বিশ্ববিখ্যাত পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রেড বুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডাইরিখ মাতেসিতজই কোনো একসময় বলেছিলেন, “এটি আপনাকে উড়ার অনুভূতি জোগাবে”। হয়তো সেদিন তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের পণ্যের প্রশংসা করতে গিয়ে এই কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবিক তার সবকটা প্রতিষ্ঠানের মতো সফল আরও একটি প্রতিষ্ঠান বর্তমান ফুটবল দুনিয়ায় আলো ছড়াচ্ছে। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে জার্মানির চতুর্থ বিভাগ থেকে মূল লিগে খেলার পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ফুটবলেও নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিচ্ছে দলটি।
গত মাসেই নিজেদের ইতিহাসে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম নক আউট পর্বের ম্যাচ খেলেছিল দলটি। প্রতিপক্ষ ছিল গতবারের রানার্স-আপ টটেনহাম। স্পার্সদের ডেরা থেকে জয় নিয়ে ফিরতে সক্ষম হয়েছিল নবাগত জার্মান জায়ান্টরা। ৩২ বছর বয়সী কোচ ইউলিয়ান নাগলসমান নেতৃত্বে দলটি জার্মান লিগেও নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে। তরুণ ফুটবলারদের সমন্বয়ে গড়া দল নিয়েও চলতি মৌসুমে পয়েন্ট টেবিলের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দলটি। বলছিলাম টিমো ওয়ার্নার, ইয়সুফ পওলসেন, অ্যাঞ্জেলিনোদের রাজেন বলস্পোর্ট লাইপজিগের কথা। সংক্ষেপে, আরবি কিংবা রেড বুল লাইপজিগ হিসেবে পরিচিত ক্লাবটি চলতি মৌসুমে বেশ উজ্জীবিত ফুটবল উপহার দিচ্ছে।
এমন উজ্জীবিত ফুটবলের কারণে বেশিরভাগ জার্মান সমর্থকরা ঘৃণার চোখে দেখে একে। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে কোনো দল এমন অভাবনীয় উন্নতি করেছে কি না জানা মুশকিল। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রেড বুল হওয়াতেই হয়তো বা এমন অভূতপূর্ব পরিবর্তন হয়েছে দলটির। যদিও দলবদলের ইতিহাস বলছে অতীতে তেমন কোনো তারকা খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ায়নি তারা। এখন পর্যন্ত দলবদলের বাজারে শালকে, বায়ার্ন মিউনিখ কিংবা বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের মতো শত মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করেনি দলটি। তারপরেও সমানে সমানে টক্কর দিয়ে যাচ্ছে লাইপজিগ। আর এই কারণেই হয়তো বেশিরভাগ জার্মান সমর্থকের চোখের বালি ক্লাবটি।
রেড বুল লাইপজিগের এমন উত্থান নিয়ে জানার আগ্রহ অনেকের। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আজকের আলোচনা। এই লেখার মাধ্যমে দলটির অতীত ইতিহাস, বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছানো অবধি পথচলা কেমন ছিল এবং ভবিষ্যতে তাদের পরিকল্পনা কেমন হবে সেসব নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
জার্মান ফুটবলে রেড বুলের অভ্যুদয়
২০০৬ সালে সর্বপ্রথম লাইপজিগ শহরের স্থানীয় ক্লাব এফসি সাচসেন লাইপজিগ ক্লাবে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেন রেড বুলের কর্ণধার ডাইরিখ মাতেসিতজই। তখনও দেশটির ফুটবল পণ্ডিত কিংবা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গগণ এই বিষয়ে জানতেন না। শেষ পর্যন্ত জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (DFB) কর্তৃক রেড বুলের প্রস্তাব নাকোচ হওয়ার পর বেশ নড়েচড়ে বসে প্রকৃত জার্মান ভক্তরা। শুধু তা-ই নয়, এটি নিয়ে সেন্ট পাওলিতে কয়েকটি দলের সমর্থকরা বিক্ষোভ করেছিল।
ইতিহাস বলে, লাইপজিগে ফুটবলের প্রেক্ষাপট ছিল তুলনামূলক জটিল। ১৯০০ সালে প্রথমবারের মতো শহরটিতে জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম শুরু হলেও এরই মাঝে একাধিক ক্লাব গড়ে উঠেছে, আবার ভেঙেও গিয়েছে। নাৎসি শাসন, সাম্যবাদী শাসন এবং পরবর্তীতে দুই জার্মানির একত্রিত হওয়ার মতো ঘটনায় বারংবার লিগের ফর্মেট পরিবর্তন হয়েছিল।
তবে এত এত পরিবর্তনের মাঝে কয়েকটি দল অবশ্য সফলতা কুড়িয়েছে। যেমন, লকোমোটিভ লাইপজিগ ১৯৮৭ সালে আয়াক্সের বিপক্ষে ইউরোপিয়ান কাপ উইনিয়ার্স’ কাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। যদিও ম্যাচটি জিততে পারেনি দলটি। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ভিএফবি লাইপজিগ জার্মান লিগ থেকে রেলিগেশনে চলে যাওয়ায় জার্মান শীর্ষ লিগ ফুটবলে লাইপজিগ শহরটি প্রতিনিধিত্ব হারায়। অতঃপর রেড বুল পঞ্চম স্তরের ক্লাব এসএসভি মার্ক্রানস্টাট এর লাইসেন্স ক্রয় করে। যদিও তখনও এই বিষয়টি একেবারেই গোপন ছিল।
অতঃপর ২০০৯ সালে রাজেন বলস্পোর্ট লাইপজিগ নামে অভ্যুদয় ঘটে নতুন ক্লাবটির। ২০০৯-১০ মৌসুমে প্রথমবারের মতো জার্মান ফুটবলে আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাচ খেলে তারা। প্রথম ম্যাচে অবশ্য দর্শক উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩০ জন। নতুনভাবে নামকরণ করার ফলে প্রকৃত সমর্থকদের মাঝে বিভাজন ঘটে। কারণ এর আগে ২০০৫ সালে রেড বুল কর্তৃপক্ষ অস্ট্রিয়ান শীর্ষ স্তরের ক্লাব এসভি অস্ট্রিয়া সালজবুর্গের মালিকানা কিনেছিল। পরবর্তীতে দলটির নাম পরিবর্তন করে রেড বুল সালজবুর্গে রূপান্তর করে তারা। এরপর অফিশিয়াল ব্যাজ, জার্সির রং এবং ডিজাইন পরিবর্তনের পাশাপাশি ক্লাবের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে অব্যাহতি দেয়া হয়। জার্মানিতেও এমনটা ঘটবে বলে আশঙ্কা করেছিল শহরের লোকজন।
যদিও জার্মানিতে রেড বুল কাজ শুরু করেছিল একেবারেই ভিন্নভাবে। ২০০৫ সালে সরাসরি প্রথম সারির দলের মালিকানা কিনতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর নিয়মিতভাবে জার্মান ফুটবল ও লিগ পর্যায়ে নজর রেখেছিল রেড বুল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়োগকৃত স্কাউটরা। কয়েক বছর পর্যবেক্ষণ শেষে ডাইরিখ মাতেসিতজ এবং তার উপদেষ্টাগণ একমত হয়েছিলেন যে, একেবারে মূল থেকে কাজ শুরু করার মধ্য দিয়ে সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
২০১৬ সালে লাইপজিগ বুন্দেসলিগায় কোয়ালিফাই করার মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করে। ২২ বছর পর লাইপজিগ শহরের কোনো ক্লাব জার্মানির শীর্ষ লিগে কোয়ালিফাই করার কৃতিত্ব অর্জন করে। ২০০৯ সালের পর ২০১৬ সাল অবধি পূর্ব জার্মানির আর কোনো দলই শীর্ষ লিগে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। লাইপজিগের এমন অভূতপূর্ব উন্নতিতে শহরের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে সমর্থন তৈরি হতে শুরু করে।
রালফ রাঙনিকের অবদান
প্রতিটি জিনিসের শুরু থেকে সফল হওয়ার আগ পর্যন্ত কারও না কারও অবদান থাকে। লাইপজিগের মালিকানা ক্রয় করা হয়তো রেড বুল কর্তৃপক্ষের অঢেল অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য রয়েছে, কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কাজে লাগানোর মতো বিচক্ষণ পরিচালকও প্রয়োজন। সৌভাগ্যবশত বিলিয়নিয়ার মালিক ডাইরিখ মাতেসিতজ সেই ব্যক্তিকে পেয়েও যান।
মাত্র ৮ বছরে জার্মান ঘরোয়া ফুটবল লিগের চারটি ধাপ পার করা লাইপজিগের পরিচালনা পরিষদের সবচেয়ে প্রবীণ এবং সফলতম ব্যক্তি ছিলেন রালফ রাঙনিক। ২০১২ সালে চতুর্থ স্তরের বাধা টপকাতে দলটি যখন হিমশিম খাচ্ছিল ঠিক তখনি লাইপজিগের দায়িত্ব কাঁধে নেন এই অভিজ্ঞ জার্মান কোচ। একই সময় তিনি রেড বুল কর্তৃপক্ষের আরেক ক্লাব সালজবুর্গের স্পোর্টিং ডিরেক্টরের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। দ্য গার্ডিয়ানের মতে, তখন তাকে লাইপজিগের দায়িত্ব দিয়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন ক্লাব কর্তারা।
রালফ রাঙনিককে সালজবুর্গে ডেকেছিলেন রেড বুলের হেড অব গ্লোবাল ফুটবল জেরার্ড হোলিয়ার। ডাইরিখ মাতেসিতজই সঙ্গে মাত্র চার ঘণ্টার মিটিংয়ে তার নিয়োগ নিশ্চিত করেন হোলিয়ার। গত বছর আফ্রিকান বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার জেতা সাদিও মানে একসময় সালজবুর্গে খেলেছেন। তাকে সালজবুর্গে ভেড়ানোর পেছনে সর্বাধিক অবদান ছিল এই হোলিয়ারের। অন্যদিকে, রালফ রাঙনিক ছিলেন শালকে এবং হোফেনহেইমের কোচ। সে হিসেবে জার্মান ফুটবল সম্পর্কে তার ধারণা ছিল প্রখর। এছাড়াও চতুর্থ বিভাগে থাকা একটি দলের পরিচালকের দায়িত্ব নিতে সে সময় অনেকেই অপারগতা প্রকাশ করছিল। সে হিসেবে অভিজ্ঞ রাঙনিক দায়িত্ব নেয়াতে দলটির অগ্রযাত্রা আরও গতিশীল হয়।
২০১৫ সালটি ছিল লাইপজিগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেবার বুন্দেসলিগায় কোয়ালিফাই করার শেষ ধাপে ছিল দলটি। বাঁচা-মরার এমন এক পর্যায়ে অবসর ভেঙে লাইপজিগের ডাগ আউটে দাঁড়ান রাঙনিক নিজে। তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলিয়ায় কোয়ালিফাই করেছিল দলটি। প্রতিষ্ঠার মাত্র ৭ বছরের মধ্যে এমন অভাবনীয় সাফল্য খুব বেশি দেখা যায়নি ফুটবলে। লাইপজিগের এমন সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব রাঙনিককেই দিয়ে থাকেন ক্লাবের সমর্থকরা। অনেকের মতে, তিনি নিজের সন্তানের মতোই লাইপজিগের যত্ন করেছেন। সন্তান যেমন বাবার হাত ধরে শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেয়, তেমনি লাইপজিগও এই বুড়ো রাঙনিকের হাত ধরে বুন্দেসলিগায় পাড়ি জমিয়েছিল।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নাগলসমান কোচের দায়িত্ব নেয়ার পূর্বে রাঙনিক দ্বিতীয় দফায় আরও একবার লাইপজিগের কোচের দায়িত্বে ছিলেন। তরুণদের নিয়ে দ্রুতগতির ফুটবলই লাইপজিগের মূলমন্ত্র। আর এটিই রাঙনিকের নিজস্ব ফুটবলীয় যুক্তি। সর্বশেষ গত বছর ৬০ বছর বয়সে ক্লাবের সবরকম দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। বর্তমানে রেড বুলের ফুটবল ডেভেলপমেন্ট ও বিনিয়োগ বিভাগের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাঙনিক। বিদায়কালে লাইপজিগের ক্রীড়া পরিচালক হিসেবে মার্কাস ক্রুশ্চেকে নিয়োগ দেন তিনি। ২০২২ সাল পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ মার্কাস লাইপজিগকে বুন্দেসলিয়ার পাশাপাশি ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন।
ভবিষ্যতের জন্য প্রতিভাবান ফুটবলার খুঁজে বের করে গড়ে তোলা
রাঙনিক ইতোমধ্যেই লাইপজিগের মৌলিক ফুটবল কৌশল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার মতে, দলের প্রত্যেক সদস্যই তরুণ হতে হবে এবং ভবিষ্যতে উন্নতির চেষ্টা করবে। বর্তমানে দায়িত্বে থাকা মার্কাসও তার দেখানো পথে হাঁটছেন। তিনি বলেন,
আমরা প্রতিভাবান এমন সব ফুটবলার খুঁজছি যারা ভবিষ্যতে উন্নতি করার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। আমরা তথাকথিত তারকা ফুটবলারদের পেছনে প্রচুর ব্যয় করার পক্ষে নই। বরঞ্চ আমরা ভবিষ্যতের জন্য তারকা ফুটবলার গড়ছি।
লাইপজিগ কর্তারা সালজবুর্গ থেকে নেবি কেইতাকে মাত্র ২৭ মিলিয়ন ইউরো মূল্যে দলে ভেড়ান। অতঃপর মাত্র ২ মৌসুম পর কেইতাকে ২১ মিলিয়ন লাভে লিভারপুলের নিকট বিক্রি করেছিল দলটি। একইভাবে দলের প্রধান তারকা টিমো ওয়ার্নারকে রেলিগেশনে বাদ পড়া দল স্টুটগার্ড থেকে নামমাত্র মূল্যে দলে ভেড়ায় লেইপজিগ। বর্তমানে তাকে দলে নিতে মুখিয়ে রয়েছে লিভারপুল, রিয়াল মাদ্রিদ ও বায়ার্ন মিউনিখের মতো দলগুলো। কয়েকটি ব্রিটিশ পত্রিকার মতে, ওয়ার্নারের জন্য শত মিলিয়নের প্রস্তাবও নাকোচ করে দেয়ার মতো শক্ত অবস্থানে রয়েছে লাইপজিগ।
ক্লাব কর্তারা জার্মানি সহ ইউরোপ এবং আফ্রিকায় অভিজ্ঞ স্কাউটস নিযুক্ত করেছে। সুইডেনের উইঙ্গার এমিল ফোর্সবার্গকে তখনকার সময়ের দ্বিতীয় বিভাগের দল মালমো থেকে দলে নিয়েছিল ক্লাবটি। তবে মার্সেল সাবিতজারকে রেপিড ভিয়েনা থেকে দলে নিয়ে সালজবুর্গে লোনে পাঠায় ক্লাব কর্তারা। ইউরোপ ছাড়াও আফ্রিকান তরুণদের প্রতিও বিশেষ নজর রাখছেন ক্লাবটির পরিচালকরা। সঠিক পরিচর্যার অভাবে ঐ অঞ্চলের অনেক প্রতিভাবান কিশোর নিজেদের ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না।
শুধুমাত্র নেবি কেইতার উদাহরণ দিয়েই রেড বুলের অধীনস্থ ক্লাবসমূহের পোর্টফোলিও কীভাবে বিশ্বব্যাপী খেলোয়াড়দের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করে তা বোঝা যায়। বর্তমান সময়ে একইভাবে ফুটবল ব্যবসায় বেশ উন্নতি করেছে সিটি ফুটবল গ্রুপ। তাদের অধীনস্থ ক্লাবসমূহ হলো ম্যানচেস্টার সিটি, জিরোনা, নিউ ইয়র্ক সিটি এফসি, মেলবোর্ন সিটি, ইয়োকোহামা মেরিনোস। যদিও বর্তমানে তারা রেড বুলের চেয়ে বেশি সফলতা কুড়িয়েছে, তবে খুব শীঘ্রই রেড বুল তাদের সমপর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কার্টেরেট ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহী জেমস পাওয়েল মনে করেন, প্রতিটি ক্লাবের লক্ষ্য উপলব্ধি করা এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্র যাচাই-বাছাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি রেড বুল ও সিটি গ্রুপের এমন ব্যবসায়ীক পন্থাকে ‘পিরামিড অব শপ উইন্ডোজ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিভাবানদের সুযোগ গিয়ে তাদের পারফরম্যান্সের উন্নতি ঘটিয়ে দরদামের উন্নতি করাই এই ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য। জেমস পাওয়েলের মতে, রেড বুল এমন কিছু সংখ্যক লোকের হাতে বৈশ্বিক ফুটবল ব্যবসায়ের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন, যাদের মাধ্যমে খুব অল্প সময়ে মালিক পক্ষ থেকে শুরু করে স্বয়ং খেলোয়াড় ও তাদের এজেন্টরাও লাভবান হচ্ছেন।
লাইপজিগের সঙ্গে রেড বুলের অন্যসব ক্লাবের সম্পর্ক মোটামুটি ঘনিষ্ঠ। সেই সাথে ক্লাবগুলোর খেলোয়াড় অদলবদলও দৃশ্যমান। এই যেমন সালজবুর্গের সঙ্গে গত গ্রীষ্মে হ্যানেস উলফ এবং আমাদো হায়দারাকে অদলবদল করে লাইপজিগ। সেই সাথে আমেরিকান তরুণ ফুটবলার টেইলর এডামসও নিউ ইয়র্ক থেকে লাইপজিগে পাড়ি জমান। আর এই গোটা প্রক্রিয়ায় ভূমিকা পালন করেছিলেন সালজবুর্গের বর্তমান মার্কিন কোচ জেসে মার্শ।
তবে খেলোয়াড় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিগত কয়েক বছর ধরে জার্মান ও আফ্রিকানদের পাশাপাশি ফরাসি ফুটবলাররা প্রাধান্য পাচ্ছেন। সাংবাদিকদের মতে, জেরার্ড হোলিয়ার ফরাসি হওয়ার সুবাদে এমনটা হচ্ছে। যদিও এর সুফলও পেয়েছে লাইপজিগ। দলের প্রধান ডিফেন্ডার হিসেবে দারুণ পারফরম্যান্স উপহার দেয়া দেয়াত আপেমেকানো এবং ইব্রাহিমা কোনাতে দুজনই জন্মসূত্রে ফরাসি। এছাড়াও মন্টপেলিয়ের থেকে যোগ দেয়া রাইট ব্যাক নর্দি মুকিলে এবং পিএসজি থেকে যোগ দেয়া মিডফিল্ডার ক্রিস্টোফার নকুনকোও ফরাসি ফুটবলার। এই চারজন ইতোমধ্যেই ফ্রান্স অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে ম্যাচ খেলেছেন।
তবে খেলোয়াড় খোঁজার ক্ষেত্রে রেড বুলের স্কাউটিং মেশিন হিসেবে খ্যাত পল মিশেলের প্রশংসা না করলেই নয়। অতীতে সাউদাম্পটন এবং টটেনহামে কাজ করা মিশেল লাইপজিগে খেলোয়াড় কেনাবেচায় বর্তমানে বেশ প্রভাব বিস্তার করছেন। এছাড়াও তার নেতৃত্বে অর্ধশত স্কাউট পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করছে। এই বিষয়ে বর্তমান পরিচালক মার্কাস বলেন,
আমরা ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছি খেলোয়াড়দের বিকাশে লাইপজিগ সফল। আধুনিক ফুটবলে বিচক্ষণ স্কাউট এবং স্কাউটিং সিস্টেমে যেকোনো তরুণ ফুটবলার নির্ভর দলের চাবিকাঠি হতে পারে।
সমর্থক, স্টেডিয়াম এবং বিনিয়োগ ব্যবস্থা
২০১০ সালে সর্বপ্রথম হোম-গ্রাউন্ডে ম্যাচ খেলে লাইপজিগ। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত ৪৩,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়ামটির বর্তমান নাম রেড বুল অ্যারেনা। এই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে ৪,০২৮ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। এটি ছিল চতুর্থ বিভাগের একটি ম্যাচ। গত বছর রেড বুল অ্যারেনার গড় দর্শক উপস্থিতি ছিল ৩৮,৩৮০ জন। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে মাঠে দর্শক সমাগম নিশ্চিত করতে পেরে ইতোমধ্যেই লভ্যাংশের দেখা পেয়েছে ক্লাবটি।
ফোর্বসের হিসেব অনুযায়ী, গত বছর ৭১তম দামী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রেড বুল। গত বছর পৃথিবীর প্রায় ১৭১টি দেশে প্রায় ৭ বিলিয়ন ক্যান এনার্জি ড্রিংক বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির বাজারমূল্যও বেড়েছে প্রায় ৭.৬ বিলিয়ন ইউরো। রেড বুলের অধীনস্থ লাইপজিগ সহ প্রায় অন্য সব ক্লাবের বিনিয়োগের একমাত্র উৎসও এটি। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে- ফুটবল থেকে কীভাবে লাভ করছে প্রতিষ্ঠানটি?
মূলত বিশ্বব্যাপী রেড বুলের পানীয় বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি দিন দিন যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানটির আয়ও বেড়েছে। আর সে হিসেবে এখন অবধি বুন্দেসলিগার যাবতীয় আয়, টিভি সম্প্রচার এবং খেলোয়াড় কেনাবেচার উপর নির্ভর করছে লাইপজিগ। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে একে লোকসানের পর্যায়ে রাখছেন না পাওয়েল। তার মতে, লাইপজিগ লিগ শিরোপা জিতে ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করলে বড়সড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে। তখন রেড বুল হয়তো লাভের দিক বিবেচনা করে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের বদলে বড়সড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ক্রীড়া পরিচালক মার্কাস দলটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিবিসি স্পোর্টসকে জানিয়েছেন। ক্লাব কর্তাদের প্রধান পরিকল্পনা আগামী বছরও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা ধরে রাখা। কিন্তু এরই মাঝে জার্মান লিগেও বেশ ভাল করেছে দলটি। শীর্ষে থাকা বায়ার্ন মিউনিখের চেয়ে লাইপজিগ মাত্র ৩ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছে। সে হিসেবে বায়ার্নের দুই এক ম্যাচের পরাজয় দলটিকে ইতিহাসের প্রথম শিরোপা জিততেও সাহায্য করতে পারে। আর এমনটা হলে নতুন ইতিহাস গড়বে লাইপজিগ।
চলতি মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলো নিশ্চিত করায় বেশ খুশি দলের পরিচালক থেকে শুরু করে রেড বুলের মালিক পক্ষ। কোচ নাগলসমানের হাত ধরে লিগ শিরোপা জেতার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছাতে পারলে রূপকথার গল্পটা লেখা হয়ে যাবে রেড বুল অ্যারেনায়। মাত্র এক দশক আগে যাদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, তাদের হাতে শিরোপা দেখাটা রূপকথার গল্প ছাড়া কিছুই নয় এই আধুনিক ফুটবলে।
কিন্তু জার্মানির অন্য সকল ক্লাবের সমর্থকরা রেড বুলের বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরোর দিকে আঙ্গুল তুলে অর্থকে লাইপজিগের সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে কখনোই ইঙ্গিত করতে পারবে না। তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে দল গড়ে সমালোচনার সেই পথটিকে বন্ধ করে রেখেছেন রেড বুলের কর্তারা। বায়ার্ন, ডর্টমুন্ড কিংবা শালকের মতো সমৃদ্ধ ইতিহাস হয়তো নেই দলটির। তবে ইতিহাস গড়তে সঠিক পথেই এগোচ্ছে লাইপজিগ সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এবারের বুন্দেসলিয়ার শিরোপা ‘দ্য রেড বুলস’ খ্যাত লাইপজিগের খেলোয়াড়দের হাতে উঠুক এই কামনা।