‘সে যদি একদিন ইতালিতে আসে, তাহলে আমি খুবই খুশি হবো। আমি আশা করবো সে আমার মতো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে। ইংল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল এবং ইতালিতে আমি খেলেছি, কিন্তু সে কেবলই স্পেনে খেলেছে। কিন্তু সে যদি সেখানেই সুখী থাকে তাহলে আমি তার সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানাই।’
কথাটা লিওনেল মেসিকে উদ্দেশ্য করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর করা। ইঙ্গিত পরিষ্কার, ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবের সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে সফল হওয়াটাকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো চ্যালেঞ্জ ভাবছেন। মেসি কেবলমাত্র একটি ক্লাবে খেলায় স্বাভাবিকভাবেই তাকে সেই চ্যালেঞ্জটা নিতে হয়নি। কিন্তু একই সময়ে সমকালীন আরেকজন গ্রেট খেলোয়াড় ইব্রাহিমোভিচের দ্বিমত ছিল বক্তব্যটা নিয়ে,
‘বিশ্বের অন্যতম সেরা একটা দলে যোগ দেওয়াটা কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। এটা নির্ভর করছে, আপনি চ্যালেঞ্জ বলতে কী বোঝাচ্ছেন তার উপর। আমি যতদূর বুঝি, তাতে কোনো একটা দলে অংশ নিয়ে তাদেরকে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছানোটাই চ্যালেঞ্জ। আমার মতে, জুভেন্টাসে অংশ নেওয়াটা চ্যালেঞ্জের আওতায় পড়ে না।’
এর অর্থ হচ্ছে, জুভেন্টাসের মতো দলে যোগ দিলে সফল হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। চ্যালেঞ্জ সেটাই হতো, যদি রোনালদো জুভেন্টাসে যোগ না দিয়ে মিলানের মতো কোনো ধুঁকতে দলে যোগ দিয়ে তাদেরকে চ্যাম্পিয়ন করাতে পারতেন।
তাহলে কোন ভাবনাটা আসলে সঠিক? সত্যি সত্যি কি জুভেন্টাসে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কোনো চ্যালেঞ্জ নেই? ইব্রাহিমোভিচ যে কথাটা বলেছেন সেটার মাঝেও তো কিছু যুক্তি রয়েছে। জুভেন্টাস গত সাতটি সিজন ধরে সিরি আ চ্যাম্পিয়ন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রোনালদো বাদেও জুভেন্টাস তাদের ঘরোয়া লিগে যথেষ্ট সফল। কিন্তু তার মতো খেলোয়াড়কে সাধারণ ক্লাবের নেওয়ার মতো ক্ষমতাও তো থাকতে হবে। পারিশ্রমিক কিংবা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত পরিমাণে না পেলে কেবলমাত্র লিগ জেতানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে রোনালদোই বা কেন যাবেন সাধারণ ক্লাবে?
বাকি থাকে চ্যাম্পিয়নস লিগ। জুভেন্টাস তাদের ইতিহাসে মাত্র দু’বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফি জিততে পেরেছে, যার সর্বশেষটি ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে। এরপর আরো পাঁচবার (সর্বশেষ ৪ বছরে ২ বার) ফাইনালে উঠলেও শেষ হাসিটা হাসতে পারেনি। একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে জুভেন্টাসকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা।
কিন্তু যদি চ্যাম্পিয়নস লিগ না জিততে পারেন, তাহলেই কি রোনালদোকে ব্যর্থ বলে দেওয়া যাবে, কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলেই কি সফল? জুভেন্টাসে কি তার অন্য কোনো চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
আলোচনাটা শুরু করা যাক ‘ক্লাব পাল্টানো’ নিয়েই। ক্লাব পাল্টানোটা কি আসলে চ্যালেঞ্জের আওতায় পড়ে? যারা পুরো ক্যারিয়ার একটি ক্লাবেই কাটিয়ে দেয়, তারা কি কোনো চ্যালেঞ্জই নেন না? অথবা ক্লাব পাল্টানোর পর ঠিক কোন কাজটা করলে একজন খেলোয়াড়কে সফল বলা যাবে? ক্লাব পাল্টানোটা ঠিক কোন দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জের?
বর্তমান খেলোয়াড় কৌতিনহোর কথা ভাবুন। সাম্প্রতিক সময়ের একজন সুপারস্টার হচ্ছেন কৌতিনহো। নেইমারের পর ব্রাজিলের নির্ভরতার অপর নাম। এমনকি গত বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা (২টি), সবচেয়ে বেশি (২ বার) ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পেয়েছেন কৌতিনহো। নেইমারকে টপকে গত বিশ্বকাপের ড্রিম টিমেও সুযোগ পেয়েছেন। ক্লাব দল লিভারপুলেও ভালো খেলছিলেন। কিন্তু নেইমার চলে যাওয়ার পর বার্সেলোনা কৌতিনহোর প্রতি আগ্রহ দেখালো। বড় দলে খেলার আগ্রহ সব খেলোয়াড়েরই থাকে, কৌতিনহোও এর ব্যতিক্রম নন। প্রথম মৌসুমটা মোটামুটি কাটলেও চলতি মৌসুমটায় প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়া নিয়েই লড়াই করতে হচ্ছে। এমনভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ যে আশানুরূপ হবে না, সেটা নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়।
কৌতিনহো ঝরে যাবেন কি না, সেটা তো সময়ই বলে দেবে। পরিস্থিতিকে নিজের পক্ষে আনার জন্য পর্যাপ্ত সময় তার হাতে রয়েছে। তবে এরকম বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ে অতীতেও অনেক খেলোয়াড় হারিয়ে গিয়েছেন।
শেভচেঙ্কোর কথা মনে আছে? ভদ্রলোক চেলসিতে যোগ দেন চেলসির ইতিহাসের সর্বোচ্চ ট্রান্সফার ফি’র রেকর্ড গড়ে। মিলানের হয়ে অসাধারণ খেলে ২০০৪ সালে ব্যালন ডি’অর জেতা শেভচেঙ্কোকে আগের দুই মৌসুমেই ঘরোয়া লিগ জেতা চেলসির নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগে ভালো করা। কিন্তু চেলসির হয়ে দু’টো মৌসুম ছিল শেভচেঙ্কোর জন্য হতাশাজনক অধ্যায়। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের পাশাপাশি দলীয় অর্জনেও ব্যর্থ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত চেলসির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে মিলানে এক মৌসুম ধারে ফেরত আসলেও আগের পারফরম্যান্সটা আর ফেরত আনতে পারেননি।
মাইকেল ওয়েনও ছিলেন ২০০১ সালের ব্যালন ডি’অরজয়ী খেলোয়াড়। লিভারপুলের হয়ে দুর্দান্ত খেলতে থাকা এই স্ট্রাইকার যোগ দেন তারকাসমৃদ্ধ রিয়াল মাদ্রিদে। একটামাত্র মৌসুম খেলেন এই ক্লাবে। কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হবার, সেটা হয়ে গিয়েছে। রাউল আর রোনালদো লিমা’র মতো স্ট্রাইকার দলে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই খেলার সুযোগ কম পেয়েছেন। ৩৬ ম্যাচে মাত্র ১৩টি গোল করা ওয়েনের সমস্যা হয়েছিলো আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া। পরবর্তীতে ক্লাব পাল্টালেও আর নিজের আগের রূপে ফেরত আসতে পারেননি।
শুধু কৌতিনহো, শেভচেঙ্কো কিংবা ওয়েনই নন, আরো অনেক খেলোয়াড়ই ক্লাব পাল্টানোর পর নিজেদের হারিয়ে খুঁজেছেন। ব্যালন ডি’অরজয়ী কাকা যেমন মিলান থেকে রিয়াল মাদ্রিদ, বেকহ্যাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রিয়াল মাদ্রিদ, রোনালদিনিহো বার্সেলোনা থেকে মিলান, কিংবা ফার্নান্দো তোরেস লিভারপুল থেকে চেলসিতে যাওয়ার পর আর কখনোই পূর্বের রূপে ফেরত আসতে পারেননি।
এর অর্থ হচ্ছে, ক্লাব পাল্টানোর সাথে ব্যর্থ হবার কিছুটা ঝুঁকি অবশ্যই কাজ করে। এই কারণে ক্লাবে ভালো অবস্থায় থাকলে সচরাচর কোনো খেলোয়াড় ক্লাব পাল্টাতে চান না।
তবে ক্লাব পাল্টানোর পরও সফল হয়েছেন, এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। ইব্রাহিমোভিচ খেলেছেন আয়াক্স, ইন্টার মিলান, বার্সেলোনা, এসি মিলান, প্যারিস সেইন্ট জার্মেই এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে। প্রতিটি জায়গাতেই শিরোপা জিতেছেন, অসংখ্য গোলও করেছেন। ইব্রা তো তবুও প্রতি ক্লাবে সফল, এমন কিছু খেলোয়াড় আছেন যারা কি না ভালো ক্লাবেও কিছুদিন ব্যর্থ ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে ক্লাব পাল্টেই সফল হয়েছেন। রোবেনের কথাই ভাবুন। তিনি রিয়াল মাদ্রিদে নিজের সেরাটা দিতে পারেননি, কিন্তু মাদ্রিদ থেকে বায়ার্ন মিউনিখে গিয়েই তিনি নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন।
তার মানে, ক্লাব পাল্টালে কেবল ব্যর্থ হবার ঝুঁকি নয়, এর সাথে সফল হবার সম্ভাবনাও থাকে। মূল কথা হচ্ছে, ক্লাবের সংস্কৃতির সাথে যখন একজন খেলোয়াড় নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারেন, তখনই তিনি ব্যর্থ হন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খেলোয়াড়রা ক্লাব পাল্টান কেন? অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে কয়েকটা মূল কারণ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
ক) পারিশ্রমিক
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই কাজ করে টাকার জন্য। খেলোয়াড়রাও এর বাইরে নয়। তবে একটি পর্যায়ে গিয়ে টাকাটাই সব কিছু হয় না, এর সাথে স্পটলাইটও অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মেসি-রোনালদোর মতো খেলোয়াড়রা চীনা অথবা আমেরিকান লিগে খেললে এখনকার চাইতেও অনেক বেশি অর্থ পাবেন। কিন্তু এরপরও তারা যান না। উদাহরণ হিসেবে ব্রাজিলের অস্কারকে দেখা যেতে পারে। ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা অস্কার চেলসির হয়েও ভালো খেলছিলেন। কিন্তু চীনা লিগে যাওয়ার পর থেকেই তিনি মোটামুটি নিখোঁজ। জাতীয় দল থেকেও জায়গা হারিয়েছেন মাত্র ২৭ বছর বয়সী এই খেলোয়াড়।
খ) প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে না পারা
প্রতিটি ক্লাবই খেলোয়াড়কে নিজেদের দলে নেয় একটি পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন খেলোয়াড় পারফর্ম করতে না পারেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি ক্লাবের আগ্রহ কমে যায়, এবং ক্লাব বিকল্প খেলোয়াড়ের সন্ধান করতে থাকে। খেলোয়াড়কেও বাধ্য হয়ে তখন ক্লাব পাল্টাতে হয়।
গ) কোচের পরিকল্পনা
যত ভালো খেলোয়াড়ই হোন না কেন, তিনি যদি কোচের পছন্দের ফর্মেশনে খেলতে না পারেন, তাহলে না চাইলেও তাকে বিদায় নিতে হয় ক্লাব থেকে। বার্সেলোনার স্যামুয়েল ইতো আর রোনালদিনহো এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গার্দিওলা যখন বার্সেলোনার কোচ হলেন, তখন তার পরিকল্পনায় ইতো, রোনালদিনহো এবং ডেকো ছিলেন না। এমন নয় যে, এত খারাপ খেলছিলেন। গার্দিওলা আসার আগে যে দুই মৌসুমে বার্সা লিগ জিতেছিলো, সেই দুই মৌসুমেই লিগে বার্সার পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ইতো। এমনকি একবার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছিলেন। গার্দিওলা যে মৌসুমে ইতোকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই মৌসুমে তিনি যেতে পারেননি। বার্সার হয়ে সেই মৌসুমে লিগ সবচেয়ে বেশি গোল করার পরও পরের মৌসুমে ক্লাব ছাড়তে হয়েছিলো ইতোকে।
ঘ) নিজের উন্নতি
অনেক সময় খেলোয়াড়রা ক্লাবে ভালো থাকার পরও আরো ভালো ফলাফলের আশায় ক্লাব পাল্টায়। কৌতিনহোর লিভারপুল ছেড়ে বার্সেলানোতে আসার পিছনে এটাও আরেকটা কারণ ছিল। লিভারপুলে ভালো খেলেও শিরোপা জেতা হচ্ছিলো না, বার্সেলোনায় শিরোপা জেতার সুযোগ স্বাভাবিকভাবেই বেশি।
ঙ) সম্মান
উপরের সব ক’টি শর্ত পূরণ হবার পরও একজন খেলোয়াড় ক্লাব পাল্টাতে পারেন, যদি ক্লাবে তিনি তার প্রাপ্য সম্মানটা না পান।
উপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান, ক্লাব পাল্টানোর পেছনে কেবলমাত্র খেলোয়াড় একাই দায়ী নন। ক্লাব কর্তৃপক্ষ এবং খেলোয়াড়ের পারস্পরিক সমঝোতা যখন না হয়, তখনই পরিবর্তনের বিষয়টি চলে আসে।
যেকোনো মানুষই কর্মক্ষেত্রে তার সামর্থ্যের সেরাটা তখনই দিতে পারবেন, যখন তিনি সেখানে তার পারফরম্যান্স দেখানোর সুযোগ পাবেন। আর মানুষ সাধারণত অভ্যস্ত পরিবেশেই নিজের সেরাটা দিতে পারে। এই কারণেই ক্লাবে ভালো অবস্থানে থাকলে সাধারণত কোনো খেলোয়াড় অন্য ক্লাবে যেতে চান না। কিন্তু ক্লাব ভালো করলেও যদি নিজের অবস্থান খারাপ হয়ে যায়, তখন নিজের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাকে অন্যত্র চলে যেতে হয়।
ক্লাব পাল্টিয়ে সব প্রতিকূলতার সাথে নিজেকে মানিয়ে সফল হতে পারাটা অবশ্যই একটা বিশেষ গুণ। তবে কোনো খেলোয়াড় আর ক্লাবের ভেতর যদি পারস্পরিক সমঝোতা ভালো থাকে, এবং সেই ক্লাবে থেকেও যদি তিনি সফলতা পান, তাহলে খেলোয়াড়টির কেবলমাত্র চ্যালেঞ্জ নেবার জন্য ক্লাব পাল্টানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কেন ক্লাব পাল্টিয়েছেন?
যেকোনো খেলোয়াড়ের সফলতাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: প্রথমটি হলো ব্যক্তিগত সফলতা, দ্বিতীয়টি দলগত সফলতা। ২০১৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের স্ট্রাইকার অলিভিয়ার জিরু কোনো গোল না করেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। যেকোনো একটি দলে একজন নাম্বার নাইনের মূল কাজ হচ্ছে গোল করা। সেই কাজ না করেও দলীয় সফলতার অংশ হয়ে গিয়েছেন জিরু। এখানে ব্যক্তিগতভাবে সর্বোচ্চ সফলতা না পেয়েও দলগতভাবে জিরু সফল। আবার ২০১৬ ইউরোতে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়া গ্রিজম্যান ব্যক্তিগতভাবে সফল হলেও চ্যাম্পিয়ন না হওয়ায় দলগত সফলতা পাননি।
ফুটবলটা দলীয় খেলা হলেও যেকোনো মানুষ ২০১৮ বিশ্বকাপের জিরুর চাইতে ২০১৬ ইউরোর গ্রিজম্যানকে এগিয়ে রাখবেন। তবে এই দু’জনের চাইতে আবার এগিয়ে রাখবে ২০০২ বিশ্বকাপের রোনালদো লিমাকে। ২০০২ বিশ্বকাপে ৮ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পান রোনালদো, সাথে ব্রাজিলকে করেন চ্যাম্পিয়ন। এর অর্থ হচ্ছে, যেকোনো জায়গাতেই প্রথম প্রাধান্য পাবে ব্যক্তিগত সফলতা, এরপর আসবে দলীয় সফলতা। তবে একই সাথে কোনো খেলোয়াড় যদি দু’টি সফলতাই পান, তাহলে তিনি হবেন সবচেয়ে সেরা।
ইউনাইটেডের হয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দু’টি সফলতাই পেয়েছিলেন। দলগতভাবে প্রিমিয়ার লিগ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাসহ অন্যান্য শিরোপা জেতার পাশাপাশি দুই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছেন। একবার জিতেছেন ফিফা বর্ষসেরা এবং ব্যালন ডি’অর। ১৯৯১ সালে ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার আরম্ভ হবার পর থেকে তিনি জেতার আগ পর্যন্ত ইংলিশ লিগ থেকে কেউ এই পুরস্কার জিততে পারেননি, তার পরেও এখন পর্যন্ত কেউ পারেননি।
এত সফলতার পরও ইউনাইটেড ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কী ছিল? রোনালদো মূলত মাদ্রিদে গিয়েছিলেন বিশ্বের সেরা ক্লাবের অংশ হতে। পাশাপাশি, বেতন কিংবা অন্যান্য সুবিধাও বেশি পাওয়া যাবে। মাদ্রিদে এসে তখন তিনিও কাকা কিংবা আরো অনেক গ্রেটদের মতো হারিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু নয় বছরের পথচলায় ব্যক্তিগত এবং দলগতভাবে রোনালদোকে সফল বলা গেলেও তার মূল সফলতা ছিল শেষ পাঁচ বছরে। এই সময়ে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার পাশাপাশি তিনবার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার জেতেন তিনি। সব মিলিয়ে মাদ্রিদে থাকা অবস্থাতেই বর্ষসেরা হয়েছেন চারবার।
এত সফলতার পরেও মাদ্রিদ থেকে রোনালদো জুভেন্টাসে কেন গেলেন? উপরে ক্লাব পাল্টানোর যে কারণগুলো আলোচনা করা হয়েছে সেখানে রোনালদোর মাদ্রিদ ছাড়ার মূল কারণ ছিল ৫ নম্বর পয়েন্টটিই। মাদ্রিদ ম্যানেজমেন্টের কাছে মনে হচ্ছিলো, ‘বয়স্ক’ রোনালদোকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করাটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। রোনালদোর প্রথম চ্যালেঞ্জটা আসলে এটাই।
বয়স হয়ে গেলেও আরো ৩-৪ বছর সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার সামর্থ্য যে রোনালদোর রয়েছে, সেটা প্রমাণ করতে পারাটাই তার প্রথম চ্যালেঞ্জ।
প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে আরেকটি ‘চ্যালেঞ্জ’ও সঙ্গী ছিল রোনালদোর। মাদ্রিদ যখন তাকে ছেড়ে দিলো, তখনই অনেকের মনে হয়েছে, তাকে ছাড়া মাদ্রিদ একটা বড়সড় হোঁচট খাবে। যদিও মাদ্রিদ ম্যানেজমেন্ট ভেবেছিলো, তার ঘাটতি তারা অন্যান্য খেলোয়াড় দিয়ে পূরণ করে ফেলতে পারবেন। তবে তাকে ছাড়া মাদ্রিদ যে অন্তত এই মুহূর্তে অসম্পূর্ণ, সেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। প্রামাণ্য, মাদ্রিদের ছন্নছাড়া খেলা। মৌসুমের এই পর্যায় পর্যন্ত বলা যায় যে, সেই ‘চ্যালেঞ্জে’ তিনিই বিজয়ী।
একইসাথে প্রথম চ্যালেঞ্জও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আপাতত পূরণ করার পথেই চলেছেন। জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে প্রথম ১০টি গোল করতে তার প্রয়োজন হয় মাত্র ১৬টি ম্যাচের। ইনজাগি (১৮ ম্যাচ), ত্রেজেগে (২৯ ম্যাচ) এবং ইব্রাহিমোভিচদের (৩০ ম্যাচ) মতো খেলোয়াড়দেরও পেছনে ফেলেছেন তিনি।
মৌসুম শেষে হয়তো জুভেন্টাসের সেরা খেলোয়াড়ও হবেন। তবে কেবলমাত্র এতটুকুতেই রোনালদো ভক্তরা খুশি থাকবেন বলে মনে হচ্ছে না। জুভেন্টাস তাকে কেন কিনেছে সেটা তো আগেই বলা হলো, মূল উদ্দেশ্যটা ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জেতাটা দলীয় সাফল্য হলেও ব্যক্তি রোনালদোর দিকেই ভক্তরা তাকিয়ে ছিল। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা হিসেবে পরিচিত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো চলতি মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে ফর্মের শিখরে নেই ঠিক। গত ছয় মৌসুম উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও এবার জুভের হয়ে করতে পেরেছেন মাত্র একটি গোল।
‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে প্রথম লেগে হেরে বসেছে তারা ২-০ গোলে। ম্যাচটিকে অন্তত টাইব্রেকারে নিতে হলেও ঘরের মাঠে ২-০ গোলের জয় পেতেই হবে জুভকে। রক্ষণাত্মক খেলা অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে কাজটা কঠিন হবে বলেই সবার ধারণা। জুভেন্টাস ২০১৮ সালে বাদ পড়েছে রিয়াল মাদ্রিদের সাথে, ২০১৭ সালে ফাইনালে হেরেছে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে, ২০১৬ সালে দ্বিতীয় পর্বে বাদ পড়েছে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে, ২০১৫ সালে ফাইনাল হেরেছে বার্সেলোনার কাছে। এই কয়েক মৌসুমে জুভেন্টাস কখনোই প্রথম লেগে হেরে পরের লেগে জিততে পারেনি। এবারও যদি দ্বিতীয় পর্বে বাদ পড়ে যায়, তাহলে রোনালদো স্বাভাবিকভাবেই একটি ধাক্কা খাবেন।
সিরি আ’র সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া, কিংবা ইতালিয়ান লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতাটা ব্যক্তিগত সফলতা হলেও রোনালদোর মতো খেলোয়াড়ের জন্য সেটা সর্বোচ্চ পুরস্কার নয়। গত বারোটি বছর যাবৎ তিনি ‘ফিফপ্রো বিশ্ব একাদশ’ এ সুযোগ পেয়েছেন। ঘরোয়া লিগে যত ভালোই করুন না কেন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দ্বিতীয় পর্বেই বাদ পড়লে এবার সেরা একাদশে থাকতে পারাটা অনেকটাই অনিশ্চিত। তাছাড়া ‘ফিফা বেস্ট’ কিংবা ‘ব্যালন ডি অর’ এর সেরা তিনে থাকতে হলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাটা গুরুত্বপূর্ণ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাটা দলগত সফলতা হলেও এই মুহূর্তে তার ব্যক্তিগত সফলতার জন্যও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে জয়টা জরুরি।
একটি পুরো টুর্নামেন্ট একজন খেলোয়াড় কখনো একা জেতাতে পারবেন না। রোনালদোর পক্ষেও সেটা সম্ভব নয়। তবে অন্তত একটা ম্যাচে বিপদ থেকে এককভাবে দলকে উদ্ধার করার ক্ষমতা তো তার রয়েছে। অতীতেও এমন পরিস্থিতিতে তিনি পড়েছেন। ২০১৫-১৬ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মাদ্রিদের হয়ে ভলফসবার্গের বিপক্ষে প্রথম লেগে ২ গোলে পিছিয়ে পড়েও দ্বিতীয় লেগে হ্যাটট্রিক করে দলকে জেতান। সেই বছর রিয়াল মাদ্রিদ পরে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপাও জিতে নেয়। এবারও মোটামুটি একই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রোনালদো। খাঁদের কিনারা থেকে এ যাত্রায় জুভেন্টাসকে বাঁচাতে পারলে এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ না জিততে পারলেও হয়তো তাকে ‘সফল’ বলা যেতেই পারে।
চ্যাম্পিয়নস লিগ এই মৌসুমে না জিতলেও জুভেন্টাসে আরো ২-৩ মৌসুম হয়তো সময় পাবেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ না জিতলেও হয়তো তাকে পুরোপুরি ব্যর্থ বলা যাবে না। কিন্তু বছরশেষে বর্ষসেরা একাদশ কিংবা সেরা তিনে নিজের অনুপস্থিতির সাথে তিনি কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নেন, সেটাই প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে মৌসুমশেষেই। তবে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে না জিতলে চ্যালেঞ্জে যে অনেকটাই পিছিয়ে যাবেন ক্রিস, সেটা হয়তো তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন।
ফিফপ্রো একাদশ কিংবা বর্ষসেরা তিনে জায়গা পাওয়া, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার লড়াইয়ে ফিরে আসা, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রথম লেগে হারার পর জুভের জিততে না পারার রেকর্ডকে ভাঙা, কিংবা রিয়াল মাদ্রিদ বোর্ডকে জবাব দেওয়ার জন্য অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে জয় পাওয়া… এই মৌসুমে আপাতত ক্রিসের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে হারাতে না পারলে অন্তত এই মৌসুমের জন্য চ্যালেঞ্জে পরাজয়টা তাকে মেনে নিতেই হবে।
আপাতত তার জন্য এই চ্যালেঞ্জ জেতাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১২ মার্চের সেই ম্যাচে কি জিততে পারবেন তিনি? অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত আর কোনো গতি নেই।