পাঠকদের উদ্দেশ্যে শুরুতেই একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজের সেরা শট কোনটি? প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ পাল্টা প্রশ্নও ছুঁড়তে পারেন, ‘আপনার চোখে সেরা কোনটি?’ এই লেখকের পছন্দ স্পষ্ট, মিশেল স্টার্ককে মারা আফিফ হোসেন ধ্রুবর লফটেড কভার ড্রাইভে সেই বাউন্ডারিটা। খুব সম্ভবত বেশিরভাগ ভোটই যাবে আফিফের ওই কভার ড্রাইভেই।
ঘটনা দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির। জেতার জন্য ২৮ বলে ২৭ রান প্রয়োজন বাংলাদেশের। বোলিংয়ে ছিলেন স্টার্ক, স্ট্রাইকে আফিফ। ওয়াইডিশ ফুল লেংথ ডেলিভারিটাকে ফ্রন্টফুটে কভার রিজিওনে যেভাবে তুলে মারলেন, গ্যালারিভর্তি দর্শক থাকলে হৈ-হুল্লোড় আর করতালির আওয়াজে মিরপুরে কান পাতা দায় হতো। আর ফলোথ্রু’তে ব্যাট ধরে রেখে কভারপানে চাহনিটা? আইকনিক! ক্রিকইনফো লাইভ কমেন্ট্রি মনে করিয়ে দেয়, কুমার সাঙ্গাকারা-সৌরভ গাঙ্গুলিরা অমন কভার ড্রাইভ করতেন। তারা দেখলেও হয়তো হাততালি দিয়ে উঠতেন। ম্যাচের অমন পরিস্থিতিতে যে কর্তৃত্ব আর দাপট দেখিয়ে আফিফ শটটা খেলেছেন, সেটাই হয়ে রইল গোটা সিরিজের প্রতীকী চিত্র।
পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজটা বাংলাদেশ জিতেছে ৪-১ ব্যবধানে, তাও অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে। অতীত বিবেচনা করলে অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়, অভূতপূর্বসহ এ ধরনের আরো অনেক বিশেষণই ব্যবহার করা উচিত সামগ্রিক চিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে। তবে সাকিব আল হাসান, মুস্তাফিজুর রহমান, শরীফুল ইসলাম, নাসুম আহমেদরা গত এক সপ্তাহে অজিদের যেভাবে নাকানিচুবানি খাইয়েছেন, যে দাপট দেখিয়েছেন, সেসব একবার রিওয়াইন্ড করলে ওই বিশেষণগুলোও ফিকে মনে হবে। তার চেয়ে বড় কথা, অজিদের খাবি খেতে দেখা মিরপুরের সাধারণ দৃশ্য হয়ে ওঠেছিল।
ইতিহাস, অর্জন, দম্ভ, দাপট – অভিধানের এই শব্দগুলোর দারুণ সন্ধি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের সাথে। ডন ব্র্যাডম্যান থেকে শুরু করে স্টিভেন স্মিথ। অনেক বড় বড় নামই সোনালী দিন দেখেছেন, সাফল্যের পতাকা উড়িয়েছেন। সেই পরাক্রমশালী দলের প্রতিনিধিদের রীতিমতো বলেকয়ে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ইনজুরিতে পড়ে স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, অ্যারন ফিঞ্চরা ছিলেন না অস্ট্রেলিয়ার এই সফরে। তামিম ইকবাল, লিটন দাসও খেলতে পারেননি একই কারণে। মুশফিকুর রহিম অবশ্য কাটা পড়েছেন অজিদের কোভিড প্রোটোকলের মারপ্যাঁচে। গোটা সিরিজজুড়েই তাই দুই দলের বিবর্ণ ব্যাটিং চোখে লেগে রইল। তবে কথা থেকে যায়, মিরপুরের এই স্লো ট্র্যাকে অজিদের বড় নামগুলোও ঠিকমতো টিকে থাকতে পারতেন কি?
জয়ের মার্জিনগুলো দেখুন। ২৩ রান, পাঁচ উইকেট, ১০ রান ও ৬০ রান। মাঝে চতুর্থ ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়া জিতেছে তিন উইকেটে। প্রথম ম্যাচের কথাই বলা যাক। ১৩১ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর দর্শকদের বেশিরভাগই ভাবেননি, ম্যাচটা জেতা সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার এই দলটা তুলনামুলক অনভিজ্ঞ হলেও জশ ফিলিপ, মিচেল মার্শ, মোজেস হেনরিকসরা তো বিগ ব্যাশের বড় নামই। তবু এক মার্শ ছাড়া অন্য কেউ সুবিধা করতে পারলেন কই! বোলারদের দাপটে অজি ব্যাটসম্যানদের অসহায় আত্মসমর্পণ। ম্যাচের শুরুতে হাই-স্কোরিং উইকেট মনে হলেও অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের প্রথম বলেই ধারণা বদলে গেল মাহেদী হাসানের কল্যাণে। ভেতরে ঢোকা দারুণ এক টার্নিং ডেলিভারিতে অ্যালেক্স ক্যারিকে ক্লিন বোল্ড! এর চেয়ে ভালো শুরু তো আর হতেই পারে না।
এরপর নাসুমের বাঁহাতি স্পিনের ধকল সইতে পারল না অজিদের টপ অর্ডার। ছায়া হয়ে ছিলেন সাকিব, তবে রানের ঘোড়ার লাগাম টেনেছেন মুস্তাফিজ। কবজির মোচড়ে ছুঁড়েছেন একের পর এক দুর্বোধ্য অফ কাটার – যার উত্তর খুঁজে পায়নি অস্ট্রেলিয়া। মুস্তাফিজের সাথে ছিলেন আরেক বাঁহাতি পেসার শরীফুল ইসলাম, পেসের ভ্যারিয়েশনে অজি টেলএন্ডারদের থামিয়েছেন। তাদেরই নৈপুণ্যে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারায় বাংলাদেশ।
সেখানেই শুরু, এরপর টানা দুই ম্যাচ জিতে সিরিজ নিশ্চিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ হয়, তাও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে; ক্রিকেটের যে সংস্করণে টেস্টের মতোই নাজুক বাংলাদেশ। চতুর্থ ম্যাচটাও জিততে পারত বাংলাদেশ, কিছু যদি-কিন্তুর হিসেব মিললেই হয়ে যেত। স্কোরবোর্ডে আর অল্প কিছু রান জমা হলেই অস্ট্রেলিয়ার সান্ত্বনা পুরস্কারটাও কেড়ে নিতে পারতেন সাকিবরা, অজিদের দিতে পারতেন হোয়াইটওয়াশের স্বাদও।
নজর ফেরানো যাক সিরিজের শেষ ম্যাচটায়, যেখানে অস্ট্রেলিয়াকে পাত্তাই দেয়নি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্কোরকার্ডে মাত্র ১২২; আগের ম্যাচে স্বস্তির জয় পাওয়া অস্ট্রেলিয়া শিবিরেও হয়তো বইছিল জয়ের সুবাস। সেই সুবাসে আরেকটা হারের গন্ধ মিশিয়ে দিতে নাসুম সময় নিলেন মাত্র এক বল। আগের ম্যাচে সাকিবের এক ওভারে পাঁচ ছক্কা মারা ড্যানিয়েল ক্রিস্টিয়ানকে বোল্ড করে শুরু। মড়ক লাগল যেন সেখানেই; অস্ট্রেলিয়া আটকে যায় মাত্র ৬২ রানে। টি-টোয়েন্টিতে তাদের সর্বনিম্ন স্কোর। দলীয় ৫০ রানের আগেই চার ব্যাটসম্যান ড্রেসিংরুমে। মাত্র নয় রানের ব্যবধানে বাকি উইকেটগুলো হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার চমকে যাওয়া তখনও বাকি। চমক শেষ হলো সাকিবের বাঁহাতি ঘূর্ণিতে জাম্পা আউট হওয়ার পর।
সাকিব দ্য কামব্যাক কিং
কামব্যাক বা ফিরে আসা – এই ব্যাপারটিতে ‘রাজকীয়’ শব্দটি যুক্ত করতে বারবার বাধ্য করেছেন সাকিব। কখনো নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরেছেন, কখনো ইনজুরির ধকল সামলে। কিন্তু যখনই ফিরেছেন, চারপাশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এমন উদাহরণ অনেকই রয়েছে; সবচেয়ে টাটকাটি যেমন এই সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে।
১০৫ রানের লক্ষ্য অস্ট্রেলিয়ার সামনে। আবারও সেই লো-স্কোরিং ম্যাচ। তিন নম্বরে নেমে বুস্টার ব্যাটিংয়ে লো-স্কোরিং ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন ক্রিস্টিয়ান। যেখানে পুরো সিরিজেই ছড়ি ঘুরিয়েছে স্পিনাররা, সাকিবকে গুনে গুনে সেখানে মারলেন এক ওভারে পাঁচটা ছক্কা। ভাবা যায়! সাকিব ছিলেন দারুণ খরুচে, চার ওভারে দিয়েছেন ৫০!
পরের ম্যাচেই সাকিব দেখা দেন স্বরূপে। পুরো চার ওভারও করতে হয়নি। তার পুরো স্পেলের দুই বল বাকি থাকতেই গুটিয়ে যায় অজিরা। মাত্র নয় রানের খরচায় নেন চার উইকেট।এক ম্যাচে কয়েকটা ওভারের ব্যবধানে চিত্রনাট্যের কী অবাক পরিবর্তন। এভাবেও সম্ভব বারবার ফিরে আসা?
খোলাসা করলেন সাকিব নিজেই। ১১৪ রান ও সাত উইকেট নিয়ে সিরিজসেরা হওয়া সাকিব ম্যাচ শেষে কথা বলেছেন তার এমন রাজসিক প্রত্যাবর্তন নিয়ে। সাকিবকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আগের ম্যাচে পাঁচ ছক্কা খেয়েছেন, এই ম্যাচে এভাবে ফিরেছেন, আপনি রক্তমাংসে গড়া সাধারণ কোনো মানুষ তো?
প্রশ্ন শুনে সাকিবও হেসে ফেলেন। তবে উত্তরটা দিয়েছেন বেশ সিরিয়াস হয়েই। সাকিবের ভাষ্য,
‘অবশ্যই আমি মানুষ। অনেকেই এসবে প্রভাবিত হয়, অনেকে হয় না। আমি নিজেকে হয়তো ওভাবেই তৈরি করে নিতে পেরেছি। আমার চারপাশটা এমন যে ওখানে আমার উপরে প্রভাব ফেলার সম্ভাবনাটা অনেক কম। তো সেদিক থেকে আমি অনেক ভাগ্যবান।’
দুর্দান্তভাবে ফিরে আসার এই ম্যাচে সাকিবের চার নম্বর শিকার জাম্পা। আর এই শিকারের মধ্য দিয়েই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সাকিব পকেটে পুরলেন ১০০তম উইকেট। এরই সাথে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ১৫০০ রান ও ১০০ উইকেট নেয়া একমাত্র ক্রিকেটার এখন সাকিবই।
মায়াবী মুস্তাফিজ
একটা সময় ছিল, যখন মুস্তাফিজ বল হাতে নিলেই মনে হতো, ‘এই বুঝি উইকেট পড়লো।’ ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথচলা শুরু তার। এরপর কেটে গেছে ছয় বছর। পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় বয়ে গেছে কত জল। ক্রিকেটও দেখেছে কত ঘটন-অঘটন। তবে একটা জিনিস ঠিক সেই আগের মতোই আছে, মুস্তাফিজের অফ কাটার। শুরুতে ব্যাটসম্যানরা যেভাবে খাবি খেতেন তার কাটারগুলোর দুর্বোধ্যতায়, এখনো ঠিক তাই। অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা সবচেয়ে বড় সাক্ষী। স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটসম্যান জানেন মুস্তাফিজের গ্রিপ থেকে কী ধরনের ডেলিভারি ছুটে যাবে তার দিকে। কিন্তু উত্তর জানা নেই। উত্তর খোঁজার চিন্তাটা আরো জটিল হয়ে যায়, যখন নিরীহদর্শন মুস্তাফিজ সেই কাটারগুলোতে যুক্ত করেন পেসের ভ্যারিয়েশন। এছাড়া ওয়াইডিশ ইয়র্কারেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন ব্যাটসম্যানদের। কেবল বাঁ কব্জির মোচড়ে একটা দলের ব্যাটসম্যানদের গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়া… অসাধারণ।
এই যেমন চতুর্থ ম্যাচের কথাটাই ধরা যাক। স্ট্রাইকে ছিলেন ক্রিস্টিয়ান। মুস্তাফিজ গেছেন বোলিংয়ে। ডাগআউটে বসে বাকি তিন ম্যাচে মুস্তাফিজকে বেশ ভালো করেই দেখেছেন তিনি। মনে মনে হয়তো তৈরিও হয়ে ছিলেন মুস্তাফিজের অফ কাটারের জন্য। ক্রিস্টিয়ানই ঠিক, একটা অফ কাটারই ছুটে গেল তার উদ্দেশ্যে। কিন্তু অ্যাপ্রোচ হবে কী, কোন শটই বা খেলবেন? ব্যাটেই লাগল না বলটা। মুস্তাফিজের দিকে রীতিমতো হাসতে শুরু করলেন ক্রিস্টিয়ান। মুচকি হাসিতে পাল্টা জবাব ছিল মুস্তাফিজের। দুই ম্যাচ যেতে না যেতেই অ্যাশটন অ্যাগার বুঝে গেছিলেন মুস্তাফিজ ঠিক কতটা দুর্বোধ্য। অ্যাগারের ভাষায়, মুস্তাফিজ আনপ্লেয়েবেল। অর্থাৎ মুস্তাফিজের বল খেলাই যায় না।
He is really good. His ability to bowl that slower ball… if you watch it in slow motion, he pretty much does it with his wrist and his fingers. It’s incredible, incredible skill.
সিরিজের পাঁচ ম্যাচে নিয়েছেন ৭ উইকেট। তবে উইকেটসংখ্যা দিয়ে যদি মুস্তাফিজকে কেউ বিচার করেন, তা সমীচীন হবে না একেবারেই। যে সুর-তাল-ছন্দ-লয়ে বল করেছেন মুস্তাফিজ, ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে তা পৌঁছেছে দারুণ এক গান হিসেবে। সেই গানের তালে মাতোয়ারা হয়েছেন বাংলার ক্রিকেট সমর্থকরা।আর ২২ গজের ওই উইকেটে উত্তর খুঁজে বেরিয়েছে অজি ব্যাটসম্যানরা।
তৃতীয় টি-টোয়েন্টির কথাই বলি। শেষ দুই ওভারে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল ২৩ রান। ১৯তম ওভারে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বল তুলে দিলেন মুস্তাফিজের হাতে। সেই ওভারে দিলেন মাত্র ১ রান। ম্যাচ তো ওখানেই জিতে গেছে বাংলাদেশ। সেই ওভারের প্রথম দুটো বল খেলেছিলেন ক্যারি। আর শেষ চারটিতে কখনো মিডল করতে চেয়েও পারেননি ক্রিস্টিয়ান। আবার কখনো উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে মারতে গিয়ে বনেছেন বোকা। এই মুস্তাফিজকে আজীবন এভাবেই দেখতে চাইবে বাংলাদেশ। নিরীহ, সারল্যমাখা হাসি, উদযাপনে শিশুসূলভ হাততালি। কিন্তু এর নেপথ্যে যে কাটার, তা বিষাক্ত, মায়াবী ও দুর্বোধ্য।
আলাদা করে বলতে হবে অধিনায়ক রিয়াদের কথা। টি-টোয়েন্টির অধিনায়কও তার হওয়ার কথা ছিল না। ঘটনাচক্রে সেই দায়িত্ব এসে বর্তেছে তার ওপর। সেই রিয়াদের নেতৃত্বেই রচিত হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম এক সিরিজ জয়ের গল্প। পুরো সিরিজেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং সবখানেই ছিলেন সরব। ব্যাটিং ইনটেন্ট নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন উঠতে পারে, টি-টোয়েন্টি দলে চার নম্বরে উঠে এসে আদৌ কতটা সুবিধা করে উঠতে পারছেন, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই। বোলিং চেঞ্জের টোটকাগুলোও কাজে লেগেছে বেশ। সিরিজ শুরুর আগেই কথা বলেছেন দলের বোলারদের সাথে। জানিয়েছেন, তাদের ওপরই নির্ভর করছে দলের ভাগ্য। আসলেই তো তাই। বোলাররাই গড়ে দিয়েছেন পার্থক্য।
নাসুম আহমেদ। অল্প ক’ম্যাচের অভিজ্ঞতা এই বাঁহাতি স্পিনারের। পাঁচ ম্যাচে আট উইকেট নিয়ে যৌথভাবে হয়েছেন সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী।
স্পিন সহায়ক উইকেটে খেলা হলেও বাংলাদেশের পেসাররাও দেখিয়ে দিয়েছেন, স্পিনই একমাত্র শক্তির জায়গা নয়। শরীফুল-মুস্তাফিজ দুই বাঁহাতি পেসার মিলে এই সিরিজে নিয়েছেন ১৪ উইকেট। দু’জনের সম্মিলিত ইকোনমি রেটটাও চমকপ্রদ, ৪.৭৭। শরীফুল কাটারে সিদ্ধহস্ত না হলেও গতির মিশ্রণটা ভালোই করতে পারেন। আগ্রাসী মনোভাবটাও বোনাস। মার্শ টের পেয়েছেন ব্যাপারটা। এক ম্যাচে সুযোগ পেয়ে বাজিমাৎ করেছেন আরেক পেসার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। লাইন-লেংথ ঠিক রেখে শুধু গতির হেরফের করেছেন আঙুলের কারসাজিতে। ব্যস! ওতেই সাইফের ঝুলিতে ১২ রানে তিন উইকেট।
এতক্ষণ ধরে বোলারদের স্তুতি গাইতে গাইতে ব্যাটসম্যানদের কথা বলাই হয়নি। দুই দলের ব্যাটসম্যানরাই ভুগেছেন। পাঁচ ম্যাচের একটিতেও দেখা যায়নি দেড়শ পেরোনো স্কোরবোর্ড। লো-স্কোরিং এই সিরিজে ব্যাট হাতে একটু ধারাবাহিক ছিলেন ওপেনার নাইম শেখ। এমন স্লো উইকেটে ৩০, ২৮, ২৩ রানের মতো স্কোর একেবারেই খারাপ নয়। তবে সমস্যার জায়গা দুটো — স্ট্রাইকরেট আর ইনটেন্ট। এই দুটো জায়গায় যে অনেকটা পিছনে পড়ে যাচ্ছেন!
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভয়ডরহীন ক্রিকেটের দারুণ একটা উদাহরণ আফিফ হোসেন ধ্রুব। সিরিজের তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের মালিক। এসব ছাপিয়ে বিজ্ঞাপন হয়ে থাকবে হেঁটে হেঁটে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ফ্লিক করে মিড উইকেট দিয়ে তার মারা ছক্কাটা। স্টার্ককে মারা লফটেড কভার ড্রাইভের কথা তো শুরুতেই বলেছি। সেই ম্যাচেই নুরুল হাসান সোহানকে নিয়ে ৫৬ রানের জুটি গড়ে ম্যাচ জেতান। সিরিজের শেষ ম্যাচ; মাত্রই আউট হয়েছেন সৌম্য। পরের বল খেলবেন আফিফ। ক্রিস্টিয়ানের ফুল লেংথের ওয়াইডিশ ডেলিভারিটাকে ইনসাইড আউট করে এক্সট্রা কভার দিয়ে যেভাবে আছড়ে ফেলেছেন, স্পিন পিচের কথা কেউ ভাববেই না। ন্যাচারাল হিটিং অ্যাবিলিটি, সিঙ্গেল রোটেশন, আর তার সাথে চ্যাম্পিয়ন ইনটেন্ট; তিনে মিলে বাংলাদেশ হয়তো ভরসা রাখতেই পারে আফিফের ব্যাটে।
উইকেটকিপার সোহান, মাঠে সবচেয়ে সরব আর চটপটে। ফিল্ডিং রোটেশন কিংবা কথা বলে সতীর্থদের চাঙ্গা রাখায় তার জুড়ি মেলা ভার। সাথে বিশ্বস্ত গ্লাভসজোড়া তো আছেই তার। গ্যালারি ফাঁকা থাকায় স্টাম্প মাইকের বদৌলতে সোহানের গলা বেশ শুনতে পেয়েছেন দর্শকরা। শেষ ম্যাচটাতে সাকিবকেই তিনি বলছিলেন,
‘ভাই জলদি করেন, অনেকদিন পর বাসায় যাব।’
অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবারের মতো হারানো শেষ, সিরিজ জেতা শেষ, অল্পের জন্য হোয়াইটওয়াশ করতে না পারলেও শেষ ম্যাচে ব্যবধানটাও ৪-১ করা তখন নিশ্চিত। বায়োবাবলে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়া সোহান যেন দলের সবার মনের কথাটাই বলে দিলেন। অবশ্য সেই কথার পর বাসায় যেতে সোহানের আর কোনো বাধাই ছিল না। ততক্ষণে সাকিবের ১০০তম উইকেটের খাতায় নাম উঠেছে জ্যাম্পার।
অস্ট্রেলিয়ার সাথে ২০০৫ সালে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ, ২০১৭ সালে ঘরের মাঠে এক টেস্ট জেতা ছাড়া বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এই পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার কাছেই কতবার নাজেহাল হয়েছে বাংলাদেশ। নত মস্তকে ড্রেসিংরুমে ফিরেছেন আফিফ-সোহানদের উত্তরসুরিরা। ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পিদের একেকটা ডেলিভারির উত্তর জানা ছিল না তাদের। সীমিত সামর্থ্য নিয়েও রিকি পন্টিংদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তেন বোলাররা। মার খেতেন, ভুগতেন। সেই সময় আমূল বদলে গেছে এখন। বাংলাদেশের নবীন এক বাঁহাতি স্পিনার নাসুম, তার স্পিনে নাকাল হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার। স্টার্ক-হ্যাজলউডদের নির্ভয়ে বাউন্ডারির ওপারে আছড়ে ফেলছেন এক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান আফিফ। স্লেজিংয়ের জবাবে উইকেট আদায় করে নিচ্ছেন শরীফুল। বিশ্বনন্দিত পেসার মুস্তাফিজের কাটারে নাজেহাল হচ্ছে অজিদের গোটা ব্যাটিং লাইনআপ। সব্যসাচী এক অলরাউন্ডার সাকিবের অভিজ্ঞতার রোশনাইয়ে ঝলসে যাচ্ছে তাদের দৃষ্টি। এই সবকিছুকে এক সুতোয় গেঁথে হেসেখেলে অস্ট্রেলিয়াকে হারালো বাংলাদেশ। বাংলার ক্রিকেটাকাশে এই পাল্টানো সময়ের রংধনুতে লেখা থাকবে: বাংলাদেশ ৪-১ অস্ট্রেলিয়া।