১
মনে করুন, ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ চলছে। নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে টাইব্রেকারের পালা, শেষ বলটি শ্যুট করতে এসেছেন দলের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। তিনি কিক নিলেন এবং বারের অনেক উপর দিয়ে বলটা মাঠের বাইরে চলে গেল। বিপক্ষ দল বিজয়ের উল্লাস করছে আর সেই সুপারস্টার হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছেন।
এমন সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে সেই খেলোয়াড়টির অবস্থা কেমন হওয়ার কথা? নায়ক থেকে সরাসরি খলনায়কে পরিণত হবার কথা। অথচ সেই দেশের জনগণের কাছে তিনি নায়ক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন এবং এখনো আছেন। সেই নায়কের নাম রবার্তো ব্যাজিও।
কী কারণে এমন ঘটনার পরেও তিনি খলনায়ক না হয়ে নায়ক হিসেবেই বিবেচিত হন, সেটি নিয়েই আজকের আলোচনা।
২
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে (১৯৯০-১৯৯৮) ইতালির ডিফেন্স বরাবরই সেরাদের কাতারে ছিল। দল হিসেবেও ইতালি বরাবরই প্রথম সারিতেই পড়ে। তবুও এখনো পর্যন্ত অতিমাত্রায় ডিফেন্সিভ খেলার কারণে ইতালির খেলা অনেকের কাছেই বিরক্তিকর ঠেকে। যেকোনো দল তার স্ট্র্যাটেজি সাজায় দলের শক্তির উপর নির্ভর করে। তবে লুকা টনি, ভিয়েরি, ডেল পিয়ারো, টট্টি কিংবা পিরলোর মতো অ্যাটাকার থাকার পরেও যদি কেউ ইরানের মতো ডিফেন্সিভ খেলে, তখন দর্শক হিসেবে মেজাজ খারাপ হওয়া দোষের কিছু নয়।
কিন্তু শুধু ডিফেন্স দিয়ে একটি বড় টুর্নামেন্টে বেশি দূর যাওয়া যায় না। এর সাথে সাথে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টেও মোটামুটি একটা সমর্থনের প্রয়োজন হয়। ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপে সেই সামর্থ্যটা ইতালির অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছিল। কিন্তু তবুও কেন জানি টুর্নামেন্টটা ইতালি ভালোভাবে শুরু করতে পারেনি।
ফুটবল দলীয় খেলা, তবে মাঝে মাঝে দলীয় খেলাতেও কোনো কোনো খেলোয়াড় নিজ যোগ্যতায় নিজেকে পুরো দলের পরিপূরক বানিয়ে ফেলেন। দল খারাপ পারফর্মেন্স করা সত্ত্বেও যারা নিজ যোগ্যতায় দলকে একটা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের মাঝে ১৯৯৪ এর ইতালির রবার্তো ব্যাজিও ইতিহাসে একটি বিশেষ জায়গা নিয়ে থাকবেন।
সেই বিশ্বকাপে ইতালি দলের সাথে সাথে ব্যাজিওর শুরুটাও করুণ ছিল। কিংবা কে জানে, ব্যাজিও খারাপ খেলার জন্যেই হয়তো ইতালির করুণ দশা ছিল। নয়তো মেক্সিকো, আয়ারল্যান্ড আর নরওয়ের গ্রুপ থেকে তো ইতালির গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের পর্বে যাওয়ার কথা। অথচ এই গ্রুপে তারা হয়ে গেল ৩য়। তিন ম্যাচে ইতালি গোল করলো মাত্র ২টি, ২টি গোল হজম করায় গোল ব্যবধান দাঁড়ালো শূন্যতে।
অথচ বিশ্বকাপে ব্যাজিও এসেছিলেন আগের বছরের (১৯৯৩) ব্যালন ডি অর জেতা খেলোয়াড় হিসেবে। বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচে গোল না পাওয়ার পর ফিসফাস শুরু হয়ে গেল, এ আবার কেমন স্ট্রাইকার? জবাব দেওয়ার তাগিদ ছিল ব্যজিওর। সেটা দিতে একটু সময় নিলেন, তবে দলের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূহুর্তেই ফিরে পেলেন নিজেকে।
৩
সেসময় বিশ্বকাপের ফরম্যাটটা একটু ভিন্ন ছিল। ৬টি গ্রুপে ২৪টি দল টুর্নামেন্টে অংশ নিত। প্রতি গ্রুপ থেকে ২টি করে দল সরাসরি পরের পর্বে খেলতো। এরপর প্রতিটি গ্রুপের ৩য় সেরা দলকে নিয়ে সেখান থেকে সেরা ৪টি দল বাছাই করা হতো। ইতালি ২য় পর্বে সুযোগ পায় ৩য় সেরা দলগুলোর মাঝে ৪র্থ হয়ে।
দ্বিতীয় পর্বে ইতালির মুখোমুখি হয় সেই বিশ্বকাপের চমক দেখানো সুপার ঈগল নাইজেরিয়া। আর্জেন্টিনা আর বুলগেরিয়ার মতো দল গ্রুপে থাকার পরেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরের পর্বে ওঠাটা একটা চমকই বলা চলে। ম্যাচ শুরুর আগে তাই নাইজেরিয়াকেই ফেভারিট ধরা হচ্ছিল। ম্যাচের ২৫তম মিনিটে গোল করে ভাবনাটা যে ভুল ছিল না, সেটি প্রমাণ করে দিল নাইজেরিয়া। ইতালির অবস্থা তখন ছন্নছাড়া।
কিন্তু বড় খেলোয়াড়েরা নাকি বড় মঞ্চে বড় ম্যাচে জেগে উঠে। ঠিক ৮৮ মিনিটে গোল করে রবার্তো ব্যাজিও ম্যাচের পুরো আলো নিজের দিকে নিয়ে নিলেন। এরপর ১০২ মিনিটে আরেকটি গোল করে ম্যাচ জিতিয়েই ফিরলেন মাঠ থেকে।
কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের সাথে ম্যাচ যখন ১-১ গোলে সমতায়, তখনই আবারও ৮৮ মিনিটেই গোল করে নায়কে পরিণত হন রবার্তো ব্যাজিও। সেমিতে ইতালি মুখোমুখি হয় সেই বিশ্বকাপের বিস্ময় বুলগেরিয়ার সাথে। বুলগেরিয়া আগের ম্যাচেই হারিয়েছে সাবেক চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে। ২-১ গোলে জেতা সেই ম্যাচের দুটি গোলই করেন ব্যাজিও।
এরপরেই এলো সেই ফাইনাল ম্যাচ। ফাইনালে ব্রাজিল আর ইতালি দুই দলই অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক খেলায় সেই ম্যাচে নির্দিষ্ট সময়ে কোনো গোল হয়নি। টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করে রবার্তো ব্যাজিও হয়ে উঠলেন ট্রাজিক হিরো। যদিও সেই গোলটি হলে আর ব্রাজিল পরের গোল করলে ম্যাচ জিততো, কিন্তু ব্যাজিওর মিসটা খুব আলোচিত হয়েছিল।
ইতালি পুরো টুর্নামেন্টে গোল করেছিল ৮টি, এর মাঝে রবার্তো ব্যাজিওর করা পাঁচটি গোলের সবগুলোই নকআউট পর্বে। আর সেবার নকআউট পর্বে ইতালির মোট গোল ছিল ৬টি। এ থেকেই বোঝা যায়, সেই বিশ্বকাপে ব্যাজিও ইতালির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এই কারণেই ইতালির সমর্থকেরা পেনাল্টি মিসের কথা ভুলে না গেলেও, এর জন্য ব্যাজিওকে অন্তত দোষী মনে করেনি।
ব্যক্তিগতভাবে সেই বিশ্বকাপের সিলভার বুট আর সিলভার বল জিতেন ব্যাজিও। তবে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে হয়তো গোল্ডেন বলটা রোমারিওর পরিবর্তে তিনিই পেতেন।
৪
শুধু ১৯৯৪ বিশ্বকাপে নয়, বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্যাজিওর রেকর্ড বরাবরই ভালো। বিশ্বকাপে অভিষেক হয় তার ১৯৯০ সালে। ১৯৯০ বিশ্বকাপের বেশিরভাগ ম্যাচে ব্যাজিও বদলি হিসেবে মাঠে নামেন। চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে করা তার গোলটি ‘গোল অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ এর মর্যাদা লাভ করে।
তবে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে রবার্তো ব্যাজিও দলে সুযোগ পান শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার জোরে। ম্যাচের শেষ ১০-১৫ মিনিট তাকে খেলানো হতো। কিন্তু এই সুযোগটাই দুর্দান্তভাবে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। গ্রুপ পর্বে চিলির বিপক্ষে ২-১ গোলে হারতে থাকা প্রথম ম্যাচে ৮৪ মিনিটে গোল করে ম্যাচটা ড্র করেন তিনি। গ্রুপ পর্বেই অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচে গোল করেন তিনি ঠিক ৮৯ মিনিটে। শেষ পর্যন্ত সেই বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলতে থাকা স্বাগতিক ফ্রান্সের সাথে টাইব্রেকারে বাদ পড়ে ইতালি। তবে যারা ম্যাচটি স্বচক্ষে দেখেছেন তারা বলতে পারবেন, শেষ মুহুর্তে ব্যাজিও নামার পরেই কেবল ইতালি গোলের কিছু সুযোগ তৈরি করতে পেরেছিল। এমনকি ম্যাচে ইতালির সবচেয়ে বড় সুযোগটা সৃষ্টি করেছিলেন সেই ব্যাজিওই। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্রথম থেকে ব্যাজিও ম্যাচটা খেলতে পারলে সেই ম্যাচটা হয়তো ইতালিই জিততো। ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেও কোচ সিজার মালদিনি ব্যাজিওর চেয়ে ডেল পিয়ারোকে বেশি সুযোগ দেন এবং এই কারণে তুমুল সমালোচিত হন।
২০০২ বিশ্বকাপে ব্যাজিওকে বয়সের জন্য স্কোয়াডে রাখা হয়নি। শুধুমাত্র বিশ্বকাপ খেলার জন্য ব্যাজিও ব্রেসিয়া নামক এক অখ্যাত ক্লাবে যোগ দেন এবং সেই সিজনে ১৫ ম্যাচে ১২ গোল দিয়ে নিজের ফর্মের জানান দেন। কিন্তু দলে ডেল পিয়ারো, ভিয়েরির মতো স্ট্রাইকার থাকায় আর জায়গা পাননি তিনি।
মূল মঞ্চে জ্বলে ওঠার এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা ব্যাজিও যাওয়ার পর ইতালিতে আর কারো ভেতর সেভাবে দেখা যায়নি। ইতালির পক্ষে বিশ্বকাপের মূল পর্বে ১৬ ম্যাচে ৯ গোল করেন ব্যাজিও, যা একটি ইতালীয় রেকর্ড। এছাড়া একমাত্র ইতালীয় খেলোয়াড় হিসেবে তিন বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ডটিও তারই। ব্যাজিওর অংশগ্রহণ করা তিনটি বিশ্বকাপে ১৯৯০ সালে আর্জেন্টিনা, ১৯৯৪ সালে ব্রাজিল এবং ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ইতালি পেনাল্টি শ্যুট-আউটে বিদায় নেয়।
৫
শুধু বিশ্বকাপ ফুটবলে নয়, পুরো ক্যারিয়ারেই ব্যাজিও ছিলেন অসামান্য এক খেলোয়াড়। ১৯৯৯ সালে ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনের মাধ্যমে গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়দের একটি তালিকা করা হয়। সেই তালিকার ষোলতে ছিলেন ব্যাজিও, যা কিনা ইতালীয় খেলোয়াড়দের মাঝে সর্বোচ্চ অবস্থান।
তবে এসবের কোনো কিছুই নয়, আজও ব্যাজিওর কথা স্মরণ করতে হলে প্রথমে সেই পেনাল্টি মিসের কথাই মনে আসে। কিন্তু এরপরেও ব্যাজিও ভিলেন হিসেবে বিবেচিত হন না। ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে এক ট্র্যাজিক হিরো হিসেবেই।