অধিকাংশ সমস্যার একটা সাধারণ দিক হলো, প্রথম দিকে তা লুক্কায়িত অবস্থায় থাকে। কিন্তু যখন কোন ব্যাপারে তা প্রকট হয়ে পড়ে, তখনই শুরু হয় কাঁটাছেড়া। ১৯ জানুয়ারি আর্সেনালের সাথে চেলসির লজ্জাজনক পারফর্মেন্সের পর আলোয় আসে তাদের চলমান এক বড় সমস্যা, দুর্বল মানসিকতা। কোচ সারি চেলসিতে যোগ দেয়ার সময়ই এক লেখায় বলা হয়েছিলো যে, তিনি আর পাঁচজন প্রথাগত কোচের মত নন। তার উঠে আসা বা দর্শন, সবটাই একটু আলাদা ধাঁচের। সেই আর্সেনাল ম্যাচের পর রাখঢাক না করেই সরাসরি বলে দেন,
‘আমি প্রচন্ড রেগে আছি, আসলেই প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। এই হারের জন্য একমাত্র দায় আমাদের মানসিকতার। ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছিলো লিগে টটেনহ্যামের সাথে। আমার তো মনে হচ্ছে, এই খেলোয়াড়দের উদ্ধুদ্ধ করা বিরাট কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
চেলসির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের সাথে পরাজয়, কিংবা বোর্নমাউথের মতো ক্লাবের বিপক্ষে লজ্জাজনক ৪-০ গোলের পরাজয় প্রথমেই আঙুল তোলে কোচের দিকে। হয়তো কোচের দিকে আঙুল তোলাটাই ফুটবলের চিরায়ত প্রথা। আপনি একবার টুইটারে ‘সারি’ লিখে খোঁজ করলে সবচেয়ে বেশি পাবেন ‘সারিআউট’ হ্যাশট্যাগের পোস্ট। কিন্তু সত্যিই কি কেবল কোচেরই দায়? একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা যাক।
দায় কি কেবল কোচের?
কোনো এক সমান্তরাল আদর্শ পৃথিবীর চেলসিতে এখনো কোচ থাকতেন আন্তোনিও কন্তে। ভগ্নপ্রায় এক চেলসিকে নিয়ে প্রথম মৌসুমেই লিগ ও ঘরোয়া কাপ জেতানো, তার পরের মৌসুমে আবার ঘরোয়া কাপ – এসবই যথেষ্ট প্রমাণ ইংলিশ লিগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগে কন্তের সাফল্যের। একটু পিছিয়ে জোসে মরিনহোর সাফল্যও স্মর্তব্য। কিন্তু উভয়েই লিগ জেতার পরের মৌসুমেই বরখাস্ত। সত্য কথা বলতে, কোচের দায়ের পাশাপাশি চেলসি স্কোয়াডের দুর্বল মানসিকতার খেলোয়াড়দের দায় কি ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? একই রকম কথা উঠে এসেছে চেলসি খেলোয়াড় আন্তোনিও রুডিগারের কথায়, লিস্টার সিটির কাছে হারের পর। তিনিও নিজেদের মানসিকতাকে দোষ দিচ্ছিলেন প্রকাশ্যে।
সারির আমলে আনা খেলোয়াড় যেমন কেপা, কোভাচিচ, জর্জিনহো বাদে এই দলটা ঠিক সেই খেলোয়াড়দের নিয়েই গঠিত, যারা কন্তের বরখাস্তের সময় দলে ছিলেন, তর্কযোগ্যভাবে বলা যায় ‘দায়ী’ ছিলেন। আর অধিকাংশ সময়েই চেলসি বোর্ড সমর্থন দিয়ে যায় খেলোয়াড়দের, আর খড়্গহস্ত হয় ম্যানেজারদের উপর। যতক্ষণ ফলাফল অনুকূলে, ততক্ষণ খেলোয়াড় বা বোর্ড থাকে ম্যানেজারের পাশে, আর ফলাফল বিরূপ হলেই উল্টোপুরাণ। এই চক্র যদি চলতেই থাকে, আর এটাই যদি স্থায়ী সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা ক্লাবের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
এডেন হ্যাজার্ড চেলসির সবচেয়ে বড় তারকা। অথচ প্রতি মাসে তার মুখে অন্তত একবার থাকে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেয়ার আকাঙ্ক্ষা। একজন ম্যানেজার তার দলে কম যোগ্যতাসম্পন্ন খেলোয়াড় নিয়ে খেলতেও রাজি থাকেন, কিন্তু এমন কাউকে চান না যার মন দলের সাথে নেই। সারি এই কাজটাই করেছেন সরাসরি হ্যাজার্ডকে এই কথাটা বলে যে, এখনই তার আদর্শ সময় ক্লাব ছাড়ার। এতেও আবার সমর্থকরা রেগে বসে আছেন। হ্যাজার্ডের সাথে কোচের বাক্যবিনিময় হচ্ছে বেশ কিছুদিন যাবতই। কোচের মতে, হ্যাজার্ডের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা তার খেলোয়াড়ি গুণের সমমানের না! আবার হ্যাজার্ডও মিডিয়ায় বলেন যে, কেউ যেন তার কাছে মৌসুমে ৫০ গোল আশা না করেন! ধরে নেয়া হচ্ছে, হ্যাজার্ড এই মৌসুমের পর চেলসি ছাড়বেন। কিন্তু যদি তিনি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তবে চেলসি বোর্ড কি সারিকে রাখবে, যার সাথে হ্যাজার্ডের সম্পর্ক ততটা ভাল না? সেই চক্র চলতেই থাকবে…
তেতো হলেও কথাটা সত্য যে, কন্তে বা মরিনহো দুজনই বরখাস্ত হয়েছিলেন এমন কিছু খেলোয়াড়ের জন্য, যারা মাসের পর মাস কন্তে বা মরিনহোর কঠোর ট্রেনিং বা চাহিদার উপর ত্যক্ত ছিলেন। এবং এই দুঁদে কোচদের প্রত্যেকের বরখাস্তের সময়ই অনেক তারকা খেলোয়াড়দের মাঠে পারফরম্যান্স বা আচরণ ছিল হতাশাজনক। আর সেই জায়গায় সারির এখনো কোনো বলার মতো শিরোপা জেতা হয়নি পুরো ক্যারিয়ারেই। নাপোলিতে সারির খেলা ইতালিয়ান লিগের ইতিহাসে অনেকটা ১৯৮২ সালের ব্রাজিলের শিরোপা না জেতার সমপর্যায়ের দুঃখজনক ঘটনা হয়ে থাকবে, কিন্তু তার পরও মরিনহো, কন্তের মতো শিরোপা জিতে অভ্যস্ত কোচেরই এই পরিণতি হলে সারি কীভাবে এই খেলোয়াড়দের উদ্বুদ্ধ করবেন, তাও দেখার বিষয়।
কোচদেরও আবার প্রকারভেদ থাকে। একটু যারা ফুটবল দার্শনিক ঘরানার, তাদের সাফল্যের জন্য একটু সময় লাগে, নিজেদের পছন্দসই খেলোয়াড় লাগে। যেমন ম্যানসিটিতে পেপ গার্দিওলার প্রথম মৌসুমটা ছিল ভুলে যাওয়ার মতো। তিন ট্রান্সফার উইন্ডোতে পেপ গার্দিওলা পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলোয়াড় বেচে দিয়েছেন, নতুন কিনেছেন। ফলাফল, এর পরেরবার দাপুটে লিগ জয় আর সেই দ্বিতীয় মৌসুমের শুরু থেকে সিটির খেলা মানেই গোলের পসরা। সেই অনুপাতে চেলসি বোর্ড কি সারিকে সময় দেবে? সারির ইচ্ছেমত খেলোয়াড় দেবে? সবচেয়ে বড় কথা সারিকে কি স্বাধীনতা দেবে? যখন খেলোয়াড়রা বুঝে যায়, ক্লাবে তাদের স্থায়ীত্ব কোচের চেয়ে বেশি, তখন তাদের উপর কর্তৃত্ব করা দারুণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
নীরবে গড়ে উঠা এক বাজে সংস্কৃতি
সর্বশেষ কবে কোনো চেলসি ম্যানেজার তার চুক্তি শেষ করতে পেরেছেন, বা চুক্তি শেষ হওয়ার কাছাকাছি গিয়েছেন? আসলে এটা একটা দুষ্টচক্র। খেলোয়াড়রা যখন বুঝে যায় ক্লাবে তারাই স্থায়ী, কোনো কঠিন অবস্থায় তারা নিজেরা এক হয়ে যান এবং কোপ পড়ে কোচের উপর। এই সবকিছুর দায় বর্তায় মালিক রোমান আব্রামোভিচের উপরও। তা না হলে কীভাবে কার্লো আনচেলত্তির মতো কোচকে প্রথম মৌসুমে দুই হাত ভরে দেয়ার পরও এক মৌসুমের ব্যর্থতার জন্য বরখাস্ত করেন? কীভাবে ক্লাবকে সাফল্যের মূলস্রোতে আনা প্রথম মেয়াদের মরিনহোকে চ্যাম্পিয়নস লিগের মোহে ত্বরিতবেগে বরখাস্ত করেন? একবার হাইপ্রোফাইল কোচের তালিকাটা দেখুন। তিন বছরে দুই লিগসহ পাঁচ শিরোপা জেতানো জোসে মরিনহো, প্রথম মৌসুমে লিগ ও লিগ কাপ জেতানো আনচেলত্তি, চ্যাম্পিয়নস লিগ এনে দেয়া ডি মাত্তেও, পুনরায় লিগ ও কার্লিং কাপ এনে দেয়া মরিনহো, প্রথম মৌসুমেই লিগ ও লিগ কাপ এনে দেয়া আন্তোনিও কন্তে; কেউই সাফল্য এনে দেয়ার পর একটা পুরো মৌসুম সময় পাননি। এটা কি রীতিমতো একটা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়নি?
এখন অবধি রোমান আব্রামোভিচ ও বোর্ড সারির উপর খুশি। এর সবচেয়ে বড় কারণ, সারি এখনও কন্তে বা মরিনহোর মতো খেলোয়াড় কেনার চাহিদা নিয়ে এত দেনদরবার করেন না। এছাড়াও আব্রামোভিচ ক্লাব বিক্রি করার জন্য ইচ্ছুক বলেও খবর উঠে এসেছে, তাই তিনিও এত খরচে ইচ্ছুক নন। লিগ জেতার পর মরিনহোর সবচেয়ে বড় দাবি ছিল একজন সেন্টারব্যাক। ক্লাব দিতে পারেনি, এনে দিয়েছিলো অখ্যাত জিবোজিল নামের এক ডিফেন্ডারকে, যিনি কখনোই চেলসির মাপের খেলোয়াড় নন। কন্তেও তার ইচ্ছেমতো খেলোয়াড় পাননি। কোচের ইচ্ছাকে ক্লাব পূর্ণ সমর্থন না দিলেও খারাপ ফলাফলের জন্য বা খেলোয়াড়রা কোচের উপর আস্থা হারালে সাথে সাথে ক্লাব কোচকে বরখাস্ত করে দিয়েছে। এভাবেই চেলসি নিজেদের অজান্তেই একটা বাজে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে ক্লাবের ভেতর।
প্রিমিয়ার লিগের জন্যই সারির সাফল্য দরকার। ক্রুয়েফ বলেছিলেন, ‘ফুটবল খেলাটা খুব সহজ কিন্তু সুন্দর ফুটবল খেলাটা খুব কঠিন।’ ইউরোপে যে অল্প কয়েকজন এই আপ্তবাক্য মেনে চলেন, সারি তাদেরই একজন। ইতিমধ্যে পেপ বা ক্লপের প্রভাব দেখে ফেলেছে ইংলিশ লিগ। সারি কিন্তু একই ঘরানার কোচ। তার সেই সামর্থ্য আছে, কেবল খেলার সৌন্দর্য্য দিয়ে দর্শক মুগ্ধ করার। কিন্তু সেইজন্য তার দরকার হবে প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা ও সমর্থন। তা না হলে সারিই হবেন চেলসির কোচিং দুষ্টচক্রের নতুনতম শিকার।