বিশ্বকাপের মতো স্বপ্নের মঞ্চে ৫ ম্যাচে ৪ গোল। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে রাশিয়া বিদায় নিলেও ডেনিস চেরিশেভ নিশ্চয়ই খুব ফুরফুরে মেজাজে আছেন। তার প্রতিভা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন ছিলো। এতদিন সেটা করতে তিনি সবসময়ই ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু এবার সেটা তিনি ঠিকভাবেই করে দেখিয়েছেন। ২৭ বছর বয়সে এসে হয়তো তার ক্যারিয়ারের মোড় আবার ঘুরে যাবে, কিন্তু ডেনিস চেরিশেভ কি কখনো তার ক্যারিয়ারের সেই অন্ধকার সময়কে ভুলে যেতে পারবেন?
রাশিয়াতে জন্মগ্রহণ করলেও ডেনিস চেরিশেভ ৬ বছর বয়সেই পাড়ি জমান স্পেনে। তার বাবা দিমিত্রি চেরিশেভকে দলে ভিড়িয়েছিলো স্প্যানিশ ক্লাব স্পোর্টিং গিহন, তাই স্পেনে পাড়ি দেওয়া লাগতোই। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত চেরিশেভ স্পোর্টিং গিহনের একাডেমিতেই বেড়ে উঠেছেন, কিন্ত তারপরই ভাগ্য তাকে নিয়ে যায় এক বিশ্বসেরা ক্লাবে। ১২ বছর বয়সে চেরিশেভ যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদ একাডেমিতে। তাদের হয়ে ছিলেন টানা ১৪ বছর। রিয়াল মাদ্রিদ বি দলের হয়ে ১০৯ ম্যাচে করেছিলেন ২২ গোল। তবে বড় ক্লাবের ছায়া গায়ে মাখলেও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে তার কোনো নজরকাড়া পারফর্মেন্স নেই। মাদ্রিদ একাডেমিতে প্রথম রাশিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে আসলেও তিনি মাদ্রিদের মূল দলের হয়ে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র সাতটি। ২০১৫ সালে রিয়াল মাদ্রিদের অভিষেক ম্যাচে মাত্র ১৩ মিনিট মাঠে ছিলেন তিনি। গ্রানাডার বিপক্ষে সেই ম্যাচ হারে লস ব্লাংকোসরা। আর সেই বছর দ্বিতীয়বারের মটো যখন মাঠে নামেন তখন রচনা হয় সেই কুখ্যাত কোপা দেল রে’র বিতর্কিত ম্যাচের।
২০১৫ সালে ২ ডিসেম্বর। কোপা দেল রেতে কার্দিজের বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচে চেরিশেভ খেলেন ৪৫ মিনিটের মতো। রিয়াল মাদ্রিদ জয় পায় ৩-১ গোলে। পাশাপাশি চেরিশেভও করেন ১টি গোল। কিন্ত ঝামেলা বাঁধে অন্য জায়গায়। আগের মৌসুমে তিনি লোনে খেলতেন ভিয়ারিয়ালের হয়ে। ইয়োলো সাবমেরিনদের হয়ে খেলতে নেমে আগের মৌসুমেই তিনটি হলুদ কার্ড পাওয়ায় তিনি নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্ত রিয়াল মাদ্রিদের কোচ থেকে শুরু করে কেউই তা মনে রাখেনি। নিষিদ্ধ খেলোয়াড়কে খেলানোয় কোপা দেল রে থেকে বাতিল হয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়াল মাদ্রিদের বাদ পড়ার পাশাপাশি চেরিশেভের ক্যারিয়ারে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়। যদিও কোনো দোষ ছিল না তার, দোষ ছিলো তার ক্লাবের। তারপরও তিনি গণমাধ্যম আর সমর্থকদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেই মৌসুমই তার শেষ। পরের বছর পাকাপাকিভাবে ভিয়ারিয়ালের কাছে চেরিশেভকে বিক্রি করে দেয় রিয়াল মাদ্রিদ। নতুন ক্লাবে এসেও থিতু হতে পারেননি তিনি। ইনজুরির সাথে লড়েছেন, ফর্ম হারিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। টানা দুই মৌসুম খেলে গোল করেছিলেন মাত্র ২টি। উত্থান-পতনের ভিড়ে চেরিশেভ যেন গহীন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলেন।
রাশিয়ার বয়সভিত্তিক দলে বেশ ভালোরকম গোল পেতেন তিনি। রিয়ালের যুবদলে ধারাবাহিক ভালো পারফর্মেন্স এবং রাশিয়া অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে নিয়মিত গোল করে ২০১২ সালেই চেরিশেভ অর্জন করেছিলেন রাশিয়ার জাতীয় দলের খেলার সুযোগ। কিন্ত ২০১২ থেকে বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত ১২ ম্যাচ খেলেও চেরিশেভ দলের জন্য কিছু করতে পারেননি। নেই কোনো গোল, এমনকি অ্যাসিস্টও! বিশ্বকাপ শুরুর আগের বছরও চোটে পড়ে এরকম ম্রিয়মান হয়ে ছিলেন। কিন্ত রাশিয়ান কোচ স্তানিস্লাভ চেরচেশভ চেরিশেভকে সুযোগ করে দিলেন স্কোয়াডে থাকার। কিন্তু কোচ থেকে চেরিশেভ নিজেও জানতেন একাদশে তার জায়গা হবে না। কারণ চেরিশেভকে নিয়ে কোচের কোনো পরিকল্পনাই আসলে নেই। হয়ত ডাগআউটে বসে থেকে আর কয়েক মিনিট খেলেই এবারের বিশ্বকাপটা কাটবে তার। কিন্ত বিধাতা যেন শেষবারের মতো চেরিশেভকে বাজিয়ে দেখতে চাইলেন। দেখতে চাইলেন ২০১৪ বিশ্বকাপে যে প্রতিভার ঝলক দেখে তৎকালীন কোচ ফ্যাবিও ক্যাপেলো তাকে দলে ডেকেছিলেন, সে প্রতিভা এখনো জীবিত আছে কিনা!
১৪ জুন, রাশিয়া। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ স্বাগতিক রাশিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামবে সৌদি আরব। রাশিয়ার স্কোয়াডে ডেনিশ চেরিশেভ নেই। থাকার কথাও নয়। ২৫ মিনিটে মিডফিল্ডার অ্যালান জাগোয়েভকে হারায় রুশরা। ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে জাগোয়েভ মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। তার ইনজুরির কারণে কপাল খুলে যায় চেরিশেভের। কোচ চেরচেশভ জাগোয়েভের বদলি হিসেবে নামান চেরিশেভকে। দেয়ালে তার পিঠ ঠেকে গিয়েছিলো। কিছু একটা তাকে করতেই হতো। কারণ চেরিশেভ জানতেন এ ম্যাচে কিছু না করতে পারলে হয়ত পুনরায় মাঠে নামার সুযোগটাই হাতছাড়া করবেন, আর সুযোগ সবসময় আসে না। মাঠে নেমে ৪১ মিনিটে রাশিয়ার হয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম গোল করেন তিনি। সেই ম্যাচে করলেন মোট ২টি গোল। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ৭৮ হাজার দর্শকের সামনে হারিয়ে যাওয়া একজন নতুনভাবে ফিরে এসে বনে গেলেন হিরো। প্রথম ম্যাচে রাশিয়া জিতলো ৫-০ গোলে। চোখের পলকে নায়ক বনে যেতে সময় লাগে না। তেমনই দুর্দান্ত জয়ের পরে চেরিশেভ রাশিয়ার নায়ক হতে সময় লাগলো না।
মিশরের সাথে দ্বিতীয় ম্যাচ জিতলেই শেষ ১৬ নিশ্চিত করবে স্বাগতিকরা। ডেনিস চেরিশেভ আবারও তার গোলের ধারা বজায় রাখলেন। বিশ্বকাপের মঞ্চে টিকে থাকলো তার রাশিয়া। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, রোমেলু লুকাকুর সাথে তিনিও ছুটে চললেন সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার দৌড়ে। দুই ম্যাচে তিন গোলের পর আরও একটা দুর্বিষহ সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিলো চেরিশেভকে। উরুগুয়ের সাথে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে হেরেছিলো রাশিয়া। চেরিশেভ করেছিলেন আত্মঘাতী গোল। তবে এবার তাকে রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকদের মতো কটু কথা শুনতে হয়নি। সকল রুশ ভক্ত ছিলো তার পাশে। ২ ম্যাচে টানা ৩ গোলের ভালোবাসার পুরষ্কার চেরিশেভ পেয়েছেন হাতেনাতে।
স্পেন বধের ম্যাচে একাদশে ছিলেন না চেরিশেভ। ৬১ মিনিটে মাঠে নেমেছিলেন বটে, তবে গোল করে দলকে লিড এনে দিতে পারেননি। পেনাল্টি শ্যুটআউটে যেখানে কোকে ও আসপাসের মতো খেলোয়াড় পেনাল্টি মিস করে বিপাকে ফেলে দিয়েছিলো স্পেনকে, সেখানে রাশিয়ার হয়ে চেরিশেভ ঠাণ্ডা মাথার শটে গোল করেছিলেন। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ৩১ মিনিটের চোখ ধাঁধানো গোলে রাশিয়াকে লিড এনে দিয়েছিলেন এই চেরিশেভই। হয়ত কখনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি নিজের প্রতিভাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, হয়তো তিনি ছিলেন না খুব পরিচিত কোনো খেলোয়াড়। তবে বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে তিনি যেভাবে নিজেকে রাঙিয়ে গেলেন, পুরো ফুটবল বিশ্ব তাকে মনে রাখতে বাধ্য।
কোচ স্তানিস্লাভ চেরচেশভ নিজেই বলেছেন, “বিশ্বকাপের আগে আমাদের নিয়ে তেমন উচ্চাশা ছিল না দেশবাসীর।” হয়তো আসলেই ছিলো না। কারণ দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মতো কোনো পরিচিত খেলোয়াড় ছিল না দলে। আকিনফিভ ছিলেন, তিনি সময়ত সবসময় জ্বলে উঠেছেন। আর বিশ্বকাপে রুশ দলটা খেলেছে তাদের পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের শক্তি দিয়ে। তবে ছিলেন কুজায়েভ, সদ্য কুঁড়ি হতে ফুল ফোটা গোলেভিন আর নিজেকে হারিয়ে খোঁজা চেরিশেভ। তাই রাশিয়া নিশ্চিতভাবে প্রত্যাশা থেকে অনেক বেশি পেয়েছে।
নিজেদের দলগত সাফল্য ছাড়াও রুশরা ফিরে পেয়েছে হারিয়ে যেতে বসা এক খেলোয়াড়কে, যিনি ফিরেছেন জিরো থেকে হিরো হয়ে। নিজের ক্যারিয়ারের অনেকটা সময় প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তবুও এখনো ৬ বছর অনায়াসে খেলে যেতে পারবেন চেরিশেভ। তবে তিনি চলতি ফর্ম ধরে রাখতে পারেন কি না সেটিই এখন মুখ্য। বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের দৌলতে হয়ত কোনো বড় ক্লাব থেকে ডাক আসলেও আসতে পারে! তবে নতুন কোনো ক্লাব হোক অথবা স্পেনের ভিয়ারিয়াল হোক, ডেনিশ চেরিশেভকে অন্তত টিকে থাকতে হবে তার দেশের জন্য। কারণ এ বিশ্বকাপের পর রাশিয়ার চালিকাশক্তি হয়তো তিনিই হবেন।
ফিচার ইমেজ: EFE-EPA