এমন কিছু যে আপনি এর আগে কখনো দেখেননি, তা বেশ নিশ্চিত। আপনার পিতা-পিতামহরাও কি দেখেছিলেন? দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, অথচ টিভি-পর্দাতে খেলা চলছে না, পত্রিকার পাতায় খেলার খবরের বদলে ছাপতে হচ্ছে ভিন্ন কিছু, খেলার ওয়েবসাইটগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোনো প্রস্তরযুগের ক্রিকেটে, এমন কিছুর সঙ্গে তাদের পরিচয়টাও নতুন করে হলে অবাক হবার কিছু নেই। জাগতিক সব খেলাধুলা বন্ধ হবার ঘটনা শেষ যে ঘটেছিল গত শতকের চল্লিশের দশকে, ওই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টাতে।
করোনাভাইরাসের কবলে পড়ে বিশ্ব-ক্রীড়াঙ্গন থমকে গিয়েছে আরেকটিবার। ক্রিকেটই বা বাদ যায় কী করে! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষ বল মাঠে গড়িয়েছে ১৩ মার্চ, নিকট ভবিষ্যতে গড়ানোর সম্ভাবনাও সীমিত। এমনকি এ বছরের মেগা ইভেন্টগুলো আয়োজিত হবে কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ
গত বছরের মতো এ বছরেও আইপিএল শুরু হবার কথা ছিল মার্চেই। দুই মাসব্যপী ক্রীড়া উৎসবের শুরুর ক্ষণও গুনতে শুরু করেছিলেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। কিন্তু বিধিবাম! করোনাভাইরাসের কারণে আইপিএল স্থগিত করা হয়েছে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত, যে সময়সীমা আরও বাড়বে বলেই অনুমান। বিদেশি ক্রিকেটারদের ভিসাও মিলবে না ১৫ এপ্রিলের আগে।
নতুন সূচি এখনো ঘোষিত হয়নি। তবে আপাৎকালীন যা খবর, তাতে জানা যাচ্ছে, আগের সূচিতে মে মাসের ২৪ তারিখে ফাইনাল হবার কথা থাকলেও নতুন সূচিতে ফাইনাল গড়াতে পারে জুনের সপ্তাহে। একটি ‘যদি’ অবশ্য থাকছে, ভারত সরকারের অনুমতি মেলা সাপেক্ষে।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ
টেস্ট ক্রিকেটকে আরও আকর্ষণীয় করতে, ‘ডেড রাবার’ বলে কোনো ম্যাচের গুরুত্ব না কমাতে আইসিসি নিয়ে এসেছিল টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ভাবনা। র্যাঙ্কিংয়ের প্রথম নয় দলকে নিয়ে গত বিশ্বকাপের ক্রিকেটের পরপরই শুরু হয়ে গিয়েছিল এই আসর, দুই বছরের চক্রে সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দুই দলকে নিয়ে যে আয়োজনের ফাইনাল হবার কথা রয়েছে আগামী বছরের জুনে, লর্ডসে।
তবে করোনাভাইরাসের থাবায় ইতোমধ্যেই স্থগিত করা হয়েছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আওতাভুক্ত শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ড সিরিজ। বছরের বাকি সময় মাঠে ক্রিকেট না গড়ালে যে ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে নিচের সিরিজগুলোকেও:
জুন: ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ (তিন টেস্ট)
জুলাই-আগস্ট: ইংল্যান্ড-পাকিস্তান (তিন টেস্ট)
জুলাই: ওয়েস্ট ইন্ডিজ- দক্ষিণ আফ্রিকা (দুই টেস্ট)
জুলাই: বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা (তিন টেস্ট)
আগস্ট: বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড (দুই টেস্ট)
নভেম্বর-ডিসেম্বর: নিউজিল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ (তিন টেস্ট)
ডিসেম্বর-জানুয়ারি: অস্ট্রেলিয়া-ভারত (চার টেস্ট)
ডিসেম্বর-জানুয়ারি: নিউজিল্যান্ড- পাকিস্তান (দুই টেস্ট)
আইসিসি অবশ্য এখনো জানায়নি, পরিস্থিতি সেরকম হলে তারা কী করবে।
ওডিআই লিগ
এ বছরের মে মাসের প্রথম দিন থেকেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আদলে মাঠে গড়ানোর কথা একদিনের ক্রিকেটের চ্যাম্পিয়নশিপ, আইসিসি যাকে ডাকছে ‘ওডিআই লিগ’ বলে। ২০২০-২২, দুই বছরের চক্রে যে লিগে অংশ নেবে তের দল, বার টেস্ট খেলুড়ে দেশের পাশাপাশি যে সুযোগটা পাচ্ছে নেদারল্যান্ডস। শিরোপার লড়াই তো আছেই, এই লিগ কাজ করবে ২০২৩ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার হিসেবেও। আয়োজক দেশ ভারতের পাশাপাশি সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া সাত দল সরাসরি অংশ নেবে বিশ্বকাপে, বাকি পাঁচ দল অবশ্য দ্বিতীয় সুযোগ পাবে সহযোগী দেশগুলোকে নিয়ে হওয়া বাছাইপর্বে।
লিগের প্লেয়িং কন্ডিশন চূড়ান্ত হবার কথা রয়েছে এ মাসেরই শেষে হতে যাওয়া আইসিসির বোর্ড সভায়, করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যে সভা হবে টেলিকনফারেন্সে।
অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, মাঠের ক্রিকেটটাও এখন টেলিকনফারেন্সেই খেলতে হবে!
দ্য হান্ড্রেড
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট তো আজকাল আয়োজন করছে সব দেশই, তবে এসবের ভিড়েও ‘দ্য হান্ড্রেড’ শুরুর আগেই সাড়া ফেলেছে বেশ। নতুনত্বে ভরপুর যে টুর্নামেন্টকে ইসিবি দেখছে নতুন দিনের ক্রিকেট হিসেবে। ক্রিকেটের পরিচিত দর্শকদের বাইরেও এই ১০০ বলের ম্যাচ ক্রিকেটকে পৌঁছে দেবে নতুন দর্শকদের কাছে, ইসিবির ধারণা এমনটাই। ১৭ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মাঝে আয়োজিত হতে যাওয়া ওই টুর্নামেন্টে খেলার কথা রয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটের নামীদামী সব তারকার।
খেলার কথা ছিল ডেভিড ওয়ার্নারেরও, নিলামে যিনি বিকিয়েছিলেন সোয়া লাখ পাউন্ড। তবে পারিবারিক আর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন হুট করেই। করোনাভাইরাস আতঙ্কেই কি?
ইম্পেরিয়াল কলেজ কোভিড-১৯ রেসপন্স টিমের কথা মানলে যে আতঙ্ক অমূলক নয় মোটেই। তাদের আশঙ্কা, এই করোনাভাইরাসের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে যুক্তরাজ্যের আড়াই লক্ষের বেশি বাসিন্দা।
এশিয়া কাপ
আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, হংকং, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানকে নিয়ে সেপ্টেম্বরে হবার কথা রয়েছে এশিয়া কাপের ২০২০ আসর। পাকিস্তানে আয়োজনের কথা থাকলেও ভারতের আপত্তির কারণে যা আয়োজিত হবে বিকল্প ভেন্যুতে। এ মাসেরই শেষ নাগাদ যা নির্ধারিত হবে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সভাতে।
টি-২০ বিশ্বকাপ (পুরুষ)
সফল এক নারী টি-২০ বিশ্বকাপ আয়োজনের পরে অস্ট্রেলিয়াতেই বসতে যাচ্ছে পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপের ৭ম আসর। অক্টোবরের ১৮ তারিখ থেকে শুরু হতে যাওয়া যে আসরে অংশগ্রহণের কথা রয়েছে ১৬ দলের। অবশ্য নামিবিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ড কিংবা ওমানের মতো দলগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কাকে খেলতে হবে কোয়ালিফায়িং পর্বে। র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা আট দলের সঙ্গে কোয়ালিফায়িং রাউন্ড পেরিয়ে আসা চার দল যোগ দেবে সুপার ১২ পর্বে। দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যারা লড়বে ১৫ নভেম্বরের ফাইনালে পৌঁছুতে।
নারী ওডিআই চ্যাম্পিয়নশিপ
২০১৭ থেকে শুরু হওয়া এ আয়োজনের ইতি ঘটার কথা রয়েছে এ বছরই। যা এক অর্থে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে নিউজিল্যান্ডে হতে যাওয়া নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইও। চ্যাম্পিয়নশিপের শীর্ষ চার দল সরাসরি অংশ নেবে বিশ্বকাপে, যেখানে অস্ট্রেলিয়া, গতবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের জায়গা নিশ্চিত করেছে ইতোমধ্যেই, স্বাগতিক হবার সুবিধা নিয়ে সরাসরি অংশ নেবে নিউজিল্যান্ডও। বাকি জায়গাটি নিশ্চিত করার লড়াইয়ে তাই আছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
সরাসরি না পেলে দ্বিতীয় সুযোগ অবশ্য আছে, এ বছরের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কায় বসবে আরেকটি বাছাইপর্ব, যেখানে নিশ্চিত হবে বিশ্বকাপের বাকি তিন দল।
সবগুলো আয়োজনই অবশ্য নির্ভর করছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে।বাংলাদেশের পাকিস্তান সিরিজের এপ্রিল অংশ স্থগিত হয়েছে ইতোমধ্যেই, স্থগিত হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজও। বড় ধাক্কাটা অবশ্য এসেছে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর জন্যে। বাণিজ্যিকীকরণের এ যুগে তাদের খেলার সুযোগই যে মেলে সীমিত। ওয়ার্ল্ড কাপ লিগ আর ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যালেঞ্জ লিগ তাদের সে সুযোগ করে দিলেও করোনাভাইরাসের কারণে তা পিছিয়ে যাবে বলেই আশঙ্কা।
যুক্তরাষ্ট্র, স্কটল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে নিয়ে এপ্রিলের এক তারিখ থেকে ওয়ার্ল্ড কাপ লিগের আয়োজন শুরু হবার কথা থাকলেও তা স্থগিতাদেশ পেয়েছে ইতোমধ্যেই, স্থগিত হতে পারে লিগের বাকি ম্যাচগুলোও। এমতাবস্থায় ২০২৩ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব ঠিক সময়ে মাঠে গড়ানো নিয়েই জেগেছে শঙ্কা। ঘরোয়া লিগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায় সব দেশেই। স্থগিত হয়ে গিয়েছে পাকিস্তান সুপার লিগের শেষ অংশ, শেফিল্ড শিল্ডের ফাইনালও গড়ায়নি মাঠে, না খেলেই শিরোপা গিয়েছে নিউ সাউথ ওয়েলসের ক্যাবিনেটে। স্বেচ্ছা-নির্বাসনে গিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটররা, ইসিবি সবধরনের পেশাদার ক্রিকেট স্থগিত ঘোষণা করেছে ২৮ মে অব্দি। যে কারণে, ১৯৪৫ সালের পরে প্রথমবারের মতো বাতিল হতে পারে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের আসর।
তাতে অবশ্য আপত্তি তুলবার কথা নয় কারও। দিনশেষে ক্রিকেট তো আর জীবনের চেয়ে বেশি কিছু নয়!