কৃতজ্ঞতায় সেঞ্চুরিটি উৎসর্গ করেছিলেন কলকাতাবাসীর প্রতি। আত্মজীবনীতে এই সেঞ্চুরির অধ্যায়টির নামই তিনি দিয়েছিলেন ‘ফর দ্য ক্যালকাটান্স’ সেক’।
কলকাতা টেস্টের আগে গভর্নর একাদশের হয়ে ম্যাচটিতেও খেলেছিলেন মুস্তাক। সেই ম্যাচেই উঠতি খেলোয়াড় হিসেবে নজর কেড়েছিলেন পঙ্কজ রায়। কিছু বছর আগে টেস্ট ডেবিউ করেছেন ভিনু মানকড়ও। ওপেনার হিসাবে দুজনেই তখন নির্বাচকদের প্রথম পছন্দ। ক্রমেই জায়গা হারাচ্ছিলেন মুস্তাক আলি ও বিজয় মার্চেন্ট। ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ড দল খেলতে এল ভারতে। পাঁচ টেস্টের সিরিজ। প্রথম টেস্টে ১৫৪ রান করেছিলেন মার্চেন্ট। ক্যারিয়ারে তাঁর সর্বাধিক রান। কিন্তু সেটাই হয়ে থাকল তাঁর শেষ টেস্ট। ফিল্ডিং করার সময় কাঁধে চোট পেয়েছিলেন। আর খেলেননি। শেষ টেস্টে অবশেষে জায়গা পেলেন মুস্তাক। ওপেন করতে নেমে মাত্র ২২ রান করলেন। পঙ্কজ রায় (১১১) ও পলি উমরিগরের (১৩০) ব্যাটিং এবং ভিনু মানকড়ের বোলিংয়ের সামনে (দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০৮ রান দিয়ে ১২ উইকেট) গুটিয়ে গেল ইংরেজ দল। ইতিহাসে ভারতের প্রথম টেস্ট জয়, তা-ও এক ইনিংস ও ৮ রানের বিশাল ব্যবধানে। দীর্ঘ কুড়ি বছরের অপেক্ষার অবসান।
আব্দুল হাফিজ কার্দারের পাকিস্তান খেলতে এল কিছু পরেই। মুস্তাকের একসময়ের সহযোদ্ধা। কাঁটাতারের ব্যবধান তাঁদের প্রতিপক্ষ করে দিয়েছে। পুরনো টিমমেটের বিরুদ্ধে খেলতে মুখিয়ে ছিলেন নিশ্চিতভাবেই। রঞ্জিতে ওদিকে বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধারাবাহিকভাবে রান পেয়ে যাচ্ছেন। বয়স হয়ে এলেও তখনও ফাস্ট বোলিং সামলানোর অসাধারণ দক্ষতা। পাকিস্তান দলে খান মহম্মদ ও মহম্মদ হুসেনের মতো ফাস্ট বোলার রয়েছে। কিন্তু না, বিস্ময়করভাবে দলে জায়গা হলো না তাঁর। আর টেস্ট খেলা হয়নি বিদেশের মাটিতে ভারতের হয়ে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিকারী ব্যাটসম্যানের। তাই মাদ্রাজে ইংল্যান্ড-বধের ওই ম্যাচই হয়ে থাকল তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট। ইতিহাস গড়ার কারিগরের বিদায়মঞ্চ জয়ীর বরমাল্যেই সজ্জিত হয়েছিল, ঘটনাক্রমেই। সিংহের ডেরায় গিয়ে তার চোখে চোখ রাখার স্পর্ধা যে তিনিই দেখিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে উইজডেনের বিচারে ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হলেন। হোলকারের হয়ে শেষ দুই মরশুমে দলকে ফাইনালে তুললেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। বোম্বাই ও মাদ্রাজের কাছে হেরে রানার্স হয়েই থাকতে হয় তাঁর দলকে। পরে একবছর নবগঠিত উত্তরপ্রদেশ ও একবছর মধ্যপ্রদেশের হয়ে খেলেছিলেন। শেষ ম্যাচ খেলেন ১৯৬৪ সালে, বোম্বাই প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে বোম্বাই গভর্নর একাদশের বিরুদ্ধে একটি প্রীতি ম্যাচে। তখন তাঁর বয়স ৪৯ পার হয়ে গিয়েছে। ওই বয়সেও দিব্যি প্রতিপক্ষের রমাকান্ত দেশাই, গুলাব্রাই রামচাঁদ, সুভাষ গুপ্তে, ভিনু মানকড়দের বোলিং সামলে ৪১ রান করেছিলেন। আসলে মুস্তাক আলি যে কখনোই ফুরিয়ে যাননি।
১৯৬৪ সালে এমসিসির আজীবন সদস্যপদ পান। সে বছরেই ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো তাঁকে পাক নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিলেন। একবার নয়, দু-দু’বার। প্রথমবার, দেশভাগের অব্যবহিত পরে, ১৯৪৮ সালে ও দ্বিতীয়বার, সিমলা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময়ে, ১৯৭২ সালে। দুজনেই দুজনের খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। জুলফিকার বোম্বাইতে তাঁর খেলাও দেখতে যেতেন। কিন্তু বন্ধুর এহেন প্রস্তাব মুস্তাক গ্রহণ করতে পারেননি। পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, ভারতই তাঁর মাতৃভূমি, সেই ভারতকে ছেড়ে অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। মুস্তাকের ছেলে গুলরেজ ও নাতি আব্বাস দুজনেই পরবর্তীকালে ক্রিকেট খেলেছেন। বন্ধুর কথা মনে রেখে নাতিকে ছোটবেলায় জুলফি বলেও ডাকতেন তিনি।
বন্ধু জুলফির রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে দিয়ে একথা পরিষ্কার, স্পষ্ট বক্তা ছিলেন মুস্তাক আলি। মনে-প্রাণে নিপাট ভদ্রলোক হলেও অকপটে ভালকে ভাল, খারাপকে খারাপ বলতে পিছপা হতেন না মুস্তাক। আত্মজীবনী জুড়ে সেই দৃঢ়চেতা মুস্তাককেই পাওয়া যায়। এমন একটা সময়ে ক্রিকেটজগতে তাঁর আবির্ভাব, যখন ক্রিকেট সাধারণ মানুষের খেলা হয়ে উঠতে পারেনি। ক্রিকেটকে চালনা করতেন বিদেশী প্রভু ও দেশীয় রাজারা। ক্রিকেটকে সাধারণ মানুষের আঙিনায় আনতে একশ শতাংশ সক্ষম হয়েছিলেন মুস্তাক আলি, সি. কে. নাইডু, বিজয় মার্চেন্ট, বিজয় হাজারেরা। দলের উপর দেশীয় রাজাদের প্রভাব সৃষ্টির বিষয়টিকে কড়া ভাষায় নিন্দা করেছেন মুস্তাক। সেই মহারাজা খেলায় কতটা দক্ষ, তা না দেখে শুধুমাত্র তার বংশমর্যাদার কথা ভেবে তাকে দলের অধিনায়কের পদ প্রদান করা, একথা বারবারই উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। সেইসময় আরও অনেকেই ছিলেন যাঁদের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রাদেশিকতার কারণে তাঁদের যে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয়নি।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন একসময় ক্রিকেটকে প্রভাবিত করত রাজা-মহারাজারা, এখন করে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। প্রতিভার উপরে প্রাদেশিকতার মাপকাঠি যে কতটা ক্ষতিকর সেটা বারবার বলতেন। বাংলার ক্রিকেটার নির্মল চট্টোপাধ্যায়, কমল ভট্টাচার্য প্রমুখদের সঙ্গে যে অবিচার হয়েছে, এ কথা স্পষ্ট জানিয়েছেন। বাংলার প্রতি তাঁর বরাবরই আলাদা টান। তাই মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ রায়দের ঢালাও প্রশংসা করেছেন তিনি। সাবেকি সময়ের মানুষ, তা-ও নতুন প্রজন্মের সীমিত ওভারের ক্রিকেটকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা করেননি তিনি। মানুষ যা ভালবাসে, সেটাই হওয়া উচিত, এই তাঁর বরাবরের বক্তব্য। তা সত্ত্বেও টেস্ট ক্রিকেটেই যে আসল পরীক্ষা হয় ক্রিকেটারের, তা-ও জানাতে ভোলেননি তিনি। ভারতীয় ক্রিকেটকে বিশ্বের আসনে সুউচ্চ স্থান দিয়েছিলেন যাঁরা, সেই শচিন টেন্ডুলকর, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, অনিল কুম্বলেদের প্রশংসায় মুখর ছিলেন নিজের সময়ের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে থাকা মানুষটি। তাই হয়তো দেশীয় টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতার নামকরণের সময়ে তিনি ছাড়া আর কারও নাম বুঝি ভাবা সম্ভব ছিল না।
‘ক্রিকেট ডিলাইটফুলে’র প্রাককথন লিখতে গিয়ে মুস্তাকের বন্ধু কিথ মিলার তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন ‘এরল ফ্লিন অফ ক্রিকেট’। এরল ফ্লিন ছিলেন হলিউডের স্বর্ণযুগের একজন অস্ট্রেলীয়-আমেরিকান অভিনেতা। অসম্ভব স্টাইলিশ, কেয়ারফ্রি অভিনেতাটি পরিচিত ছিলেন তাঁর ‘সোয়াসবাকলিং’ অর্থাৎ বেপরোয়া মনোভাবের জন্য। মুস্তাক আলির সম্পর্কে একেবারে সঠিক মূল্যায়নটি করেছিলেন কিথ। সেই কিথ চলে গেলেন ২০০৪ সালের ১১ই অক্টোবর। একবছরও পার হলো না। ১৮ই জুন ২০০৫। ঘুমের মধ্যেই চিরঘুমে শায়িত হলেন বন্ধুও, ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার সৈয়দ মুস্তাক আলি।